ভুলের মাশূল
গত শুক্রবার বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য করার জন্য পাক গণপরিষদের নিকট সুপারিশ করিয়া প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীন ব্যবস্থা পরিষদে এক বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করেন; উহা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। বহু বিলম্বে এবং বহু অবাঞ্ছিত ঘটনার পর মন্ত্রিসভা ও ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যগণের আংশিক শুভবুদ্ধি উদয় হইয়াছে দেখিয়া সকলেই সুখী হইবেন। কিন্তু এই প্রস্তাব কার্যকরী করণে মন্ত্রিসভা ও তাদের সমর্থক দল কতটা দৃঢ়তা দেখাইবেন, এ সম্পর্কে জনমনে সন্দেহের অবসান হয় নাই। বিশেষত যে সব ঘটনার পর উক্ত প্রস্তাব পেশ ও গ্রহণ করা হয় উহাই মন্ত্রিসভার উপর জনসাধারণের আস্থাহাস করিয়াছে।
প্রস্তাব পেশ করিবার সময় জনাব নূরুল আমীন বরেন যে, গত বৃহস্পতিবারে সরকার যে ব্যবস্থা অবলম্বন করেন তাহা রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে দাবি বিরােধী বলিয়া মনে করার নানারূপ ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াছে। তিনি বলেন যে, সেরূপ বিরােধিতা করার ইচ্ছা সরকারের নাই। ইহাই যদি প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার প্রকৃত বক্তব্য হয়, তাহা হইলে তাহারা ২১ শে তারিখের পূর্বেই উহা প্রকাশ না করার কারণ দুয়ে রহস্যরূপে থাকিয়া যাইতেছে, এমন কি ২১ শে তারিখের সকালবেলাতেও এরূপ একটা বিবৃতি মন্ত্রিসভার তরফ হইতে প্রকাশিত হইলে পরবর্তী মর্মন্তুদ ঘটনা হয়ত সংঘটিত হইত না এবং আমাদের বিশ্বাস, কতকগুলাে অমূল্য জীবনেরও অবসান হইত না। সুতরাং নানারূপ ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়াই থাকে, তাহা হইলে সেজন্য জনসাধারণকে দোষ দেওয়া যায় না।
শহরে ১৪৪ ধারা জারীর কারণ ব্যাখ্যা করিতে গিয়া প্রধানমন্ত্রী বলিয়াছেন, সরকার জানিতে পারিয়াছেন যে, কোনও কোনও লােক শহরের স্বাভাবিক জীবন যাত্রাকে অচল করিতে চায়। ২২ শে তারিখে প্রকাশিত সরকারি বিবৃতিতেও এই মর্মে মন্তব্য প্রকাশিত হইয়াছিল যে, যে সকল তথ্য আছে তাতে জানা যায়, বেআইনী কার্যকলাপের দরুন আজকের (অর্থাৎ ২১ শে তারিখের) অবাঞ্ছনীয় ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার জন্য দায়ী এমন একদল লােক যাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনাে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক নাই। একথাটা যদি সত্য হয় তাহা হইলে এতদিন জনসাধারণের নিকট এসব তথ্য যতদূর সম্ভব উদঘাটন করা হয় নাই কেন? যদি পূর্বাহেই বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা সম্পর্কে মন্ত্রিসভার মনােভাব প্রকাশিত হইত এবং দেশবাসীর নিকট রাষ্ট্র-বিরােধীদের কার্যকলাপ প্রকাশিত হইত, তাহা হইলে গুলি চালান বন্ধ হতাে। ১৪৪ ধারার প্রয়ােজন হতাে না। মন্ত্রিসভা আজ নিজেদের যে অবস্থা করিয়াছেন তাহাকে কেবল সুস্পষ্ট অভিযােগ দ্বারা দেশের জনসাধারণকে স্বীকৃতি বা তাদের আস্থা অর্জিত করিতে পারিবেন বলিয়া মনে হয় না। দেশের জনসাধারণ শান্তি ও শৃংখলাকারী বা রাষ্ট্রবিরােধীদের কখনও সহ্য করিবে না। ছাত্রসমাজের দেশাত্মবােধের উপর আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। সুতরাং সরকার আজ তাদের ভােলা ঢেল টেবিলে রাখুন। সব তথ্য হয়ত প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু যথাসম্ভব প্রকাশ করুন। আমরা তাদের এ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আমাদের ছাত্রসমাজ আমাদের দেশের জনসাধারণ দুষ্কৃতকারীদের সমূলে উচ্ছেদ করিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবােধ করিবে না।
জনাব নূরুল আমীন ও তাঁর মন্ত্রিসভা ভুলের পর ভুল করিয়া চলিয়াছেন। তাঁহারা নিজেদের গণনেতা বলিয়া দাবি করেন। সর্বজনবিদিত যে, জননেতা তারাই, যাদের পরিপূর্ণ যােগাযােগ আছে জনতার অন্তরে সঙ্গে, সঙ্কটকালে তাঁরা ‘রােডাকে সঙ্কটকালে তারা… জনতাকে সুষ্ঠু পথে চালিত করিতে পারেন। এই মাপকাঠিতে জনাব নূরুল আমীন ও তার মন্ত্রিসভার বিচার করিলে তাদের সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হয়, তা নিষ্প্রয়ােজন।
যে যাহাই হােক বর্তমান মন্ত্রিসভার বিচার দেশের জনসাধারণই করিবে। কিন্তু আজ তারা যে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়াছেন, তার সমাধান তাদেরই করিতে হইবে। এখন তাদেরই ভুলে যে অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, উহার সমাধানের জন্য তাদেরই অগ্রসর হওয়া কর্তব্য। এটা তাদের ভুলের মাসুল এবং তা দেওয়া হইবে যদি তারা অহেতুক প্রেস্টিজ ত্যাগ করিয়া অনতিবিলম্বে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করেন এবং উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ ও জনসাধারণের আস্থাভাজন তদন্ত কমিটি নিয়ােগ করেন শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষাকল্পে এবং দেশের কল্যাণের জন্য এ ছাড়া অন্য কোন পথ আছে বলিয়া আমরা মনে করি না।
সূত্র: দৈনিক আজাদ, ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২