You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952 | ভাষা আন্দোলনের পটভূমি- আবদুল হক - সংগ্রামের নোটবুক

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
আবদুল হক

পাকিস্তান আমলে ভাষা-আন্দোলনের পূর্ণ ইতিহাস রচনা এবং যথার্থ ব্যাখ্যা ছিল কঠিন, তথাপি ঐ সময়ে প্রশংসনীয় কাজ কিছু হয়েছিল। এরূপ প্রয়াসে যেসব অসম্পূর্ণতা ছিল তার একটি কারণ রাজনৈতিক, আরেকটি কারণ প্রয়ােজনীয় যাবতীয় তথ্যের অভাব। আরাে একটি কারণ কালের পরিপ্রেক্ষিত: একাত্তরের আগে যা ছিল এক রকম, একাত্তরের পরে তা অন্য রকম।।
সাধারণভাবে বলা হয় প্রথম ভাষা-আন্দোলন হয়েছিল ১৯৪৮ সালের গােড়ার দিকে। শুধু সক্রিয় আন্দোলন অর্থেই এমন উক্তি করা সম্ভব, কিন্তু এরূপ আন্দোলনেরও একটা পশ্চাদভূমি এবং মানসিক প্রস্তুতির অধ্যায় থাকে। সভাশােভাযাত্রায় উচ্চারিত শ্লোগানের আগের স্তরটি সমাজের সচেতন অংশে চিন্তার আকারে মৌল দাবিগুলাের সঞ্চারণ এবং ভাষায় তার উচ্চারণ। আধুনিককালে যাবতীয় সক্রিয় আন্দোলনেরই সূচনা হয় এইভাবে। ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসগুলাের বিবরণ অনুযায়ী বাঙালি লেখকগণ বাংলা রাষ্ট্রভাষার সপক্ষে পত্রপত্রিকায় লিখতে আরম্ভ করেছিলেন ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে এবং এ প্রয়াসের সূচনা ঢাকায়। কিন্তু তা ঠিক নয়। এ প্রচেষ্টার শুরু আরাে আগে এবং কোলকাতায়। ভাষা-আন্দোলনে লেখক-সমাজের অবদান কতখানি, এবং এ আন্দোলনের তাৎপর্য কি সে সম্বন্ধেও এসব ইতিবৃত্ত থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। বর্তমান আলােচনায় এসব বিষয়ে কিছু আলােকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
ভাষা-আন্দোলনের মধ্যেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম বহিঃপ্রকাশ। ঘটেছিল। অবশ্য এই জাতীয়তাবাদ তখন রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিল না। তেসরা জুন ভারত বিভাগ পরিকল্পনা ঘােষিত হওয়ার পর পাকিস্তানের দুটি বিচ্ছিন্ন অংশের মােটামুটি রূপরেখা বাস্তব রূপ নিয়েছিল (এই রূপরেখার প্রাথমিক রােমান্টিক ধারণা লাহাের প্রস্তাবেই দেওয়া হয়েছিল) এবং এই বিচ্ছিন্ন দুটি অঞ্চলের ভৌগােলিক দূরত্বের তাৎপর্য এবং সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও রাজনৈতিক ব্যবধানের স্বরূপ তখনই উদঘাটিত হয়নি। দু’অঞ্চলের মানসিক বিচ্ছেদের প্রশ্নও তখন ছিল না। পাকিস্তান আন্দোলনের উন্মাদনা এবং সাম্প্রদায়িক তন্ময়তা, বিদ্বেষ ও রক্তাক্ত সংঘর্ষ তখন এইসব ব্যবধানের প্রশ্নকে চাপা দিয়ে রেছেছিল। তা ছাড়া ঐসব ব্যবধানের বাস্তব অভিজ্ঞতাও তখন হয়নি।
কিন্তু ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যচেতনা বাঙালি (মুসলিম) সমাজে আগে থেকেই ছিল এবং মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘােষণার অব্যবহিত পরেও তার প্রকাশ ঘটেছিল। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিও উঠেছিল তখনই।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘােষণার সময় ভাবী পূর্ববঙ্গ সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত লেখক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিরাট অংশই ছিলেন কোলকাতায়, পাকিস্তানের সমর্থক দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রপত্রিকায় এবং বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত লেখক ও সাংবাদিকরাও ছিলেন ঐ মহানগরীতে। বামপন্থী মুসলিম তরুণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী (নেতৃস্থানীয় প্রধান অংশ) ছিলেন সেখানেই। বস্তুত কোলকাতা শুধু অখণ্ড বাংলাদেশের নয়, কিছুদিন খণ্ডিত পূর্ববঙ্গেরও রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী ছিল— আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘােষণার পরে-পরেই আসন্ন পাকিস্তানের বিভিন্ন সমস্যা তাদের দৈনন্দিন উত্তেজনাময় আলােচনার বিষয়বস্তু ছিল। এইসব আলােচনার একটা প্রধান বিষয় ছিল রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন, কেননা ইতিমধ্যে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল যে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চলছে। সচেতন লেখকবৃন্দ তখনই এ প্রয়াসের বিরােধিতা করার এবং বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প নিয়েছিলেন। তাঁরা অনেকে ব্যক্তিগত প্রচারকার্য চালিয়েছিলেন এবং পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছিলেন। এ সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে-সব প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল তার কিছু বিবরণ এখানে দেওয়া হলাে।
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের একটা মূল কথা ছিল ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যচেতনা, সেই সঙ্গে অন্য চেতনাও ছিল, কিন্তু ঐ স্বাতন্ত্র্যচেতনাই ছিল মুখ্য। দৈনিক ইত্তেহাদের সাহিত্য বিভাগে ১৯৪৭ সালের ২২ জুন এবং ২৯ জুন তারিখে দু’কিস্তিতে ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, বাঙালির ভাষাগত স্বাতন্ত্র ঘােষণাই ছিল এর লক্ষ্য। এর প্রথম কিস্তি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, দ্বিতীয় কিস্তি আরম্ভ হয়েছিল এইভাবে:
ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যদি শুধু ইংরেজিরই আধিপত্য দেখতাম, অন্য কোনাে ভাষার আধিপত্য না দেখতাম, তবে বলতাম তার কারণ ইংরেজির ঐ রাষ্ট্রভাষিক মর্যাদা, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে তার অতিমূল্যবানতা, এবং শিক্ষা-ব্যবস্থায় বাংলার নিম্নতম স্থান নির্দেশ। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে বাঙালিদের ব্যবহারিক জীবনে শুধু ইংরেজির নয়, উর্দু এবং হিন্দিরও সমান আধিপত্য।।
অনুমান করা অসঙ্গত হবে না, প্রবন্ধের প্রথম কিস্তির বক্তব্য ছিল বাঙালির ইংরেজিয়ানা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের কিছু অভিব্যক্তি ঐ অংশে থেকে থাকবে।
বিদেশী এবং অবাঙালিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বাঙালি ভাষাগত এবং জাতিগত হীনম্মন্যতার পরিচয় দেন। তিনি কথা বলেন হয় ইংরেজিতে না হয় উর্দু-হিন্দিতে।
প্রায় বাঙালি এটা মনে-প্রাণে জানেন যে, হিন্দী-উর্দুভাষীর সঙ্গে কথা বলতে হলে তাকে হিন্দি-উর্দুতে বলতে হবে, কেননা অপর পক্ষ বাংলা জানেন না।
স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হলেও এটা একটা বাধ্য-বাধকতা, এরূপ বাংলা জানা এবং বলার বাধ্যবাধকতা ও গরজ এখন পর্যন্ত অবাঙালিদের নেই।
কেন এমন হয়?
এর প্রধান কারণ এই যে বাঙালির জাতীয়তাবোেধ এখনাে পরিপূর্ণভাবে ফুরিত হয়নি। তার জাতীয় মর্যাদাবােধ এখনাে অত্যন্ত কাঁচা, তার পূর্ণ জাতীয় ব্যক্তিত্ববােধ এখনাে অপ্রতিষ্ঠিত। এই কারণেই বাঙালিরা সাধারণত বুঝতে পারেন যে, নিজ বাসভূমেও ইংরেজ তথা অবাঙালিদের সঙ্গে তাদেরই ভাষায় কথা বললে জাতীয়তাবােদের দিক থেকে নিজেকে ছােট করা হয়, নিজের অমর্যাদা করা হয়, নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেওয়া হয়।… আমার মনে একটা প্রশ্ন সব সময়ই উদ্যত হয়ে থাকে : আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজি-উর্দু-হিন্দি বলতে বাধ্য থাকব? আমাদের দেশে যারা বাস করে সেইসব ইংরেজ বা উর্দু-হিন্দিভাষীরা কেন বাংলা শিখতে বাধ্য হবে না?
বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন প্রথম আলােচিত হওয়ার মুহূর্তেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ ব্যক্ত হয়েছিল এই প্রবন্ধে, ঈষৎ তীব্রতা এবং উষ্ণতার সঙ্গেই। অবশ্যই এই জাতীয়তাবাদের উপলক্ষ বাংলাভাষা : সম্ভবত একে বলা চলে ভাষাগত জাতীয়তাবাদ। ঐ প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার একদিন পরে, ৩০ শে জুন তারিখে দৈনিক আজাদ’ এর সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল একই লেখকের ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ। সূচনায় বলা হয় :
‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা এখন স্থির করার সময় এসেছে। যে ভাষাকেই আমরা রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করি, তার আগে আমাদের বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হবে, – কোন্ ভাষায় পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লােক কথা বলে, পাকিস্তানের মধ্যে সব থেকে শ্রেষ্ঠ ভাষা কোটি, কোন্ ভাষায় সব থেকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে এবং কোন্ ভাষা ভাব প্রকাশের পক্ষে সব থেকে বেশি উপযােগী। … যেদিক থেকেই বিবেচনা করা যাক না কেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবিই সবচেয়ে বেশি। … এর মধ্যে দ্ব্যর্থক যদিও কিছু নেই, তবু এখানে স্পষ্ট করেই বলা প্রয়ােজন বােধ করছি যে, কেবল পূর্বপাকিস্তানের জন্যই নয়, পশ্চিম-পাকিস্তানসহ সমগ্র পাকিস্তানেরই রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবি এবং যােগ্যতা সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষার।
এরপর পাকিস্তানের ভাষাগুলাের একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালােচনা দেওয়া হয়। জনসংখ্যা, সাহিত্য ও প্রকাশ ক্ষমতার দিক দিয়ে, বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয়, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার যােগ্য একমাত্র বাংলা ভাষাই।’ এরপর উর্দুর প্রশ্ন আলােচিত হয়। উর্দু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে এমন কথা কেউ কেউ বললেও সরকারিভাবে বলা হয়নি, স্বাধীনতা তখনাে আসেনি এবং পাকিস্তানে কোনাে সরকারই গঠিত হয়নি, কিন্তু বহু বছরের উর্দু-হিন্দি বিরােধ এবং মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সংগঠন ও স্বরূপের কথা স্মরণ করে বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ অনুমান করতে পেরেছিলেন (এবং এ ধরনের কথাও তখন রটেছিল) যে উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা করা হবে। কিন্তু সেটা হবে অসঙ্গত। পাকিস্তানে বাঙালির চেয়ে উর্দুভাষীর সংখ্যা বেশি নয় ‘এবং ভাষাগত উৎকর্ষ ও সাহিত্য সৃষ্টির দিক থেকে উর্দুর চেয়ে বাংলা ভাষাই শ্রেষ্ঠতর। তা সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হলে তার ফল হবে অত্যন্ত অশুভ, বিশেষ করে বাঙালির জন্য ক্ষতিকর। উর্দু রাষ্ট্রভাষা ঘােষিত হলে ইংরেজির স্থান নিবে উর্দু, এবং ইংরেজি না জানা যেমন সরকারি চাকরির জন্য অযােগ্যতা, উর্দু না জানা তেমনি অযােগ্যতা বলে গণ্য হবে এবং পূর্ব-পাকিস্তানের পাঁচ কোটি লােক সরকারি চাকরির অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। অন্যদিকে উর্দু-শিক্ষিত মাত্রেই চাকরির যােগ্য বলে গণ্য হবে। উর্দু সংবাদপত্রের মর্যাদা হবে বাংলা সংবাদপত্রের চেয়ে বেশি। উর্দু শিখলেও বাঙালিরা কখনই উর্দুভাষীদের মতাে উর্দু সংবাদপত্রের মর্যাদা হবে বাংলা সংবাদপত্রের চেয়ে বেশি। উর্দু শিখলেও বাঙালিরা কখনই উর্দুভাষীদের মতাে উর্দু লিখতে-বলতে পারবেন না। অতএব সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের আইন-পরিষদে এবং অন্যত্র বাঙালিদের প্রভাব হবে উর্দুভাষীদের থেকে অনেক কম।
প্রবন্ধে আরও বলা হয় : ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করলে আমাদের সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নতি শুধু ব্যাহত হবে না, রুদ্ধ হয়ে যাবে। কেননা ইংরেজ-আমলে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব যেমন পড়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উপর, পাকিস্তান আমলেও তেমনি প্রভাব পড়বে উর্দুভাষা ও সাহিত্যের। কিন্তু ইংরেজি বাংলার থেকে শ্রেষ্ঠতর ভাষা ও সাহিত্য, উর্দু তা নয়। তার ফলে ইংরেজির প্রভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে, উর্দুর প্রভাবে তা হবে না। কেননা : সাহিত্য হিসেবে উর্দু-সাহিত্য ইংরেজির থেকে তাে নয়ই বাংলা-সাহিত্য থেকেও শ্রেষ্ঠতর নয়। অথচ উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তার প্রভাব বাংলা-সাহিত্যের উপর পড়বে; যে সাহিত্য শ্রেষ্ঠতর নয় তার প্রভাব পড়বে শ্রেষ্ঠতর সাহিত্যের উপর এবং তার ফলে বাংলা সাহিত্য লাভবান না হয়ে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিপদ শুধু সেদিক থেকেই নয়। বাঙালি সমাজ সব সময়েই জানতাে ইংরেজি বিদেশী ভাষা এবং এই কারণে এর প্রভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সত্তা হারিয়ে ফেলতে আমরা দেইনি, কিন্তু যেহেতু উর্দু বিদেশী ভাষা নয়, এবং এই ভাষা ও সাহিত্যকে আমরা শ্রদ্ধা করি, এমনকি বােধ হয় কেউ কেউ বাংলার চেয়েও শ্রদ্ধা করি, সেহেতুই বিপদ আরাে বেশি। এতে এমন সম্ভাবনাও আছে যে আমরা সম্পূর্ণভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বর্জন করে সম্পূর্ণভাবে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যকে গ্রহণ করবাে; বাংলা-সাহিত্যের আসর থেকে আমরা চিরবিদায় নেব… যার অর্থ হবে আমাদের মৃত্যু। এই আশঙ্কা অমূলক ছিল না। বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ভাষা বাংলা হওয়া উচিত না উর্দু, তা নিয়ে এই বাংলাদেশেই একদিন প্রশ্ন উঠেছিল, এবং এককালে বাংলা পুঁথি লেখা হয়েছিল আরবী হরফে। উর্দু সমর্থন করার মতাে রাষ্ট্রশক্তি সেকালে ছিল না বলেও প্রশ্ন প্রাধান্য পায়নি, কিন্তু পাকিস্তানে উর্দু সমর্থক রাষ্ট্রশক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়াই ছিল নিশ্চিত।
এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল ঐ প্রবন্ধে।
আমরা স্বাধীনতা পেতে যাচ্ছি। স্বাধীনতা যদি সবদিক দিয়েই না পাওয়া যায় তবে সে স্বাধীনতাকে পূর্ণ স্বাধীনতা বলা যায় না। অতএব, অন্যান্য স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাষাগত স্বাধীনতাও পাওয়া দরকার। যে ভাষাগত স্বাধীনতা পেলে আমরা আমাদের মনােভাব সুষ্ঠুরূপে প্রকাশ করতে পারব সে স্বাধীনতা যদি আমরা না পাই, তবে আমাদের মুখ আংশিকভাবে বন্ধ রেখেই স্বাধীনতা দেওয়া হবে নাকি?”
এর প্রায় এক মাস পরে, ২৭ জুলাই তারিখের দৈনিক ইত্তেহাদ’– এ প্রকাশিত “উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে’ শীর্ষক প্রবন্ধে উল্লিখিত প্রবন্ধের কয়েকটি বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছিল। ভাষাগত স্বাধীনতার উল্লেখ করা হয়েছিল ভাষাগত স্বাধীনতা না পেলে বদ্ধমুখ অবস্থাতেই স্বাধীনতা পাওয়া যাবে।” ভাষার প্রশ্নে বাঙালি মানসের হীনমন্যতার উল্লেখ করে বলা হয়েছিল ‘নাছারার জবান ইংরেজির প্রতি বাঙালি মুসলমানের এককালীন বিদ্বেষ থাকা সত্ত্বেও বাঙালি প্রাণপণে এবং যথাসাধ্য ইংরেজি বলার, ইংরেজি জানার এবং ইংরেজি শেখার চেষ্টা করেন, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে উর্দুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল বাঙালি মুসলমান তেমনি করবেন বরং তার চেয়েও বেশি করবেন, কেননা আগে থেকেই এ ভাষার প্রতি তাঁর একটা মােহ আছে। উর্দু আরবি হরফে লেখা হয়, উর্দু ভাষায় খােতবা পর্যন্ত পঠিত হয়, এবং এসব কারণে উর্দু বাংলার মুসলিম জনসাধারণের কাছে পবিত্র ভাষারই সামিল। পক্ষান্তরে কোনাে কোনাে মহলে বলা হয় বাংলা মূলত হিন্দুর ভাষা এবং হিন্দু-সংস্কৃতি ও পৌত্তলিকতার ভাষা, অতএব বর্জনীয়। পাকিস্তানে এই মানসিকতার প্রসার ঘটার সম্ভাবনা আছে এবং প্রসার ঘটলে বাঙালি মুসলমান হয়তাে একদিন বাংলাকে বর্জন করে উর্দুকে মাতৃভাষারূপে গ্রহণ করে বসতে পারে। কিন্তু বাংলাভাষা হিন্দুর ভাষা নয়, হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ভাষা এবং বাঙালি হিন্দুর চেয়ে বাঙালি মুসলমানের সংখ্যাই বেশি। এককালে এ ভাষার প্রতি ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের বিদ্বেষ ছিল, মুসলিম রাজশক্তিই একে লালন করে সম্মানের আসন দিয়েছে। পৌত্তলিকতা কোনাে ভাষার স্থায়ী লক্ষণ বা একমাত্র লক্ষণ নয়, কোনাে ধর্মাবলম্বী লেখক কোনাে ভাষায় কি পরিমাণে লিখেছেন তার উপরেই নির্ভর করে সে-ভাষার উপর কোনাে বিশেষ ধর্মের প্রভাব কতখানি। অন্যথায় কোনাে ভাষাই কোনাে ভাষা থেকে পবিত্রতর বা অপবিত্রতর নয়।
আসন্ন পাকিস্তান রাষ্ট্রের রুপ কেমন হবে তার আলােচনা প্রসঙ্গে ১৯৪৭ সালের ২৭ শে জুন তারিখে সাপ্তাহিক ‘মিল্লাত’ এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিল : পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা ভাষাই হইবে, ইহা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ঐ সময়ে এমন কথাও শােনা যাচ্ছিল যে উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। এই ‘কানাঘুষার কথা উল্লেখ করে উক্ত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছিল :
একটা দেশকে পুরাপুরি দাসত্বে রূপান্তরিত করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীর যত রকম অস্ত্র আছে তার মধ্যে সবচাইতে ঘৃণ্য ও মারাত্মক অস্ত্র হইতেছে সেই দেশের মাতৃভাষার পরিবর্তে একটি বিদেশীয় ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত করা। মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য কোনাে ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে বরণ করার চাইতে বড় দাসত্ব আর কিছু থাকিতে পারে না। পূর্ব-পাকিস্তানবাসীকে এই ঘৃণ্য দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধিতে যদি কেহ বাসনা করে তাহা হইলে তাহার সেই উদ্ভট বাসনা বাঙালির প্রবল জনমতের ঝড়ের তােড়ে তৃণখণ্ডের মতাে ভাসিয়া যাইবে।”
মাহবুব জামাল জাহেদী ২০ জুলাই তারিখের দৈনিক ইত্তেহাদ’-এ প্রকাশিত ‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, ‘সমগ্র পাকিস্তানের জন্য একমাত্র উর্দু এবং একমাত্র বাঙলা রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব উভয়ই অযৌক্তিক হবে। উর্দু বাঙালিদের কাছে প্রায় বিদেশী ভাষা; এবং এ ভাষা বিশেষভাবে মুসলমানী ভাষা তাও নয়। উর্দু, অধিকন্তু তুলনামূলকভাবে জটিল অথচ অনুন্নত ভাষা। পূর্বপাকিস্তানের জন্য বাংলা রাষ্ট্রভাষা এবং পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য উর্দু রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করা হলেই সুবিচার হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা কি হবে, সে সম্বন্ধে কোনাে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে লেখক আসতে পারেননি।’
আশ্বিন সংখ্যা (১৩৫৪) সওগাত’ এ কবি ফররুখ আহমদ ‘পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক প্রবন্ধে পূর্ব-পাকিস্তানের বাংলা রাষ্ট্রভাষার সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার যে-কথা উঠেছিল সে-সম্পর্কে তিনি বলেন : গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যারা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব-পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
তিনি অবশ্য ইসলামী সাংস্কৃতিক প্রসারের জন্যই রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামী সংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘কৃষ্টি’ নামক মাসিক পত্রিকার কার্তিক (১৩৫৪) সংখ্যায় পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা’ শীর্ষক প্রবন্ধে ড. মুহম্মদ এনামুল হক উর্দুকে একটি অপরিচিত বিদেশী ভাষা বলে বর্ণনা করেন, এবং এই ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। উর্দুকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকার করিয়া লইলে, বাংলা ভাষার সমাধি রচনা করিতে হইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানবাসীরও জাতি হিসেবে ‘গাের দেওয়ার আয়ােজন করিতে হইবে। রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে জাতীয় মর্যাদা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন জড়িত। উর্দু ইসলামী সাহিত্যে সমৃদ্ধ, উত্তর-ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা দরকার ড. এনামূল হক এইসব যুক্তির অসারতা প্রদর্শন করেন, এবং পশ্চিম-পাকিস্তানের জন্য উর্দু, ও পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব করেন। এক রাষ্ট্রে একাধিক (রাষ্ট্র) ভাষা অচল এই
৪১১
শ্ৰেণীর ধারণা সাম্রাজ্যবাদের পরিপােষক’ এই উক্তির পর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সম্ভাব্য ফল বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন : ইহাতে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সর্বনাশ ঘটিবে।… উর্দু বাহিয়া আনিবে পূর্ব-পাকিস্তানবাসীর মরণ, – রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পূর্ব-পাকিস্তান হইবে উত্তর-ভারতীয এবং পশ্চিমপাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শােষণের ক্ষেত্রে, যেমন ভারত ছিল ইংরেজি রাষ্ট্রভাষার সূত্রে ইরেজদের শাসন ও শােষণের ক্ষেত্র।
উর্দুকে বিদেশী ইংরেজি রাষ্ট্রভাষার সমপর্যায়ে স্থাপন এবং একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাবকে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা লক্ষণীয়।
‘সওগাত’-এর অগ্রহায়ণ (নভেম্বর-ডিসেম্বর) সংখ্যায় প্রকাশিত রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা-সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে কাজী মােতাহার হােসেন বলেছিলেন বাংলা এবং উর্দু উভয় ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত: পশ্চিম-পাকিস্তানে উর্দু (অথবা পশতু) এবং পূর্ব-পাকিস্তানে বাংলা। যদি তা না করা হয়, যদি উর্দুকে পূর্ব-পাকিস্তানেরও রাষ্ট্রভাষা করা হয় তাহলে বাঙালি হিন্দুমুসলমান ইংরেজ-রাজের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের কবলে গিয়ে পড়বে। সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন : বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশিদিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।১৭
মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী সওগাত’-এর পৌষ (ডিসেম্বর-জানুয়ারি) সংখ্যায় ‘শিক্ষার কথা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, (ক) বাংলা হবে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার স্বাভাবিক বাহন,’ এবং (খ) উর্দু নিঃসন্দেহে হবে নিখিল পাকিস্তানের আন্তঃপ্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা এবং কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের সরকারি ভাষা। মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী সাহেবের প্রথম উক্তিতে দৃশ্যত বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি স্বীকার করা হলেও, দ্বিতীয় উক্তি বহুলাংশে কার্যত তাঁর প্রথম উক্তির বিরােধী। ব্রিটিশ আমলে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের নয়, প্রাদেশিক সরকারের ভাষা এবং শিক্ষার বাহনও ছিল ইংরেজি। ওয়াজেদ আলী সাহেব এই ব্রিটিশ নীতি অতিক্রম করে খানিক দূর অগ্রসর হয়েছিলেন মাত্র, তথাপি বাঙালিকে বাধ্যতামূলকভাবে বাঙলা ও উর্দু উভয় ভাষাই শিখতে হবে এই প্রশ্ন ছিল, যা পশ্চিম-পাকিস্তানিদের বেলায় ছিল না। কিন্তু উর্দু কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সকল সরকারের ভাষা হবে এবং সম্ভবত কালক্রমে ইংরেজির অনুরূপ উর্দুই হবে শিক্ষার মাধ্যম, এমনকি পূর্ব-পাকিস্তানেও, গোড়া পাকিস্তানি মহলের এই চিন্তা থেকে তাঁর চিন্তা খানিকটা অগ্রসর ছিল এবং এইটুকুই বাংলার সপক্ষে গিয়েছিল, এর বেশি নয়।
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা এবং আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা হবে উর্দু এবং পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (সরকারি ভাষা) ও শিক্ষার বাহন হবে বাংলা, এ ছিল ‘সওগাত’ এরই অভিমত। এই অভিমত ঐ পত্রিকাকে রাষ্ট্রভাষা-সমস্যার এক কানাগলিতে নিয়ে গিয়েছিল, যা ছিল ‘সওগাত’ এর মতাে প্রগতিবাদী পত্রিকার পক্ষে অপ্রত্যাশিত। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বাংলাদেশে যে ভাষা-আন্দোলন হয়েছিল তার দাবি ছিল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে। সওগাত’- এর সম্পাদকীয় মন্তেব্যে এই দাবিকে সমর্থন করা হয়নি। বলা হয়েছিল :
উর্দুকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও আন্তঃপ্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা হইতেছে এবং সমগ্র পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক করা সঙ্গত হইবে। ইংরেজির স্থলে উর্দুই অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা (Lingua Franca) হইবে এবং হওয়া উচিত। … উর্দুর বিশেষ সম্মান যেন আমরা ক্ষুন্ন করিতে অগ্রসর না হই।”
পক্ষান্তরে, ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে জিন্নাহ সাহেব পূর্ব-পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানের বক্তৃতায় এবং কার্জন হলে সমাবর্তন অভিভাষণে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দু এবং পূর্ব-পাকিস্তানের সরকারি ভাষা বাংলা। সম্বন্ধে যে উক্তি করেছিলেন, ‘সওগাত’- এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে তা সমর্থন করা হয়েছিল। এ সম্বন্ধে মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী নিজে যে অভিমত পােষণ করতেন, তার সূত্র ধরেই একটা সম্ভব হয়েছিল।
একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষার পেছনে পশ্চিম-পাকিস্তানি এবং পাকিস্তানে আগত উত্তর-ভারতীয় মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক মনােভাব তাে ছিলই, সেই সময়ে বাঙালি সমাজের একাংশের উর্দুমুখী মানসিকতাও ছিল তাদের পক্ষে। ‘উর্দুর বিশেষ সম্মান যেন আমরা ক্ষুন্ন করিতে অগ্রসর না হই, সওগাত’-এর এই উক্তি ছিল ঐ মানসিকতারই পরিচায়ক। সওগাত’ তথা বাঙালি সমাজের ঐ অংশের কথা ছিল, স্বাধীন ভারতে উর্দুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় উর্দুর প্রতি পাকিস্তানের (পূর্ব-পাকিস্তানসহ) উপর একটা নৈতিক দায়িত্ব বর্তিয়েছে, এবং উর্দু ইসলামী সাহিত্যে সমৃদ্ধ। ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষার জন্যও পাকিস্তানিদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু। (ড. মুহম্মদ এনামুল হক তার পূর্বোল্লিখিত প্রবন্ধে এইসব যুক্তির অসারতা প্রদর্শন করেন)। তা ছাড়া অনেক বাঙালি মুসলমানের কাছে বাংলার চেয়ে ইংরেজি ও আরবির মতােই উর্দুরও সম্মান ছিল বেশি। গােলাম মােস্তফার মতাে বিশিষ্ট বাঙালি কবিও উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষপাতী ছিলেন, পাকিস্তানি তথা ইসলামী জাতীয়তাবাদের প্রেরণায়। এই বাস্তবতার কথা স্মরণ না রাখলে ঠিক বােঝা যাবে না, অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে কিরূপ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছিল।


১৯৪৭ সালের জুন মাস থেকে প্রথম সক্রিয় ভাষা আন্দোলনের প্রাক্কাল অবধি কয়েক মাস যাবত কোলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় একমাত্র উর্দুর বিরুদ্ধে এবং বাংলা ভাষার সপক্ষে যে-সব পবন্ধ ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল তার কিছু বিবরণ প্রবন্ধের প্রথম অংশে দেওয়া হলাে। এখানে আমরা তার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ করব মাত্র। জুলাই মাস নেকে ঢাকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে যে সব আলােচনা ও প্রচার অভিযানের আয়ােজন করেছিল। বিভিন্ন লেখক তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। জুলাই মাসে ঢাকায় মুসলিম লীগের বামপন্থীদের নিয়ে ‘গণ-আজাদী লীগ’ নামে একটি ক্ষুদ্র সংস্থা গঠিত হয়। এই সংস্থার ম্যানিফেস্টোতে বলা হয়, বাংলা হইবে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তাঁদের এ প্রস্তাব ছিল গঠনােন্মুখ রাষ্ট্রের প্রাথমিক রূপরেখার একটি অংশ মাত্র। কিন্তু এর পরেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে ওঠে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দীনের একটি বিবৃতির ফলে। তিনি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। জুলাই এর শেষদিকে দৈনিক আজাদ’-এর প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ড. শহীদুল্লাহ এ প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রভাষারূপে, এবং উর্দুকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণের সপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। আরবি এবং ইংরেজিকেও তিনি অনুরূপ মর্যাদা দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সেই সময় তিনি যুক্তিসিদ্ধ বাস্তব সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন একথা বলা কঠিন; তবে এ প্রশ্নে তার অভিমতের গুরুত্ব। এখানে যে তিনি একমাত্র উর্দু-রাষ্ট্রভাষার দাবিকে সমর্থন করেননি।
রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নের সক্রিয় আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার পূর্বে প্রতিষ্ঠানগতভাবে তমদুন মজলিশ বাংলার দাবির সপক্ষে প্রচারকার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত এই সংস্থা ঐ মাসে বাংলা ভাষার দাবির সমর্থনে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু নামে পুস্তিকা প্রকাশ করে। এতে কাজী মােতাহার হােসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং তমদুন মসলিসের প্রধান কর্মকর্তা আবুল কাসেমের রচনা সংকলিত হয়। তমদুন মজলিশে ভাষা-বিষয়ক প্রস্তাবের মূল কথা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা এবং উর্দু এবং পূর্ব-পাকিস্তানের অফিস ও আদালতের ভাষা অর্থাৎ সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহন হবে বাংলা। কাজী মােতাহার হােসেনের ‘রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা-সমস্যা শীর্ষক প্রবন্ধটি অগ্রহায়ণ সংখ্যা ‘সওগাত’-এও প্রকাশিত হয়েছিল এবং এ সম্বন্ধে পূর্বেই আলােচনা করা হয়েছে। আবুল মনসুর আহমদ ‘বাংলা ভাষাই হইবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন : উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত ও সরকারি চাকরীর অযােগ্য বনিয়া যাইবেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যবাগে। ফারসির জায়গায় ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি ‘অশিক্ষিত’ ও সরকারি কাজের ‘অযােগ্য করিয়াছিল।।
উল্লেখনীয় যে প্রায় আড়াই মাস আগে ৩০ জুন তারিখে দৈনিক আজাদ’-এর প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে ঠিক অনুরূপ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছিল উর্দু না জানার জন্যেই পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসীরা সরকারি চাকরির অনুপযুক্ত বলে গণ্য হবেন।
এই সংক্ষিপ্ত পর্যালােচনা থেকে দেখা যাবে, একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম লেখক-সম্প্রদায়ই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, প্রথমে কোলকাতা থেকে, তারপর ঢাকা থেকে। বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে পূর্ব-পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলেই ছিলেন উর্দুর সপক্ষে, শিক্ষিত-সমাজ এবং ছাত্র-সমাজেরও একটা বড় অংশ ছিলেন তাই সমাজের এই মনােভাবের পরিবর্তন আনতে না পারলে ভাষা-আন্দোলনের সাফল্য সম্ভব হতাে; লেখকসমাজে এই মনােভাবের পরিবর্তন আনতে সহায়তা করেছিলেন। একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে পূর্ববাংলার উপর কিরূপ অবিচার হবে এবং তার সংস্কৃতিজীবনে কিরূপ সঙ্কটের সৃষ্টি হবে সেদিকে তারা সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, এবং অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির সপক্ষে অগ্রগামীর ভূমিকা নিয়েছিলেন। এইসবই তারা করেছিলেন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সরকারিভাবে তাদের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত বাসনা ব্যক্ত করার পূর্বেই। শাসক-সম্প্রদায়ের প্রকৃতি সম্বন্ধে লেখক-সমাজ এমনিতেই সচেতন ছিলেন: স্বদেশের ও বিদেশের ইতিহাস থেকে তাদের এই চেতনা এসেছিল। অধিকন্তু, লীগ-নেতৃত্বের এবং সরকারি কাঠামাের সংগঠন তাদের এই চেতনাকে তীক্ষ্ণতর করেছিল। একাদিক্রমে কয়েক মাস ধরে বাংলা ভাষার সপক্ষে তারা লিখেছিলেন; প্রধানত তাদেরই প্রয়াসে শিক্ষিত ও ছাত্র-সমাজ বাংলা ভাষার দাবি সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন, এবং এভাবেই ভাষাআন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল।
উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে যে চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালি অসুবিধায় পড়বে, তার লক্ষণ প্রকাশ পেতে বেশি দেরী হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে যে হিন্দু-আধিপত্য ছিল, দেশ-বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে তার অবসান হয়, অধিকাংশ হিন্দু কর্মচারী ভারতে চলে যাওয়ায়। একই সঙ্গে ইংরেজের আধিপত্যেরও অবসান হয়। কিন্তু দেশ-বিভাগ কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে রাজনৈতিভাবে তাে বটেই চাকরির ক্ষেত্রেও উর্দুভাষী তথা পাকিস্তানিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা যেন বাঙালিদের চাইতে উন্নতর জাতের লােক এরূপ মনােভাব তাদের আচরণে প্রকাশ পায়। স্বভাবতই চারি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বাঙালি সুবিচার পাবে না, এই আশঙ্কা বাঙালি সমাজে ঘনীভূত হতে থাকে।
মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানের চূড়ান্ত রূপলাভের পূর্বেই বাংলা রাষ্ট্রভাষা দাবির পেছনে ছিল ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যচেতনা, অধিকন্তু প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পর্কে প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পর্কে চেতনা। বাঙালি উন্নত ভাষা ও সাহিত্যের অধিকারী না হলে, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলে ভাষা-আন্দোলন হয়তাে হতাে না। প্রবন্ধের প্রথমাংশে উল্লেখিত ‘দৈনিক আজাদ’-এর প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, ‘সিলেটের গণভােটে আমাদের জয় হলে এবং সীমা নির্ধারণ-রায়ের ফলে আপাতত-নির্দিষ্ট পূর্ব-পাকিস্তানের সংলগ্ন মুসলিম অঞ্চলগুলাে এর সঙ্গে সংযুক্ত হলে পূর্ব-পাকিস্তানের লােকসংখ্যা দাঁড়াবে পাঁচ কোটিরও কিছু বেশি। এই পাঁচ কোটির
প্রায় সবাই বাংলাভাষী, পশ্চিম-পাকিস্তানের লােকসংখ্যা কিছু কমবেশি তিন কোটি, এবং ভাষা হিসেবে এই তিন কোটি লােকও আবার প্রধান চারভাগে বিভক্ত।” তখন যে রকম মনে করা হচ্ছিল সেভাবে পূর্ব-পাকিস্তানের সীমা-নির্ধারণ করা হয়নি। যেসব মুসলিম-প্রধান এলাকা পূর্ব-পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত থাকবে অথবা অন্তর্ভুক্ত করা হবে মনে করা গিয়েছিল তার কতকগুলাে সীমা-নির্ধারণ কমিশন পশ্চিবঙ্গের এবং আসামের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তা সত্ত্বেও ১৫ই আগস্টে পাকিস্তানের যে রূপ দাঁড়িয়েছিল তাতে নতুন রাষ্ট্রে বাঙালিই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। এবং বাঙালির বসবাস পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন একক একটি ভূভাগে। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের প্রথম সক্রিয় ভাষা-আন্দোলনের পেছনে সচেতনভাবে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেতনা এবং একটি বিশেষ মানবগােষ্ঠী হিসেবে স্বাতন্ত্র্যবােধ কাজ করেছিল।
১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানবগােষ্ঠীর আনুপাতিক হার দেওয়া হয়েছিল এই রকম :
ভাষাগােষ্ঠী শতকরা হার বাঙালি
বাঙ্গালী ৫৪.৬
পাঞ্জাবি ২৮.৪
উর্দুভাষী ৭.২
সিন্ধী ৫.৮
পশতু ৭.১
ইংরেজি ১.৮
(মােট ১০৪.৯ কারণ অনেকেই নিজেদের দ্বিভাষী বলে জানিয়েছিলেন)
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় জনসংখ্যার কোনাে সঠিক হিসাব নির্ণীত হয়নি, কিন্তু বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল অভ্রান্ত, উর্দু পাকিস্তানের বিশেষ অঞ্চলের ভাষা ছিল, এবং পাকিস্তানের নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষাগুলাের মধ্যে বাংলা ভাষাই ছিল সর্বাপেক্ষা উন্নত। এইসব ছিল বাংলা ভাষার সপক্ষে বড় যুক্তি। অল্পদিন পরেই দেখা গেল পাকিস্তান সরকার এসব যুক্তি মানতে রাজী নন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে বাংলাদেশের প্রশাসনযন্ত্রসহ বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রে উর্দুভাষীসহ অন্যান্য পাকিস্তানিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষাগত সংঘাতের এইটা ছিল প্রত্যক্ষ এবং সব চেয়ে বড় কারণ।
লেখক-সমাজ একমাত্র উর্দু-রাষ্ট্রভাষার বিরােধিতা করেছিলেন এবং বাংলা ভাষার সপক্ষে বিকল্প প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তাদের মধ্যে ঐকমত্য ছিল না, এবং প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় ভাষা-আন্দোলনের আগে এই আন্দোলনের লক্ষ্য-নির্ধারণ হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছু আগে থেকে প্রথম ভাষা-আন্দোলন পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সরকার-পক্ষীয় অভিমতসহ যেসব অভিমত ব্যক্তি হয়েছিল তা ছিল এই রকম :
১. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং আন্তঃপ্রাদেশিক যােগাযােগের ভাষা হবে একমাত্র
উর্দু। এই ছিল জিন্নাহ সাহেব এবং পাকিস্তানের নীতি। সেই সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা বাংলা হবে কিনা তা ঠিক করবেন এ দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ। বাংলাদেশের মানুষ এই নীতি মেনে নেয়নি :
ভাষা-আন্দোলনের লক্ষ্যই ছিল এ নীতির বিরােধিতা।
২. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত বাংলা। এর অর্থ ইংরেজির পরিবর্তে
বাংলা। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে দৈনিক আজাদ’-এ প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই দাবিই জানানাে হয়েছিল। এ ছিল প্রায় চরম দাবি, দু’একজনের বেশি লেখক এরূপ দাবি জানাননি, কিন্তু উর্দুর প্রতি বাঙালির মােহ ভাঙতে, ভাষা হিসেবে বাংলার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং অন্তত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবির সমর্থনে
এই অভিমতের একটা ভূমিকা ছিল।
৩. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত বাংলা, উর্দু, ইংরেজি এবং আরবি। পূর্ব বাংলার শিক্ষার বাহন হওয়া উচিত বাংলা। ড. শহীদল্লাহ্ এই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। এটি অবাস্তব দাবি, এর ফলে বাংলার দাবি দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে একই সঙ্গে একমাত্র উর্দুর দাবিও দুর্বল হয়, এই ছিল এ অভিমতের ভূমিকা।
৪. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি ভাষা (রাষ্ট্রভাষা) এবং আন্তঃপ্রাদেশিক যােগাযােগের ভাষা হওয়া উচিত উর্দু, উর্দুকে একটা সম্মান দেওয়া উচিত, কিন্তু পূর্ববাংলার রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার বাহন হওয়া উচিত বাংলা। মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী এবং সওগাত’ এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। পাকিস্তান সরকারের নীতির সঙ্গে এ অভিমতের বেশ খানিকটা সাদৃশ্য ছিল। এই অভিমত কার্যকর হলে পশ্চিম-পাকিস্তানের কারাে বাংলা শেখার বাধ্যবাধকতা থাকত না। একমাত্র উর্দু-রাষ্ট্রভাষা পূর্ববাংলায় চালানাে অসঙ্গত হবে, এবং এখানে বাংলা হবে শিক্ষার মাধ্যম, মাত্র এইটুকু ছিল এ অভিমতের বক্তব্য।
৫. পশ্চিম-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত উর্দু এবং পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত বাংলা। প্রাদেশিক সরকারের নীতি ও ভাষা কি হবে সে সম্বন্ধে এই অভিমত সুস্পষ্ট ছিল না। তবে এই অভিমত পরবর্তী ষষ্ঠ অভিমতের খুব কাছাকাছি।
৬. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দু। পূর্ববাংলায় শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা। বাঙালি উর্দু শিখবে শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরির জন্য। একই প্রয়ােজনে পশ্চিম-পাকিস্তানিরা শিখবে বাংলা। এই ছিল (তমদুন মজলিশসহ) অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীর অভিমত।
এইসব অভিমতেরই বিস্তারিত ভাষ্য সম্ভব: মােটামুটিভাবে বলা চলে, ষষ্ঠ। অভিমতই হয়ে উঠেছিল ভাষা-আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
ভাষা-আন্দোলনের লক্ষ্য নিছক ভাষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি, চাকরি তথা অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, ভাষার ভিত্তিতে পাকিস্তানে বাঙালির মর্যাদা, বিশেষ একটি মানবগােষ্ঠী হিসেবে বাঙালির সমগ্র ভবিষ্যৎই রাষ্ট্রভাষা-চিন্তার অন্তর্গত ছিল, এবং সক্রিয় ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এইসব বিশেষ তাৎপর্য লাভ করেছিল। যাবতীয় তাৎপর্যসহ ভাষা-আন্দোলনের লক্ষ্য, মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা ঘােষণার পর থেকে ক্রমে ক্রমে আলােচনা ও সক্রিয় আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৮ সালের মার্চের মধ্যেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এবং পুস্তিকায় সংকলিত প্রবন্ধ মারফত যে-সব ধারণা প্রচার লাভ করেছিল এবং প্রথম সক্রিয় ভাষা-আন্দোলনের ফলে দৃঢ়মূল হয়েছিল তা হচ্ছে: ধর্মীয় সাহিত্য বা অন্যান্য কারণে উর্দু অধিকতর সম্মানীয় ভাষা এরূপ ধারণা অযৌক্তিক; বাংলাভাষা ও সাহিত্য অধিকতর উন্নত এবং বাংলাভাষা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ভাষা, সে হিসেবে এই ভাষাই সাধারণ নিয়মে রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত, তথাপি পাকিস্তান সরকার এই ভাষাকেই দূরে ঠেলে রাখছেন, তাঁরা উর্দু ভাষা এবং পশ্চিম-পাকিস্তানিদের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করছেন; এ নীতি গণতন্ত্র-বিরােধী এবং সাম্রাজ্যবাদী নীতির অনুরূপ। একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে এবং বাঙলার দাবি বাতিল হলে ব্রিটিশ শাসনের অবদানে প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে না, বাঙালিরা ইংরেজদের পরিবর্তে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের অধীনে গিয়ে পড়বে মাত্র। গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে বাংলা ও উর্দু এই উভয়ই রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। এইবাবেই বায়ান্ন সালের দ্বিতীয় ভাষাআন্দোলনের লক্ষ্য, মানসিকতা ও ভিত্তিমূল প্রস্তুত হয়েছিল আটচল্লিশের মার্চের মধ্যেই।


ভারত-বিভাগ পরিকল্পনা কার্যকরকরণ এবং পাকিস্তান সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও পুস্তিকায় যে-সব প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল তাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের কয়েকটি লক্ষণ পরিস্ফুটিত: ভাষা ও সংস্কৃতিগত স্বাতন্ত্র্যচেতনা এবং সেই স্বাতন্ত্রের অধিকার অক্ষুন্ন রাখার তীব্র ইচ্ছা, এ ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র মানবগােষ্ঠী হিসেবে অর্থনৈতিক স্বার্থবােধ। সাক্ষাত্তাবে উর্দু উপনিবেশবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে এই ভাষা ও সংস্কৃতিগত জাতীয়তাবাদের উদ্ভব এরূপ তাৎক্ষণিক ছিল না। এর মূল ছিল আরও গভীরে এবং বেশ খানিকটা অতীতে প্রসারিত।
জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতাে বাংলা সাহিত্যেও হিন্দু-মুসলিম ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যচেতনার অস্তিত্ব ছিল, বিশেষ করে আধুনিক যুগে। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের চিত্রটি মুসলমানদের জন্য বিশেষ সুখকর ছিল না, এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অভিযােগ ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের বিরুদ্ধে। আরেকটি অভিযােগ ছিল বহু শতাব্দী যাবৎ পাশাপাশি অবস্থান সত্ত্বেও মুসলিম সমাজের প্রতি হিন্দু লেখকগণ উদাসীন এবং এই সমাজ সম্বন্ধে অজ্ঞ। রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রের বিপুল রচনাপুঞ্জে মুসলিম সমাজ প্রায় অনুপস্থিত এই অভিযােগ ত্রিশের দশক অথবা তার আগে থেকেই করা হচ্ছিল (যদিও এরূপ অভিযােগের সপক্ষে প্রবল যুক্তি ছিল না)। তৃতীয় অভিযােগ ছিল, মধ্যযুগে প্রধানত বাংলার মুসলিম সুলতানগণের পৃষ্ঠপােষকতার ফলেই বাংলা সাহিত্যের বিকাশ সম্ভব হয়েছিল, এবং দৌলত কাজী ও আলাওলের আগে থেকেই মুসলিম কবিকুল বাংলা কাব্যের সাধনা করে আসছেন, তারা বাংলা কাব্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, মুসলিম পল্লী কবিদের অবদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ পণ্ডিতগণ উদারভাবে তা স্বীকার করেছেন এবং আধুনিকযুগে রবীন্দ্রনাথের পরেই নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক, তা সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বর্ণনায় এবং আলােচনায় মুসলিম অবদানকে যথাযােগ্য মূল্য দেওয়া হতাে না, অথবা উপেক্ষা করা হতাে। অন্তত এইরূপ ধারণা মুসলিম সাহিতিক-মহলে প্রচলিত ছিল। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য-সমিতি, মুসলিম সাহিত্য-সমাজ অথবা এই ধরনের সম্প্রদায়ভিত্তিক সংস্থা গঠন, এবং বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান, মুসলিম পুঁথিসাহিত্য, মুসলিম বাংলা সাহিত্য অথবা এই ধরনের সম্প্রদায়ভিত্তিক সাহিত্য-নিরীক্ষা ছিল মূলত হিন্দু লেখকসমাজের উপেক্ষারই প্রতিক্রিয়াস্বরূপ।
মুসলিম সমাজ এবং মুসলিম সাহিত্য-সাধনার প্রতি উপেক্ষার জন্য হিন্দু সাহিত্যিকদের দায়ী করা যায়, তবে পুরােপুরি নয়। এই উপেক্ষার জন্য সমগ্র বাঙালি সমাজের ইতিহাসের গতিধারাও খানিকটা দায়ী। ব্রিটিশ আমলে, বিশেষ করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে অর্থনৈতিকভাবে অভিজাত মুসলিম সমাজ প্রায় বিধ্বস্ত হয় এবং হিন্দু বিত্তশালী ও মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠে। এই কারণে এবং মুসলিম শাসনের তিরােধানজনিত হতাশায় এবং ইংরেজ ও ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষবশত শিক্ষা ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমান পিছিয়ে পড়ে। একদিকে যখন নবােদ্ভূত হিন্দু বিত্তশালী ও মধ্যবিত্তের পৃষ্ঠপােষকতায় এবং পশ্চিমী সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সংস্পর্শে হিন্দুসমাজ মহান সাহিত সৃষ্টিতে নিয়ােজিত ও রেনেসাঁর দ্বারপ্রান্তে উপনীত, তখন অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত এবং শিক্ষায় অনগ্রসর মুসলিম সমাজ মধ্যযুগীর আবেশে আচ্ছন্ন মুসলিম সমাজের যদি এই অবস্থা না হতাে, যদি অর্থনীতি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই সমাজ একই পর্যায়ে থাকত এবং হিন্দু সমাজের অনুরূপ অগ্রসর হতে পারত, এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অনুরূপ সৃষ্টিশীল ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারত, তাহলে হিন্দু লেখকগণ মুসলিম সাহিত্য-প্রয়াসকে উপেক্ষা করতে পারতেন না। কিন্তু এটা হলাে চিত্রের একটা দিক। অন্যদিকে ছিল সাম্প্রদায়িক অনুভূতি, সমাজের সর্বস্তরে, এব এই অনুভূতির জন্য মুসলিম সাহিত্য-প্রয়াস হিন্দু লেখকদের দ্বারা বহুলাংশে উপেক্ষিত হতাে। দীনেশচন্দ্র সেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ এবং আরাে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি ও সাহিত্যকর্মীর প্রয়াসে কয়েক শতাব্দীব্যাপী মুসলিম সাহিত্য-প্রয়াসের একটি অবিচ্ছিন্ন ইতিহাস উদঘাটিত হয়েছিল, আর এজন্য মুসলিম সাহিত্যনুরাগী মহলে একটা গৌরববােধ সঞ্চারিত হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক স্মৃতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল আধুনিক কৃতিত্ব। অন্যান্য অনেক ব্র্যাপারের মতাে সাহিত্যেও বিষয় নির্বাচন, দৃষ্টিকোণ এবং সংস্কৃত-আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের ভারতম্যের মধ্যে সাম্প্রদায়িক স্বাতন্ত্র্যচেতনা প্রকাশ পেতাে। সাহিত্য-মূল্যায়নেও তারতম্য ঘটত।
এই সাম্প্রদায়িক চেতনা, এবং মুসলিম সাহিত্য-সমাজ ও মুসলিম সাহিত্যপ্রয়াসের পশ্চাদ্বর্তিতা এবং এইসব কারণে তার প্রতি হিন্দু-সমাজের উপেক্ষা বাস্তব ব্যাপার ছিল। এবং অন্যান্য অনেক কারণসহ এই কারণেও অধিকাংশ মুসলিম লেখক পাকিস্তান-আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিলেন। কিন্তু লক্ষণীয় যে, যে সব মুসলিম লেখক হিন্দু-সমাজেরও কমবেশি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তারা পাকিস্তানআন্দোলনকে সমর্থন করেননি। এঁদের মধ্যে নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ ও হুমায়ুন কবির বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সমাজ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যদি সাম্প্রদায়িকতা না থাকত, এবং সাহিত্যক্ষেত্রেও না থাকত এবং মুসলিম সাহিত্যপ্রয়াস উপেক্ষিত হচ্ছে এই ধারণা যদি গড়ে না উঠত তাহলে মুসলিম লীগের লাহাের-প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর সাহিত্যে-পাকিস্তান’ রবটি উঠত না। উল্লেখনীয় যে বুদ্ধদেব বসুর একটি প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে চল্লিশের দশকে ঐ শিরােনামে কিছুদিন বিতর্ক চলেছিল। সমস্যাটা ছিল এই যে সমগ্র উপমহাদেশের বহুদিনের হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সঙ্গেই সাহিত্যে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের স্বাতন্ত্র্যচেতনা জড়িত ছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলিম লেখকগণ তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি পাবেন এবং তাদের সাধনার অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এই ছিল তাদের প্রত্যাশা। আরও প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তানে তারা একদিন হিন্দুদের মতােই উন্নত সাহিত্য গড়ে তুলতে পারবেন। পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটি এবং অনুরূপ সংস্থা আয়ােজিত সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলাে ঐসব প্রত্যাশাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছিল। কিন্তু ভারত-বিভাগের সিদ্ধান্ত ঘােষিত হওয়ার পর যখন শােনা গেল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু তখন ঐ সাহিত্য প্রত্যাশার উপরেই প্রথম আঘাত পড়েছিল। হিন্দুসমাজ এবং হিন্দু লেখকগণ মুসলিম সাহিত্য-প্রয়াসকে উপেক্ষা করে এসেছেন। তবু উভয়ের ভাষা এক এবং সেদিক থেকে যােগাযােগের পথ উন্মুক্ত; কিন্তু পাকিস্তানে অবাঙালিদের সঙ্গে একে তাে অনুরূপ ভাষাবন্ধন অনুপস্থিত, তার উপর উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য ও সাহিত্যিক আরও উপেক্ষিত হবেন এটাই অনিবার্য। এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত অনুন্নত উর্দুভাষা ও সাহিত্যের প্রভাবের অশুভ দিক, এবং ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি ও অবনতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কেও তারা অবহিত ছিলেন, কেননা তার উদাহরণ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেই ছিল। পাকিস্তানে উর্দুভাষা ও সাহিত্য যে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপােষকতা পাবে, এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে যে তার একটা ফল দেখা যাবে, আর তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষে যে শুভ হবে না সে বিষয়ে তাঁরা সচেতন ছিলেন। এবং তাঁরা এই অবিচার সম্বন্ধেও সচেতন ছিলেন যে পাকিস্তানে বাঙালিই সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী, এবং বাংলা ভাষা উপেক্ষতি হতে যাচ্ছে, মুসলিম সাহিত্য-প্রয়াসের প্রতি হিন্দু সমাজের উপেক্ষার থেকে যার অশুভ ফল কোনাে অংশে কম হবে না।
উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালির প্রতি অবিচার হবে এ সম্বন্ধে বাঙালির মনে কোনাে সন্দেহ ছিল না, কেননা এ ব্যাপারে তাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল। ব্রিটিশ আমলে শিক্ষায় মুসলমানদের চেয়ে হিন্দু অগ্রসর ছিল, এবং তার ফলে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দু-প্রাধান্য স্থাপিত হয়েছিল। এই প্রধান্যের ফলে মুসলমানদের চাকরি পাওয়া ছিল কঠিন। এর দরুন সে হতাে বঞ্চিত। পাকিস্তানে এর প্রতিকার হবে বলে মুসলিম শিক্ষিত সমাজ আশা করেছিল। পাকিস্তান দাবির স্বপক্ষে একটা বড় যুক্তি ছিল সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতি অবিচার ও বঞ্চনা। কোন্ অফিসে কিরূপ অবিচার ও বঞ্চনা হয়েছে পাকিস্তান-আন্দোলনের সময় সংবাদপত্রে তার বিবরণ প্রকাশিত হতাে। এইসব বিবরণ পাকিস্তান আন্দোলনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করত। কিন্তু উর্দু রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব অপর এক সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করলাে। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বাঙালি মুসলমান বুঝল পাকিস্তানে উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে সেই একই ব্যাপারে ঘটবে। উর্দু জানার ফলে অবাঙালিরা আগে থেকেই এগিয়ে আছে, অতএব সরকারি চাকরিতে তারাই প্রধান্য পাবে, এবং বরাবর এই প্রাধান্য চলতে থাকবে। ব্রিটিশ আমলে বাঙালি মুসলমান হিন্দুদের দ্বারা বঞ্চিত হয়েছে, পাকিস্তান আমলে অবাঙালি মুসলমানদের দ্বারা বঞ্চিত হবে।
চাকরির প্রশ্ন থেকে অর্থনতিক এবং অন্যান্য প্রশ্নও এসে গেছে। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলাদেশ পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে না, বদ্ধমুখ অবস্থায় স্বাধীনতা পাবে, এবং বাঙালির স্বতন্ত্র সত্তাই বিপন্ন হয়ে উঠবে, উর্দু বিদেশী ভাষা, এ ভাষা পূর্ব পাকিস্তানেরও রাষ্ট্রভাষা হলে এদেশ হবে উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শােষণের ক্ষেত্র, এবং জাতি হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তানিদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত হয়ে উঠবে, বাঙালি হিন্দু-মুসলমান ইংরেজ রাজের হাত হতে মুক্তি পেয়ে পশ্চিমপাকিস্তানিদের কবলে গিয়ে পড়বে, এবং জোর করে উর্দু রাষ্ট্রভাষা পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দিলে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে এসব উক্তি করেছিলেন বিভিন্ন লেখক, ১৪ই আগস্ট ১৯৪৭-এর মাস দুই আগে থেকে পরবর্তী চার পাঁচ মাসের মধ্যেই।
ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিভাবনার ভিত্তিতে একটা বিশেষ মানবগােষ্ঠী হিসেবে স্বাতন্ত্র্যবােধ, নিয়তিচেতনা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থবােধ এবং ঐ স্বাতন্ত্রকে অক্ষুন্ন রাখার ও একটি বিশেষ মানবগােষ্ঠী হিসেবে ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণের ইচ্ছা, জাতীয়তাবাদের এইসব লক্ষণ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অন্তর্গত ছিল। অবশ্য এই জাতীয়তাবাদ খুব স্পষ্ট ছিল না এবং স্বতন্ত্র রাষ্ট্র-কল্পনাও এর অন্তর্গত ছিল না। কিন্তু ভাষা সাহিত্য ও চাকরির প্রশ্নে এই অনুভব বাঙালি শিক্ষিত মুসলিম সমাজে খুব দ্রুত ব্যাপ্ত হয়েছিল; এবং এটাই ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জনপ্রিয়তার কারণ। এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল লেখকদের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত আলােচনায়, পাকিস্তান সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই, কোলকাতার পত্র-পত্রিকায়, এবং পরেও তারা ক্রমাগত লেখনী চালনা করে গেছেন। এইভাবেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মানসিক প্রস্তুতি হয়েছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম সরব প্রকাশ। পুরনাে সম্প্রদায়ভিত্তিক অনুভব থেকে এর উদ্ভব হলেও, এই অনুভবের মধ্য দিয়ে ক্রমে ক্রমে বাঙালি মুসলমানদের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম