You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার সঙ্গে অন্যান্য ভাষার তুলনা চলে না
আবদুল গফুর

অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষাকে তাচ্ছিল্য করার কোনাে কথা উঠতে পারে না। প্রতিটি ভাষা তাহার উপযুক্ত মর্যাদায় সমাসীন হউক- ইহা আমরা মনে প্রাণে চাই। কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, আমরা বাস্তবতাকে অস্বীকার করিয়া আকাশ কুসুম চিন্তা করিয়া বসিব। বাস্তবতা হইল পশ্চিম পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি ভাষা প্রচলিত থাকিলেও পাঞ্জাবিরা উর্দুকেই তাহাদের আপন ভাষা হিসেবে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিয়াছে। পাঞ্জাবের প্রায় প্রত্যেকে পত্রিকা চলিতেছে উর্দুতে, পুস্তক লিখিত হইতেছে উর্দুতে এমন কি লাহাের বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির পরিবর্তে উর্দুকে করা হইয়াছে শিক্ষার মাধ্যম। উপর হইতে কেউ ইহাদের উপর কিছু চাপাইয়া দেয় নাই পাঞ্জাবিরাই তাহা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিয়াছে। খামখেয়ালিভাবে নয়— সুবিধার জন্যই উর্দু পাঞ্জাবিরা প্রায় সকলেই বােঝে উর্দুতে প্রায় সকলেই কথা বলিতে পারে, পাঞ্জাবি ভাষার ভিন্ন কোনাে বর্ণমালা নাই– উর্দু বর্ণমালাই তাহাদের বর্ণমালা। উর্দুর জন্য পাঞ্জাবিরাই দাবি করে এমন কি বাংলার বিরুদ্ধেও। এক কথায় পাঞ্জাবিকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। পাঞ্জাবীরাই ইহাকে পাগলামী বলিয়া উড়াইয়া দেবে। গুজরাটী বেলুচি, সিন্ধি প্রভৃতি সম্বন্ধেও কমবেশি একই কথা। এর কয়েকটি ভাষা সংস্কার সাপেক্ষে কালক্রমে প্রাদেশিক সরকারের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমে হিসেবে মর্যাদা পাইতে পারে সন্দেহ নাই, তবে সেজন্য সেই ভাষা ভাষীদের পক্ষ থেকে চেষ্টা হওয়া উচিত। সিন্ধি-পশতু ভাষা প্রাদেশিক সরকারের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমে করার একটি ক্ষীণ দাবি একবার উঠিয়াছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত সে সম্বন্ধে আর কোনাে সাড়াশব্দ পাওয়া যায় নাই। (কেন্দ্রীয়) পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি কোনাে কালে উঠিয়াছিল কিনা জানা যায়। নাই। ইহারও কারণ রহিয়াছে।
প্রথমত, ইহাদের একটি ভাষা এখনাে একেবারেই কথা ভাষা (Dialect) মাত্র লিখার জন্য উপযুক্ত নয় সাহিত্য সৃষ্টি তাে দূরের কথা।
দ্বিতীয়ত, যে কয়টি লিখিত ভাষা আছে– তা ও লিখিত হয় উর্দু অক্ষরে ‘উর্দু শব্দ সমভাবে এগুলি সমৃদ্ধ। এক কথায় উর্দু পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র, বিশেষ করিয়া শিক্ষিত সমাজে অতি আপন হিসেবে স্থান গ্রহণ করিয়াছে পাঞ্জাবি, পাঠান, ও বেলুচ সৈনদের দ্বারা উর্দু গ্রামেও প্রচলিত ও লােকপ্রিয় হইয়াছে যুগ যুগ ধরিয়া। একারণে সুবিধার জন্য এবং উর্দুকে আপন বলিয়া ভাবিতে পারিতেছে বলিয়া পশ্চিম পাকিস্তানিরা সাধারণ ভাবে উর্দুর বিরােধিতা তাে করেই নাই বরং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাইতে উন্মুখ।
অনেকে বলেন আমেরিকানরা যেমন অন্যান্য ভাষা বাদ দিয়া ইংরেজিকে মাতৃভাষা হিসেবে আপন করিয়া লইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানে সেরূপ উর্দুকে সর্বত্র মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণের সম্ভাবনা আছে। অথচ বাংলার সম্বন্ধে একথা বলা চলে। বাংলা পৃথিবীর একটি অন্যতম উন্নত ভাষা। ইহার সাহিত্য ও সাহিত্যিকেরা খ্যাতি লাভ করিয়াছেন। সাহিত্য সৃষ্টি, পত্রিকা প্রকাশ সবই এখানে চলিতেছে এই বাংলাভাষায়। পূর্ববাংলার অধিবাসীরা পশ্চিম পাকিস্তানের মতাে উর্দুকে সাধারণ ভাবে না শিখিতে পারিয়াছে আর না পারিয়াছে আপন ভাবে গ্রহণ করিতে। পাকিস্তানের অধিক সংখ্যক লােক বাংলা ভাষার ধারক ও বাহক। পশ্চিম পাকিস্তানিদের উর্দুই আপন-পর তাে নয়ই- অতিথিও নয়। আর পূর্ববাংলার কাছে বাংলাই আপন, উর্দু হইল অতিথি। অতিথিকে সম্মান করার উদারতা পূর্ব পাকিস্তানের আছে। তাই বলিয়া আপনকে পর করিয়া অতিথিকে ঘরের কর্তৃত্ব দেওয়ার মতাে বেওকুফী আশা করা ঠিক নয়। অবশ্য ইহার অর্থ এই নয় যে, আমরা অন্য প্রদেশের বা অন্য ভাষার কোনাে ন্যায্য দাবিকে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করিতেছি। আমাদের জন্য আমরা যাহা চাই অন্যদের জন্য ও আমরা তাহা দিতে শুধু রাজী নই তাহা দিতে অত্যন্ত উদগ্রীব। কিন্তু অপর প্রদেশ যাহা আপন মনে করে। দেড় হাজার মাইল দূর হইতে তাহাকে মনে করা ধৃষ্টতা আমাদের নাই। উর্দুকে তাহারা যদি আপন বলিয়া মনে করে— তাহাকে তাহাদের পর বলার অধিকার আমাদের কোথায়? প্রশ্ন উঠিতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলাের লােকেরা অত্যন্ত অনগ্রসর বলিয়া তাহারা এখনাে দাবি তুলিতেছে না। সজাগ অগ্রসর হইলে তাহারা এ দাবি উত্থাপন করিবে। পরবর্তীকালে অন্য ভাষার দাবি উঠানাে হইলে ঐ দাবি যদি জনমতের অভিব্যক্তি হয়, তবে ঐ দাবিকে নিশ্চয় স্বীকৃতি দিতে হইবে। কিন্তু প্রশ্ন হইল: ভাষার ব্যাপারে সিন্ধী, পাঞ্জাবী পাঠান ও বেলুচিদের সুবিধা অসুবিধার কথা তাহাদের চাইতে আমরা বেশি বুঝি এই দাবি কোনাে বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি করিবেন কি? যাহারা পাখতুনিস্তান আন্দোলন, হারি (কৃষক) আন্দোলন পরিচালনা করিতেছে তাহারা তাহাদের ভাষা সমস্যাটি বােঝে না আর আমরা তাহা বেশি বুঝি এ দাবি অর্বাচীনতার শামিল নয় কি?
পূর্বেই বলিয়াছি- বাংলা বিরােধীরা বহু ভাষার প্রশ্ন তুলিয়া বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষার পর্যায়ে নামাইয়া দিতে চায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এই বাংলা বিরােধীদের খপপরে পড়িয়া বাংলার ন্যায্য দাবিকে ধোয়াটে করিয়া তুলিতেছেন। এই রকম একটি লেখার নজীর দিয়া উর্দু ভাষার সমর্থন জনৈক কবি (গােলাম মােস্তফা) তাহার মাসিক পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখিয়াছেন লেখকদের বক্তব্যের ভিতর একটি প্রশংসনীয় জিনিস এই আছে যে, তিনি বাংলার ভাষার কথা ভাবিতে গিয়া অন্যান্য ভাষাভাষীদের কথাও ভাবিয়াছেন এই মনােভাব সত্যিই গণতান্ত্রিক। আশ্চর্যের বিষয়, যে কথা বহু পূর্বে আমি বলিয়া রাখিয়াছি এবং যার সাথে আমরা যথেষ্ট নিগ্রহ ভােগ করিতেছি। সে কথাই আজ আন্দোলনকারীদের মুখে শুনিলাম। আমরাই কি আগে বলি নাই যে, বাংলা যদি রাষ্ট্রভাষা হয় তবে সিন্ধী, পাঞ্জাবী প্রভৃতি হােক প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা। লেখক প্রকারান্তরে কি এই কথাই বলেন নাই। (মাসিক নওবাহার, ঢাকা)।
সুতরাং আমাদের সজাগ থাকা দরকার। আমরা যেন যা তা বলিয়া লিখিয়া বাংলাভাষার শত্রুদের এভাবে সাহায্য না করি। আমাদের কাছে আজ বড় প্রশ্ন, বাংলার স্বীকৃতির অন্যান্য অবান্তর কথা তুলিয়া যেন আমরা মূল সমস্যাকে ধামাচাপা দিবার চেষ্টা না করি কিংবা নতুন নতুন অবাস্তব প্রশ্ন তুলিয়া আমাদের মধ্যে অবাঞ্ছিত মতবিরােধ সৃষ্টি না করি। মনে রাখা অত্যাবশ্যক, সর্ব দলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ, সর্বদলীয় একটি প্লাটফর্ম সকলে এখানে মিলিত হইয়াছে একটি সুস্পষ্ট ইসুতে সে ইস্যু হইল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন। এই আন্দোলকে অন্যান্য সাইড ইস্যু তুলিয়া মতবিরােধের সৃষ্টি করা শুধু মারাত্মক নয় বর্তমান জরুরি পরিসমাপ্তিতে প্রতিক্রিয়াশীল ও দালালদের সাহায্য করাই শামিল।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!