স্বাধীন বাঙলার বিপ্লব ও আমরা
নির্মল সেন
মুক্তিফোজ ঝড়ের বেগে ঢাকার দিকে এগিয়ে চলছে। রংপুর, সৈয়দপুর, খুলনা, যশাের, কুমিল্লা একের পর এক মুক্তিফৌজ দখল করে নিয়েছে। বেপরােয়া গণহত্যা চালিয়েও বাঙলাদেশে পিন্ডির ফৌজ হালে পানি। পাচ্ছে না। পূর্ব বাঙলা থেকে ইয়াহিয়ার ফৌজি কমান্ডান্ট পিন্ডিতে আকুল আবেদন জানিয়েছে – আরও ফৌজ পাঠাও। সুরক্ষিত প্রাসাদ, পিন্ডি থেকে আগত হাজার হাজার সৈন্য ও তাদের হাতের সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রের প্রতিরক্ষা কোনাে কিছুই টিক্কা খানকে বাঁচাতে পারেনি। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে টিক্কা খান খুন হয়েছে; খুন হয়েছে তার চারজন। সামরিক সাগরেদ। টিক্কা খান ছিল পূর্ববঙ্গে সামরিক আইনের প্রধান প্রশাসক। সেই প্রধানের হত্যার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক প্রশাসন বিপর্যস্ত। পিন্ডির হুকুম ছিল টিক্কা খানের মৃতদেহ বিমানযােগে পিডি পাঠাতে হবে। মুক্তিফৌজের যােদ্ধারা সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। রাতের অন্ধকারে শেষ পর্যন্ত ঢাকা শহরে সেই শয়তানের মৃতদেহ গাের দিতে হয়েছে।
এই খবরটা ইচ্ছাকৃত গুজব ছড়ানাে হয়
যাতে মুক্তিফৌজ ও দেশীয় জনগণ শক্তি পায়।
পিন্ডির বােমারু বিমান আকাশ থেকে বােমা বর্ষণ করেছে, সমুদ্র থেকে চট্টগ্রাম শহরের উপর গােলা। বর্ষণ করছে, বেপরােয়া নিরস্ত্র জনসাধারণকে গুলি করে মারছে আন্তর্জাতিক আইন ও সভ্যতার কোনাে নির্দেশই ইয়াহিয়া মানছে না। পরাজয়ের একেবারে প্রান্তে এসে সর্বত্র ফৌজি শাসনের যে দাঁত-বারকরা হিংস্র চেহারা হয় সেই চেহারায় দেখা দিয়েছে ইয়াহিয়া ও তার পিন্ডির ফৌজি চক্র।
অন্যদিকে স্বাধীন বাঙলা বেতার থেকে জনসাধারণকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জোয়ান পুরুষেরা কেউ শহর থেকে গ্রামে যাবেন না, শহরকে নিপ্রদীপ করে রাখুন, মুক্তিবাহিনীর পরিচয়পত্র ছাড়া আর কাউকে পেট্রল বিক্রি করবেন না। মুক্তিফৌজের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন মেজর জিয়া। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার দিকে মুক্তিফৌজ এগিয়ে চলছে, মুজিবরের নেতৃত্বে গঠিত বাঙলাদেশের অস্থায়ী সরকার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলাের কাছে স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানিয়েছেন— এই হলাে এখন পর্যন্ত ওপার বাঙালার শেষ খবর।
স্বাধীন বাঙলা থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় এমন দ্রুত নতুন খবর আসছে যে মাত্র দুঘণ্টা আগে শােনা খবরকে দুঘণ্টা পরে মনে হচ্ছে কত পুরনাে। এই মুহূর্তে শত চেষ্টা করেও আমি বিপ্লব শুরুর সাতদিন আগের পূর্ব বাঙলার ঘটনাবলীকে মনে করতে পারছি না। তার কারণ আমাদের সকলের স্মৃতির উপর স্বাধীন বাঙলা থেকে পাওয়া পাহাড়প্রমাণ টাটকা খবরের ভার। বিপ্লবের দিনে এটাই স্বাভাবিক।
“আমরাই এর সৃষ্টিকর্তা। আজ জনগণের শাসনের যুগের সূচনা হলাে। গভীর অন্ধকার থেকে আমরা আলাের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি। সর্বত্র আলােয় উদ্ভাসিত হােক” বিগত নির্বাচনে পূর্ব বাঙলার মুজিবর রহমান ও আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক জয়ের পর গত ৮ ডিসেম্বর গভীর রাতে ঢাকা রেডিও থেকে জনৈক বেতার ভাষ্যকারের উপরােক্ত ঘােষণা যারা শুনেছিলেন তারা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি মাত্র তিন মাসের মধ্যে বাঙলাদেশের ঘটনাবলী এমন রুপ পরিগ্রহ করবে। আমাদের সকলেরই ধারণা ছিল ইসলামাবাদেও জঙ্গী শাসক চক্র পূর্ব বাঙলার নির্বাচনের ফলকে হয়তাে শেষ পর্যন্ত অস্বীকার করবে এবং ফল হয়তাে কিছুদিনের গণ-বিক্ষোভের পর পূর্ব বাঙলা আবার স্থির শান্ত হয়ে যাবে। এবং তা যদি না হয় তাহলে শেষ পর্যন্ত। হয়তাে একটা আপস রফা হয়ে যাবে ইয়াহিয়া-মুজিবর-ভুট্টোর মধ্যে। পূর্ব বাঙলা শেষ পর্যন্ত এমন এক গণতান্ত্রিক সশস্ত্র বিপ্লবের পথ নেবে তা আমরা যেমন ঘুণাক্ষরে ভাবতে পারিনি, তেমনি ভাবতে পারেনি। বাঙলাদেশের সাইক্লোন-বিধ্বস্ত মানুষেরা যারা ডিসেম্বরে আওয়মি লীগের নৌকা প্রতীকচিহ্নের বাক্সে দলে দলে এসে ভােট দিয়েছিল।
বিপ্লবের বিজ্ঞান আছে, তার তত্ত্বও আছে- এ সবই ঠিক; কিন্তু বিপ্লব যখন আসন্ন হয়ে ওঠে তখন তার সেই ঝােড়াে গতিকে আগে থেকে বুঝতে পারা আমাদের মতাে ইতর জনের ক্ষমতা নেই। এমনকি সব নেতাও যে তা বুঝতে পারেন নির্বাচনকে নিছক একটা কৌশল বলে মনে করে যারা গ্রহণ করে এবং মুখে। সশস্ত্র বিপ্লবের খই ফোটায় তেমন ‘মার্কসবাদী’ দেরও ধারণা ছিল গণতন্ত্রবাদী বুর্জোয়া মুজিবরের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবী গণ-সংগ্রাম চলতে পারে না। ইতিহাসের কোন ক্ষণে দেশ-কাল-পাত্র-বিশেষে ঐতিহাসিক প্রয়ােজনে বুর্জোয়ার সঙ্গে একই সঙ্গে ক্ষমতায় অংশ গ্রহণ করা-একে তারা হারাম খাওয়ার মতই পাপ বলে। মনে করে। বিপ্লবের চূড়ায় যদি প্রলেতারিয় নেতৃত্বেও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা না গেল অর্থাৎ ঠেঙিয়ে, খুন করে, গুপ্তহত্যা করে অন্য সব সহযাত্রী বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক দলকে যদি ধরাশায়ী করে দেওয়া না গেল। তাহলে বিপ্লবী সংগ্রাম আদৌ বিপ্লবী অথবা সংগ্রাম নয় – ওটা সংশােধনবাদী কুহক মাত্র। পাকিস্তানের বর্তমান ঘটনাবলী থেকে বিপ্লবের ‘বিশুদ্ধ-সিদ্ধান্তপন্থী’ ও ‘গােস্বামীপন্থী উভয়বিধ অতিবিপ্লবী পুরােহিতদেরই শিক্ষা নেবার দিন এসেছে।
নিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের শক্তিসমন্বয় গড়ে তােলা যায় না। পূর্ব বাঙলায় যারা কৃষিবিপ্লবের ডাক দিয়েছিল কৃষক তাদের ধারে-কাছেও নেই, যারা শ্রমিক-নেতৃত্বে জনগণতন্ত্রেও ধ্বজা উড়িয়েছিল তাদের পাশে শ্রমিক নেই। শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, বুর্জোয়া-সমস্ত বামপন্থি ও গণতান্ত্রিক শক্তির সমাবেশ ঘটেছে। মুজিবের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পতাকার নিচে। গণতান্ত্রিক শক্তিকে, গণতান্ত্রিক বুর্জোয়াকে অদৃশ্য করে রেখে এ-বাঙলায় যারা বিপ্লবের খােয়াব দেখে তারা কি আজ নাকে খৎ দেবে?
রাওয়ালপিন্ডি থেকে যখন আদেশ দিয়ে ইয়াহিয়া সারা দেশে সাময়িক আইন কঠোরতর করলে, যখন লেফটনান্ট-জেনারেল আহসানকে সরিয়ে জঙ্গী ঘুঘু খানকে পূর্ব বাঙলায় সামরিক শাসনের মাথায় এনে বসানাে হলাে তখন থেকে পূর্ব বাঙলার বিপ্লবের নেতৃত্ব স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে আপস রফার সম্ভাবনা কমে আসছে এবং সামনে লড়াই খালি হাতে হবে না। পূর্ব বাঙলার জনসাধারণের সংগ্রামী মনােভাবের দর্পণে আগামী দিনের সংগ্রামী রূপের প্রতিবিম্বকে তারা চিনে নিলেন। তারপরের প্রয়ােজনই পূর্ব বাঙলার শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলকে সশস্ত্র গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে পরিচালিত করল।
আজকে পূর্ব বাঙলার পথে পথে জনসাধারণের পাশে ঈস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও আনসার বাহিনীর বীরত্বপূর্ণ লড়াই প্রমাণ করছে পথ ভুল হয়নি।
বাঞ্চলে বড় বড় রাজপথে ইয়াহিয়ার ট্যাঙ্কবাহিনী কিছুদিনের জন্য দাপট চালাতে হয়তাে পারবে তা নয়।
ঠিক একই কথা বলা যায় বিপ্লবী সংগ্রামের রুপ ও পদ্ধতি সম্পর্কে। অস্ত্রের ঝনঝনা দিয়েই যে সমস্ত বিপ্লবের মুখবদ্ধ রচিত হবে এমন কোনাে কথা নেই। এমন কোন কথাও নেই যে পরিপাটি এক নিরবচ্ছিন্ন। শান্তিপূর্ণ পথ ধরে এগিয়ে বিপ্লব সফল হবে।
বৈয়াকরণিকের মতাে পুথিবদ্ধ বিপ্লবী সূত্রে ও ফর্মুলায় যাদের আস্থা সীমাবদ্ধ তারা ভাবতেও পারেনি, এমনকি আজও ভাবতেও পারছে না যে মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব বাঙলার গণতান্ত্রিক বিপ্লব সশস্ত্র সংগ্রামের পথ নিতে পারে। কারণ মুজিবর সমাজন্ত্রবাদী নয়, মুজিবর কমিউনিস্ট নয় এবং মুজিবর বুর্জোয়া ও গণতন্ত্রবাদী। আর তাদের ভাষায় পার্লামেন্ট তাে গুয়ােরের খোয়াড়, নির্বাচন মানুষকে বুর্জোয়ার খোয়াড়ে বন্দি করার ছলনা মাত্র। অন্যদিকে বাল্যকাল থেকে ডিগবাজি খেতে খেতে বয়সকালে সার্কাসের খেলােয়াড় হয়তাে হওয়া যায় কিন্তু তাই বলে গোড়া থেকে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য উত্থালি-পাতালি করেই যে সশস্ত্র সংগ্রাম করে ফেলা যায় তা নয়। বড়জোর অস্ত্রের নামে পাইপগান ও বােমা নিয়ে, বেপরােয়া গলাকাটায় মেতে একটা ক্যারিকেচার করা যায়। এর বেশি নয়।
গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা পার্লামেন্টারি পথেও হতে পারে- পূর্ব বাঙলা আমাদের শেখাল। আর এও শেখাচ্ছে যে অতিবিপ্লবী ছুঁৎমার্গ কিন্তু শহরের অলিতে গলিতে যেখানে জনজীবনের প্রাণস্পন্দন সবচেয়ে বেশি সেখানে, অথবা খাল-বিল-নদী-নালায় ঘেরা সজল বাঙলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মাটিতে সাজোয়া ট্যাঙ্ক কি ইয়াহিয়া ফরমান মানতে পারবে? তাছাড়া যে লড়াই জনসাধারণের সর্বস্তরে রক্তস্রোতের মতাে ছড়িয়ে পড়েছে সেই লড়াইয়ের প্রতিরােধের সামনে কয়েক হাজার বহিরাগত পাঞ্জাবী সৈন্য কতক্ষণ টিকবে?
কামান দেগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অংশ উড়িয়ে দিয়ে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা যখন ভাবছে কেল্লা ফতে দেরি নেই সেই সময়েই একে একে যশাের, খুলনা, কুমিল্লা, রংপুর মুক্তিফৌজের দখলে চলে আসছে। কতদিন সামলাবে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা। অতবড় মার্কিন বাহিনীই ভিয়েতনামে বেসামাল হয়ে পড়েছে তাে ইয়াহিয়া। তবুও যতদূর মনে হয় স্বাধীন বাঙলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হবে। মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের মতাে সকালে শুরু হয়ে এ যুদ্ধ সন্ধ্যায় বিশ্রাম নেই। অনুন্নত দেশের আধুনিক কুরুক্ষেত্র এ। এ লড়াই রাতের অন্ধকারেই ক্ষিপ্র হয়, অতর্কিত হয়, তীব্রতর হয়। মুখােমুখি লড়াইয়ে এর ফয়সালা হয় না। দীর্ঘায়িত লড়াইয়ে শত্রুর লাশকে ধরাশায়ী করে এ লড়াই জিতবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ততদিন আমরা কি করব? এক পা বাড়ালেই যেখানে ওপার বাঙলা সেখানে আমাদের সাহায্য আরও বাস্তব আরও কার্যকর হতে পারে। স্থির হয়ে আমাদের কিছুক্ষণ বােধ হয়, সেই ভাবনাই আজ ভাবা উচিৎ।
সূত্র: সপ্তাহ, ২ এপ্রিল, ১৯৭১