শহীদানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানে শ্রদ্ধা নিবেদন
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবিতে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করাচী প্রতিনিধি :
২১শে ফেব্রুয়ারি : গত বছর এদিনে যাদের পবিত্র লহুতে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। মাতৃভাষার ন্যায়সঙ্গত দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হাসতে হাসতে শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন সেই সব সৈনিকদের শ্রদ্ধা নিবেদন এবং তাদের রুহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় আস্থাশীল পাক রাজধানীতে বাস করা বিভিন্ন পেশার লােকজন সমবেত হয়েছিল এই মহতী সভায়। জনাব আখতার সাহেবের বক্তব্যে সভা শুরু হয়। প্রথমে দুই মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে। মহান আল্লাহ তালার শহীদানের পবিত্র রুহের শান্তি কামনা করেন। | অধীনস্থ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সাধারণ সম্পাদক জনাব রহমান খােন্দকার তার বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বাংলার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি বলেন যে, দেশের যে কোনাে দুর্যোগ মুহূর্তেই দায়িত্ব সুষ্ঠভাবে পালন করতে হবে। তমদুন মজলিশের করাচিস্থ সাধারণ সম্পাদক মুসা মুনসুর বাংলাভাষার উদ্দেশ্য এবং গতি বুঝাতে একটি ইংরাজি প্রবন্ধ পাঠ করেন। শ্রোতাবৃন্দ তাঁহাকে অনুরােধ করেন ঐ প্রবন্ধটি যাতে করাচিস্থ ইংরাজি দৈনিক কাগজগুলােতে ছাপানাে যায়। তাতে করে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বাংলা ভাষার প্রতি যে অন্ধতা আছে তা দূর হতে সাহায্য করবে। সভাপতি তাহার অভিভাষণে বলেন যে শহীদদের স্মৃতির প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রদর্শন সে দিনই সার্থক হবে যে দিন আমরা বাংলা ভাষাকে তার যােগ্য মর্যাদা দিতে সক্ষম হবাে। পশ্চিম পাকিস্তানের যে সব প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান এবং নেতা বাংলা ভাষাকে সমর্থনের নামে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণকে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করছে, তিনি যে সম্পর্কে হুসিয়ার থাকার জন্য পূর্ববাংলার জন সাধারণের প্রতি আবেদন জানান। সভায় নীচের প্রস্তাবগুলাে সর্ব সম্মতিক্রমে গৃহীত হয়:
১. বাংলা ভাষাকে অনতিবিলম্বে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বলে ঘােষণা
করা হউক।
২. ভাষা আন্দোলনে আটক আবুল হাশিম, মওলানা ভাসানী শামছুল হক
সহ সব বন্দিদের অবিলম্বে বিনাশর্তে মুক্তি দেওয়া হউক।
৩. ভাষা আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন এবং যারা আটক রয়েছেন
তাঁদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হউক।
রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ পুনর্গঠিত
কুষ্টিয়া ২৫শে ফেব্রুয়ারি : ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে কুষ্টিয়া রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠনের সময় আওয়ামী লীগের কোন শাখা এখানে না থাকায় এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের জেলা কমিটি গঠিত হওয়ার উক্তদলের ৪ জন মনােনীত প্রতিনিধি রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদে গ্রহণ করিয়া একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হইয়াছে। বর্তমানে নিম্মলিখিত ব্যক্তিগত জেলা রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের কর্মকর্তা ও সদস্য আছেন।
জনাব আবদুল হক এল, এল বি- (চেয়ারম্যান) সা’দ আহমদ এম, এ, এল, এল, বি, জনাব কফিল উদ্দিন আহমদ, জনাব লুফুল হক, জনাব নুরুল ইসলাম মােঃ শওকত আলী (যুগ্ম আহবায়ক) আবুল কাসেম, আলপ্তগীন মহবুবুল ইসলাম শামসু হুদা (যুগ্ম আহবায়ক), মাে: জিয়াফুর রহমান, মাে: আবুল কাসেম, মাে: আবদুল মতিন, নজম, উদ্দীন আহমদ, কাজী আবদুল কাজী মােয়াজ্জেম হােসেন, শফীকুল ইসলাম, এ, এম জামান – জালান উদ্দীন খান।
রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্য বহিষ্কৃত
অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপের অভিযােগে কুষ্টিয়া রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্য দেওয়ান আহমদকে সর্ব সম্মতিক্রমে বহিস্কৃত করা হইয়াছে।
সৈনিক প্রতিনিধি
বাংলা ভাষা সম্বন্ধে আলােচনা
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদে নির্দেশ অনুসারে গতকল্য এখানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির যৌক্তিকতার উপর এক মনােজ্ঞ আলােচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন দলের পক্ষ হইতে জনাব সাদ আহমদ, এম, এ এল এল বি, সামছুল হুদা, শওকত আলী আবদুল মতিন, জিয়াউর রহমান, আবুল কাসেম, কাজী আবদুল কাদীর, নজম উদ্দীন আহমদ প্রভৃতি আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন। সভাপতিত্ব করেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের চেয়ারম্যান জনাব আবদুল হক। বৈঠকের শেষে নিম্মলিখিত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়:
এই সভায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলিতে বাধ্যতামূলকভাবে উর্দু পড়াইবার জঘন্য প্রচেষ্টায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিতেছে এবং কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র ভাষা কর্মপরিষদের নিকট আবেদন জানাইতেছে। রাষ্ট্রভাষা মীমাংসায় পূর্বে এর বিরুদ্ধে সারা প্রদেশ ব্যাপী গড়িয়া তােলা হউক এবং বিলম্বে প্রদেশের প্রত্যেকই উর্দুকে বয়কট করিবার ব্যবস্থা নেওয়া হউক—
সৈনিক প্রতিনিধি।
চারদিকে রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনের বিপ্লবী অভিব্যক্তি
শহীদদের প্রতি সমগ্র পাকিস্তানের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন :
মাতৃভাষার দাবি আদায় করিতে গিয়া গত বৎসরের ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারি যে সকল বীর শহীদান পুলিশের নির্মম বেয়নেটের মুখে শাহাদাৎ বরণ করিয়াছিলেন, তাহাদের রক্ত রঙীন অমর স্মৃতির প্রতি এই বৎসরের ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ব বঙ্গের প্রতিটি নরনারী স্বতস্ফূর্তভাবে আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। প্রদেশের সর্বত্র ধর্মঘট, সভা ও শােভাযাত্রা অনুষ্ঠান কালাে ব্যাজ পরিধান ঘরে ঘরে কালাে পতাকা উত্তোলন করার মধ্যে শহীদানের অমর আত্মার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা এবং ভাষার দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন অভিব্যক্তি লাভ করে। সাড়ে চার কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলায় দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার মহান সংগ্রামে গত বৎসরের ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারিতে যে, বরকত ছালাম রফিক শফিক প্রমুখ বীর সেনাগণ পুলিশের নির্মম রেয়নেটের মুখে ঢাকার রাজপথকে বুকের তপ্ত রক্তে রক্তে সিক্ত করিয়া শাহাদাৎ বরণ করেন এই বৎসরের ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গের আবাল বৃদ্ধ বণিতা- শ্রমিক, কিষাণ, ছাত্র জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাহাদের অমর স্মৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। প্রদেশের সর্বত্র সাধারণ ধর্মঘট সভা ও শােভাযাত্রা কালাে ব্যাজ পরিধান, ঘরে ঘরে কালাে পতাকা উত্তোলন ইত্যাদির মধ্যে শহীদানের রক্ত রঙীন অমর স্মৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং যে দাবিকে প্রতিষ্ঠা করিতে যাইয়া তাঁহারা শাহাদাৎ বরণ করিয়াছিলেন সেই মাতৃভাষা বাংলার দাবির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন অভূতপূর্বরূপে অভিব্যক্তি লাভ করে। ঐ দিন সর্বত্র শহীদ দিবস পূর্ববাংলার প্রতিটি জনপদে অভূতপূর্ব সাফল্যের সহিত প্রতিপালিত হইয়াছে বলিয়া সংবাদ পাওয়া গিয়াছে।
রাজধানী :
ঐতিহাসিক ২১ শে ফেব্রুয়ারি সমাগত হওয়ার সাথে সাথে পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকা নগরীতে অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আবেদনক্রমে ২০ তারিখে রােজা রাখা ও মসজিদে মসজিদে শহীদানের মাগফেরাত কামনা, ঘরে ঘরে কালাে পতাকা উত্তোলন, কালাে ব্যাজ পরিধান করা হয়। শহরে পূর্ণ হরতাল প্রতিপালিত হয়। রাজধানী সমস্ত দোকান পাট, হাট বাজার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও অধিকাংশ অফিস আদালত সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়া শহীদ দিবস সাফল্য লাভ করে। প্রত্যুষে প্রভাতফেরি আজিমপুর গােরস্তানে সমবেত হয়। শহীদানদের সমাধি পুষ্পস্তবকে আচ্ছাদিত হইয়া যায় এবং শহীদানদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়।
শহীদদের সমাধিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা কর্মপরিষদ আওয়ামী লীগ, তমদুন মজলিশ, বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠান হল ও কলেজ ইউনিয়ন যুবলীগ গণতন্ত্রীদল প্রভৃতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফ হইতে মাল্যদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, সলিমুল্লা মুসলিম হল, ফজলুল হক হল ইকবাল হল, মেডিক্যাল কলেজ, মিটফোর্ড, মেডিক্যাল স্কুল, ছাত্রীনিবাস সমূহ এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভীর শােকের প্রতীক হিসেবে কালাে পতাকা উত্তোলিত হয় এবং ঐ সময়ে বেসরকারি বাসগৃহ সমূহে ও কালাে পতাকা উত্তোলিত হয়। অর্ধ লক্ষাধিক জনতার মিছিল রাজধানীর রাজপথ পরিভ্রমণ কালে উফুল্ল অভিযাত্রীর পুষ্পবৃষ্টি দ্বারা নাগরিকদের অভিনন্দিত করে।
শহীদানদের সম্মানার্থে ফজলুল হক হল, মেডিক্যাল কলেজ ও কামরুন্নেছা গার্লসই সকুলে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপিত হয়।
রাজবাড়ি : রাজবাড়ি ২৩শে ফেব্রুয়ারি। তমদুন মজলিশ ও খিলাফত পার্টির যুক্ত উদ্যোগে গত ২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখে এখানে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে শহীদ দিবস উদ্যাপিত হইয়াছে। মজলিশ কর্মীদের চেষ্টায় ২০শে ফেব্রুয়ারি শত্রুবার বিভিন্ন মজলিশ শহীদানের রূহের মাগফেরাত কামনা করিয়া মােনাজাত করা হয়। শনিবারে গােয়ল মহকুমার প্রায় সমস্ত দোকান বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ হরতাল পালন করা হয়।
সৈনিক, শুক্রবার ১৮ই নভেম্বর, ১৯৪৯
নতুন পদক্ষেপ
নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে সৈনিক আজ দ্বিতীয় বর্ষে আসিয়া পদাপর্ণ করিল। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, প্রেসের অসহযােগিতা, সরকারি ভ্রুকুটি- সর্বোপরি কায়েমি স্বার্থের রক্ষক ও তাদের দালালদের মিথ্যা প্রচারণা কোনাে কিছুই সৈনিকের অগ্রগামী অভিযানকে রুখিতে পারে নাই। এ দেশের কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধার পীড়িত, তাদের পরনে প্রয়ােজনীয় বস্ত্র নাই, দেহে স্বাস্থ্য নাই- শিক্ষাহীন, সৌন্দর্যহীন এই মানুষরাই রাষ্ট্রের সমস্ত প্রয়ােজন ও দাবিদাওয়ার বােঝা বহিয়া চলিয়াছে। অথচ তাহাদের কথা কেহ ভাবে না, ভাবিয়া দেখার প্রয়ােজন মনে করে। এই অবহেলিতদের মান আশা, আশ্বাস ফিরাইয়া আনিবার জন্য, তাদের পক্ষে হইয়া অবিরাম লড়িয়া যাইবার জন্য ‘সৈনিক লড়াই এর ময়দানে নামিয়াছিল তার সংশয়হীন, কুণ্ঠহীন তরবারী উন্মুক্ত করিয়াছিল, সে তরবারি সে মুহূর্তের জন্যও বন্ধ করে নাই। কোন ভয় দ্বিধা আসিয়া কখনাে তার বজ্রমুষ্টিকে শিথিল করিয়া দিতে পারে নাই। আজ দ্বিতীয়বর্ষে পদার্পণ করিয়া গত এক বছরে ‘সৈনিক কতটুকু সাফল্য অর্জন করিতে পারিয়াছে, তার হিসাব নিকাশের প্রশ্ন মান জাগা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা আজ তার প্রয়ােজন বোেধ করিতেছি না কারণ, লড়াইয়ের তাে সবেমাত্র শুরু হইল। সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের সকল গলদ এবং সকল দুশমনের বিরুদ্ধে এই যে সংগ্রামের সূচনা হইয়াছে তাহাকে আগাইয়া নেওয়াকেই ‘সৈনিক’ তার জীবনের ব্রত বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে— কোথায় সে হারিল, কোথায় জিতিল, তার বিচারের ভার সৈনিকের নিজের উপর নয়। সৈনিক তার লক্ষ্যে অবিচল থাকিয়া সংগ্রাম করিয়া আসিয়াছে। ইহাই তারপক্ষে বড়াে কথা দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের আনাচে কানাচে দানবেরা রক্তচক্ষু পাকাইয়া শাসাইতেছে। ইহাদের প্রচণ্ড শক্তির সঙ্গে সৈনিক একাই সংগ্রাম করিয়া। আসিয়াছে। দোসর না জুটিলেও সে ভয় পাইয়া পিছু হটে নাই। দেশে সংবাদপত্রের সংখ্যা কম নয়, তবুও কাহাকেও সৈনিক এই জেহাদে সঙ্গী হিসেবে পায় নাই, একাকিই তাকে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে হইয়াছে। এই সংগ্রামে হাজারাে রকমের ব্যর্থতা সত্ত্বেও সৈনিক যে কিছুটা সফলতা অর্জন করিয়াছে— এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সৈনিকের হাঁকে বার বার প্রতিক্রিয়ায় ধ্বজাধারীদের বুক কাঁপিয়া উঠিয়াছে। লাল ঝান্ডাওয়ালারা অসহায়তায় চমকাইয়া উঠিয়াছে, দুর্নীতিবাজদের পিলা চমকাইয়া গিয়াছে। প্রতিক্রিয়া, দুর্নীতি , কায়েমী স্বার্থ কিছুই দূর হয় নাই; কিন্তু তাদের ভিত্তিমূল ক্ষীণ এবং অস্পষ্টভাবে হইলেও কাপিয়া উঠিয়াছে। এ কৃতিত্ব সৈনিককে সৈনিকের শত্রুরাও দিতে বাধ্য হইবে। ইহাছাড়াও, সৈনিকের এই এক বৎসরের অভিযানে তার একটা মহামূল্যবান অভিজ্ঞতা হইয়াছে মানুষের শুভবুদ্ধি, মনুষ্যত্ববোেধ ও জেহাদি মনােবৃত্তি যে মরিয়া যায় নাই – বরং প্রকাশের সুযােগ খুঁজিতেছে তার প্রমাণ ও পরিচয় আমরা নানাভাবে পাইয়াছি। এই যে দুর্জয় শক্তি, প্রকাশের বেদনায় এতদিন গুমরিয়া মরিতেছিল, সৈনিকের জেহাদি আওয়াজে তাহাই ‘সংগ্রামী শিবিরে ঝাঁপাইয়া পড়িবার জন্য সাড়া দিয়াছে। সাহিত্য, সমাজ সেবার, সংস্কৃতি আন্দোলনে ইহারা সৈনিকের পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন ও দাঁড়াইতেছেন। এই জাগরণের মধ্যে আমরা এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখিতে পাইয়াছি। সৈনিকের জন্য এর চাইতে বড় আশা আশ্বাসের কথা আর কিছু হইতে পারে না। সৈনিক আজ এই মােজাহিদদের সাহায্য, সমর্থন ও শুভেচ্ছা মাথায় লইয়া দ্বিতীয় বর্ষের অভিযান শুরু করিতে যাইতেছে। বাধাবিঘ্ন এবারাে আছে, এবং তাহা হয়তাে প্রবল ভাবেই তারা আসিবে। কিন্তু তবু সৈনিক সত্য ও ইনসাফকে সমর্থন করিয়া, সংগ্রাম করিয়া যাইবে। প্রতিক্রিয়া, দুর্নীতি ও কায়েম স্বার্থের ভিত্তিতে আরাে কঠোর ভাবে আঘাত হানিবে জীর্ণ পুরাতনকে ধ্বংস করিয়া নতুন সমাজের বুনন প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত সে থাকিবে না। সৈনিক জানে এ কাজ তার একার নয়, কিন্তু আর কেহ না আসিলেও, সৈনিক তার নিজের কর্তব্য করিয়া যাইবে। সে ক্লান্তি জানে না, সংগ্রাম করিতেই সে আসিয়াছে অনেক মঞ্জিল, বহু দূর দূরান্ত পথ তাকে অতিক্রম করিতে হইবে, — এ সংগ্রামের শেষ নাই।।
‘সৈনিক সংগ্রামের ওয়াদা নিয়েই যুদ্ধে নেমেছে সৈনিকের জন্ম-বার্ষিকীতে সাংবাদিকদের অভিমত
ঢাকা ১৪ই নভেম্বর। অপরাহ্ন ৫ ঘটিকার সময় সৈনিক দফতরে সৈনিকের প্রথম জন্ম বার্ষিকী অনুষ্ঠান শুরু হয়। অধ্যাপক জনাব আবদুল্লাহ্ ফারুক সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সাহিত্যামােদী এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা অংশগ্রহণ করেন। সমাগত অতিথিবৃন্দকে পরস্পরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর সৈনিকের সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি জনাব শাহেদ আলী প্রথম সংখ্যা সৈনিকের সম্পাদকীয় পাঠ করেন। এরপর জনাব নুরুল হুদা সৈনিকের যশস্বী লেখক প্রজেশকুমার রায়ের ‘সৈনিক’ শীর্ষক কবিতা এবং জনাব সানাউল্লাই নূবী তাঁর ‘মাটির ঘরের সৈনিকেরা জাগাে’ নামক কবিতাটি পড়ে শুনান। অতঃপর সৈনিকের সাংবাদিকতার উপর আলােচনায় উপস্থিত হন জনমত সম্পাদক অধ্যাপক শ্রীগত সমর গুহ, ‘যুগের দাবি’ সম্পাদক জনাব খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার অধ্যাপক জনাব আব্দুল হাই এবং বিশিষ্ট সাহিত্যামােদী জনাব আবদুল ওয়াদুদ জনাব আবদুর রশিদ ও জনাব মােহাম্মদ ওয়ালি মিয়া। সৈনিকের সাংবাদিকতার উপর সুষ্ঠু সমালােচনা করতে যেয়ে সবাই একমত হয়ে একথা বলেন: যে সংগ্রামী ওয়াদা নিয়ে সৈনিক যুদ্ধের ময়দানে। নেমেছে তার এতটুকুনও খেলাফ হয়নি। অনাচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিরামহীন নির্ভীক সংগ্রামের সৈনিকের এক বছর কেটেছে খুব সতর্ক পাহারা দিয়ে। দেখা গিয়েছে এই মহান সংগ্রামে সৈনিক পিছপা হয়নি। সৈনিক ভূমিকা অসীম এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ। দিশাহারা নেতৃত্বকে পথ প্রদর্শন, শােষণ ও শাসনের অটোপাশে আবদ্ধ গণতন্ত্র ও জনমতের মুক্তি সাধন এবং স্বপ্ন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে জনগণের রাষ্ট্র পরিণত করার ভার সৈনিকের, সৈনিককে এই ব্যাপক লড়াইয়ে সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
আলােচনা শেষে সভাপতি সৈনিকের নয়া জয় যাত্রাকে অভিনন্দন জানিয়ে অভিভাষণ দেন। অতঃপর সৈনিকের তরফ থেকে জনাব নূরী অভাগাদের মােকারকবাদ জানান হয়। অতপর সন্ধ্যা ৭ টায় অনুষ্ঠানের কাজ শেষ হয়।
সৈনিকের সাংবাদিকতার উপর আলােচনায় উপস্থিত হন জনমত সম্পাদক অধ্যাপক শ্রীগত সমর গুহ, ‘যুগের দাবি’ সম্পাদক জনাব খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার অধ্যাপক জনাব আব্দুল হাই এবং বিশিষ্ট সাহিত্যামােদী জনাব আবদুল ওয়াদুদ জনাব আবদুর রশিদ ও জনাব মােহাম্মদ ওয়ালি মিয়া। সৈনিকের সাংবাদিকতার উপর সুষ্ঠু সমালােচনা করতে যেয়ে সবাই একমত হয়ে একথা বলেন: যে সংগ্রামী ওয়াদা নিয়ে সৈনিক যুদ্ধের ময়দানে। নেমেছে তার এতটুকুনও খেলাফ হয়নি। অনাচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিরামহীন নির্ভীক সংগ্রামের সৈনিকের এক বছর কেটেছে খুব সতর্ক পাহারা দিয়ে। দেখা গিয়েছে এই মহান সংগ্রামে সৈনিক পিছপা হয়নি। সৈনিক ভূমিকা অসীম এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ। দিশাহারা নেতৃত্বকে পথ প্রদর্শন, শােষণ ও শাসনের অটোপাশে আবদ্ধ গণতন্ত্র ও জনমতের মুক্তি সাধন এবং স্বপ্ন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে জনগণের রাষ্ট্র পরিণত করার ভার সৈনিকের, সৈনিককে এই ব্যাপক লড়াইয়ে সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে অগ্রসর হতে হবে।
আলােচনা শেষে সভাপতি সৈনিকের নয়া জয় যাত্রাকে অভিনন্দন জানিয়ে অভিভাষণ দেন। অতঃপর সৈনিকের তরফ থেকে জনাব নূরী অভাগাদের মােকারকবাদ জানান হয়। অতপর সন্ধ্যা ৭ টায় অনুষ্ঠানের কাজ শেষ হয়।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম