You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন
উদ্বোধনী বক্তৃতা
ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ
কার্জন হল, ঢাকা
২৩ শে এপ্রিল, ১৯৫৪

সমাগত সাহিত্যিক ও সাহিত্যামােদী বন্ধুগণ,
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টে বহু দিনের গােলামীর পর যখন আজাদীর সুপ্রভাত হলাে, তখন প্রাণে আশা জেগেছিল যে, এখন স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে বাংলা সাহিত্য তার সমৃদ্ধির পথ খুঁজে পাবে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর ঢাকার যে সাহিত্য সম্মিলনীর অধিবেশন হয়েছিল, তাতে বড় আশাতেই বুক বেঁধে আমি অভিভাষণ দিয়েছিলুম। কিন্তু তারপর যে প্রতিক্রিয়া হয়, তাতে হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলুম স্বাধীনতার নতুন নেশায় আমাদের মতিচ্ছন্ন করে দিয়েছে। আরবী হরফে বাংলা লেখা, বাংলা ভাষায় অপ্রচলিত আরবী পারসী শব্দের অবাধ আমদানী, প্রচলিত বাংলা ভাষাকে গঙ্গাতীরের ভাষা বলে তার পরিবর্তে পদ্মাতীরের ভাষা প্রচলনের খেয়াল প্রভৃতি বাতুলতা আমাদের এক দল সাহিত্যিককে পেয়ে বসল। তাঁরা এইসব মাতলামিতে এমন মেতে গেলেন যে প্রকৃত সাহিত্য সেবা যাতে দেশের ও দশের মঙ্গল হতে পারে, তার পথে আবর্জনার স্তুপ দিয়ে সাহিত্যের উন্নতির পথ কেবল রুদ্ধ করেই খুশিতে ভূষিত হলেন না, বরং খাটি সাহিত্যসেবীদিগকে নানা প্রকারে বিড়ম্বিত ও বিপদগ্রস্ত করতে আদাজল খেয়ে কোমর বেঁধে লেগে গেলেন। তাতে কতক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীরা উস্কানি দিতে কসুর করলেন না। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং অন্যান্য পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সাহিত্যিকগণের কাব্য ও গ্রন্থ আলােচনা, এমন কি বাঙালি নামটি পর্যন্ত যেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে কেউ কেউ মনে করতে লাগলেন। কেউ বা এতে মিলিত বঙ্গের ভূতের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আবল তাবল বকতে শুরু করে দিলেন এবং বেজায় হাত-পা ছুঁড়তে লাগলেন। করাচীর তাঁবেদার গত লীগ গভর্নমেন্ট বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির জন্য কিছু করা দূরে থাক, বাঙালি বালকের কচি মাথায় উর্দুর বােঝা চাপিয়ে দিলেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আরবী হরফে বাংলা ভাষা লেখার এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টায় সহযােগিতা করেছেন। এইরূপ বিষাক্ত আবহাওয়ায় ১৯৪৮ সালের পরে আর কোনও সাহিত্য সম্মেলনের আয়ােজন সম্ভবপর হয়নি। আজ জনপ্রিয় পূর্ব বাঙ্গালার গভর্নমেন্টের আশ্রয়ে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এক সর্বদলীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়ােজন করেছি।
পূর্ববঙ্গবাসীদের উদারতা যে তারা চার কোটি লােকের ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি না করে বরং উর্দুকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে মানতে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই উদারতার কৃতজ্ঞ না হয়ে কেউ কেউ এখনাে হুঙ্কার দিয়ে বলছেন, যারা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি করে তারা পাকিস্তানের দুশমন। আজ পূর্ববঙ্গবাসী সমন্বয়ে বলবে যে এই রকম উর্দু পূজারীরাই পাকিস্তানের দুশমন। আমরা পাকিস্তানের জানী দোস্ত, তার জন্যে আন্তঃপ্রাদেশিক ঐক্য চাই; সেই ঐক্যের খাতিরে আমরা বাংলার সঙ্গে উর্দুরও দাবি মেনে নিয়েছি। যারা জরবদস্তি ক্রমে সমস্ত পাকিস্তানের ওপর কোন একটি ভাষা চাপিয়ে দিতে চায়, তারাই পাকিস্তানের দুশমন; তারাই পাকিস্তান ধ্বংস করবে। | সুখের বিষয়, মুসলিম লীগ পার্লিমেন্টারি পার্টির কিঞ্চিৎ সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে। তারা উর্দু ও বাংলা উভয়কে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন, যদিও অন্য কতকগুলাে ভাষার বিষয় তারা বিবেচনা করতে স্বীকৃত হয়েছেন, কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার আসনে আসীন দেখলেই আমরা চরিতার্থ হব না, যদি না সেই সঙ্গে আমরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধিকেও না পাই। তার জন্য সর্বপ্রথম প্রয়ােজন হচ্ছে পূর্ববঙ্গের সমস্ত সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং সাহিত্যের উন্নতির প্রকৃষ্ট পন্থা অবলম্বনের জন্য একটি সুপরিকল্পিত পন্থা নির্দেশ করা। এই জন্য এইরূপ সাহিত্য সম্মেলনের আজ বিশেষ গুরুত্ব দাঁড়িয়েছে। আশা করি সমবেত সাহিত্যিকগণ এ বিষয়ে অবহিত হবেন।
আমরা চাই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ন্যায় একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি যার পরিচালনাধীনে প্রতি বছরে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে এইরূপ সম্মিলনীর অধিবেশন হবে। যাতে সাহিত্যিকরা আমাদের সাহিত্যের উন্নতির পন্থা নির্ধারণ ও ভাবের আদান প্রদানে সমর্থ হবেন। এই জন্য একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি স্থাপনের বা গ্রহণের কথাও এই সম্মেলনের প্রতিনিধিবর্গ বিবেচনা করবেন এই আশা করি। ঘরে ঘরে সাহিত্য সভা মন্দ কথা নয়; কিন্তু চাই একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি, যার নিজস্ব কার্যালয় থাকবে আর মুখপত্র থাকবে। আমরা অবিভক্ত পরাধীন বঙ্গে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি স্থাপন করেছিলুম। এখন স্বাধীন পূর্ববঙ্গে কি একটি উন্নততর কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি স্থাপন করতে পারব?
বর্তমান অবস্থায় পূর্ববঙ্গ সরকারের কার্যত সহানুভূতি ভিন্ন আমরা আমাদের সাহিত্যিক অভাব দূর করে তাকে সমৃদ্ধিশালী করতে পারি না। সেই জন্য একটি বাংলা একাডেমি বা বাংলা সাহিত্য নিকেতনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অত্যন্ত আনন্দের বিষয় আমাদের জনপ্রিয় পূর্ববাংলা সরকার এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে অগ্রসর হয়েছেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা সম্পর্কে সকলের হয়তাে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। এই জন্য আমি এই বাংলা সাহিত্য নিকেতন বলতে কি বুঝি, তা গত অক্টোবর মাসে সিলেটর এক জনসভায় যা বলেছিলুম এখানে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি।
‘এই বাংলা সাহিত্য নিকেতন বলিতে আমি বুঝি কলিকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ন্যায় বরং তদপেক্ষা উন্নততর ও ব্যাপকতর একটি প্রতিষ্ঠান। ইহার জন্য প্রথম প্রয়ােজন সুন্দর পরিবেশের মধ্যে আধুনিকভাবে সজ্জিত একটি প্রশস্ত দ্বিতল গৃহ। তাহার সংলগ্ন পুস্তকালয়ে বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট গ্রন্থগুলি বিশেষ : বাংলা ভাষায় মুসলমান রচিত, মুদ্রিত ও অমুদ্রিত সমস্ত বই ও পুঁথি থাকিবে। তাহাতে পাকিস্তানের ধর্ম, ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্বন্ধীয় আরবী, ফারসী, উর্দু, হিন্দী, ইংরেজি, ফরাসী, জার্মান, ইতালিয়ান, ডাচ, স্পেনিশ, এবং রুশ ভাষায় লিখিত পুস্তক এবং সাহিত্যিক পত্রিকাগুলাে রক্ষিত হইবে। ইহার একটি অনুবাদ বিভাগ থাকিবে। তাহার কার্য হইবে বিভিন্ন ভাষা হইতে পাকিস্তানের ধর্ম, সংস্কৃতি, প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস সম্পর্কীয় মূলবান পুস্তকগুলাে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা। ইহার একটি পস্তক প্রকাশ বিভাগ থাকবে তাহা হইতে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ এবং মুসলমান রচিত মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের সংস্করণ প্রকাশিত হইবে। এই বাংলা সাহিত্য নিকেতনের সহিত পাঠকক্ষ, গবেষণা প্রকোষ্ঠ এবং গবেষণাকারীদের জন্য বাসভবন থাকিবে।
‘সৌভাগ্য ক্রমে আমরা মরহুম আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ সাহিত্যসাগর সাহেবের সংগৃহীত অমূল্য পুঁথিগুলাের অধিকাংশ পাইয়াছি এবং তাঁহার অবশিষ্ট পুঁথিগুলােও পাইতে আশা করি। কিন্তু আরও অনেক মুসলমান লিখিত প্রাচীন পুঁথি অযত্নে, গৃহদাহ, জলপ্লাবন বা কীটদষ্ট হইয়া চিরতরে বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে। ব্যাপকভাবে এই সকল পুঁথি আহরণের জন্য কর্মচারী নিয়ােগ এবং অর্থ ব্যয় করিতে হইবে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে এই পূর্ববঙ্গ হইতেই ময়মনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা সংগৃহীত হইয়া প্রকাশিত হইয়াছে। চেষ্ট করিলে লােক-সাহিত্য এখনও সংগ্রহ করা যাইতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অর্থাভাবে এই সকল আবশ্যকীয় কাজ করিতে পারিতেছেন না। এই অর্থাভাবের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচীন পুঁথির সংস্করণ। ছাপাইতে পারিতেছে না।’
… সুতরাং এখন আমাদের একমাত্র ভরসা যে প্রস্তাবিত বাল্য সাহিত্য নিকেতন পূর্ববঙ্গ সরকার কর্তৃক স্থাপিত হইয়া এই সমস্ত সাহিত্যিক অভাব দূর করিতে অগ্রসর হইবে।
আমি সর্বপ্রথম ১৯৪৮ সালের সাহিত্য সম্মেলনে এই একাডেমির কথা বলেছিলুম। আমাদিগকে একটি একাডেমি (পরিষদ) গড়তে হবে, যার কর্তব্য হবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাবলীর অনুবাদ বাংলায় প্রকাশ। এজন্য এক পরিভাষা সমিতির প্রয়ােজন আছে। বিশেষ করে আরবী, পারসী এবং উর্দু ভাষা থেকে পাকিস্তানের ধর্ম ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে সইগুলাের অনুবাদ একান্ত প্রয়ােজনীয়। | এই সাহিত্য নিকেতনের আরাে কিছু কাজ আছে, যখন বাংলা রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে। তখন বাংলা ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত বিভাগের বইয়ের রচনা বা অনুবাদ আবশ্যক হবে এই জন্যে বিবিধ বিজ্ঞানের পরিভাষাগুলাে বাংলার করতে হবে, বাংলা সাহিত্য নিকেতনের একটি কাজ হবে একটি পারিভাষিক অভিধান সংকলন। করা।
প্যারিসে Académie Française এর নিয়ন্ত্রণাধীনে ফরাসি অভিধান সংকলন করা হয়েছে, তাতে যেসব শব্দ আছে তা ছাড়া ফরাসি সাহিত্যে অন্য শব্দ ব্যবহার। করবার কারাে অধিকার নেই। আমাদের এই সাহিত্য নিকেতনেরও কাজ হবে। এইরূপ একটি অভিধান সংকলন করা। কিন্তু দক্ষ কর্ণধার না হলে নৌকা যেমন মাঝ দরিয়ায় ডুবে যায় সেইরূপ এই সাহিত্য নিকেতনের যদি উপযুক্ত অধ্যক্ষ নিযুক্ত না হয় তবে তার দ্বারা ইষ্ট অপেক্ষা অনিষ্ট হবারই আশঙ্কা বেশি আছে। আশা করি আমাদের জনপ্রিয় সরকার বিশেষত শিক্ষামন্ত্রী আমাদের এই মন্তব্যটি ধীরভাবে বিবেচনা করে দেখবেন।
ভূতপূর্ব লীগ সরকারের আমলে বাংলা ভাষা ও অক্ষর সম্বন্ধে যে কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছিল দুঃখের বিষয় এখনও পর্যন্ত কেউ কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, এই প্রসঙ্গে আমি ১৯৪৮ সালে ঢাকায় সাহিত্য সম্মেলনের বলেছিলুম এখানে তা উদ্ধৃত করবার প্রয়ােজন মনে করছি।
‘মূল আর্যভাষার সঙ্গে মিশেছে আদি যুগে কোল, মধ্যযুগে ফারসি ও পারসীর ভিতর দিয়ে কিছু আরবী ও যৎসামান্য তুর্কি এবং পরবর্তী যুগে পর্তুগীজ আর ইংরেজি। দুচারটা দ্রাবিড়, মােঙ্গলীয়, ফরাসি, ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষায় শব্দও বাংলার আছে। মিশ্র ভাষা বলে আমাদের কিছু লজ্জা নেই। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা চলিত ভাষা ইংরেজির প্রায় দশ আনা শব্দসমষ্টি বিদেশী। পশ্চিম বাংলার পরিভাষা নির্মাণ সমিতি খাটি সংস্কৃত ভাষায় পরিভাষা রচনা করেছেন। পাঠ্য পুস্তক এইরূপ খাঁটি আর্য ভাষা চলতে পারে কিন্তু ভাষায় চলে না। আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ‘আর্গের কোনও স্থান নেই।’
‘ঘৃণা ঘৃণাকে জন্ম দেয়। গােড়ামি গােড়ামিকে জন্ম দেয়। একদল যেমন বাংলাকে সংস্কৃত-ঘেঁষা করতে চেয়েছে, তেমনি আর একদল বাংলাকে আরবীপারসী ঘেঁষা করতে উদ্যত হয়েছে। একদল চাচ্ছে খাটি বাংলাকে বলি দিতে। আরএক দল চাচ্ছে ‘জবে’ করতে। একদিকে কামারের খাড়া, আর একদিকে কসাইয়ের ছুরি।
‘নদীর গতিপথ যেমন নির্দেশ করে দেয়া যায় না, ভাষারও তেমনি। একমাত্র কালই ভাষার গতি নির্দিষ্ট করে। ভাষার রীতি (Style) ও গতি কোন নির্দিষ্ট ধরা বাঁধা নিয়মের অধীন হতে পারে না। ফরাসী ভাষা বলে Le style c’est I’ homme-ভাষার রীতি সেটা মানুষ অর্থাৎ মানুষে মানুষে যেমন তফাৎ, প্রত্যেক ললাকের রচনাতেও তেমনি তফাৎ থাকা স্বাভাবিক। এই পার্থক্য নির্ভর করে লেখকের শিক্ষা-দীক্ষা, বংশ এবং পরিবেষ্টনীর উপর। মােট কথা ভাষা হওয়া চাই সহজ, সরল এবং ভাষার রীতি (Style) হওয়া চাই স্বতঃস্ফুর্ত, সুন্দর ও মধুর। আমাদের স্মরণ রাখা উচিত ভাষা ভাব প্রকাশের জন্য, ভাব গােপনের জন্য নয়, আর সাহিত্যের প্রাণ সৌন্দর্য, গোঁড়ামি নয়।
‘কিছু দিন থেকে বানান ও অক্ষর সমস্যা দেশে দেখা দিয়েছে। সংস্কারমুক্ত ভাবে এগুলাের আলােচনা করা উচিত এবং তার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শ সমিতি গঠন করা আবশ্যক। যারা ধ্বনিতত্ত্বের সংবাদ রাখেন, তারা স্বীকার করতে বাধ্য যে বাংলা বানান অনেকটা অবৈজ্ঞানিক, সুতরাং তার সংস্কার দরকার। কেউ কেউ আরবী হরফে বাংলা লিখতে উপদেশ দিয়েছেন। যদি পূর্ববাংলার বাইরে বাংলা দেশ না থাকত আর যদি গােটা বাংলা দেশে মুসলমান ভিন্ন অন্য সম্প্রদায় না থাকত তবে এই অক্ষরের প্রশ্নটা এত সঙ্গীন হত না। আমাদের বাংলাভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। কাজেই বাংলা অক্ষর ছাড়তে পারা যায় না। আরবি হরফে বাংলা লিখলে বাংলার বিরাট সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে আমাদিগকে বঞ্চিত হতে হবে। অধিকন্তু আরবীতে এতগুলাে নতুন অক্ষর ও স্বরচিহ্ন যােগ করতে হবে যে বাংলার বাইরে, তা কেউ অনায়াসে পড়তে পারবে।
‘বিদেশীর জন্য অক্ষর জ্ঞানের পূর্বে ভাষাজ্ঞান এমন অদ্ভুত কল্পনা এ বৈজ্ঞানিক যুগে খাটে না। অক্ষর সম্বন্ধে বিবচেনা করতে হলে ছাপাখানা, টাইপরাইটার, শর্টহ্যান্ড এবং টেলিগ্রাফের সুবিধা অসুবিধার কথা মনে রাখতে হবে। বিশেষ করে বাংলাকে যখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা হচ্ছে তখন বাংলা ভাষার রাজনৈতিক সম্ভাবনা ও উপযােগিতার কথা চিন্তা করারও প্রয়ােজন রয়েছে। জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারের জন্য Basic English এর মতাে এক সােজা বাংলার বিষয় আমাদের বিবেচনা করা কর্তব্য। যদি ৮৫০টি ইংরেজি কথায় সমস্ত প্রয়ােজনীয় ভাব প্রকাশ করতে পারা যায়, তবে বাংলায় তা কেন সম্ভব নয়?
পূর্ববাংলার জনসংখ্যা গ্রেটব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালী, স্পেন, পর্তুগাল, আরব, পারস্য, তুর্কি প্রভৃতি দেশের চেয়ে বেশি। এই সােনার বাংলাকে কেবল জনে নয়, ধনে-ধান্যে, জ্ঞানে-গুণে, শিল্প-বিজ্ঞানে পৃথিবীর যে কোন সভ্য দেশের সমকক্ষ হতে হবে। তাই কেবল কাব্য ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। দর্শন, ইতিহাস, ভূগােল, গণিত, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনােবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, প্রভৃতি জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল বিভাগে বাংলাকে উচ্চ আসন নিতে ও দিতে হবে। তার জন্য শিক্ষার মাধ্যম স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে আগাগােড়া বাংলা করতে হবে।।
আমি অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ‘নুরনামার’ লেখক নােয়াখালীর সন্দ্বীপ নিবাসী আবদুল হাকিমের একটি কথা আমাদের দেশের এক শ্রেণির লােককে শুনিয়ে রাখছি :

‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে সবার কিবা রীতি নির্ণয় না জানি ॥
মাতা পিতাময় ক্রমে বঙ্গেতে বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি ॥
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়।
নিজ দেশে তেয়াগি কেন বিদেশে না যায় ॥
সাহিত্যিক বন্ধুগণ, আমি পুরানাে হয়েছি, আমার কথাও পুরানাে হয়েছে। কিন্তু আমার সব কথা এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু উদ্বোধনী বক্তৃতার সীমা লংঘন করে আপনাদের ধৈর্য্যের উপর অত্যাচার করতে চাই না, তাই করুণাময় আল্লাহ্ তায়ালার নিকট বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি এবং এই সাহিত্য সম্বেলনের সাফল্যপূর্ণ ও শান্তিময় পরিসমাপ্তি কামনা করে এর শুভ উদ্বোধন ঘােষণা করছি।
‘আল্লাহুমা-ফতাহ্ লনা আরওয়াবি রহমতিক’
হে আল্লাহ্ আমাদের জন্য তােমার দয়ার দ্বার উন্মুক্ত কর।
বাংলা ভাষা জিন্দাবাদ
পাকিস্তান জিন্দাবাদ
পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের কার্যনির্বাহক সমিতি
১৯৫২–১৯৫৩
সভাপতি : ডক্টর কাজী মােতাহার হােসেন।
সহ-সভাপতি : বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক সরওয়ার মুর্শেদ, আবদুল গনি হাজারী
মােস্তফা নূরউল ইসলাম
সাধারণ সম্পাদক : ফয়েজ আহমদ।
সহ-সম্পাদক : হাসান হাফিজুর রহমান
বােরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
বিভাগীয় সম্পাদক : আলাউদ্দিন আল আজাদ ফজলে লােহানী (সাহিত্য)
আবদুল্লাহ আল-মুতী (বিজ্ঞান)
আমিনুল ইসলাম (চিত্রকলা)
এম, আর, আখতার (প্রচার)
সদস্য :
শামসুর রাহমান
আনিস চৌধুরী
দৌলতে নেসা খাতুন
লায়লা সামাদ
সরদার জয়েন উদ্দিন
আতাউর রহমান
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
আনিসুজ্জামান
শেখ লুঙ্কর রহমান

সূত্র: সাহিত্য সম্মেলন প্রচার কমিটি, ২৩শে এপ্রিল, ১৯৫৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!