ষড়যন্ত্রের গােড়ার কথা
এম. শামসুল আলম
… কথাগুলাে আমার মনুঃপুত হলাে। উভয়ে একত্রে রাস্তা ঘুরে পুনরায় মেডিকেল কলেজে গেলাম। সেখানে নেতৃস্থানীয় সকল বন্ধুদিগকে দেখতে গেলাম। গােলাম মাওলাকে দেখলাম পাগলের মতাে ছুটাছুটি করতেছে, মৃতদেহগুলাে বারান্দায় পূর্ববৎ পড়ে আছে অবশ্য কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। এ করুণ দৃশ্য দেখে মনে হল যেন সমস্ত আকাশ বাতাস একেবারে ঝিম খেয়ে গেছে। আমরা সকলে পরামর্শ করে ঠিক করলাম রাত্রে ২০/২৫ জন ছাত্র মেডিকেল কলেজে থাকবে এবং মৃতদেহ পাহারা দিবে কারণ আমাদের একটা গােপন সন্দেহ হয়েছিল যে মৃতদেহগুলাে পরদিন সকালে আমাদের হাতে নাও আসতে পারে। রাত্র অনুমান ১০ টা পর্যন্ত আমরা নেতৃস্থানীয় প্রায় সকলেই সেখানে ছিলাম। হঠাৎ মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব সেখানে উপস্থিত হলেন। প্রিন্সিপাল সাহেবের আদেশ মতে মৃতদেহগুলাে বারান্দা হতে এনাটমি রুমের ভিতর নিয়ে টেবিলের উপর রাখা হলাে। প্রিন্সিপাল সাহেব অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও দরদের মন নিয়া আমাদের নিজ নিজ বাসস্থানে গিয়া বিশ্রাম করার জন্য অনুরােধ করলেন। আমরা আমাদের সন্দেহের কথা প্রকাশ করে বললাম যে স্বৈরাচারী সরকারের লােকেরা রাতের অন্ধকারে মৃতদেহ গােপন করে ফেলতে পারে। প্রিন্সিপাল সাহেব দুঃখের হাসি হেসে বললেন দেখুন আমিও মানুষ আমারও ছেলেমেয়ে আছে’ (কথাটা ইংরেজিতে বলেছিলেন) তখন আমাদের অনুরােধে তিনি রাত্রে মৃতদেহগুলাে পাহারা দেওয়াবেন বলে আশ্বাস দিলেন। সাব্যস্ত হলাে পরদিন সকাল ৮টায় প্রিন্সিপাল সাহেব নিজে উপস্থিত থেকে মৃতদেহগুলাে আমাদের কাছে ফেরত দেবেন এবং আমাদের উপস্থিতিতিইে তিনি এনাটমি রুমের দরজায় তালাবন্ধ করালেন। প্রিন্সিপাল সাহেব জোর গলায় তাহার মনুষ্যত্বের বড়াই করলেন কিন্তু স্বৈরাচারী যাতাকলের নিষ্পেষণে তাহার মনুষ্যত্বের কোনাে মূল্যবােধ সেইদিন রইল না। দুঃখের বিষয় প্রিন্সিপাল সাহেব নিজেই জানতেন না যে অশুভচক্র বাঙালির জাতীয়তাবাদকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য বদ্ধপরিকর সেই অশুভচক্রের অজ্ঞাত হস্তের ইশারায় প্রিন্সিপাল সাহেবের মনুষ্যত্ব বােধকে বাতাসে উড়িয়ে দিবে। আপাতত আমরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হতে চলে এলাম।
নিয়তিকে বিশ্বাস করার মত বয়স তখনও আমাদের হয় নাই। তাে এটা বুঝি, সময় সময় কাজের চাপে মানুষ সাইকেলের চাকার মতাে ঘুরতে ঘুরতে একটার পর একটা কাজ এমন সুন্দরভাবে করে যায় যে মনে হয় সবকিছু পূর্ব পরিকল্পিত। মধুর রেস্তোরায় বসে আমরা পরদিনের কর্মসূচি প্রণয়ন করলাম। রাত্রেই মাইক যােগে সমস্ত ঢাকা শহরে প্রচার করে দিলাম যে, পরদিন সকাল ৯ টায় মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের সামনে জানাজার নামাজ আদায় করে মিছিল সহকারে মৃতদেহ নিয়ে আজিমপুর গােরস্থানে যাব। সমস্ত রাত্রে ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ হল, মেডিকেল হােস্টেল, ইঞ্জিনিয়ারিং হােস্টেলের ছাদে মাইক লাগিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের কীর্তি প্রচার করা হয়। পরদিন অর্থাৎ ২২ শে ফেব্রুয়ারি সমস্ত অফিস আদালত ব্যবসা বাণিজ্য ও যানবাহন সমস্ত হরতাল ঘােষণা করা হলাে। হরতাল শুধু হরতাল। ঢাকা শহরের সমস্ত অলি-গলিতে হরতাল বয়ে গেল। কান্নার রােলে ঢাকা শহর বন্যায় প্লাবিত হয়ে গেল। যাহার দিকে তাকাই, দেখি শুধু মলিন বদনে। কি যেন চিন্তা ভাবধারা নিয়া সম্মুখের দিকে চলছে। ঢাকার সমস্ত প্রাণচাঞ্চল্য স্তব্ধ হয়ে গেল। হিন্দু মুসলমান আবাল বৃদ্ধ বণিতা সকলকে সকাল ৯টায় মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে হাজির হওয়ার জন্য অনুরােধ জানান হয় এবং ঢাকার সমস্ত আলীম, ওলামা ও মাওলানা সাহেবদের জানাজা নামাজে শরিক হওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরােধ করা হয়।
২২ শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৭ টায় আমরা সকলে জানাজা পড়বার জন্য কলেজে যাই এবং সাথে সাথে গােলাম মাওলা ও কয়েকজন ছাত্র দৌড়ে এসে আমাদিগকে জানাল যে এনাটমি রুমে কোনাে মৃতদেহ নাই। এনাটমি রুমের সামনে গিয়া দেখি তালা বন্ধ। গােলাম মাওলা ও গাজীউল হক প্রিন্সিপাল সাহেবকে আনতে গেল। আধ ঘণ্টা পর প্রিন্সিপাল সাহেব আসলেন। তাহার মুখের অবস্থা দেখে মনে হয় যেন অপরাধী সেজেই তিনি এসেছিলেন। অশ্রুসিক্তনয়নে অতীব দুঃখের সহিত তিনি জানালেন যে, রাত্রি ১টার সময় পশ্চিম পাকিস্তানের পশুশক্তির দালালদের নির্দেশে কুর্মিটোলা সামরিক ক্যান্টনমেন্ট হতে জনৈক মেজরের তত্ত্বাবধানে সামরিক বাহিনীর লােকজন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অনধিকার প্রবেশ করত মিলিটারী গাড়িতে করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনাটমি রুম হতে ছয়টি মৃতদেহ নূরুল আমীন সরকারের আদেশ মােতাবেক নিয়া যায়। সৈন্য বিভাগের লােকজন ইহাও জানাচ্ছে যে কর্তৃপক্ষ তাহাদিগকে উক্ত মৃতদেহ আজিমপুর গােরস্থানে দাফন করবার জন্য আদেশ দিয়াছে। (বলা বাহুল্য রাতের অন্ধকারে)..
ষড়যন্ত্রের গােড়ার কথা, শহিদীয়া লাইব্রেরী, ১৯৭২
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম