ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলি
আবুল হাশিম তখন আমার জন্ম হয়েছিল ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ২৭ শে জানুয়ারি রাত্রি ৪র্থ প্রহরে আলােলা অন্ধকারের সন্ধিক্ষণে। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ঠিক এমনি সময়েই পুলিশ আমার বাড়ি ঘেরাও করলেন এবং আমি হলাম রাজবন্দি। আমাকে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হলাে সূত্রাপুর থানায়। আমি গিয়ে দেখলাম আমার সঙ্গেই সেখানে উপস্থিত আছেন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, মনােরঞ্জন ধর ও খয়রাত হােসেন। আমাদের সকলকেই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে উপস্থিত করা হলাে। অল্পক্ষণ পরেই ঢাকা জেলে উপস্থিত হলেন অধ্যাপক মুনির চৌধুরী ও পরলােকগত অধ্যাপক অজিত গুহ। দিন দুই আমরা একসঙ্গে ছিলাম। হঠাৎ রাত্রিতে আমাকে একা সিলেট জেলে স্থানান্তরিত করা হলাে। সাড়ে চার মাস সিলেট জেলে থাকার পর আমাকে পুনরায় ঢাকা জেলে আনা হলাে। এবার দেখলাম ঢাকা জেলে অনেক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সমাবেশ ঘটেছে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আবদুল রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হােসেন, খান সাহেব ওসমান আলী, মরহুম শাসুল হক, মুনির চৌধুরী, অজিত গুহ, তােয়াহা, ওলি আহাদ প্রমুখ। পনের মাস পর একে একে সকলে মুক্তিলাভ করলেন, কেবল আমাকেই মুক্তি দেওয়া হলাে না। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি গােলাম মুহাম্মদ খাজা নাজিমুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করলেন। গােলাম মুহম্মদের এই নয়া ব্যবস্থার ফলেই আমাদের মুক্তি দেওয়া আরম্ভ হলাে। সর্বশেষে আমিও মুক্তি পেলাম রমজান মাসের এক সন্ধ্যায়। এই হলাে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে আমার জড়িত হবার সংক্ষিপ্ত কাহিনী।
মন্ত্র শুনেছি শােণিতে, ১৯৭২
কবিতাভবন
২০২ রাসবিহারী এভিনিউ কলকাতা ২৯
২ আশ্বিন, ১৩৫৪
সবিনয় নিবেদন,
কলকাতার মুসলমান সাহিত্যিকরা মিলে নতুন একটি বাংলা সাপ্তাহিক বের করছেন, এই খবর পেয়ে উৎসাহিত হয়েছি।
বলা বাহুল্য, বাঙালি সাহিত্যিকদের ‘হিন্দু ও মুসলমান এই দুই অংশে বিভক্ত আমি নিজের মনে কখনােই করি না; কিন্তু ঘটনাচক্র আজ এমন ঘনজটিল হয়ে উঠেছে যে আপাতত এই বিভাগ মেনে নিতে হলাে। রাষ্ট্রিক ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর বিচ্ছেদ ঘটলাে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমানে; এ-বিচ্ছেদ যে কত সুদূরপ্রসারী সর্বনাশে আমাদের উত্তীর্ণ করতে পারে, এখন তা আমাদের কল্পনাও অনায়ত্ত। এখনকার মতাে, বিধাতার কাছে শুধু এই প্রার্থনা আমরা জানাতে পারি যে সেসর্বনাশ যেন না ঘটে, কালক্রমে বাঙালির ঘরে যত ভাই-বােন আবার যেন এক হয়।
রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে কখনও একটি মিলনের ক্ষেত্রে আছে আমাদের, একটিই আছে, একটিমাত্র। সে-ক্ষেত্র আমাদের সাহিত্য, আমাদের ভাষা। একমাত্র সাহিত্যই সেই শ্রীক্ষেত্র, যেখানে জাতিভেদ নেই, দেশে-দেশে সীমান্তরেখা নেই, মানুষে-মানুষে ভেদচিহ্ন নেই। কত দূর, কত অচেনা, কত বিরােধীর পরস্পরের সঙ্গে মিলন ঘটে সাহিত্যে-আর এ তাে বাংলার হিন্দু মুসলমান। হিন্দু মুসলমান উভয়েই যে বাংলা ভাষা বলে, এই কি তাদের ঐক্যের অলঙ্ পরিচয় নয়? | আমাদের এই মৌল-এবং বর্তমানে একমাত্র-মিলনক্ষেত্রেও বিপন্ন হবে, যদি রাষ্ট্রভাষারূপে পূর্ববাংলায় উর্দু আর পশ্চিম বাংলায় হিন্দি স্থাপিত হয়। সে-দুর্দৈব যাতে না ঘটে, সে উদ্দেশ্যে আন্দোলন আরম্ভ করার সময় এসেছে। রাষ্ট্রব্যবস্থা যে-রকমই হােক, স্বাধীন দেশে মাতৃভাষা ভিন্ন অন্যকোনাে ভাষা যে রাষ্ট্রভাষার স্থান পেতে পারে, আধুনিক জগতে এ-প্রস্তাব অচিন্ত্য। এই সংকটকালে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচাবার দায়িত্ব হিন্দু মুসলমান উভয়েরই। আশা করি আপনাদের পত্রিকায় এই বিষয়টিকে যথােচিত প্রাধান্য দেবেন।
‘কাফেলা সম্পাদক
সমীপেষু
বুদ্ধদেব বসু কাফেলা, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা