You dont have javascript enabled! Please enable it! 1953 | ভাষা আন্দোলনের দুর্নীতিবাজদের শাস্তি চাই | সৈনিক - সংগ্রামের নোটবুক

‘ভাষা আন্দোলনের দুর্নীতিবাজদের শাস্তি চাই’
সৈনিক ১৯৫৩

সম্পাদকীয় : আজ আর অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের একটি প্রগতিশীল আন্দোলন। দুই একজনের কথা বাদ দিলে পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা একশ জন শিক্ষিত লােক ইহাকে সমর্থন করে এবং অনেক। ছাত্র অছাত্র কর্মীর অধ্যবসায় ও আত্মত্যাগে ইহা আজ এক সাফল্যময় গণ আন্দোলনের রূপ নিয়াছে। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এইরূপ একটি মহান আন্দোলনকে নিয়াও কয়েকজন স্বার্থপর ব্যক্তি ছিনিমিনি খেলিতে কসুর করে নাই। ভাষা আন্দোলনকে পুঁজি করিয়া অতীতে তােফাজ্জল আলী মােহাম্মদ আলীরা যে মন্ত্রী বনিয়াছেন আজ আমরা সে কথার পুনঃ ব্যাখ্যা করিতেছি না, আজিকার দুঃখ জনক বক্তব্য হইল কয়েকজন প্রগতির নামধারী এবং অন্য রকমের ব্যক্তি ছাত্র ও জনগণের প্রিয় এই ভাষা আন্দোলনকে তাদের দুর্নীতির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করিয়া জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছে গত বৎসর আমলা প্রভাবিত নূরুল আমীন গভর্নমেন্ট এই ভাষা আন্দোলনকে দমাইতে গিয়া ছাত্র ও জনসাধারণের উপর গুলি ছুড়িয়া যে হত্যাকাণ্ডের সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা কোনাে মতেই ভুলিবার নয়। শত শত লােক আহত হইয়া এবং বহু লােক নিহত হইয়া যখন অসহায় ভাবে রাস্তায় ঘাটে ও হাসপাতালে পড়িয়া রহিয়াছিল, যখন শত শত ছাত্র ও অছাত্র কর্মীকে যেখানে সেখানে গরু ছাগলের মতাে বন্দি করিয়া নূরুল আমীন গভর্নমেন্টই জেইলে পুরিতেছিল তখন তাহাদেরই সাহায্যার্থে জনগণ স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া হাজার হাজার টাকা দান করিয়াছিল। মেডিকেল কলেজের হােস্টেলের সমুখে (যেখানে কয়েকজন ছাত্রকর্মি শহীদ হন) এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হইয়াছিল। হাজার হাজার পথিক যার যা ছিল তা অকাতরে স্বতস্ফূর্তভাবে দান করিতে থাকে। দশ, বিশ, একশ টাকা এমন কি ভিক্ষুকেরা পর্যন্ত তাদের সারা দিনের ভিক্ষালব্ধ আয় ভিক্ষাপাত্র হইতে ঢালিয়া দেয়। অনেক মা বােন তাদের হাত কান ও গলার গহনা পর্যন্ত খুলিয়া দেয়। এছাড়া বিরাট ঢাকা শহরের অলিতে প্রতিটি দোকানে প্রতিটি অফিসে বহু টাকা সংগৃহীত হয়। এর প্রধান অংশ যায় মেডিকেল হােস্টেলে যারা ছিলেন তাদের কাছে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা সংগৃহীত হইয়াছিল বলিয়া প্রকাশ। এছাড়া ইউনিভারর্সিটি ছাত্র সংগ্রাম কমিটি, ফজলুল হক হল, জগন্নাথ কলেজ প্রভৃতি স্থানে ও ফ্ল্যাগ বিক্রী ও অন্যান্য উপলক্ষে বহু অর্থ জমা হয়। কিন্তু এই টাকার কোন পাত্তা নাই বলিলেও চলে। এই বিরাট পরিমাণ অর্থ কোথায় গেল— আজ এই প্রশ্ন প্রতিটি ভাষা আন্দোলন কর্মীর মনে। দুঃখজনকভাবে উদয় হইতেছে। যারা অসহায়ভাবে মেডিকেল হাসপাতালে মারা গেলেন তাহের জন্য কিংবা তাহাদের আত্মীয়দের জন্য কি এক পয়সাও ব্যয়িত হইয়াছে? না-হয় নাই। শত শত দীন দরিদ্র ছাত্র অছাত্র যারা গুরুতর ভাবে আহত হইয়া বহু দিন ধরিয়া ভুগিয়াছে, কেহ কেহ সর্বস্বান্তও হইয়াছে তাদের জন্য ও কি কোনাে টাকা খরচ করা হইয়াছে? কিংবা আজ পর্যন্ত প্রায় অন্ধ আবুল হাশেম, রােগগ্রস্ত ভাসানী, মৌলানা সামছুল হকের জন্য অথবা তাদের দুঃস্থ পরিবারের, জন্যও কি কোনাে অর্থ খরচ করা হইয়াছে? টাকার অভাবে ভাষা বন্দিদের কয়েকটি পরিবার আজ ধংসের মুখে। অথচ আজ পর্যন্ত কোনাে টাকাই এইখাতে পাওয়া যায় নাই। অন্য পক্ষে ভাষা আন্দোলনের কোন কাজেও এই টাকা দেওয়া হয় নাই। সেই মহা হত্যাকাণ্ডের পর হইতে অর্থের অভাবে ভাষা সংগ্রাম কমিটির কার্য্য ও সুসমাধান করা কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। আজ চারিদিকে দুর্নীতির দ্বারা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ধ্বংসের সম্মুখীন হইয়াছে। সব চাইতে মারাত্মক দুর্নীতি করে তারা যারা জনগণের আন্দোলনকে এই দুর্নীতি ও ব্যক্তিগত স্বার্থের হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করে। এ পর্যন্ত বহু অভিযােগ আমরা পাইয়াছি শুধু আন্দোলনকে এই নেতৃত্বের একাংশের দুর্নীতিতে শিক্ষিত সমাজে বদনাম হইবে বলিয়া আমরা তা আলােচনা করি নাই। কিন্তু দুর্নীতির প্রশ্রয় দেয়া মারাত্মক পাপ, তাই দেশের দরিদ্র জনগণের অর্থ নিয়া যেন ছিনিমিনি না চলে সেই জন্য প্রতিটি দেশ হিতৈষী প্রগতিশীল কর্মীর নিকট আমরা আবেদন জানাইতেছি। আমরা দাবি করিতেছি এই রকম দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মুখােশ অবিলম্বে খুলিয়া ধরিয়া শাস্তির ব্যবস্থা হউক। দলমত প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে এ ব্যাপারে সকলের আগাইয়া আসা অবশ্য কর্তব্য। আমাদের মনে রাখা উচিত -ভাষা আন্দোলনের টাকা যারা আত্মসাৎ করিয়াছে তাদেরকে জনগণ কখনাে ক্ষমা করিবে না।

সৈনিক ১৯৫৩ সাল

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম