You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিচারপতি তালিকার তদন্ত প্রতিবেদন

১৩ মার্চ ১৯৫২ তারিখের ৯৪৩ পিএল নং প্রজ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতে, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২-তে ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণের বিষয়ে ঢাকা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি জনাব এলিসের তদন্ত প্রতিবেদন।
১. ৩১ জানুয়ারি ১৯৫২ সালে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ (All-party Committee of Action) নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পূর্ববাংলায় উত্তেজনা সৃষ্টি করা। এই কমিটি এই আন্দোলন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করছে বলে দাবি করে এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে ঘােষণা করে যে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি একটি বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এবং তারা একই দিন। সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাকে দেয়। ২১ ফেব্রুয়ারিতে পূর্ববাংলা আইন পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিল এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলও একই দিনে একটি মিটিং আয়ােজন করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এই মর্মে আশঙ্কা করেন যে, শহরে শান্তি-শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের বিকাল ৫ টায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা অনুসারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্ব অনুমতি ছাড়া সারা শহরে মিছিল, বিক্ষোভ এবং ৫ জন বা ততােধিক ব্যক্তির সমাবেশ নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করেন। সারা শহরে ঢােল পিটিয়ে আদেশটি প্রচার করা হয়। একটি প্রচার গাড়ি সহযােগে সারা শহরে মাইক্রোফোনের সাহায্যে একটি প্রচার করা হয় এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে এর অনুলিপি দেওয়া হয়। যেকোনাে ধরনের জরুরি পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সকাল ৭.৩০ টার মধ্যে নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করা হয় এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী পর্যাপ্ত পুলিশ মােতায়েন করা হয়। সকালে এক ঘণ্টার মধ্যে নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও বিভিন্ন পুলিশ স্টেশনে খবর আসে যে দোকানপাট বন্ধ করে, যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত করে ট্যাক্সি, রিকশা ও ভাড়াটে গাড়ি থেকে যাত্রীদেরকে নামিয়ে হরতাল কার্যকর করার চেষ্টা চালানাে হচ্ছে। সারা দিন ধরে পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে পুলিশ বিকাল ৩ টা ২০ মিনিটের দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেইটে সরাসরি গুলি বর্ষণ করে। যার ফলে একজন ঘটনাস্থলে মারা যায় এবং তিনজন মারাত্মকভাবে আহত হয়ে পরে মারা যায়। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে আবুল বরকত নামে একজন ছাত্র ছিল।
2. ১৯৫২ সালের ১৩ মার্চ রােজ বৃহস্পতিবার বিশেষ ঢাকা গেজেটে, ১৩ মার্চ ১৯৫২ তারিখ সংবলিত, ৯৪৩ পিএল নং প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। প্রজ্ঞাপনটি ছিল নিম্নরূপ : ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশ কর্তৃক গুলি বর্ষণের ব্যাপারে পূর্ববাংলা সাকার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনােনীত ঢাকা হাইকোর্টের একজন সম্মানিত বিচারপতি মাধ্যমে এর একটা তদন্ত হওয়া উচিত। তদন্তের বিষয়াদি নিম্নরূপ :
(i) পুলিশ কর্তৃক গুলিবর্ষণ অত্যাবশ্যক ছিল কি না, এবং
(ii) পরিস্থিতির বিচারে পুলিশ কর্তৃক এভাবে শক্তি প্রয়ােগ করা যুক্তিযুক্ত
ছিল কি না অথবা শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যতটুকু প্রয়ােজন ছিল তার অতিরিক্ত শক্তি প্রয়ােগ করা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রদান করা। তদন্ত সম্পন্ন হতে হবে গােপনে। আর তদন্তে নিয়ােজিত বিচারপতি তাঁর মর্জিমাফিক তদন্তের কাজে তাকে সাহায্য করার জন্য অ্যাডভােকেট নিযুক্ত করতে পারবেন। তদন্তে নিযুক্ত বিচারপতি কর্তৃক নির্দিষ্ট তারিখে তদন্ত শুরু হবে এবং যথাশীঘ্র শেষ হবে।
৩. প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ ছিল যে, পূর্ববঙ্গ সরকার এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনােনীত ঢাকা হাইকোর্টের একজন বিচারপতি তদন্ত পরিচালনা করবেন। অতঃপর, আমি পূর্ববাংলার মহামান্য গভর্নরের কাছ থেকে ১৭ মার্চ ১৯৫২ সংবলিত আদেশের একটি কপি হাতে পাই। তাতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, তদন্তের কাজটি আমাকে সম্পন্ন করতে হবে। আদেশটি ছিল নিম্নরূপ : পূর্ববাংলার মহামান্য গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, ঢাকা হাইকোর্টের সম্মানিত বিচারপতি জনাব টি.এইচ. এলিস ১৯৫২ সালের ১৩ মার্চ বিশেষ ঢাকা গেজেটে প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন নং ৯৪৩-পিএল অনুযায়ী ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশ কর্তৃক গুলিবর্ষণের ঘটনাটি তদন্ত করবেন। এ. ও. রাজিউর রহমান। সচিব, গভর্নর,
পূর্ববাংলা।
৪. আদেশ পাওয়ার পর আমি নিম্নোক্ত নােটিশ জারি করি
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশ কর্তৃক গুলিবর্ষণের ব্যাপারে জনসাধারণ, বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র সংগঠন অথবা প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট অনান্য পক্ষ থেকে লিখিত, টাইপকৃত হলে ভালাে, বিবৃতি আহ্বান করা হচ্ছে।
বিবৃতিসমূহের সমর্থনে উল্লিখিত সাক্ষীদের পূর্ণ নাম ও ঠিকানা সংবলিত একটি তালিকা বিবৃতির সঙ্গে পাঠাতে হবে। বিবৃতিসমূহ ১৯৫২ সালের ৩১ মার্চ তারিখের মধ্যে মাননীয় বিচারপতি টি.এইচ, এলিসের ঠিকানায় পাঠাতে হবে।
টি.এইচ. এলিস
বিচারপতি, হাইকোর্ট, ঢাকা।
২০-৩-১৯৫২

প্রাদেশিক পত্রিকাসমূহ এবং রেডিও পাকিস্তানে সম্প্রচারের মাধ্যমে নােটিশটির ব্যাপক প্রচার চালানাে হয়।
৫. ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণ সম্পর্কিত ঘটনাবলির ব্যাপারে যাদের কিছু বলার আছে, নােটিশের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে লিখিত বিবৃতি আহ্বান করা হয়। আমি সর্বমােট ২৮টি বিবৃতি পাই। তার মধ্যে ১টি ছিল ২২ ফেব্রুয়ারি সংক্রান্ত, যা আমার তদন্তের আওতাবহির্ভূত এবং ফলে তা বিবেচনা করা হয়নি। এর মধ্যে ১১ জন বিবৃতি পাঠিয়েছেন। যাদের কাছে ঐদিন পুলিশের গুলিবর্ষণ ন্যায়সঙ্গত মনে হয়নি। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক এবং পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ থেকে দুটি বিবৃতি আছে। তারা স্মারকলিপির মাধ্যমে এই মর্মে তাদের নিজ নিজ দলের অবস্থান ঘােষণা করে যে, তারা তদন্তে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক নন, এবং তারা এর পরিধি ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তােলেন। ছাত্র এবং জনসাধারণের পক্ষ থেকে একটি অজ্ঞাতনামা বিবৃতি আসে। এতে অভিযােগ করা হয়ে যে, যে সকল ছাত্রনেতা ও জননেতা আন্দোলনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন তারা জেলে বন্দি আছেন। ফলে তাদের দ্বারা পুলিশ কর্তৃক গুলি বর্ষণের বিষয়ে কোনাে বিবৃতি প্রদান করা সম্ভব হয়নি। ময়মনসিংহের সাইদুল হকের নিকট থেকে একটি বিবৃতি আসে। তিনি তার বিবৃতিটি ছাপানাের জন্য পত্রিকায় পাঠানাের অনুরােধ করেন। এটা বােঝা যাচ্ছে যে, ব্যক্তিগত লাভালাভের প্রত্যাশায় ভারাক্রান্ত এই ব্যক্তির এক্ষেত্রে কোনাে ব্যক্তিস্বার্থ আছে এবং তিনি কিছুটা সস্তা ও নিরাপদ জনপ্রিয়তা পেতে উন্মুখ। ২৮ মার্চ ১৯৫২ তারিখ সংবলিত বাংলায় লেখা একটি বিবৃতি পাওয়া যায় মাে. আব্দুল মতিন নামক ঢাকা কলেজের এক ছাত্রের কাছ থেকে। কিন্তু পরে ৯ এপ্রিল, ১৯৫২ তারিখে তিনি ও তাঁর উল্লিখিত সাক্ষীদের পক্ষ থেকে একটি চিঠির মাধ্যমে তা প্রত্যাহার করে নেন। ৯ এপ্রিল ১৯৫২ সালে একটি বিবৃতি পাঠানাে হয় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি জনৈক আক্তারুদ্দীনের কাছ থেকে। যার ঠিকানা ছিল ২৪, এস.এম. হল, ঢাকা। বিবৃতি পাঠানাের সময় শেষ হওয়ার ১ দিন পর ১৯৫২ সালের ১ এপ্রিল একটি আমার কাছে পৌছায়। এই বিবৃতির মাধ্যমে একটি বিস্ময়কর বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বর্ধমান হাউস থেকে বের হয়ে আসা একটি প্রাইভেট কার থেকে পুলিশের কাছে গুলি করার লিখিত আদেশ হস্তান্তর করা হয়েছে। এর সঙ্গে তদন্তের সীমাবদ্ধ পরিধি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে একটি চিঠিও ছিল। তাতে আশঙ্কা করা হয়েছে, ঘটনার প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
হবে, কিংবা ইতিমধ্যে অসম্ভব করে তােলা হয়েছে।
৬. বিবৃতি প্রদানকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা পুলিশের গুলিবর্ষণের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন দেওয়ান হারুন মাে. মুনীরুদ্দিন নামক ঢাকার জগন্নাথ কলেজের এক ছাত্র। তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যিনি নিজেকে গুলিবর্ষণের সরাসরি সাক্ষী হিসেবে দাবি করেছেন।
৭. ১৯৫২ সালের ২১ মার্চ তিনি একটি বিবৃতি দাখিল করেন। সেখানে তিনি আরও ৫ জন সাক্ষীর নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু দুদিন পর ২৩ মার্চ ১৯৫২ তারিখে তিনি আরেকটি বিবৃতি দাখিল করেন যা আগের চেয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু বক্তব্যের দিক থেকে লক্ষণীয়ভাবে আগেরটার মতােই যেখানে তিনি আরও ১৭ জন সাক্ষীর নাম যুক্ত করেন। ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের অরাজকতার শিকার হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে ১৬টি বিবৃতি পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে ছিলেন বাসের কন্ডাক্টর, চালক ও রিকশাওয়ালা। তাদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, তদন্তটির একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে- যাদের যানবাহন ভাঙচুর করা হয়েছে, তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান। করা। গুলিবর্ষণের সমর্থনে প্রধান বিবৃতিটি এসেছে পূর্ববাংলা সরকারের পক্ষ থেকে। এ বিবৃতিতে ২১ জন সাক্ষীর নাম যুক্ত করা হয়, যারা তদন্তের জন্য
গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দেয়ার মতাে অবস্থানে ছিলেন।
৮. বিভিন্ন বিবৃতিতে যে সকল ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, আমি তাদের
সকলের বিবৃতি নেয়া জরুরি বলে মনে করি এবং সেই অনুযায়ী তাদের তদন্ত প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণের আদেশ কিংবা অনুরােধ জানিয়ে নােটিশ জারি করি। পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা না থাকায় তালিকায় থাকা ৮ জনের কাছে নােটিশ পাঠানাে সম্ভব হয়নি। নােটিশ পাওয়া ৭ জন সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য হাজির হননি। তাদের কেউ কেউ সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে জনাব দিয়েছেন কিংবা কেউ নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে জানিয়েছেন তদন্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
কোনাে সাক্ষ্য দেয়ার মতাে বক্তব্য তাদের নেই।
৯. ১৩ মার্চের সরকারি প্রজ্ঞাপন আমাকে তদন্ত পরিচালনার ক্ষেত্রে আমার মর্জি
অনুযায়ী আইনজীবীদের সহায়তা নেয়ার অনুমােদন দিয়েছে। আমার অনুমতি সাপেক্ষে জনাব হামুদুর রহমান তদন্তে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষে হাজিরা দিয়েছেন। অন্য কোনাে আইনজীবী হাজিরার অনুমতি প্রার্থনা করেননি। কিংবা অন্য কোনাে পক্ষই আইনজীবীদের প্রতিনিধিত্ব চায়নি। যদিও পূর্ববঙ্গ সরকার একটি বিবৃতি দাখিল করেছিল কিন্তু তারা নিজেদেরকে তদন্তের কোনাে পক্ষ বলে বিবেচনা করেনি এবং আইনগতভাবে প্রতিনিধিত্ব করেনি। যাহােক, আমার অনুরােধক্রমে জনাব সৈয়দ আব্দুল গণি সরকার কর্তৃক নিয়ােগকৃত হয়েছেন তদন্তকাজে আমাকে সহায়তা করার জন্য।
১০. গােপন শুনানি শুরু হওয়ার কথা ছিল ১৯৫২ সালের ৭ এপ্রিল। কিন্তু কিছু প্রাথমিক আয়ােজন সময়মতাে সম্পন্ন না হওয়ায় ওই দিন সাক্ষীদের জেরা শুরু করা সম্ভব হয়নি। সাক্ষীদেরকে জেরা করা শুরু হয়েছে মূলত ৮ এপ্রিল।
১১. গুলিবর্ষণ যৌক্তিক ছিল এবং প্রয়ােজনের তুলনায় বাড়াবাড়ি ছিল না—
পুলিশের এই দাবির পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন, এমন সাক্ষীদের জেরা করা হয় ৮, ৯, ১০, ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ এপ্রিল অর্থাৎ ৭ দিন। গুলিবর্ষণকে অননুমােদন করে বিবৃতি লিপিবদ্ধ করার পর যুক্তিতর্কের জন্য দুদিন সময় দেওয়া হয়। ২ মে জনাব হামুদুর রহমান তার মক্কেলদের পক্ষে মামলাটি উপস্থাপন করেন এবং জনাব আব্দুল গণি তার মামলা লড়েন ৩ মে। তদন্ত শেষ হওয়ার পর আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাই। গুলিবর্ষণের ঘটনাস্থলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য (টপােগ্রাফি) আমার জানা থাকলেও তদন্তসংশ্লিষ্ট ভবন ও সীমানাসমূহের অবস্থান ও আকৃতির ব্যাপারে নিজের স্মৃতিকে ঝালিয়ে নেয়া এবং মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে গুলির চিহ্নগুলাে স্বচক্ষে দেখার জন্য তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর আমি সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করি।
১২. তদন্তে রেকর্ডকৃত সাক্ষীদের বিবৃতিসমূহকে সহজেই ৫টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণীতে আছেন ১ থেকে ২১ পর্যন্ত লিপিবদ্ধ অফিসিয়াল সাক্ষীগণ এবং ৩৬নং সাক্ষী আশরাফ আলী ওয়াহিদী, মেসার্স জাইদী অ্যান্ড কোং-এর একজন ফটোগ্রাফার, যিনি ঘটনার পরে পুলিশের সহায়তায় কিছু ছবি তুলেছিলেন।
সাক্ষী নং
জনাব, মাে. ইদ্রিস, পি, এস, পি., এস.পি; ঢাকা -১
জনাব এস.এইচ. কুরাইশী, সি.এস.সি. ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা -২
জনাব এ. জেড. ওবায়দুল্লাহ, ডি.আইজি, ঢাকা রেঞ্জ- ৩
জনাব মাে. সিদ্দিক দেওয়ান, ডি.এস.পি., সিটি, ঢাকা- ৪
জনাব নূরুদ্দিন আহমেদ, এস.ডি.ও., সদর, ঢাকা দক্ষিণ- ৫
জনাব মাসুদ মাহমুদ, পি.এস.পি., অ্যাডিশনাল এস.পি.সিটি, ঢাকা- ৬
জনাব নবী শের খান, তৎকালীন আর.আই.সেকেন্ড, ঢাকা, বর্তমান- ৭
আর.আই. ফরিদপুর
জনাব মাে. ইউসুফ, স্পেশাল সুপারিন্টেনডেন্ট অব পুলিশ, -৮
আই.বি. ইস্টবেঙ্গল, ঢাকা
জনাব আবদুল গােফরান, তৎকালীন ও.সি. লালবাগ, ঢাকা,
বর্তমান ইন্সপেক্টর, বরিশাল -৯
জনাব মীর আশরাফুল হক, পুলিশ ইন্সপেক্টর, ডি.ডি., ঢাকা –১০
জনাব জে. ডি’মেলাে, পুলিশ ইন্সপেক্টর, ঢাকা ১১
জনাব হাসান আলী, মাননীয় মন্ত্রী, সি.বি.আই. ডিপার্টমেন্ট,
পূর্ববঙ্গ সরকার, ঢাকা- ১২
জনাব সৈয়দ আবদুল মজিদ, ডিরেক্টর অব ল্যান্ড রেকর্ডস অ্যান্ড সার্ভেইজ,
পূর্ববঙ্গ, ঢাকা-১৩
জনাব আউলাদ হােসাইন খান, পূর্ববঙ্গ সরকারের ঢাকার সিভিল
সাপ্লাইজ বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রীর সংসদ সচিব, ঢাকা -১৪
ডা. আলতাফউদ্দীন আহমেদ, সিভিল সার্জন, ঢাকা -১৫
জনাব আব্দুর রহমান,সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা -১৬
জনাব এ জব্বার, পুলিশ ইন্সপেক্টর, লালবাগ সার্কেল, ঢাকা -১৭
ডা. হাবিবুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক, ধাত্রী ও প্রসূতিবিদ্যা, মেডিকেল কলেজ, ঢাকা-১৮
ডা. আহমেদ হােসাইন, মেডিকেল সলেজ হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট, ইলেক্ট্রো থেরাপিস্ট, ঢাকা -১৯
ডা. হাম্মাদুর রহমান, চিকিৎসক, ঢাকা -২০
ডা. শেখ আব্দুস শাকুর, চিকিৎসক, ঢাকা -২১
জনাব আশরাফ আলী ওয়াহিদী, ফটোগ্রাফার, মেসার্স জাইদী অ্যান্ড কো. -২২
১৩. দ্বিতীয় শ্রেণীর সাক্ষীদের মধ্যে আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন কর্মকর্তা-সাক্ষী নং
ড. এস. এম. হােসেন, উপাচর্য, ঢাকা -৩৫
ড. আই. এইচ. জুবেরী, ডীন, কলা অনুষদ -৩৬
এবং ইংরেজি বিভাগের প্রধান-৩৭
ড. এম. ও গণি, প্রভােস্ট, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা -৩৮
১৪. ৩য় শ্রেণীর সাক্ষীদের মধ্যে আছে ১০ জন ছাত্র যাদের মধ্যে ৭ জন মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের বাসিন্দা এবং ৩ জন বহিরাগত। ছাত্ররা হলেন—
সাক্ষী নং
আব্দুল মালিক –৪২
সফিউদ্দিন চৌধুরী -৪৭
হুরমত আলী ৫০
মমা. গােলাম জুলফিকার -৫১
আমিনুর রহমা- ৫২
রফিকুর রেজা চৌধুরী -৫৪
সৈয়দ আব্দুল মালিক -৬০
এবং তিনজন বহিরাগত হলেন—
আহসানউল্লাহ, সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা, আবাসিক ছাত্র, ঢাকা -৫৮
শেখ মাে. আব্দুল হাই -৬২
দেওয়ান হারুন মাে. মুনীরুদ্দিন -৬৪
১৫. চতুর্থ শ্রেণীর সাক্ষী, মেডিকেল কলেজ থেকে এসেছেন বলা যায়, তাদের মধ্যে চারজন ডাক্তার-
সাক্ষী নং
ডক্টর জিন্নর আহমেদ চৌধুরী-৩৯
ডক্টর আবুল মাসুদ খান মজলিস -৪০
ডক্টর নবাব আলী, এবং -৪১
ডক্টর আব্দুস সামান খান চৌধুরী -৫৫
সাক্ষীদের এই শ্রেণির মধ্যে তিনজন সেবিকা, যথাক্রমে
সাক্ষী নং
সিস্টার মিস এলিজা কুরুয়ালা- ৪৩
মিস নূর জাহান বেগম, এবং- ৪৪
মিস পুলু কস্তা -৪৮
সাক্ষীর মধ্যে পাঁচজন ওয়ার্ড বয় এবং অ্যাম্বুলেন্স তত্ত্বাবধায়ক, যথাক্রমে
সাক্ষী নং
দিদার বাক্স -৪৫
মােহাম্মদ মিয়া।- ৪৬
সেকান্দার আলী -৪৯
মুসলিম খান, এবং- ৫৯
রমজান খন্দকার- ৬১
সাক্ষী নং ৫১, জনাব আব্দুস সাত্তার দেওয়ান হিসাবরক্ষক হিসেবে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। সাক্ষী নং ৬৩, জনাব ইখলাস উদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খন্দকার অ্যান্ড কোং কোম্পানির প্রতিনিধি।
১৬. পঞ্চম এবং শেষ শ্রেণীর সাক্ষীদের মধ্যে ছিলেন এমন ব্যক্তিগণ, যাদেরকে জনসাধারণ হিসেবে শ্রেণীভুক্ত করাটাই সুবিধাজনক। তারা হলেন—
সাক্ষী নং
মীর মুসলিম, বাস চালক -২২
মনসুর, বাস কন্ডাক্টর -২৩
সােনা মিয়া, রিকশাচালক -২৫
পিয়ার বক্স, রিকশাচালক -২৭
ফাকু মিয়া, রিকশাচালক -২৯
কালা চান, রিকশাচালক -৩০
নবাব মিয়া, রিকশাচালক -৩১
আশরাফুদ্দিন, রিকশাচালক -৩২
আব্দুল হামিদ, রিকশাচালক -৩৩
সাক্ষী নং, ২৬, খায়রুল্লাহ ছিলেন একজন রিকশা যাত্রী।
এই শ্রেণীতে আরও ছিলেন-
ডক্টর এ. মুসা এ. হক, মেডিকেল প্রাকটিশনার -২৪
জনাব মােহাম্মদ কামাল, এম.এ., বর্তমানে বেকার -২৮
জনাব আব্দুস সাত্তার, টেকনিশিয়ান, এ.পি.পি. -৩৪
মতিউল ইসলাম, সহকারী, পূর্ববঙ্গ সি.এল. অ্যান্ড আই,
অধিদপ্তর, ঢাকা, এবং -৫৬
জনাব নূর মােহাম্মদ, সহকারী, এয়ার কাস্টমস অফিস, তেজগাঁও- ৫৭
১৭. জনাব হামুদুর রহমান যেসব সাক্ষীর পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন,
তাদের বক্তব্য ইতিমধ্যে রেকর্ড করা হয়েছে এবং প্রত্যেক সাক্ষী সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। প্রয়ােজনীয় বিবেচনায় প্রত্যেক সাক্ষীকে হামুদুর রহমান নতুন করে জেরা করেন এবং তারপর জনাব গণি পুনরায় সওয়াল-জবাব করেন। যে সকল সাক্ষী গুলিবর্ষণকে অননুমােদন করে বক্তব্য দিয়েছেন, তারা যখন নিজেদের পক্ষ অবলম্বন করছিলেন তখন তাদেরকে প্রথমে প্রিজাইডিং অফিসার এবং পরে জনাব এ. গণি ও হামুদুর রহমান পালাক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এটা যােগ করা যায় যে, যেহেতু তদন্তের সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপিত কোনাে ব্যক্তিকে শপথ পাঠ করানাের ক্ষমতা তদন্ত কর্মকর্তাদের ছিল না, সেহেতু কোনাে সাক্ষীই তদন্ত
কর্মকর্তাদের কাছে কোনাে শপথ করেননি।
১৮. এই পর্যায়ে এটা বলা যায় যে, এই তদন্তের ক্ষেত্রে যাদের সাক্ষ্য প্রকৃতপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ, তাঁরা হলেন ৮ জন অফিসিয়াল সাক্ষী, ৬ জন পুলিশ কর্মকর্তা
সাক্ষী নং
জনাব মাে. ইদ্রিস, পি.এস.পি., এস.পি. ঢাকা- ১
জনাব এ.জেড. ওবায়দুল্লাহ, ডি.আই.জি, ঢাকা রেঞ্জ- ২
জনাব মাে. সিদ্দিক দেওয়ান, ডি.এস.সি. সিটি ঢাকা- ৩
জনাব মােহাম্মদ ইউসুফ, স্পেশাল সুপারিন্টেডেন্ট অব পুলিশ
আই.বি. ইস্ট বেঙ্গল, ঢাকা- ৮
জনাব আব্দুল গােফরান, তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা,
লালবাগ থানা বর্তমান পুলিশ ইন্সপেক্টর, বরিশাল -৯
জনাব মীর আশরাফুল হক, পুলিশ ইন্সপেক্টর, গােয়েন্দা বিভাগ, ঢাকা; -১০
এবং দুজন ম্যাজিস্ট্রেট
এস.এইচ.কুরাইশী, সি.এস.সি, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা- ২
মাে. নুরুদ্দিন আহমেদ, এস.ডি.ও., সদর দক্ষিণ, ঢাকা -৫
এবং নন-অফিসিয়াল সাক্ষী মাে. কামাল এম.এ. দেওয়ান হারুন মাে. মুনীরউদ্দিন
মূলত এই সাক্ষীরাই পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন। বলে দাবি করেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারির দিন প্রথম সাল থেকে বেলা ৩.২০ ঘটিকায় ঠিক পুলিশ যখন গুলি করতে শুরু করে তখন পর্যন্ত ঘটনা কীভাবে মােড় নিয়েছে সেই পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেই শুধু অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ গুরুত্বপূর্ণ।
১৯. সকালের ঘটনাবলি সম্পর্কে পুলিশ সাক্ষীগণ দাবি করেন যে, সেদিনের শুরুই হয় সকাল ৭.৩০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্বাভাবিক যানবাহন চলাচলে বাধা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে। পুলিশ আশঙ্কা করে, ২১ ফেব্রুয়ারিতে পূর্বঘােষিত হরতালের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গণ্ডগােল হতে পারে এবং জরুরি অবস্থা মােকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। সকাল ৭.৩০টার মধ্যে পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী পুলিশ বাহিনী তাদের অবস্থান নেয়। ঢাকা সিটি ডি.এস.পি. জনাব সিদ্দিক দেওয়ানকে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের দায়িত্ব দেয় হয়। সকাল থেকেই অতিরিক্তি পুলিশ সুপার, সিটি জনাব মাসুদ মাহমুদ টহলে বের হন এবং পুলিশের অস্থায়ী ফাঁড়িগুলাে পরিদর্শন করেন। তিনি দেখতে পান বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীরা যান চলাচল বন্ধ করে যাত্রীদের বাস, ট্যাক্সি, রিকশা ও গাড়ি থেকে নেমে যেতে বাধ্য করছে এবং টায়ারের হাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে, যাতে পরে সেগুলাে আর চলতে না পারে। গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ কর্মকর্তারা হস্তক্ষেপ করলে, তাদেরকে নােংরা ভাষায় গালাগাল করা হয়। বিশেষত অতিরিক্ত এস.পি, সিটি শিক্ষার্থীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন। ৭.৪৫ টায় পুলিশ সুপার মাে. ইদ্রিসের কাছে খবর আসে যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের ভেতরে ও বাইরে এবং মেডিকেল ছাত্রাবাসে প্রচুর শিক্ষার্থী জড়াে হচ্ছে এবং তারা পূর্বঘােষিত হরতাল কার্যকর করার লক্ষ্যে গাড়িচালকদের থামতে এবং যাত্রীদের নামতে বাধ্য করছে। পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট দ্রুত পদক্ষেপে সকাল ৮.১৫ টায় গােলযােগপূর্ণ স্থানে পৌছান এবং দেখতে পান শিক্ষার্থীরা যান চলাচল থামাতে সহিংস আচরণ করেছে, যে ব্যাপারে আগেই তাকে রিপাের্ট করা হয়েছিল। এস.পি. যথাসাধ্য চেষ্টা করেন শিক্ষার্থীদের এ ধরনের কাজ থেকে নিবৃত্ত করতে। কিন্তু তাতে কোনাে কাজ না হওয়ায় তিনি গােলযােগের আশঙ্কায় নির্দিষ্ট এলাকায় পুলিশ মােতায়েন করেন। ৯টার সময় তিনি, ডি.এস.সি. সিটি, ১ জন ইন্সপেক্টর, ২ জন প্রধান কনস্টেবল, এস.এ.এফের ২০ জন কনস্টেবল, ইন্সপেক্টর, ১ জন সাব-ইন্সপেক্টর, ১ জন সার্জেন্ট, ২ জন প্রধান কনস্টেবল এবং লাঠিসজ্জিত ১৪ জন কনস্টেবল বিশ্ববিদ্যালয় গেইটে অবস্থান নেন। মেডিকেল কলেজ গেটে ১ জন হেড কনস্টেবলসহ ১০ জন এস.এ.এফের কনস্টেবল এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল গেইট ১ জন প্রধান কনস্টেবলসহ ১০ জন অস্ত্রসজ্জিত কনস্টেবল নিয়ে গঠিত তার বাহিনী
অবস্থান নেয়।
২০. এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অল্প অল্প করে মানুষ জড়াে হতে থাকে।
শিক্ষার্থী এবং বহিরাগতরা ছােট ছােট দলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢুকতে থাকে। সকাল ১০টা নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিশাল সংখ্যক মানুষ সমবেত হয় এবং জনসভা করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। সকাল ১০টার দিকে পরিস্থিতি এতই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠে যে, সে জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব কুরাইশীকে খবর পাঠানাে হয় এবং দ্রুত তিনি বিশ্ববিদ্যালয় গেইটের দিকে আসেন। ঘটনাস্থলে পৌছে জনাব কুরাইশী দেখতে পান বিশ্ববিদ্যালয় গেইটের ভেতরে-বাইরের বিশাল জমায়েত, যারা পুলিশকে অপদস্থ করছিল এবং গণহারে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জনাব কুরাইশী উপাচার্যের ফোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে পান এবং অনুরােধ করেন তিনি যেন শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে বলেন তারা যেন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আসার কিছুক্ষণের মধ্যে ডক্টর জুবেরী এবং ডক্টর গণিকে নিয়ে উপাচার্য ঘটনাস্থলে পৌঁছান। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব কুরাইশী তাদেরকে অনুরােধ করেন তারা যেন ছাত্রদের বুঝিয়ে বলেন তারা যেন বেআইনি কর্মকাণ্ড বন্ধ করে এবং রাজপথে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত করা থেকে বিরত থাকে। উপাচার্য যখন ছাত্রদের মুখােমুখি হন, তখন তদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজারের বেশি। তারা প্রথমেই তাকে আইন লঙ্ঘন করে তাদের সমাবেশে নেতৃত্ব দিতে বলে। তিনি ছাত্রদের প্রস্তাব করেন যে, তারা একটি সভা আলােজন করতে পারে যেখানে তারা একটি প্রস্তাব পেশ করবে এবং এরপর ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। শিক্ষার্থীরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করে এং তাকে এই সভায় নেতৃত্ব দিতে ও সভাপতিত্ব করতে অনুরােধ করে। তিনি তাতে সম্মত হননি। তবে তিনি বলেন যদি তারা এই নিশ্চয়তা দেয় যে তারা শান্তিপূর্ণ আচরণ করবে এবং সব শেষে শান্তিপূর্ণভাবে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে তাহলে তিনি তাদের সহযােগিতা করতে প্রস্তুত। এই নিশ্চয়তা কখনােই দেওয়া হয়নি, যদিও কিছু নেতৃস্থানীয় শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে বােঝানাের ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। বরং উপাচার্যকে সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে বলা হয় এবং তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এটি খুবই সুস্পষ্ট ছিল যে শিক্ষার্থীরা কোনাে যৌক্তিক পরামর্শ গ্রহণের অবস্থায় ছিল না এবং তারা স্পষ্টভাবে কোডের ১৪৪ ধারা অনুযায়ী জারিকৃত আদেশ ভঙ্গ করবে বলে মনস্থির করে রেখেছে।
২১. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে আয়ােজিত সভাটি শেষ হয় বেলা ১১টার দিকে। ড. জুবেরীর মতে, ‘ভয়ানকভাবে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা তখন বিশ্ববিদ্যালয় গেটের দখল নেয়। উপাচার্য এবং তার দুজন সহকর্মীর মতে, পুলিশের হাতে গ্রেফতার এড়ানাের জন্য ছাত্ররা ৫ জন, ৭ জন অথবা ১০ জনের একেকটি ছােট ব্যাচ করে একই সাথে গেট থেকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তারা ২৫ অথবা ৩০ জনের ব্যাচ করে আসছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, একটি নােটবুক থেকে তালিকা ধরে ধরে ছাত্রদের নাম ডাকা হচ্ছিল এবং তারা গেইটের বাইরে যাচ্ছিল পরিস্থিতি এমন ছিল তা থেকে নিঃসন্দেহে বােঝা যাচ্ছিল যে, সভাটি একটি পরিষ্কার ভণিতা এবং ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সর্ব পূর্বপ্রস্তুতি সেরে রেখেছিল। কারা আইন ভঙ্গ করবে তাদের নাম নির্ধারণ করা ছিল এবং কোন সুনির্দিষ্ট ছাত্র কখন সেই উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ত্যাগ করবে এই ক্রমও সাজানাে ছিল। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইট দিয়ে বের হলে ছাত্রীদেরকে বাদ দিয়ে পুলিশ তাদের সবাইকে গ্রেফতার করে এবং কিছু ছাত্র নিজে নিজেই পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়ে। সব মিলিয়ে ৯১ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং ততক্ষণে পুলিশের গাড়িতে উঠে পড়ে। সব মিলিয়ে ৯১ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং ততক্ষণে পুলিশের যানবাহনের ধারণক্ষমতা পূর্ণ হয়ে যায়। পুলিশ আর কাউকে গ্রেফতার করতে পারছিল না বলে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। পুলিশের এই ব্রিতকর অবস্থা আঁচ করতে পেরে উপস্থিত জনতা আরও হিংস্র হয়ে ওঠে এবং পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুলিশকে তাদের বাহিনীর পুনর্বিন্যাস করতে হয়। কিছু কনস্টেবলকে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের সঙ্গে পাঠাতে হয়েছিল। অ্যাডিশনাল সিটি এসপিকে অ্যাসেম্বলি হাউসে পাঠানাে হয়েছিল সেখানকার নিরাপত্তা বিধান করার জন্য। কারণ, ছাত্ররা অ্যাসেম্বলি হাউসের সামনে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে প্রতিবেদন। করা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় গেইটে একটি গ্যাস স্কোয়াড মােতায়েন করা। হয়। ১ জন ইন্সপেক্টর, ১ জন সাব-ইন্সপেক্টর, ১ জন হেড কনস্টেবল, ৬ জন এস.এ. এফ.-এর কনস্টেবল, ৪ জন লাঠিসজ্জিত কনস্টেবল এবং ১৬ জন কনস্টেবলের একটি সম্মিলিত গ্যাস স্কোয়াড ছিল। মেডিকেল কলেজ গেইটে শহরের ডিএসপি, ১ জন হেড কনস্টেবল এবং ১০ জন এস.এ.এফ.-এর কনস্টেবল ছিলেন। পরিষদ ভবনের কর্নারে ছিলেন অ্যাডিশনাল এসপি, ৩ জন সার্জেন্ট, একজন সাব-ইন্সপেক্টর এবং ২ জন হেড কনস্টেবল এবং ১৮ সশস্ত্র কনস্টেবল, ১ জন হেড কনস্টেবল এবং ৪ জন লাঠিসজ্জিত কনস্টেবল এবং ৬ জন কনস্টেবলের সম্মিলিত একটি গ্যাস স্কোয়াড।
২২. ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ৯১ জনকে গ্রেফতার করার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে মিছিল নিয়ে এগােতে থাকে। এসপি এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের সতর্ক করে দেন যে, তারা একটি বেআইনি সমাবেশ করছে এবং তারা নিজেরা ছত্রভঙ্গ হলে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে শক্তি প্রয়ােগ করা হবে। তারা ছত্রভঙ্গ হয়নি এবং ফলে পুলিশ গ্যাস শেল ও গ্যাস গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য। গ্যাস অ্যাটাকের ফলে ছাত্ররা কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হয় এবং পরক্ষণেই মেডিকেল কলেজ এলাকায় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে, সেক্রেটারিয়েট রােডের উল্টো দিকে জড়াে হয়। ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে সহজেই মেডিকেল কলেজ এলাকায় চলে যেতে পারছিল। কারণ সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেলের মাঝখানে যে দেয়াল ছিল সেটি ভাঙ্গা ছিল এবং সেজন্য দুই এলাকায় যাতায়াতের জন্য সেক্রেটারিয়েট রােড হয়ে যাওয়ার প্রয়ােজন হতাে না। গ্যাস অ্যাটাক সাময়িকভাবে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়, কিন্তু ততক্ষণে অতিরিক্ত সিটি এসপি জনাব মাসুদ মাহমুদ আহত হন, একটি জিপ গুড়িয়ে দেয়া হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে অনবরত পুলিশ ফোর্সের ওপর ইটপাটকেল ছোঁড়া হচ্ছিল। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর বলে বিবেচনা করা হয় যে, সেখানে ঢাকা রেঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল জনাব এ. জেড. ওবায়দুল্লাহর উপস্থিতি কামনা করা হয়। তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছান। বেলা ১টার দিকে। তিনি সেখানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সুপারিন্টেডেন্টের সঙ্গে দেখা করেন এবং দেখতে পান যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, মেডিকেল কলেজ এলাকা থেকে শুরু করে প্রায় পরিষদ ভবন পর্যন্ত জায়গাটি জনাকীর্ণ হয়ে রয়েছে। উপস্থিত জনতা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং পুলিশ সুপারিন্টেডেন্টরাে সতর্কবার্তা অবজ্ঞা করে পুলিশের ওপর আক্রমণ জোরদার করে এবং ক্রমাগত ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। গ্যাস অ্যাটাকের ফলে ছত্রভঙ্গ হয়েও সাময়িকভাবে তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে তাদের অভয়ারণ্যে— পিছু হটে এবং আরেকটি নতুন আক্রমণের জন্য সমবেত হয়। মনে হচ্ছিল গােলযােগের কেন্দ্রবিন্দু মেডিকেল কলেজ গেইট এবং সেই অনুযায়ী পুলিশ বাহিনীকে মেডিকেল কলেজের সামনে জড়াে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারণ, তখন সেখানে এই ফোর্স নিয়ােগ অতীব জরুরি হয়ে পড়েছিল। বেলা ২ টা থেকে ২.৩০টার মধ্যে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক হয়ে পড়ে এবং পুলিশ সদস্যরা সচিবালয় রােডের পশ্চিম দিকের দোকানগুলাের পিছনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। আইন পরিষদ সদস্য মৌলভি আওলাদ হােসেন পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার পথে বাধাপ্রাপ্ত হন এবং তাঁর গাড়ি মেডিকেল কলেজ কম্পাউন্ডের ভেতরে নিয়ে যেতে বাধ্য হন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, এই মর্মে একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর দিতে তাকে বাধ্য করা হয়। হুমকির মুখে তাকে এ রকম একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছিল যে, তিনি লাঠিচার্জ করতে দেখেছেন এবং তার ফলে কয়েকজন ছেলেকে আহত হতে দেখেছেন। যদিও প্রকৃতপক্ষে তিনি তা ঘটতে দেখেননি। রাত ৯টা পর্যন্ত তিনি সেখান থেকে বের হতে পারেননি। প্রায় সেই সময়ে সিটি ডিএসপি জনাব মুহাম্মদ সিদ্দিক দেওয়ান জনতার হাতে প্রহৃত হন। এবং ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে যে দুই দফায় মারাত্মকভাবে লাঠিচার্জ করা হয়েছিল তার একটি ছিল তাকে জনতার হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য। পুলিশ বার বার টিয়ার গ্যাস গ্রেনেড ব্যবহার করছিল এবং এতে কোনাে দীর্ঘস্থায়ী ফল হচ্ছিল না। বরং জনতা খুব তাড়াতাড়ি পুলিশের এই পদক্ষেপ সামলে নিচ্ছিল। একজন সাক্ষী যেমন বলেছেন, তারা পুলিশের সাথে ‘হঁদুর-বেড়াল’ খেলা খেলছিল, পুলিশের নিক্ষিপ্ত টিয়ারশেল ও গ্রেনেডগুলাে পানি ঢেলে অকেজো, করে দিচ্ছিল। তারা পুলিশ ও পথচারীদের উপরে বৃষ্টির মতাে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে তাদের ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল।
২৩. ওই সময় মাননীয় জনাব হাসান আলী এই পথ দিয়ে তার গাড়িতে করে পরিষদের দিকে যাচ্ছিলেন। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুল্লাহের বাকী (এম.এল.এ., এম.সি.এ.) ও তার সঙ্গে একই গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন। জনতা গাড়িটি থামিয়ে দেয় এবং টায়ারের বাতাস বের করে দিযে তা অকেজো করে দেয়। বাম পাশ দিয়ে একজন, ডান পাশ দিয়ে আরেকজন, দুই যুবক গাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারা যাচ্ছিল মাননীয় মন্ত্রী এবং তার সঙ্গী যেন তাদের সঙ্গে মেডিকিল কলেজ হাসপাতালের ভিতরে যান। এবং এ নিয়ে তারা বেশ জোরাজুরি করছিল। তার সঙ্গী যুবকদের কথামতাে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে মাননীয় মন্ত্রী এবং তার আর্দালি তাকে গাড়ির ভিতরে টেনে তুলে নেন। মাননীয় মন্ত্রীর কাছে মনে হয়েছিল এটা তার [সঙ্গী] জন্য বিপজ্জনক হবে। কারণ, তখনও মুহুর্মুহু ইট-পাটকেল উড়ে আসছিল। পুলিশ সদস্যরা মাননীয় মন্ত্রী ও তার সঙ্গীকে একটি পুলিশ ভ্যানে তুলে নেন এবং তাদেরকে পরিষদ ভবনে পৌঁছে দেন। জিপটি যাওয়ার পথে মাথায় একটি ইটের আঘাতে মাননীয় স্ত্রী আহত হন। ততক্ষণে পুলিশের অনেক সদস্য হতাহত হন। ডিআইজি, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপারিন্টেডেন্ট এবং অ্যাডিশনাল সিটি এসপি সবাই ইটের আঘাতে আহত হন। অন্য পুলিশ সদস্যরাও আহত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তারা তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন।
২৪. প্রায় বেলা ৩.০০টার পর থেকে পুলিশ বুঝতে পারে, পরিস্থিতি তাদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বেলা ৩.০০টার সময় রাস্তায় জড়াে হওয়া বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশ দ্বিতীয় ও শেষবারের মতাে মারাত্মকভাবে লাঠিচার্জ করে। কিন্তু এই সময়ে লাঠিচার্জের ফলে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, বরং পুলিশ দেখতে পায় বিক্ষোভকারীদের বদলে তাদেরকেই পিছু হটতে হচ্ছে। কারণ তাদের দিকে বৃষ্টির মতাে ছুড়ে আসা ইট পাটকেলের মুখে তারা দাঁড়াতে পারছিলেন না। ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতার সংখ্যা ছিল প্রায় ৫,০০০ (পাঁচ হাজার)। এই মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ ও মেডিকেল কলেজ হােস্টেল দুই দিক থেকে এত দ্রুত এবং বিপজ্জকভাবে পুলিশের দিকে ধেয়ে আসছিল যে, পুলিশ সদস্যরা তাদের দ্বারা চারপাশ থেকে ঘেরাওকৃত এবং আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় পড়ে গিয়েছিল। ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ডি.আই.জি এবং এস.পি. এ ব্যাপারে একমত হন যে, পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যে গুলি করার আদেশ দেওয়া উচিত। শেষ অবলম্বন হিসেবে তারা একটি চূড়ান্ত সতর্কবার্তা দেন। কিন্তু তাতে কোনাে কাজ হয়নি। তখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশনায় এবং পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টের সরাসরি নির্দেশে পুলিশ জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিবর্ষণকারী দলের মধ্যে ৩ জন হেড কনস্টেবল এবং ৩০ জন কনস্টেবল ছিল, যারা মেডিকেল কলেজ গেইট ও মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের মাঝামাঝি বর্গাকারে অবস্থান নেয়। ৫ জনের প্রতিটি গ্রুপের পুলিশ সদস্যরা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল ও বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের মুখােমুখি হাঁটু গেড়ে তাদের অবস্থান নেয়। বাকি সদস্যরা উত্তর-পূর্ব দিকে মুখােমুখি হয়ে অবস্থান নেয়। তাদের অবস্থান সম্বন্ধে ডিআইজ এবং এসপির বর্ণনা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু যেহেতু এসপি প্রকৃত কমান্ডে ছিলেন, তার বর্ণনা অধিকতর সঠিক হওয়ার কথা। অন্য পুলিশ সদস্যরা এবং এসপি নিজেও এই বর্গের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করেন। এসপি দুই গ্রুপের সদস্যদের এক রাউন্ড করে গুলি করার আদেশ দেন এবং তারা তাই করেন। বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের দিকের বিক্ষোভকারীরা পিছু হটে যায়। কিন্তু মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের দিকের বিক্ষোভকারীরা কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালেও পুনরায় ইট-পাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসে। আর তখনই এসপি মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের দিকে অবস্থিত পুলিশ সদস্যদেরকে দ্বিতীয়বারের মতাে গুলি করার নির্দেশ দেন। এই দিক্কার বিক্ষোভকারীরা যখন পিছু হইতে শুরু করে, তখনই পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট গুলি বন্ধ করার আদেশ দেন। গুলিবর্ষণ শেষে গােলাবারুদ চেক করা হয় এবং দেখা যায় সব মিলিয়ে ২৭ রাউন্ড গুলি ছােড়া হয়েছিল। ৫ রাউন্ড বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের দিকে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে এবং বাকি ২২ রাউন্ড মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের দিকে অবস্থানরত বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে ছােড়া হয়েছিল। গুলিবর্ষণের সময় বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের কোণার কাছে একটা লােক তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এবং একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। যেহেতু বিক্ষোভকারীরা তখনাে খুবই উত্তেজিত এবং সহিংস ছিল, তাই পুলিশের পক্ষে মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের দিকে হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব ছিল না। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় গুলি বর্ষণের ফলে ৯ জন হতাহত হয়েছিল, যার মধ্যে ৩ জন ছাত্র এবং বাকি ৬ জন বহিরাগত। রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে ২ জন মারা যায়, যার মধ্যে ১ জন ছিল ছাত্র, এবং আহত আরেকজন তদন্ত কালে মারা যান। এমনকি গুলিবর্ষণ শুরু করার পরেও বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল ছােড়া বন্ধ করেনি। মেডিকেল কলেজ হােস্টেল কম্পাউন্ডে ১টি মাইক্রোফোন লাগানাে হয় এবং তার মাধ্যমে সরকার এবং পুলিশের বিরুদ্ধে বিষােদগারপূর্ণ বক্তব্য দেওয়া হয়। বিক্ষোভকারীদের উত্তেজনা তুঙ্গে রাখার লক্ষ্যে রক্তমাখা জামাগুলাে প্রদর্শন করা হয়। এবং বিকেল ৪.৩০টা বা ৫.০০ টার সময় পরিষদ ভবন অভিমুখে বিক্ষোভকারীদের আরেকটি জমায়েত ঠেকাতে পুলিশকে আরেকবার লাঠিচার্জ করতে হয়।।
২৫. জনাব হামুদুর রহমান যুক্তি দেখান যে, বিশ্ববিদ্যালয় ও আশেপাশের এলাকার সার্বিক পরিস্থিতির ব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয় পক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যের সামঞ্জস্যপূর্ণ। সাক্ষীদের মধ্য ছিলেন মাননীয় উপাচার্য, ড. জুবেরী এবং ড. গণি, যারা বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডের ভেতরের পরিস্থিতির ব্যাপারে এং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিদ্যমান গােলমাল এবং উত্তেজনা নিয়ে কথা বলার মতাে পর্যায়ে ছিলেন, যদিও বিশ্ববিদ্যালয় গেইট পরিদর্শন ছাড়া প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় গেইটের বাইরে রাস্তার ওপারে কী হচ্ছিল, তা তারা দেখেননি। তবে তারা এটা স্বীকার করেন যে, তাদের নিকট পুলিশ অফিসার কর্তৃক এই অভিযােগ করা হয়েছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হচ্ছিল এবং তার ফলে পুলিশ সদস্যরা আহত হয়েছেন এবং পুলিশের কিছু যানবাহনও বিনষ্ট হয়েছে। ইট-পাটকেল সম্পর্কে ড. জুবেরীকে (সাক্ষী নং-৩৭) জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়—
প্রশ্ন-১৪০। মনে করার চেষ্টা করুন, আপনি কি লক্ষ করেছেন যখন গ্রেফতার করা হচ্ছিল তখন কি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে কোনাে প্রকার ইটপাটকেল ছোড়া হচ্ছিল এবং পুলিশ ও তাদের জিপে আক্রমণ করছিল? উত্তর : আমার মনে হয় না যখন গ্রেফতার করা হচ্ছিল, তখন কোনাে ইটপাটকেল ছোঁড়া হচ্ছিল।
প্রশ্ন-১৪১। তারপর? উত্তর : কিন্তু টিয়ার গ্যাস শেল নিক্ষেপ করার পর পুলিশ উপাচার্যকে অভিযােগ করল যে, ইট-পাটকেল ছোঁড়া হচ্ছে।
প্রশ্ন-১৪২। ইট-পাটকেলগুলাে রেলিংয়ের ভেতর থেকে ছোড়া হচ্ছিল কিনা তা নিরূপণ করার জন্য মাননীয় উপাচার্য কর্তৃক কি কোনাে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল? উত্তর : আমি মনে করি না যে মাননীয় উপাচার্য এর জন্য কোনাে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু আমি মনে করি কিছু ইট-পাটকেল ছোড়া হয়েছিল। এগুলাে রেলিয়ংয়ের বাইরে পড়ছিল। আমি ছাত্র-ছাত্রীদের এটা থেকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলাম। আমি এটা স্পষ্ট মনে করতে পারছি।
২৬. যদিও মাননীয় উপাচার্য এবং ড. গণি কোনাে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে দেখেননি,
তথাপি উপাচার্য মহােদয় ৫৯, ৬৪, এবং ২৪৫নং প্রশ্নের উত্তরে স্বীকার করেন। যে, তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন রাস্তায় ইটপাটকেল পড়ে থাকতে দেখেছেন। ২৪৬নং প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করছিলেন তখন তার কাছেই ইট-পাটকেল এসে পড়ে এবং ফলে তিনি দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করেন। যেসব চিকিৎসক সাক্ষ্য দিয়েছেন তারাও বলেছেন, তারা কর্তব্য পালনের জন্য মেডিকেল প্রাঙ্গণে ঢুকতে বা বেরিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা ইট-পাটকেল দেখেছেন। ৩৯নং সাক্ষী ড. জিল্লুর আহমেদ চৌধুরী, ৪০নং সাক্ষী ড. আবুল মাসুম খান মজলিস, ৪১ নং সাক্ষী ড. নবাব আলী, এবং সব পুরুষ সেবাকর্মী যেমন— ৪৬নং সাক্ষী মােহাম্মদ মিয়া, ৪৯নং সাক্ষী সেকান্দার আলী সবাই তাদের বিবৃতিতে ইট-পাটকেলের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমনটি করেছেন ৬৩নং সাক্ষী এখলাস উদ্দিন আহমেদ যিনি একজন ঠিকাদারের প্রতিনিধি। প্রদর্শিত ফটোগ্রাফগুলাে থেকেও এটা স্পষ্ট যে, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছিল এবং তা রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। সাধারণ জনগণের শ্রেণিতে পড়েন এমন সাক্ষ্যদাতা বাসচালক, চিকিৎসক এবং যানবাহনের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে চেয়েছেন তাদের (সাক্ষী নং ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪) সাক্ষ্য থেকেও এটা স্পষ্ট হয়। সম্ভবত এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য দিয়েছেন ২৪নং সাক্ষী ডা. এ. মুসা এ. হক, যিনি ঢাকার একজন প্র্যাকটিশনার। তিনি হলফ করে বলেন যে, রােগী দেখার উদ্দেশ্যে তিনি যখন গাড়িতে করে মেডিকেল কলেজ পার হয়েছেন তখন তাকে থামানাে হয়। তিনি জানান, সেই মােড়ে হঠাৎ করে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা বেড়ে যায় এবং তারা বিপজ্জনক জিনিসপত্র দ্বারা সজ্জিত ছিল। পুলিশকে লক্ষ করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা হচ্ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। এই চিকিৎসক একজন ভদ্রলােক। তাঁর বক্তব্য নিয়ে সন্দেহ করার কোনাে কারণ নেই। যদি তার বক্তব্য সত্য বলে গ্রহণ করা হয়, তাহলে অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে বিশেষত বেলা ২টায় মেডিকেল কলেজের গেটের সামনের পরিস্থিতি ছিল খুবই মারাত্মক।
২৭. জনাব গণি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, বাস্তবিকপক্ষে পুলিশ কর্তৃক গুলিবর্ষণের পূর্বেকার ঘটনাগুলােকে অতিরঞ্জিত করা হয়েছে এবং পুলিশ সদস্যগণ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন এই মর্মে দেয়া তাদের বিবৃতির ওপর সত্যের প্রলেপ দেয়ার জন্য বিক্ষোভকারীদের সংখ্যাকে বড় করে দেখানাে হয়েছে। যেমন পুলিশ সাক্ষীদের বিবৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল এলাকায় জনতার সংখ্যা ৪,০০০ কিংবা ৫,০০০-এর মতাে বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ উপাচার্যের বক্তব্য অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বমােট ছাত্র সংখ্যাই মাত্র ২,৫০০। দাবি করা হয়, যদি পুরাে ছাত্রসমাজ ও মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের বাসিন্দাদের সবাই অরাজকতায় অংশ নিতেন, তাহলেও পুলিশ প্রদত্ত সংখ্যার কম হতাে। এটিও দাবি করা হয়েছিল যে, মাত্র দুইজন বহিরাগত জনাব শামসুল হক এব অলি আহাদকে ঐ দিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখা গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, যেমন উপাচার্য, ড. জুবেরী এবং ড. গণির বিবৃতিতে প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় জনতার সংখ্যা প্রায় ১,০০০। জনাব গণি আরও বলেন যে, সমাবেশ শেষে আগত জনতার একটি বড় অংশ শান্তিপূর্ণভাবে স্থান ত্যাগ করে। ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত ক্রমশ হালকা হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যে তারা সমাবেশ স্থান ত্যাগ করে। এছাড়া এটাও বলা হয়েছিল যে, যে সকল ছাত্র-ছাত্রী ওই জায়গা থেকে চলে যেতে চেয়েছিল তাদের ব্যাপারে পুলিশ কোনাে আপত্তি তােলেনি এবং তাদেরকে চলে যেতে দিয়েছিল। কাজেই যদি বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তাদের প্রদত্ত ১,০০০ জনের হিসাব মােটামুটি সঠিক হয় এবং এর মধ্যে একটি উল্লেখযােগ্য সংখ্যক যদি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশস্থল ত্যাগ করে থাকে, তাহলে দুপুর ১.৪৫ টায় পুলিশ প্রদত্ত ৪,০০০-৫,০০০ সংখ্যাটি মেনে নেওয়া কঠিন। যা হােক, প্রকৃতপক্ষে এই যুক্তিটি তেমন গুরুত্ব বহন করে না। কারণ, পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করে ৩.২০ মিনিটে। এবং এটা সম্ভব যে, প্রকৃত গুলিবর্ষণ এবং সমাবেশের মধ্যবর্তী সময়ে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল। এমনকি যদি ২৮ নং সাক্ষী জনাব মােহাম্মদ কামালের বিবৃতি আমলে নেওয়া হয়, যা প্রকৃত ঘটনারই বর্ণনা বলে সত্য মনে হয় এবং ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি মূল রাস্তায় প্রবেশ না করেও মেডিকেল কলেজ কম্পাউন্ড থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকে পড়া ছাত্র এবং বহিরাগতদের জন্য কঠিন কিছু ছিল না। আর এই সুনির্দিষ্ট মুহূর্তে যে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বহিরাগত মানুষজন ছিল সেন বিষয়ে সাক্ষীদের বক্তব্য ও হতাহতের তালিকার মধ্যে বৈপরীত্য দেখা যায়।
২৮. উপাচার্য ছাত্রদের সম্পর্কে বলেন যে, পুলিশ টিয়ারগ্যাস ছোড়ার পর তারা উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। এটা সম্ভবত গুরুত্বহীন নয় যে ৫৫ নং সাক্ষী নাক, কান ও গলা বিভাগের সহকারী সার্জন আব্দুস সামাদ খান চৌধুরী সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি যখন ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে ছোড়া প্রথম টিয়ারগ্যাস বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান, তার পরপরই ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে পড়ে ও চিৎকার করতে থাকে। তিনি তখন রেসিডেন্ট সার্জনকে গােলযােগের আশঙ্কার কথা জানান। কেন তিনি গােলযােগের আশঙ্কা করেছিলেন এ প্রশ্নের জবাবে সাক্ষী তার ১৯৪৭ সালে কলকাতার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনি জানান, সেই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন উত্তেজিত ছাত্ররা যখন পুলিশের মুখােমুখি হয়, তখন সবসময়ই গােলযােগ ঘটে। আর ছাত্ররা আসলেই অনেক উত্তেজিত ছিল। তাই তার কলকাতার অভিজ্ঞতা আলােকে তিনি বিপুল হতাহতের আশঙ্কা করেন। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে, তিনি রেসিডিন্ট সার্জনকে ডাক্তারদের একটি তালিকা প্রস্তুত করতে বলেন যাতে সম্ভাব্য হতাহতের প্রবাহ তারা সামাল দিতে পারেন।
২৯. বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের উদাসীনতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং বিশ্ববিদ্যালয় গেইট বন্ধ রাখতে ব্যর্থ হয়। উপাচার্য বলেন, বহিরাগতদের সরিয়ে নেওয়ার যেকোনাে চেষ্টা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে ফেলত পারত এবং বহিরাগতদের সরাতে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পুলিশ ডেকে আনলে পরিস্থিতি আরাে জটিল হতে পারত। তার সহকর্মীরা তাকে এ ব্যাপারে সমর্থন করেন এবং তারাও বলেন যে, কোনাে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব ছিল না এবং কার্যত গেট বন্ধ করাও সম্ভব ছিল না। কেননা গেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল ছাত্ররা।
৩০. জনাব গণি অবশ্য এটা বলেছেন যে, প্রাথমিক পর্যায় থেকে পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দেয়নি এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা সেদিন গণ্ডগােলের কেন্দ্রবিন্দু হতে যচ্ছে বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে আরও অধিক সংখ্যক পুলিশ মােতায়েন বা পুলিশি টহল বেষ্টনী দিয়ে ঘেরাও করলে সম্ভবত এ পরিস্থিতিতে গুলিবর্ষণ এড়ানাে যেত। অবশ্য এটা খুব একটা সন্তোষজনক যুক্তি মনে হয় না। সংগত কারণেই কোনাে সুনির্দিষ্ট এলাকায় নয়, সারা শহরে সম্ভাব্য যেকোনাে গােলােযােগ সামাল দিতে পুলিশ বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। পুলিশ এই ব্যাপারটিও বিবেচনা করেছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সব পুলিশ সদস্যকে জড়াে করাতে গিয়ে সারা শহরকে অরক্ষিত রাখলে তা বিপর্যয় ডেকে আনার মতাে ঘটনা হতে পারত।
৩১. যা হােক, প্রকৃতপক্ষে এই তদন্তের বিষয়বস্তু নয়। বরং প্রমাণ করতে হবে,
২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩:২০ মিনিটে ঘটনাস্থলে মােতায়েনকৃত পুলিশদের নিয়ে।
গুলিবর্ষণ এড়ানাে যেত কি না।
৩২. পুলিশের সাক্ষ্য অনুযায়ী তাদের বক্তব্য হলাে, পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে এবং বেলা ৩টার মধ্যে তারা প্রচুর পরিমাণ টিয়ার গ্যাস— সর্বমােট ৩৯টি গ্যাস গ্রেনেড ও ৭২টি গ্যাস শেল ব্যবহার করলেও মেডিকেল কলেজের গেটে, চত্বর, রাস্তাজুড়ে ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে একত্রিত ও পুনঃএকত্রিত হতে থাকা জঙ্গি-জনতাকে মােকাবিলা করার মতাে অবস্থানে তারা ছিলেন না। এটা খুবই সুস্পষ্ট যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, মেডিকেল কলেজ চত্বর এবং হােস্টেল এলাকাকে ছাত্ররা তাদের অভয়ারণ্য হিসেবে নিয়েছিল, যেখান থেকে তারা একত্রিত হয়ে নিরাপদে পুলিশের ওপর ঝটিকা হামলা ও আক্রমণ করতে পারত। সম্ভবত এজন্যই যেসব শিক্ষার্থী সাক্ষ্য দিয়েছিল তারা সবাই দাবি করেছে যে, তারা রেলিংয়ের ভেতরে চত্বরে অবস্থান করছিল এবং শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে নিয়ােজিত ছিল।
৩৩. এই পর্যায়ে এসে ৩.২০ মিনিটে পুলিশ বাহিনীর অবস্থান ও জনতার ওপর গুলিবর্ষণের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে অফিসিয়াল সাক্ষীদের জবানবন্দি থেকে উদ্ধৃত করা যথার্থ হবে।
৩৪. জনাব ইদ্রিসকে তিনি যখন গুলিবর্ষণ শুরু করেন তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল :
প্রশ্ন-৭৫। এখন চূড়ান্ত লাঠিচার্জের বিষয়ে ফিরে আসা যায়। আপনি কি মহামান্য আদালতকে বলবেন, লাঠিচার্জের ফল কী হয়েছিল? উত্তর : লাঠিচার্জ পুরােপুরি বিফল হয়েছিল। ছত্রভঙ্গ হওয়া ও ইট-পাটকেল | ছােড়া বন্ধ করার পরিবর্তে তারা বৃষ্টির মতাে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে ধেয়ে আসছিল, প্রধানত দুই দিক থেকে।
প্রশ্ন-৭৬। দুই দিক থেকে আসা বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা কত ছিল বলে আপনার ধারণা? উত্তর : পাঁচ থেকে ছয় হাজার।
প্রশ্ন-৭৭। সে-সময় ঘটনাস্থলে মােতায়েনকৃত পুলিশের জনবল কেমন ছিল? উত্তর : সেখানে সে-সময় সশস্ত্র শাখার ৩ জন হেড কনস্টেবল, ৩০ জন কনস্টেবল; নিয়ন্ত্রণ শাখার ২ জন হেড কনস্টেবল এবং ১৪ জন কনস্টেবল এবং গ্যাস স্কোয়াডের ১ জন হেড কনস্টেবলসহ ১৪ জন কনস্টেবল; একজন ইন্সপেকটর এবং দুজন সার্জেন্ট ছিলেন।
প্রশ্ন-৭৮। আপনি বলছেন যে, যখন বিক্ষোভকারীরা এগিয়ে আসছিল, লাঠিচার্জ কোনাে প্রভাব ফেলতে পারেনি। আপনি মহামান্য আদালতকে কী বলবেন, সে সময় আপনি কী পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করছিলেন? উত্তর : জনতা বৃষ্টির মতাে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে এগিয়ে। আসছিল। আমাকে সশস্ত্র বাহিনীর কাছে আসতে হয় এবং তাদের অবস্থানে পাঠাতে হয়। যখন পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়ে যে, আমরা চারপাশ থেকে প্রায় ঘেরাওকৃত এবং নিরুপায় হয়ে পড়ছি, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ডি.এম. এবং ডি.আইজির সঙ্গে পরামর্শ করি। আমরা গুলি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই।
প্রশ্ন-৭৯। আপনি কি আদালতকে বলতে পারেন, আপনি কীভাবে গুলি চালিয়েছিলেন এবং কার নির্দেশে? উত্তর : আমার নির্দেশে গুলিবর্ষণ করা হয়। আমি আমার লােকদের ৫ জন করে এক-একটি দলে ভাগ করে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের কোনায় এবং মেডিকেল কলেজের হােস্টেলের পাশে অবস্থান নিতে বলি। আমি আমার উভয় দলের সদস্যদের এক রাউন্ড করে গুলি ছুঁড়তে আদেশ করি। তারা তা-ই করে। বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের নিকটে এবং মাঠের কোনায় অবস্থানরত জনতা পিছু হটে এবং আমি একজন লােকে সেখানে পড়ে যেতে দেখি। কিন্তু মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের পাশের জনস্রোত ক্ষণিকের জন্য পিছু হটলেও পুনরায় প্রচণ্ডভাবে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসছিল। আমি সেদিককার ৫ জনের দলকে একযোেগে গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দিলাম। বিশৃঙ্খল জনতাকে পিছু হটতে দেখার সাথে সাথেই আমি তাদের থামতে নির্দেশ দিলাম। আমি আদেশ করলাম, ‘গুলি থামাও এবং তারপর গােলাবারুদ পরীক্ষা করা হয় এবং দেখলাম যে সব মিলিয়ে ২৭ রাউন্ড গুলি বর্ষিত হয়েছে।
প্রশ্ন-৮০। গুলিবর্ষণ করার পূর্বে বিশৃঙ্খল জনতাকে কি কোনাে সতর্কতা দেয়া হয়েছিল? উত্তর : হ্যা, আমরা তাদের বার বার সতর্ক করেছিলাম।
প্রশ্ন-৮১। আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে : কে সতর্ক করেছিল? উত্তর : আমরা সবাই।
প্রশ্ন-৮২। সবাই বলতে আপনি কি বােঝাতে চাচ্ছেন? উত্তর : ডিআইজি, ডিএম এবং আমি নিজে সবাই তাদের সতর্ক করেছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত গুলিবর্ষণ করা হয়।
প্রশ্ন-৮৩। জনাব এইচ. রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে : আপনি কি গুলিবর্ষণের আনুমানিক সময় বলতে পারেন? উত্তর : প্রায় বেলা ৩টা।
-৮৪। গুলিবর্ষণের ফল কী ছিল? উত্তর : একজন ব্যক্তি লুটিয়ে পড়েছিল, সেটা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে।
প্রশ্ন-৮৫। আর কোনাে হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল? উত্তর : আমরা তা নিরূপণ করতে পারিনি।
প্রশ্ন-৮৬। কেন পারেননি? উত্তর : কারণ, বিক্ষোভরত জনতার আচরণ ছিল খুবই সহিংস। দাঙ্গাকারীদের মধ্যে থেকে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করার চেষ্টা করা হলে তুমুল গণ্ডগােল হতে পারত। সেই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে এটাই ছিল আমার পর্যবেক্ষণ। কেননা, গুলিবর্ষণের পরেও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ চলছিল।
প্রশ্ন-৮৭। আপনি বলেছেন দ্বিতীয়বার গুলিবর্ষণের পরেই দুষ্কৃতকারীরা পিছু হটেছিল এবং আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘গুলি থামাও। দুষ্কৃতিকারীরা যখন পিছু হটছিল, তখন কি আপনি রাস্তায় কোনাে আহত ব্যক্তিকে লক্ষ করেছেন? উত্তর : না।
প্রশ্ন-৮৮। যে ব্যক্তি নিহত হয়েছিল তার কী হয়েছিল? উত্তর : অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে সেই মরদেহ সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
প্রশ্ন ৮৯। কারা সরিয়ে ফেলেছিল? উত্তর : আমি ঠিক বলতে পারব না।
প্রশ্ন ৯০। কোন পরিস্থিতিতে আপনি গুলিবর্ষণ শুরু করেছেন আদালতকে সে ব্যাপারে জানিয়েছেন, আপনি কি এখন আদালতকে বলতে পারবেন, যদি আপনি গুলির আদেশ না দিতেন, তাহলে তার ফল কী হতাে? উত্তর : আমি যদি গুলি ছোড়ার আদেশ না দিতাম তাহলে পুরাে বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে যেত।
প্রশ্ন-৯১। তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনার এবং আপনার বাহিনীর নিরাপত্তার জন্য গুলিবর্ষণ আবশ্যক ছিল? উত্তর : সেটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। তা না হলে অনেক আগেই গুলিবর্ষণ শুরু হতে পারত। কেবল যখন আমরা পর্যদস্ত হয়ে পড়ছিলাম তখন। নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমরা গুলিবর্ষণ করি।
প্রশ্ন-৩০৫। এক কথায় যদি বলি, মি. ইন্দ্রিস, এটাই কি ঘটনা নয় যে, গুলিবর্ষণ করা বরং বাড়াবাড়ি ছিল এবং গুলিবর্ষণ করার মতাে জরুরি পরিস্থিতি তখন ছিল না? | উত্তর : গুলিবর্ষণ করা বাড়াবাড়ি ছিল না। গুলিবর্ষণ খুবই অপরিহার্য ছিল। যদি আমরা গুলিবর্ষণ না করতাম তাহলে হয়তাে আজ আমি এখানে সাক্ষ্য দিতে পারতাম না। আমার সামনে দুটি রাস্তা খােলা ছিল— হয় আমরা বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যাওয়া অথবা নিজেকে আক্রান্ত এবং খুন হয়ে যাওয়ার।
পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়া।
৩৫. জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও (সাক্ষী নং ২) একই রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হন—
প্রশ্ন-৫৯। আনুমানিক বেলা ৩টার সময় মােড়ের আশেপাশে জড়াে হওয়া জনতার সংখ্যা কত ছিল বলে আপনার ধারণা? উত্তর : জনতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, তাদের সংখ্যা অবশ্যই ৫০০০ হওয়ার কথা।
প্রশ্ন-৬০। সেখানকার পরিস্থিতি মােকাবেলা করার জন্য পুলিশ বাহিনীর কতটুকু শক্তি ছিল? সে ব্যাপারে আপনার কোনাে ধারণা ছিল? উত্তর : সেখানে মােতায়েনকৃত পুলিশ বাহিনীর মােট জনবল ছিল ৫০ জনতাদের কেউ অস্ত্র সজ্জিত, কেউ-বা টিয়ার গ্যাস সজ্জিত ছিল।
প্রশ্ন-৬১। দয়া করে আদালতকে বলুন, আপনি কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন? উত্তর : আমরা উচ্ছঙ্খল জনগণকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কয়েকজন পুলিশ সদস্য বিক্ষোভকারীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হন। তখনও আমরা যখনই সম্ভব অনবরত লাঠিচার্জের মাধ্যমে জনতাকে গেটের কাছ থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম এবং সেটা করতে গিয়ে পুলিশ পক্ষে হতাহতের ঘটনা বাড়তে থাকে। কিন্তু, এত লাঠিচার্জ করার পরেও তা বিক্ষোভকারীদের ওপর কোনাে প্রভাব ফেলতে পারেনি। বরং আমাদের পক্ষের হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছিল। টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করেও কোনাে ফল পাওয়া যায়নি। বরং একপর্যায়ে ইট-পাটকেল বৃষ্টি এত ভয়াবহ হয়ে পড়ে যে, পুলিশ বাহিনীকে দোকানগুলাের কাছে জড়াে করা হয় এবং ইট-পাটকেল ও নিক্ষিপ্ত অন্যান্য বস্তু থেকে তাদের সুরক্ষার জন্য দোকানগুলাের কাছে আশ্রয় নিতে হয়। বেলা ৩টার পরে এই ছিল ঘটনা। এতকিছুর পরেও জনতা থামেনি। যেখানে পুলিশ টহলরত ছিল তারা সেদিকে এগােতে থাকে। এবং আক্রমণ করার মতাে দুরত্বে পৌছে একযােগে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে।
প্রশ্ন-৬২। পুলিশ তখন কী পদক্ষেপ নেয়? উত্তর : তখন পরিস্থিতি এমন সঙ্গিন হয়েছিল যে পুলিশ বাহিনী আক্রান্ত হতে পারে। বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য সকল প্রকার চেষ্টা করা হয়েছিল। জনতার কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখার সব চেষ্টা আবারাে ব্যর্থ হয়। পরিস্থিতি নিয়ে ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল, পুলিশ সুপার ও আমি আলােচনা করি এবং আমরা দৃঢ় মত প্রকাশ করি যে, এখন গুলিবর্ষণ শুরু করা উচিত, তা হলে পুলিশ বাহিনী বিক্ষোভকারীদের দ্বারা যেকোনাে সময় আক্রান্ত হতে পারে। তখন বেলা প্রায় সােয়া তিনটা। আমরা আবার সিদ্ধান্ত নিলাম চূড়ান্ত লাঠিচার্জের মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দেয়ার একটা শেষ চেষ্টা করা উচিত। আমাদের লােকজন অগ্রসর হয়, কিন্তু লাঠিচার্জ ব্যর্থ হয়। কারণ, জনতার কাছাকাছি পৌছার আগেই আমরা প্রায় পাথর-বৃষ্টিতে নিক্ষিপ্ত হই এবং তখন রাস্তায় নিয়ােজিত পুলিশ বাহিনী নিজেদের চরম অসহায় পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করে। এই অবস্থা দেখে জনতা আবার জড়াে হতে থাকে এবং আরাে তুমুলভাবে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। এই পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য, আমার বিবেচনায়, জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা কিংবা পুলিশ বাহিনীকে আক্রান্ত হওয়া থেকে উদ্ধার করার জন্য গুলিবর্ষণ চাড়া অন্য কোনাে রাস্তা খােলা ছিল না। তখন এসপি আমার কাছে গুলিবর্ষণের অনুমতি চান এবং আমি তাকে গুলিবর্ষণের অনুমতি দিই।
প্রশ্ন-৬৩। কার নির্দেশে গুলিবর্ষণ শুরু হয়েছিল? উত্তর : আমার আদেশে (Order) ও এসপির নির্দেশে (Command)।
প্রশ্ন-৬৪। আপনি কি জানেন কোন দিক লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল? উত্তর : বিক্ষোভকারীদের দুই অংশের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল, যাদের একদল হাসপাতালের গেটের দিকে ও ক্রসিংয়ের সামনে এবং অপর অংশ মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের সামনের রাস্তা ও গেটের সামনে অবস্থান করছিল।
প্রশ্ন-৬৫। আপনি কি জানেন কত রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়েছিল? উত্তর : গুলিবর্ষণ শেষ হওয়ার পরে আমাকে বলা হয় যে সর্বমােট ২৭ রাউন্ড গুলি করা হয়েছিল। আমি এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে চাই যে, গুলি করার আদেশ দেওয়ার পর এক রাউন্ড চালানাের আগেই তা বন্ধ করা হয়, এটা দেখার জন্য যে, তা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট কি। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পুনরায় সামনে এগিয়ে আসছিল।
প্রশ্ন-৬৬। আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে : কার আদেশে গুলিবর্ষণ বন্ধ করা হয়েছিল? আপনার না এসপির? উত্তর : এসপির আদেশে বন্ধ করা হয়েছিল। তারপরও দুই এক রাউন্ড গুলি করা হয়েছিল। কিন্তু সব মিলিয়ে ২৭ রাউন্ড।
প্রশ্ন-৬৭। জনাব রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে : গুলিবর্ষণের আদেশ দেয়ার পূর্বে আপনি কি কোনাে সতর্ক সংকেত দিয়েছলেন? উত্তর : বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য এবং পুলিশের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আমি এবং অন্য পুলিশ অফিসাররা বারংবার সতর্ক সংকেত দিয়েছিলেন এবং বলা হয়েছিল, না সরে গেলে গুলিবর্ষণ করা হবে।
প্রশ্ন-৬৮। আপনি কি গুলিবর্ষণের ফলে কোনাে হতাহতের ঘটনা লক্ষ করেছিলেন? উত্তর : আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের কোনায় একটি ঘটনা লক্ষ করেছিলাম।
প্রশ্ন-৬৯। ওই মৃতদেহের কী ব্যবস্থা হয়েছিল? উত্তর : জনতার একাংশ দেহটি একটি ভ্যানে করে সরিয়ে নেয়, ভ্যানটি সেখানেই ছিল নাকি গুলিবর্ষণের পর অন্য কোথাও থেকে এসেছে। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।
প্রশ্ন-৭০। গুলিবর্ষণ শুরু হওয়ার পরে এবং গুলিবর্ষণ বন্ধের আদেশ দেওয়ার পরে আপনি কী করেছিলেন? উত্তর : [এই প্রশ্নের উত্তর মূল রিপাের্টে উল্লেখ করা হয়নি।]
প্রশ্ন-৭১। আপনি কি ঘটনাস্থলে ছিলেন, নাকি অন্য কোথাও গিয়েছিলেন? উত্তর : আমাদেরকে পরিষদ ভবনে পাঠনাে হয়েছিল এবং সেখানে গিয়েছিলাম।
প্রশ্ন ১৫৩। আপনি গুলি করার আদেশ দিয়েছিলেন কেন? ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য, নাকি পুলিশকে রক্ষা করার জন্য, নাকি উভয় কারণে? উত্তর : পুলিশ বাহিনীকে আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য আমি গুলিবর্ষণের আদেশ দিয়েছিলাম।
প্রশ্ন-১৫৪। তারা কি আক্রান্ত হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আপনার কাছ থেকে গুলি করার অনুমতি চেয়েছিল? উত্তর : আমি নিজে পুলিশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিলাম।
প্রশ্ন-৫৫। তারা কি আপনার কাছ থেকে গুলি করার আদেশ চেয়েছিল? উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন-১৫৬। আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে : কে আদেশ চেয়েছিল? উত্তর : এসপি আমাকে বলেন যে, পরিস্থিতি এতই ভয়াবহ যেকোনাে মুহূর্তে পুলিশ বাহিনী আক্রান্ত হতে পারে। আমার কাছেও পরিস্থিতি ঠিক যে রকম মনে হয়েছিল। তখন আমার মনে হয়েছে গুলি করার আদেশ দেওয়া উচিত।
৩৬. তারপর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশকে (সাক্ষী নং ৩) জেরা করা হয়—
প্রশ্ন-২০। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ কী পদক্ষেপ নিয়েছিল? উত্তর : বিকাল ৩টার দিকে যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, তখন চূড়ান্ত লাঠিচার্জের আদেশ দেয়া হয়।
প্রশ্ন-২১। লাঠিচার্জের ফল কী হয়েছিল? উত্তর : জনতা পিছু হটে। কিন্তু পুনরায় জড়াে হয় এবং ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে।
প্রশ্ন-২২। সেই সময় ঠিক কোন দিকে বা কোন জায়গায় বিক্ষুব্ধ জনতা জড়াে হয়েছিল? উত্তর : বিক্ষুব্ধ জনতা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল চত্বর ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে জড়াে হয়েছিল।
প্রশ্ন-২৩। এই বিক্ষুব্ধ জনতার সংখ্যা কত ছিল সে সম্পর্কে আপনার কোনাে ধারণা আছে? উত্তর : ৫ থেকে ৬ হাজার তাে ছিলই।
প্রশ্ন ২৪। লাঠিচার্জে কাজ হচ্ছে না দেখে আপনারা কি অন্য কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন? উত্তর : ততক্ষণে আমরা প্রায় ঘেরাও হয়ে যাই এবং মেডিকেল কলেজ গেটের পাশের দোকানের পিছনে আশ্রয় নিই। এসসি তার বাহিনী প্রস্তুত করেন এবং তারা ফায়ারিং পজিশন গ্রহণ করে। আমি নিজে বিক্ষুব্ধ জনতাকে সতর্ক করি যে, যদি তারা ইট-পাটকেল ছুঁড়ে পুলিশ বাহিনীকে আঘাত করা বন্ধ না করে তাহলে তাদের ওপর গুলি করা হবে।
প্রশ্ন-২৫। এতে কোনাে কাজ হয়েছিল? উত্তর : এতে কোনাে কাজ হয়নি। বিক্ষুব্ধ জনস্রোত ইট-পাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছিল।
প্রশ্ন-২৬। তখন আপনারা কি করলেন? উত্তর : এ সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও আমার পরামর্শ চূড়ান্ত সতর্কবার্তা দেয়ার পর এসপি গুলিবর্ষণের আদেশ দেন।
প্রশ্ন-২৭। কার আদেশ বা নির্দেশে গুলি করা হয়েছিল? উত্তর : পুলিশ সুপারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে গুলি করা হয়।
প্রশ্ন-২৮। আপনি কি মনে করেন, গুলিবর্ষণ যুক্তিসংগত ছিল? উত্তর : আমার মনে হয় তিনি যথার্থভাবেই গুলি করার আদেশ দিয়েছেন।
প্রশ্ন-২৯। সে সময় আপনি কোথায় ছিলেন? উত্তর : আমি তখন এসপি, ডিএম ও অন্য অফিসারদের সঙ্গে ছিলাম।
প্রশ্ন-৩০। কোন দিকে গুলি করা হয়েছিল? উত্তর : মেডিকেল কলেজ হােস্টেল ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের দিকে।
প্রশ্ন-৩১। রাস্তার ওপর ঠিক কোথায় গুলিবর্ষণকারী দল অবস্থান নিয়েছিল, সে ব্যাপারে আপনি মাননীয় আদালতকে ধারণা দিতে পারেন? উত্তর : তারা দোকানের সামনের কোন থেকে বিপরীতমুখী দুটি সারিতে দোকানের আড়ালে অবস্থান নিয়েছিল।
প্রশ্ন-৩২। ওই মুহূর্তে গুলিবর্ষণ করা আপনার কাছে জরুরি মনে হয়েছিল?
উত্তর : অতি জরুরি। অন্যথায় পুলিশ বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে যেত।।
৩৭. (সাক্ষী নং ০৪) সিটি ডিএসপি, যিনি জনতা-কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়েছিলেন,
তাকে প্রশ্ন করা হয়—
প্রশ্ন-৩০। আপনি কি জানেন, কী পরিমাণ টিয়ারগ্যাস ছোঁড়া হয়েছিল? উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এবং মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে বেশ কয়েকবার তিন থেকে চারবার টিয়ার গ্যাস ছোঁড়া হয়।
প্রশ্ন-৩১। এরপর কী ঘটেছিল? উত্তর : পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল, বিক্ষোভকারীরা চারদিক থেকে ধেয়ে আসছিল এবং বৃষ্টির মতাে ইট-পাটকেল ছোঁড়া হচ্ছিল এবং আমাদের আশ্রয় নেয়ার মতাে কোনাে জায়গা ছিল না এবং আমাদের অনেক পুলিশ অফিসার ও কনস্টেবল আহত হন; পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক ছিল যে ডিএম গুলি করার নির্দেশ দেন।
প্রশ্ন-৩২। কে গুলি নির্দেশ দেন? উত্তর : ডিএম।
প্রশ্ন-৩৩। গুলি কি করা হয়েছিল? উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন-৩৪। যখন গুলি করা হয় তখন সময় কত ছিল? উত্তর : প্রায় ৩.৩০ টা।
প্রশ্ন-৩৫। যখন গুলিবর্ষণ শুরু হয় তখন আপনি কোথায় ছিলেন? উত্তর : আমি মেডিকেল কলেজ গেট ও মেডিকেল কলেজ হােস্টেল গেটের মাঝামাঝি ছিলাম, দোকানগুলাের ঠিক সামনে।
প্রশ্ন-৩৬। দোকানের পিছনে নয়? উত্তর : দোকানের সামনের রাস্তায়।
প্রশ্ন-৩৭। আপনি কি জানেন, কোন্ দিকে গুলি করা হয়েছিল? উত্তর : সবদিক দিয়েই গুলি করা হয়। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে, অন্যদিকে মেডিকেল কলেজ হােস্টেল চত্বরে।
প্রশ্ন-৩৮। আপনি গােলাগুলির ফলে কোনাে হতাহতের ঘটনা লক্ষ করেছিলেন? উত্তর : আসলে, ঠিক বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের সামনে আমি একজনকে ঢলে পড়তে দেখেছিলাম; আর কাউকে হতাহত হতে দেখিনি।
প্রশ্ন-৩৯। গুলিবর্ষণের পর হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণের জন্য পুলিশ কোনাে পদক্ষেপ নিয়েছিল? উত্তর : জি, আমরা চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তখন কম্পাউন্ডের ভেতর ঢুকে। তা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
প্রশ্ন-৪০। আপনি কেন বলেছেন, এটা সম্ভব ছিল না? উত্তর : কারণ এমনকি গুলি করার পরেও ছাত্ররা হােস্টেল এবং মেডিকেল কলেজ কম্পাউন্ডে অবস্থান করছিল। তারা তখনও সেখানে ছিল এবং ইটপাটকেল ছুঁড়ছিল।
প্রশ্ন-১৩০। আপনি বলেছেন জনতাকে এরকম বিক্ষুব্ধ অবস্থায় পেয়েছেন আনুমানিক বেলা ৩.০০ টায়। কিন্তু এটা ঠিক কখন শুরু হয়েছিল? বেলা ২.০০টা, ১.০০ টা নাকি ১.৩০ টায়? উত্তর : ততক্ষণে তারা চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ফেলছিল। তার আগে আমরা টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করি এবং লাঠিচার্জ করি।
প্রশ্ন-১৩১। তারা কি একবার পিছু হটছিল আবার সামনে এগিয়ে আসছিল? উত্তর : জি।
প্রশ্ন-১৩২। আচ্ছা, আপনি যখন প্রথম এসেছেন, তখন তাদের ঠিক কোন জায়গায় পেয়েছিলেন? তারা কি আরও নিকটবর্তী হচ্ছিল? উত্তর : হ্যা, তারা ক্রমান্বয়ে আরও নিকটবর্তী হচ্ছিল। যখন আমরা লাঠিচার্জ করছিলাম ও টিয়ার গ্যাস চুড়ছিলাম, তখন তারা দৌড়ে পালাচ্ছিল। তারপর আবার জড়াে হয়ে সামনে এগিয়ে আসছিল।
প্রশ্ন-১৩৩। আপনি বলছেন এই বিক্ষুব্ধ জনতা একদিকে ৪০-৫০ ফুট আর অন্যদিকে ২৫-৩০ ফুট দূরে অবস্থান করছিল। আপনি আসার আগেও কি তারা একই অবস্থানে ছিল? উত্তর : তারা ক্রমান্বয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল।
প্রশ্ন-১৩৪। সেটা কতক্ষণ ধরে। ১০ মিনিট বা ১৫ মিনিট? উত্তর : তারা ক্রমান্বয়ে এদিকে আসছিল, ১০ মিনিট জন্য হতে পারে।
প্রশ্ন-১৩৫। তারা কখন ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে এবং আরও নিকটবর্তী হতে শুরু করে? উত্তর : প্রায় ৩.০০ টার সময়। সঠিক সমটা বলা সম্ভব নয়।।
প্রশ্ন-১৩৬। আপনার মতে গুলিবর্ষণ শুরু হয়েছিল ৩.৩০ টায়? উত্তর : ৩.১৫টা থেকে ৩.৩০ টার মধ্যে।
১৩৭। শেষবারের মতাে, লাঠিচার্জ হয়েছিল কখন? উত্তর : ৩.০০ টার আগে।
প্রশ্ন-১৩৮। সেটাই ছিল সর্বশেষ পদক্ষেপ, অর্থাৎ শেষবারের মতাে লাঠিচার্জ এবং তারপরই গুলি করা হয়। তার মানে শেষবার নির্বিচার লাঠিচার্জের পর গুলি চালানাে হয়েছিল? উত্তর : হঁ্যা গুলি চালানাে হয়েছিল।
৩৮. মাে. নুরউদ্দীন আহমেদ, এসডিও, সদর দক্ষিণ (সাক্ষী নং ৫)-এর জবানবন্দি ছিল নিম্নরূপ :
প্রশ্ন-২৯। আপনি যখন ফিরে আসেন, তখন সেখানকার পরিস্থিতি কেমন ছিল?
উত্তর : সেখানে আমি দেখতে পাই বিশাল সংখ্যক বিক্ষুব্ধ জনতা মেডিকেল কলেজ গেটের সামনে, বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের পাশে এবং সম্ভবত ফুলার রােডের দিকে যাওয়ার রাস্তায় জড়াে হয়েছে।
প্রশ্ন-৩০। সে সময় জনতার সংখ্যা কত ছিল বলে আপনার মনে হয়? উত্তর : চারপাশ থেকে আসতে থাকা জনতার সংখ্যা ৫০০০ হতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ মেডিকেল কলেজ গেট ও হাসপাতাল গেটের সামনে ছিল।
প্রশ্ন-৩১। আপনি কি লক্ষ করেছেন সেই মুহূর্তে জনগণের মনােভাব কী রকম ছিল? উত্তর : তারা খুব আক্রমণাত্মক ছিল এবং চারপাশ থেকে অবিরাম বৃষ্টির মতাে ইট-পাটকেল উড়ে আসছিল, বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের হােস্টেলের গেটের সামনে থেকে। এবং আমি দেখলাম অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। স্বয়ং এসপির কাঁধ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।
প্রশ্ন-৩২। আপনার মতে, ঐ সময় পুলিশ বাহিনীর অবস্থান কেমন ছিল? উত্তর : বিক্ষোভরত জনতা পুলিশ সদস্যদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিল। পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে ছিল এবং তাদের ভীত সন্ত্রস্ত লাগছিল। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল কিন্তু তারা কোনাে পদক্ষেপ নিতে পারছিলেন না। এই সময় তাদের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া হচ্ছিল এবং অনেকেই আহত হচ্ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে ডি.আই.জি., জেলা প্রশাসককে গুলি করার আদেশ দিতে বলেন। উপস্থিত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তখন লাঠিচার্জ করার আদেশ দেন।
প্রশ্ন-৩৩। তখন কি লাঠিচার্জ করা হয়েছিল? উত্তর : হ্যা, হয়েছিল।
প্রশ্ন-৩৪। এতে কি কোনাে কাজ হয়েছিল? উত্তর : দুই-তিন মিনিটের জন্য একটা তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা এক মুহুর্তের জন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং পরমুহূর্তেই আবার চারপাশ থেকে জড়াে হয়ে পুলিশের দিকে ধেয়ে আসছিল। পুলিশ সদস্যদের দিকে অবিরাম ইট-পাটকেল ছােড়া হচ্ছিল। পুরাে রাস্তা ইটের টুকরায় ভরে গিয়েছিল। আমি নিজে তখন একটা দোকানের পিছনে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
প্রশ্ন-৩৫। লাঠিচার্জের পরে পুলিশ কি আর কোনাে পদক্ষেপ নিয়েছিল? উত্তর : লাঠিচার্জের পরে যখন দেখা গেল পুলিশ সদস্যরা আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন, তখন বিক্ষোভকারীদের বার বার সতর্ক করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোনাে কাজ না হওয়ায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গুলি করার আদেশ দেন।
৩৮. মাে. নুরউদ্দীন আহমেদ, এসডিও, সদর দক্ষিণ (সাক্ষী নং ৫)-এর জবানবন্দি ছিল নিম্নরূপ :
প্রশ্ন-২৯। আপনি যখন ফিরে আসেন, তখন সেখানকার পরিস্থিতি কেমন
ছিল? উত্তর : সেখানে আমি দেখতে পাই বিশাল সংখ্যক বিক্ষুব্ধ জনতা মেডিকেল কলেজ গেটের সামনে, বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের পাশে এবং সম্ভবত ফুলার রােডের দিকে যাওয়ার রাস্তায় জড়াে হয়েছে।
প্রশ্ন-৩০। সে সময় জনতার সংখ্যা কত ছিল বলে আপনার মনে হয়? উত্তর : চারপাশ থেকে আসতে থাকা জনতার সংখ্যা ৫০০০ হতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ মেডিকেল কলেজ গেট ও হাসপাতাল গেটের সামনে ছিল।
প্রশ্ন-৩১। আপনি কি লক্ষ করেছেন সেই মুহূর্তে জনগণের মনােভাব কী রকম ছিল? উত্তর : তারা খুব আক্রমণাত্মক ছিল এবং চারপাশ থেকে অবিরাম বৃষ্টির মতাে ইট-পাটকেল উড়ে আসছিল, বিশেষ করে মেডিকেল কলেজের হােস্টেলের গেটের সামনে থেকে। এবং আমি দেখলাম অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। স্বয়ং এসপির কাঁধ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।
প্রশ্ন-৩২। আপনার মতে, ঐ সময় পুলিশ বাহিনীর অবস্থান কেমন ছিল? উত্তর : বিক্ষোভরত জনতা পুলিশ সদস্যদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছিল। পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে ছিল এবং তাদের ভীত সন্ত্রস্ত লাগছিল। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল কিন্তু তারা কোনাে পদক্ষেপ নিতে পারছিলেন না। এই সময় তাদের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া হচ্ছিল এবং অনেকেই আহত হচ্ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে ডি.আই.জি., জেলা প্রশাসককে গুলি করার আদেশ দিতে বলেন। উপস্থিত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তখন লাঠিচার্জ করার আদেশ দেন।
প্রশ্ন-৩৩। তখন কি লাঠিচার্জ করা হয়েছিল? উত্তর : হ্যা, হয়েছিল।
প্রশ্ন-৩৪। এতে কি কোনাে কাজ হয়েছিল? উত্তর : দুই-তিন মিনিটের জন্য একটা তাৎক্ষণিক প্রক্রিয়া হয়েছিল। বিক্ষোভকারীরা এক মুহুর্তের জন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং পরমুহূর্তেই আবার চারপাশ থেকে জড়াে হয়ে পুলিশের দিকে ধেয়ে আসছিল। পুলিশ সদস্যদের দিকে অবিরাম ইট-পাটকেল ছােড়া হচ্ছিল। পুরাে রাস্তা ইটের টুকরায় ভরে গিয়েছিল। আমি নিজে তখন একটা দোকানের পিছনে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
প্রশ্ন-৩৫। লাঠিচার্জের পরে পুলিশ কি আর কোনাে পদক্ষেপ নিয়েছিল? উত্তর : লাঠিচার্জের পরে যখন দেখা গেল পুলিশ সদস্যরা আক্রান্ত হতে যাচ্ছেন, তখন বিক্ষোভকারীদের বার বার সতর্ক করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতে কোনাে কাজ না হওয়ায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গুলি করার আদেশ দেন।
প্রশ্ন-৩৬। গুলি কি করা হয়েছিল? উত্তর : হ্যা।
প্রশ্ন-৩৭। কত রাউন্ড গুলি করা হয়েছিল এ ব্যাপারে আপনার কোনাে ধারণা আছে? উত্তর : ঘটনার একটু পরেই গণনা করা হয়, তাতে দেখা যায় মােট ২৭ রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়েছে। সতর্কবাণী এবং কয়েক রাউন্ড গুলি করার পর তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়, তা দেখার জন্য।
প্রশ্ন-৩৮। প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? উত্তর : প্রথম দফা গুলিতে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। লােকজন পুনরায় এগিয়ে এসেছিল এবং ইট-পাটকেল ছুঁড়ছিল। গুলি মূলত দুই দিকে করা হয়েছিল—মেডিকেল কলেজের হােস্টেলের দিকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের কোনায়।
প্রশ্ন-৩৯। আপনি কি লক্ষ করেছিলেন ঠিক কখন গুলি বন্ধ করা হয়? উত্তর : দ্বিতীয় দফায় গুলি করার ফলে লােকজন ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর গুলি বন্ধ করা হয়।
প্রশ্ন-৪০। আপনি কি গুলিতে কোনাে প্রকার হতাহতের ঘটনা লক্ষ করেছেন? উত্তর : আমি বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে একজনকে ঢলে পড়তে দেখি এবং মেডিকেল কলেজ হােস্টেল কম্পাউন্ডের ভিতরেও কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। সঠিক সংখ্যা আমি বলতে পারব না। কারণ ছাত্ররা এতই উত্তেজিত ছিল যে আমি সেদিকে যেতে সাহস করিনি।
৩৯. স্পেশাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ, গােয়েন্দা শাখা (সাক্ষী নং ৮), জনাব মাে. ইউসুফ তার জবানবন্দিতে বলেন—
প্রশ্ন-২৪। দয়া করে বলুন, আপনি যখন মেডিকেল কলেজ গেইটের সামনে ছিলেন, জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশ তখন কোন ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছিল? উত্তর : আমি যখন সেখানে যাই, তখন লাঠিসজ্জিত কিছু পুলিশকে সেখানে আনা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে জড়াে করা হয়। তারপর ডি.এম.এর আদেশক্রমে একবার লাঠিচার্জ করা হয়। আমি সেখানে ছাত্র ও অন্যান্য বিক্ষোভকারীদের দেখেছি। তারা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল চত্বরের দিকে কিছুটা পিছু হটে যায়। কিন্তু তুমুল ইট-পাটকেলের বৃষ্টি নিয়ে প্রতি আক্রমণ করে এবং পুলিশ বাহিনীকে ধাওয়া করে। বস্তুত পুলিশ বাহিনী এই আক্রমণের মুখে টিকতে পারেনি। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে ফিরে আসে। পুরােটা সময় ছাত্ররা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে পুলিশের দিকে এগিয়ে আসছিল। বাস্তবে সবদিক থেকেই ইট-পাটকেল উড়ে আসছিল, তবে বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ ও হােস্টেল চত্বর থেকেই বেশি আসছিল। ছাত্র ও বিক্ষোভকারীরা ঘটনাস্থলের আরাে কাছাকাছি এগিয়ে আসছিল। ছাত্ররা চারদিক থেকে আক্রমণ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ ও মেডিকেল হােস্টেলের দিকে থেকে তা অনেক শক্তিশালী ছিল। ছাত্র ও বিক্ষোভকারীরা চারদিক থেকে আস্তে আস্তে নিকটবর্তী হয়ে এক জায়গায় জড়াে হচ্ছিল। পরিস্থিতি খুবই নাজুক হয়ে পড়ে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গুলিবর্ষণের সিদ্ধান্ত নেন। অনেক পুলিশ সদস্য আহত হন। তাদের কেউ কেউ মাথায় আঘাত পান। আমি দেখতে পাই, ডি.আই.জি., এস.পি., ডি.এম.ও জনতার ইট-পাটকেলের মুখে পড়েন এবং আঘাতপ্রাপ্ত হন।
প্রশ্ন-২৫। গুলি কি করা হয়েছিল? উত্তর : হ্যা, তখন গুলি করা হয়।
প্রশ্ন-২৬। আনুমানিক কয়টার সময়? উত্তর : আনুমানিক বেলা ৩.১৫টা থেকে ৩.২০টার সময় হবে।
প্রশ্ন-২৭। কোন দিক থেকে গুলি করা হয়? উত্তর : দুইদিক লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। এক দল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আর অন্য দল হােস্টেল গেইটের দিকে লক্ষ্য করে গুলি করে।
প্রশ্ন-২৮। আপনি তখন ঘটনাস্থল থেকে কতটুকু দূরে ছিলেন? উত্তর : আমি তখন গুলিবর্ষণকারী দুই দলের মাঝখানে এবং মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের সামনে রাস্তার পাশের দোকানগুলাের পেছনে ছিলাম।
প্রশ্ন-২৯। আপনি কি জানেন, মােটামুটি কত রাউন্ড গুলি চালানাে হয় এবং গুলিবর্ষণ কতটা নিয়ন্ত্রিত ছিল? উত্তর : আমার মনে হয়, সব মিলিয়ে ২০-২৫ রাউন্ড গুলি চালানাে হয়। আমি আগেও বলেছি, দুইটি দল মিলে গুলি করে। প্রথম দফায় তারা মাত্র এক রাউন্ড গুলি করে এবং কয়েক মিনিট বিরতি নেয়।
প্রশ্ন-৩০। কেন? উত্তর : কারণ, প্রথম রাউন্ড গুলির পর বিক্ষোভকারীরা কিছুটা পিছু হটে যায় কিন্তু একটু পর তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে দ্রুত সামনে এগিয়ে আসে। ফলে এসপি দ্বিতীয় দফায় গুলির নির্দেশ দেন।
প্রশ্ন-৩১। আপনি কি গুলিতে কোনাে হতাহতের ঘটনা লক্ষ করেছিলেন? উত্তর : একজন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কোনাে হতাহতের ঘটনা আমি লক্ষ করিনি। মেডিকেল কলেজ হােস্টেল চত্বরে দু-তিনজন সহকর্মী তাকে নিজেদের বাহুতে জড়িয়ে সরিয়ে নেন। এটা ছিল গুলি বন্ধ হওয়ার কিছুক্ষণ পরের
ঘটনা।।
৪০. জনাব আবদুল গােফরান, তৎকালীন ওসি, লালবাগ (সাক্ষী নং-৯) তার জবানবন্দিতে বলেন।
প্রা-৩২। এবার বলুন বেলা ৩টা বা তার কিছুক্ষণ পূর্বে পরিস্থিতি কেমন ছিল? উত্তর : ছাত্ররা পুলিশকে লক্ষ করে মেডিকেল কলেজ হােস্টেল, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের ভেতর থেকে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে আরম্ভ করে। নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমাদের সবাইকে দুইবার দোকানগুলাের পূর্ব পাশে সেক্রেটারিয়েট রােডের পশ্চিম পাশে আশ্রয় নিতে হয় এবং ইট-পাটকেলের আঘাতে রেঞ্জে ডি.আই.জি. ও এস.পি.-সহ আমাদের অনেকে আহত হন।
প্রশ্ন-৩৩। আপনিও কি আহত হয়েছিলেন? উত্তর : না, সম্ভবত আমিই একমাত্র লােক যে আহত হয়নি।
প্রশ্ন-৩৪। ওই সময় পুলিশ কি কোনাে পদক্ষেপ নিয়েছিল? উত্তর : হঁ্যা, পুলিশ তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার জন্য বার বার টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং লাঠিচার্জ করে। কিন্তু তাদের মধ্যে পিছু হটার কোনাে লক্ষণ ছিল না। বরং তার আরও সহিংসভাবে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে এবং মেডিকেল কলেজ হােস্টেল, বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ ও মেডিকেল কলেজের দিক থেকে কর্তব্যরত পুলিশদের প্রায় ঘেরাও করে ফেলে।
প্রশ্ন-৩৫। তারপর কী ঘটেছিল? উত্তর : পরিস্থিতি পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বার বার সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়। তারপর তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে চূড়ান্ত লাঠিচার্জ করা হয়। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তাদের মধ্যে পিছু হটার কোনাে লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। বরং তারা ইটপাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে পুলিশের দিকে এগিয়ে আসছিল। নিজেদের রক্ষা করার কোনাে বিকল্প উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ গুলি করার আদেশ দেয়। আনুমানিক সাড়ে তিনটার সময় গুলি চালানাে হয়।
প্রশ্ন-৩৬। আপনি কি জানেন ঠিক কোন দিক লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছিল? উত্তর : মেডিকেল কলেজ গেইট ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ লক্ষ্য করে।
প্রশ্ন-৩৭। ওই মুহূর্তে আপনি কোথায় ছিলেন? উত্তর : আমি তখন মােড়ের দোকানগুলাের সামনে ছিলাম।
প্রশ্ন-৩৮। কয় দফা গুলি চালানাে হয়েছিল? উত্তর : দুই দফা।
প্রশ্ন-৩৯। আপনি গুলিবর্ষণের ফলে কাউকে হতাহত হতে দেখেছেন? উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের পাশে এক ব্যক্তিকে ঢলে পড়তে দেখেছি। তাৎক্ষণিকভাবেই একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
৪১. ১০ নং সাক্ষী, পুলিশ, ইন্সপেক্টর, মাে. মীর আশরাফুল হককে পরিস্থিতির ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়—
প্রশ্ন-১৫। তারপর কী ঘটেছিল? আপনি কী করেছেন? উত্তর : তখনও বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল ছুঁড়ছিল। আনুমানিক ৩.০০টার সময় একবার মারাত্মকভাবে লাঠিচার্জ করা হয়। কিন্তু তাতে কোনাে কাজ হয়নি। পিছু হটার পরিবর্তে তারা আরও তীব্রভাবে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে।
প্রশ্ন-১৬। তারপর? উত্তর : এই সময় ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, এসপি, আমি এবং অন্য পুলিশ অফিসাররা আহত হন। তখনও বৃষ্টি মতাে ইট-পাটকেল ছোড়া হচ্ছিল এবং পুলিশ সদস্যরা আহত হচ্ছিলেন।
প্রশ্ন-১৭। দয়া করে আমাদের বলুন, আপনার জানা মতে পুলিশ কি আরও কোনাে পদক্ষেপ নিয়েছিল? উত্তর : পুলিশ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটতাদের বার বার সতর্ক করে দেন কিন্তু তাতে কোনাে কাজ হয়নি। তখন এসপি গুলি করার আদেশ দেন। এটা আনুমানিক বেলা ৩.২০ টার দিকে হতে পারে।
প্রশ্ন-১৮। আপনি কি জানেন, কোন দিক লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছিল? উত্তর : প্রথম দফায় বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ এবং মেডিকেল কলেজ হােস্টেল লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। কিন্তু এক মুহূর্তে পরেই বিক্ষোভকারীরা দ্বিগুণ সহিংসভাবে পুলিশ সদস্যদের আক্রমণ করে।
প্রশ্ন-১৯। তারপর? উত্তর : দুই-তিন মিনিট পর মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের সামনে। বিক্ষোভকারীদের আবার গুলি করা হয়।
প্রশ্ন-২০। তাতে কোনাে ফল হয়েছিল? উত্তর : কিছু সময়ের জন্য বিরতি ঘটে কিন্তু একটু পরেই আবার ইটপাটকেল চলতে থাকে। |
প্রশ্ন-২১। গুলি করার পর কোন দিক থেকে ইট-পাটকেল ছােড়া হয়? উত্তর : মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের দিক থেকে এবং প্রধানত, তারা অ্যাসম্বেলি কর্নারের কাছে জড়াে হয়েছিল।
প্রশ্ন-২২। আপনি গুলিবর্ষণের ফলে কাউকে হতাহত হতে দেখেছেন? উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয় মাঠের কাছে একজন মানুষকে লুটিয়ে পড়তে দেখেছি।
প্রশ্ন-২৩। তারপর তার কী হয়েছিল? উত্তর : কিছু বিক্ষোভকারী তাকে সরিয়ে নিয়েছিল।
প্রশ্ন-২৪। কোথায়? উত্তর : একটা অ্যাম্বুলেন্সে।
প্রশ্ন-২৫। গুলিবর্ষণের ফলে কতজন হতাহত হয়েছে তা নির্ধারণের জন্য কোনাে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল? উত্তর : পরিস্থিতি তখনও বেশ উত্তপ্ত ছিল এবং ছাত্ররা ছিল উত্তেজিত। ফলে ওই সময় কোনাে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণ করতে গিয়ে হয়তাে হতাহতের সংখ্যা আরও বেড়ে যেত।
প্রশ্ন-৬৭। তার মানে আপনি সেখানে পৌছানাের সময় থেকে গুলিবর্ষণ পর্যন্ত এই ঘটনাগুলাে ঘটে চলছিল? উত্তর : আমি আসার পর এবং গুলিবর্ষণ শুরু হওয়ার আগে দুবার লাঠিচার্জও করা হয়েছিল।
প্রশ্ন-৬৮। আপনি কি বলতে চাচ্ছেন এই দুইবার লাঠিচার্জ করা ছাড়া সেখানে কোনাে ধরনের ইট-পাটকেল ছােড়ার ঘটনা ঘটেনি? উত্তর : পুরাে সময়টা বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল ছুঁড়ছিল। কিন্তু লাঠিচার্জের পর এটা আরও ভয়াবহ মাত্রা লাভ করে।
প্রশ্ন-৬৯। জেলা প্রশাসক, ডি.আই.জি., এস.সি., এ.এস.পি. সকলেই ইটপাটকেলের শিকার হচ্ছিলেন? উত্তর : জি স্যার।
প্রশ্ন-৭০। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যখন প্রকৃতপক্ষে গুলির আদেশ দিচ্ছেন তখন আপনি কোথায় ছিলেন? আপনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থেকে ঠিক কতটুকু দূরত্বে ছিলেন? উত্তর : আমি তা শুনিনি। আমি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে গুলি ছোড়ার আদেশ দিতে শুনিনি।
প্রশ্ন-৭১। যখন প্রকৃতপক্ষে গুলি করা হয় তখন আপনি কোথায় ছিলেন? উত্তর : আমি বাইরে ছিলাম। দোকনের সামনের রাস্তায় ছিলাম।
প্রশ্ন-৮২। কতক্ষণ ধরে গুলি চলছিল? উত্তর : প্রথম দফায় ১ মিনিট কিংবা ২ মিনিট গােলাগুলি হয়। মাঝে ২-৩ মিনিটের বিরতি ছিল। তবে এটি সম্ভবত ২ মিনিটের বেশি হবে না।
৪২. গুলিবর্ষণের দায়ভার অবশ্যই তিন পদস্থ কর্মকর্তা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট,
পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল ও পুলিশ সুপারিন্টেন্ডের ওপর বর্তায়। এ ব্যাপারে সমালােচনা করা হয়েছে, যে সমস্ত কনস্টেবল গুলি করেছিল তদন্তে তাদেরকে সাক্ষী হিসেবে জেরা করা হয়নি। যদি ঘটনা এমন হতাে যে আত্মরক্ষার জন্য তারা কোনাে আদেশ ছাড়াই বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি করেছে, তাহলে যেসব কনস্টেবল গুলি করেছে তাদের আত্মরক্ষার অধিকারের আশ্রয় গ্রহণ করা যৌক্তিক ছিল কি না, তা নির্ণয় করার জন্য তাদের সবাইকে জেরা করার প্রয়ােজন হতাে। যা-ই হােক, এই প্রশ্ন ওঠে। না। কারণ, এটা সুস্পষ্ট যে, কনস্টেবলরা আদেশ পেয়েই গুলি করেছিল। কিন্তু এখানে বিবেচ্য বিষয় হলাে যে কর্মকর্তা গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে তা ন্যায্য ছিল কি না?
৪৩. ২৮নং সাক্ষী (জনাব মােহাম্মদ কামাল এম.এ.) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন সাক্ষী। তিনি এই ঘটনার একমাত্র নিরপেক্ষ সাক্ষী, যিনি পুলিশের গুলিবর্ষণ প্রত্যক্ষ করেছেন। পুলিশ গুলি করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তিনি ঘটনাস্থলে পৌছান। এই সাক্ষী উল্লেখ করেন যে, তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে হাইকোর্টে ছিলেন। পরিষদ ভবনে জনৈক মৌলভি নজিবুল্লাহর সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি ২.৩০টায় হাইকোর্ট ত্যাগ করেন। তিনি ফুলার রােড দিয়ে। হেঁটে যাচ্ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিমে পাম্পিং স্টেশনের নিকটে এসে বিক্ষোভকারী দলের মধ্যে পড়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে একদল বিক্ষোভকারী সংগঠিত হচ্ছিল। তার মতে, তাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজারের কাছাকাছি। তারা স্লোগান দিচ্ছিল আর পুলিশের দিকে ইট পাটকেল ছুঁড়ছিল। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছিল। টিয়ার গ্যাস কিছুক্ষণের জন্য কার্যকর ছিল এবং বিক্ষোভকারীদের পিছু হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ শুরু করে। সাক্ষী আরও উল্লেখ করেন যে, তিনি ফুলার রােডে তার পূর্বের অবস্থানে দাড়িয়ে ছিলেন। কারণ, বিক্ষোভকারীদের পিছু হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ শুরু করে। সাক্ষী আরও উল্লেখ করেন যে, তিনি ফুলার রােডে তার পূর্বের অবস্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কারণ, বিক্ষোভকারীদের ভেতর দিয়ে রাস্তা পার হওয়া তার কাছে অসম্ভব মনে হয়েছিল। তিনি প্রকৃতপক্ষে পুলিশের গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন এবং পাম্পিং স্টেশনের কাছে এক ব্যক্তিকে মাথায় গুলিবিদ্ধ হতে দেখেন। এসব দেখে এই সাক্ষী দ্রুত দৌড়াতে শুরু করেন এবং নাজিমউদ্দিন রােড ধরে পালিয়ে বাঁচেন। তিনি হচ্ছেন দুইজন নন-অফিসিয়াল সাক্ষীদের একজন। যারা সুনির্দিষ্টভাবে গুলিবর্ষণের ব্যাপারে কথা বলেছেন। তিনি বলেন তিনি পাম্পিং স্টেশন থেকে ১০০ গজ দূরে বিক্ষোভকারীদেরও পেছনে ছিলেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই অনুমান সঠিক নয়। তিনি সম্ভবত স্টেশন থেকে ১০০ ফুট দূরত্বের কথা বলতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি তার গন্তব্য স্থান পরিষদ ভবনে যেতে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। যেমনটি তিনি ৭৪ ও ৭৫ নং প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করেন যে, তিনি রাস্তা পার হতে ভয় পাচ্ছিলেন। তার মনে হয়েছে, তাতে তার জীবন হুমকির মুখে পড়বে। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, তিনি পুলিশ কিংবা বিক্ষোভকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন। তার চোখের সামনেই পুলিশের গুলিতে পাম্পিং স্টেশনের পাশে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় একজন। বেলা ৩.০০ টার দিকে মেডিকেল কলেজ গেটের পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে পুলিশ সাক্ষীদের বর্ণনার সমর্থনে জনাব হামুদুর রহমান এই সাক্ষীর বিবৃতির ওপর নির্ভর করেন। পুলিশের প্রতি কোনাে রকম বাধ্যবাধকতাহীন একজন নিরপেক্ষ ভদ্রলােক হিসেবে তখনকার পরিস্থিতি পর্যালােচনার ক্ষেত্রে তার বক্তব্য মূল্যবান।
৪৪. যে সকল সাক্ষী পুলিশের গুলিবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, তাদের বক্তব্য বিশ্বাসযােগ্য নয়। এসব বিবৃতির অধিকাংশ তদন্তের উদ্দেশ্য সাধনে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে না। এটা সুস্পষ্ট যে, সব ধরনের অস্বস্তিকর ঘটনা ও পরিস্থিতি অস্বীকার করার ব্যাপারেই তারা সচেষ্ট ছিলেন। জনাব হামুদুর রহমান উল্লেখ করেন, তদন্তে তারা যেসব বিবৃতি দিয়েছেন সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের সড়ক, মেডিকেল কলেজের গেটে যেসব ঘটনা ঘটেছে সযত্নে সেগুলাে সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানার অভ্যন্তরে – যেটাকে তারা পুলিশের জন্য নিষিদ্ধ এলাকা মনে করেন— ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপারেও তারা একই রকম বিবৃতিদান করেন। পুলিশের গুলিবর্ষণ বন্ধ হওয়ার পর চত্বরের ভেতরে মাইক্রোফোন স্থাপন এবং সেগুলাে থেকে এই এলাকায় উত্তেজনামূলক বক্তব্য প্রচার—এসব বিষয়ও তারা এড়িয়ে গেছেন। ড. গণি বলেছেন, ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল এং তাদের নিজেদের স্বার্থে কম্পাউন্ডের বাইরে যা ঘটেছে তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা এবং গেটের অভ্যন্তরে কী ঘটেছে, তার মধ্যেই বিবৃতি সীমাবদ্ধ রাখাই মঙ্গলজনক হবে বলে মনে করেছে তারা। এই অবস্থানের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জনাব হামুদুর রহমান বলেন, এসব বিবৃতির ওপর নির্ভর করা যায় না। ছাত্ররা যদি রাস্তায় সংঘটিত ঘটনা উল্লেখ করতে এড়িয়ে যায় এবং সেদিনের সমাবেশে অংশগ্রহণকারী হিসেবে তাদের উপস্থিতি অস্বীকার করার চেষ্টা করে, তাহলে তাদের বক্তব্য পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুত্ববহ সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা উচিত হবে না। একজন সাক্ষী যখন তার ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য সত্য গােপন করে, তখন তার গ্রহণযােগ্যতা থাকে না।
৪৫. সাধারণ মানুষ যে সকল বিবৃতি দিয়েছেন তার মধ্যে দেওয়ান হারুন, মাে. মুনীরউদ্দিনের (৬৪ নং সাক্ষী) বক্তব্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি একমাত্র সাক্ষী যিনি প্রকৃতপক্ষে গুলি করতে দেখেছেন বলে দাবি করেছেন। এই সাক্ষী বলেন যে, তিনি জগন্নাথ কলেজের একজন ছাত্র। এবং তিনি স্বীকার করেন যে, সরকারি প্রজ্ঞাপনের জবাবে তিনি দুটি বিবৃতি দাখিল করেছেন। প্রথম বিবৃতিটি তিনি এই বলে শুরু করেন, তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি সকাল ১০.৩০ টায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসেন। সমবেত ছাত্রদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এম.এল.এ. এবং এম.সি.এদের তাদের দাবির কথা জানানাে। তার মানে, তিনি একটি বিবৃতিতে স্বীকার করেন যে, সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিবৃতিতে তার অবস্থান ছিল এ রকম“দেওয়ান হারুন মাে. মুনীরুদ্দিন ২৩-০৩-১৯৫২ ঢাকার জগন্নাথ কলেজের একজন ছাত্র, যিনি গুলিবর্ষণের সময় উপস্থিত ছিলেন এবং ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। যখন তদন্ত কমিটির সামনে আসেন তখন তিনি তার সুর পরিবর্তন করেন। এবং বলেন যে, তিনি সেদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি বরং চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহিঃবিভাগে যান। এবং ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ বিষয়ক ইতিপূর্বে দাখিলকৃত তার লিখিত বিবৃতি অস্বীকার করেন। তার উল্লিখিত সাক্ষীদের সম্বন্ধে তিনি বলেন যে, তিনি গােলাগুলি সম্বন্ধে কিছু জানেন কি না, সে ব্যাপারে তাদের সাথে কোনােকিছু আলােচনা করেননি এবং তিনি এই মর্মে এদেরকে সাক্ষী হিসেবে পরিগণিত করেন যে তারা ‘ভালাে সাক্ষী হতে পারে। এই ভিত্তিতে তিনি জনাব ফজলুল হক এবং জনাব শামসুদ্দিন এমনকি গােলাগুলির দিন চাঁদপুরে থাকা মতিউল ইসলাম (সাক্ষী নং ৫৬) এবং নােয়াখালীতে থাকা নূর মােহাম্মদকে (সাক্ষী নং ৫৭) যুক্ত করেন। এই সাক্ষীর দেওয়া সাক্ষ্য অনুযায়ী তিনি সত্যিই পুলিশকে মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের ভিতর ঢুকতে, হােস্টেলের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তায় অবস্থান নিতে এবং সেখান থেকে হােস্টেল চত্বরে গুলিবর্ষণ করতে দেখেছেন। যার ফলে কোনাে একটি হােস্টেলের বারান্দায় একজন লুটিয়ে পড়েন এবং ৭-৮ জন আহত হন।
প্রশ্ন-৫২। তারপর কী ঘটেছিল? উত্তর : প্রায় আধা ঘণ্টা বা তার কিছু পর কিছু পুলিশকে হােস্টেলের ভেতরে ঢুকতে এবং হােস্টেলের দিকে যাওয়ার রাস্তায় অবস্থান নিতে দেখি।
প্রশ্ন-৫৩। তারপর তারা কী করল? উত্তর : তারা লােকজনকে লক্ষ্য করে গুলি করে।
প্রশ্ন-৫৪। সেই সময় লােকজন কি করছিল? উত্তর : তারা হােস্টেল ও কলেজ চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিল।
প্রশ্ন-৫৫। আপনি তখন কোথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন? উত্তর : আমি মেডিকেল কলেজ চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
প্রশ্ন-৫৬। পুলিশ কতবার গুলিবর্ষণ করেছিল? উত্তর : আমি তা গুনে দেখিনি।
প্রশ্ন-৫৭। পুলিশের গুলিতে কি কেউ হতাহত হয়েছিল? উত্তর : যখন গােলাগুলি হয়েছিল তখন কেউ আহত হয়েছিল কি না, আমি তা দেখিনি। কিন্তু পরবর্তীসময় একজন লােককে বারান্দায় ঢলে পড়তে দেখেছি।
প্রশ্ন- ৫৮। তিনি কি মারা গিয়েছিলেন? উত্তর : জি স্যার।
প্রশ্ন-৫৯। আপনি একজনকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যেতে দেখেছেন, আপনি কি আর কাউকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছেন? উত্তর : কিছুক্ষণ পরে দেখেছি।
প্রশ্ন-৬০। আপনি আর কাউকে আহত হতে দেখেছেন? উত্তর : ৭-৮ জনকে দেখেছি।
প্রশ্ন-৬১। মৃত? উত্তর : মৃত নয়, আহত। লােকজন যখন তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন দেখেছি।
প্রশ্ন-৬২। আপনি কি হাসপাতালের ভেতরে গিয়েছিলেন? উত্তর : না, স্যার।
প্রশ্ন-৬৩। আপনি ৭-৮ জনকে হাসপাতালের নিয়ে যেতে দেখলেন, তারপর কী করলেন? উত্তর : এরপর আমি ইএনটি বিভাগের পেছনের ভাঙ্গা দেওয়াল দিয়ে দেওয়ানজি বাজারে রােডের দিকে যাই এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ পার হয়ে যাই।
প্রশ্ন-৬৪। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন? উত্তর : দেওয়ানজি বাজার ও নাজিমুদ্দিন রােড হয়ে আমি আগামাসি লেনে যাই এবং সেখান থেকে সরাসরি আমার বাসায় চলে যাই। আমি এই রকম একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন সাক্ষীকে সত্য সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই। এই ব্যাপারে কোনাে ইঙ্গিত দেয়া হয়নি যে সওয়াল-জওয়াবে তিনি বিবৃতি পরিবর্তন করেছেন এবং বলেছেন, তিনি আসলে একজন পুলিশ সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে জানতে পেরেছেন যে, পুলিশ কনস্টেবল মেডিকেল কলেজ চত্বরে অনুপ্রবেশ করেছেন এবং সেখান থেকে ছাত্র ও সমবেত জনতার উপর গুলিবর্ষণ করেছেন। বরং এটা বলা হয়েছিল যে, একজন কনস্টেবল মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের গেটের কোনায় অবস্থিত দ্বিতল দোকান ‘মাস্টার কেবিনের দিকে অগ্রসর হন এবং সেখান থেকে চত্বরে গুলিবর্ষণ করেন। পুলিশ কর্মকর্তাগণ এই বক্তব্য অস্বীকার করেন। বরং তারা দাবি করেন, কোনাে অবস্থাতেই তারা ব্যুহ ছিন্ন করেননি। এবং পুলিশ সুপারের নির্দেশ অনুযায়ী যেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখান থেকে গুলি করেছেন (দেখুন, সাক্ষী নং ১, প্রশ্ন নং ২৮১-২৮৪)।
প্রশ্ন-২৮১। আমি আপনার কাছে জানতে চাই যে আপনার কনস্টেবলরা দ্বিতল দোকানের কাভার নিয়ে ডান দিকের রাস্তার পাশে অবস্থান নিয়েছিল কি না এবং তারপর এগিয়ে এসে গুলিবর্ষণ করে চলে গিয়েছিল কিনা? উত্তর : আমার বাহিনী কখনও অবস্থান পরিবর্তন করেনি।
প্রশ্ন-২৮২। কিন্তু আপনাকে ইঙ্গিত করে এটা বলা হচ্ছে যে তারা অবস্থান। পরিবর্তন করেছিল এবং দোতলা হােটেলের কাভার নিয়েছিল? উত্তর : তারা আমার নির্দেশ অনুযায়ী অবস্থান নিয়েছে। এরপর তারা তাদের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চিও সরেনি।
প্রশ্ন-২৮৩। তারা কি এক জায়গা থেকেই একের পর এক গুলি করেছিল? উত্তর : না জনাব। তারা একে একে যায়নি এবং গুলিও করেনি।
প্রশ্ন-২৮৪। আপনার লােকেরা ছাত্রাবাস চত্বরে গুলি করেছিল? উত্তর : ছাত্রবাস চত্বরে গুলি যেতে পারে। কারণ হােস্টেলের অবস্থান ছিল মাত্র কয়েকশ গজ দূরে। ‘একই বিন্যাসে নির্মিত ১২ ও ২০নং হােস্টেলে গুলির চিহ্ন পাওয়া যাবে ১২নং হােস্টেলের পূর্বমুখী দেয়ালে দুটি, ২০নং হােস্টেলের পূর্বমুখী দেয়ালে একটি এবং ১২নং শেডের উত্তর পাশের দেয়ালে পিছলে যাওয়া একটি গুলির চিহ্ন। আমার মতে, এই চিহ্নগুলাে সুস্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে, পুলিশ সুপার বর্ণিত লাইনেই গুলি চালানাে হয়েছিল এবং পুলিশরা গুলিবর্ষণের সময় তাদের নির্দিষ্ট অবস্থান পরিবর্তন করেনি এবং অবশ্যই সেই উদ্দেশ্যে মেডিকেল কলেজ হােস্টেল চত্বরে প্রবেশ করেনি।
৪৬. জনাব গণির মতে, শুধু হােস্টেল কম্পাউন্ডে গুলির চিহ্ন পাওয়ার ঘটনাই পুলিশের এর দাবি নাকচ করে দেয় যে, তারা শুধু একদিকে রাস্তার ওপর এবং অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় খেয়াল মাঠের দিকে গুলি করেছিল। পুলিশ মেডিকেল কলেজ হােস্টেল কম্পউন্ডে গুলি করেছিল, এটাকে অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু বিবৃতিগুলাে থেকে এবং আমার ব্যক্তিগত অনুসন্ধান থেকে আমার কাছে এটি প্রতীয়মান হয় না যে, পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে হােস্টেল কম্পাউন্ডে ঢুকেছিল এবং চত্বরের রাস্তা থেকে গুলি করেছিল। বরং এ রকম হতে পারে যে, পুলিশ মেডিকেল কলেজ গেটের সামনে থেকে নেওয়া অবস্থান থেকে রাস্তার দিকে গুলি ছুঁড়েছিল, এবং এ কারণে কম্পাউন্ডের একটি অংশ পুলিশের গুলির আওতায় পড়ে গিয়েছিল।
৪৭. গুলিবর্ষণের ব্যাপারে এটা আরও একবার দাবি করা হয় যে, যে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশনায় মূল আদেশ দেওয়া হয়েছিল, তিনি ছিলেন একজন স্বল্প অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট যিনি ঐ ঘটনার মাত্র এক দিন আগে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং তাক্ষণাৎ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেছেন। এটা সত্য যে ম্যাজেস্ট্রেট হিসেবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অভিজ্ঞতা তুলনামূলকভাবে কম ছিল। কিন্তু, তদন্তের মাধ্যমে আমাদের কাছে এটা কোনােভাবেই প্রতীয়মান হয় না যে, জরুরি অবস্থার মুখােমুখি হয়ে তার মতিভ্রম হয়েছিল। অথবা তিনি ডিআইজি এবং এসপি কর্তৃক প্ররােচিত হয়ে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এসপির ব্যাপারে এটা বলা হচ্ছে যে, বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা পুলিশদের ওপর পাথর নিক্ষেপ করছিল এবং উপর্যুপরি ইট-পাটকেলের মুখে উত্তেজিত হয়ে তিনি গুলিবর্ষণ করেছেন। কিন্তু তিনি এই অভিযােগ অস্বীকার করেন এবং বলেন, তার সামনে উন্মুক্ত দুটি বিকল্প ব্যবস্থার কোনটিই গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। তার মুখােমুখি অবস্থানরত জনতার দিকে প্রচুর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছেন কিন্তু তাতে কোনাে কাজ হয়নি। তিনি সর্বশেষ যে চুড়ান্ত লাঠিচার্জ করেছেন, তা-ও ব্যর্থ হয়েছে। তিনি হয় তার বাহিনীকে | সরিয়ে নিয়ে মাঠটি বিক্ষোভকারীদের দখলে ছেড়ে দিতে পারতেন যাদের ঘোষিত লক্ষ্যই ছিল ১৪৪ ধারা বন্ধ করা, অথবা তিনি দাঁড়িয়ে থেকে তার বাহিনীতে আক্রান্ত হতে দেখতেন। কিন্তু একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে দুটি বিকল্পের কোনােটিই তিনি গ্রহণ করতে পারছিলেন না। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ ছিল তার প্রমাণ শুধু ডি.এম., ডি.আই.জি., এস.পি., ডি.এস.পি. ইট-পাটকেলে আহত হয়েছেন তা নয়, বরং বলা ৩.২০ নাগাদ নিয়ােজিত পুলিশ বাহিনীর সর্বমােট ৬০ সদস্যের মধ্যে ২৪ জনই আহত হয়ে পড়েন। ওই পরিস্থিতিতে পুলিশ সুপার যদি বিক্ষুব্ধ জনতার কাছে তার বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পর্যুদস্ত হওয়া থেকে বাঁচানাের জন্য গুলি করার আদেশ দিয়ে থাকেন, তবে আমি মনে করি না যে, এটি দৃশ্যত একতরফা তদন্তে উঠে আসা প্রায় অপরীক্ষিত বিবৃতিগুলাের ওপর নির্ভর করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে যে, গুলিবর্ষণ করার ব্যাপারে তার অবস্থান যৌক্তিক ছিল না।
৪৮. আমাকে এখন দেখতে হবে গুলিবর্ষণ বাড়াবাড়ি ছিল কিনা। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রথমে পুলিশ দুই পাশে অবস্থান নিয়েছিল এবং প্রত্যেক স্কোয়াড এক রাউন্ড করে গুলি করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠের পাশে একজন ব্যক্তি নিহত হয় এবং অবিলম্ব সেখানকার হৈহুল্লোড় থেমে যায়। অন্যদিকের উত্তেজনা, অর্থাৎ মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের পাশের বিক্ষোভটি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে কিন্তু, আবার তারা সামনে অগ্রসর হতে শুরু করে এবং পুলিশের দিকে তারা ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে। তাই জনতার সেই অংশের ওপর পুলিশ দ্বিতীয়বারের মতাে গুলিবর্ষণ করে। রেজিস্ট্রার খাতার তথ্য থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, সব মিলিয়ে ২৭ রাউন্ড গুলি করা হয়েছিল এবং ঐ ২৭ রাউন্ড গুলির কারণে ৯ জন হতাহত হয়, যাদের মধ্যে ৪ জন নিহত হয়— এসব বিবেচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না যে, পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করেছে। হতাহতের সংখ্যার সাথে কয় রাউন্ড গুলি ছোঁড়া হয়েছে তা মিলিয়ে আমি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি না যে, বাড়াবাড়ি রকম শক্তি প্রয়ােগ করা হয়েছে। গুলিবর্ষণ ছিল নিয়ন্ত্রিত এবং কার্যকর।
৪৯. মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেজিস্ট্রার দেখে আমি নিজে এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছি যে, তদন্তে আমার সামনে যা উপস্থাপন করা হয়েছে পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে হতাহতের সংখ্যা ঠিক তা-ই। এটা সত্য যে, রেজিস্ট্রারে দেখা গিয়েছে যে, টিয়ার গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে, লাঠিচার্জ খেয়ে কিংবা মাটিতে পড়ে গিয়ে একটা বড় সংখ্যক মানুষ হতাহত হয়েছেন। কিন্তু পুলিশ বেশি পরিমাণে গ্যাস গ্রেনেড ও শেল নিক্ষেপ করেছে এবং দুবার চুড়ান্ত লাঠিচার্জ করেছে— এসব মাথায় রাখলে তা অপ্রত্যাশিত মনে হবে না।।
৫০. আমি আমার বিস্ময় প্রকাশ না করে এই তদন্ত শেষ করতে পারছি না যে, আমি জানতে পেরেছি, পূর্ববঙ্গের পুলিশ বাহিনী স্টিলের হেলমেট দিয়ে সজ্জিত নয়। তাদের সম্বল অল্প কিছু প্রাচীন এআরপি হেলমেট। এটা অবিশ্বাস্য মনে হয়, যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়ােজিত একটি বাহিনীকে তাদের অভিযান পরিচালনা করতে হয় কাপড়ের টুপি পরে এবং ইট-পাথর বা অন্য কোনাে কিছুর বৃষ্টির মুখে বিপর্যস্ত হতে হয়। অথচ ঢাকায় বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আইন ভঙ্গকারীদের বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত থাকতে দেখা যায়। যদি জনাব ইদ্রিসের অধীনস্থ পুলিশ বাহিনী যথার্থভাবে অস্ত্রসজ্জিত থাকত, এটা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়, তাহলে এই তদন্তের উপলক্ষ কখনােই তৈরি হতাে না।
৫১. পরিশেষে, তদন্তকালে গৃহীত বিবৃতিগুলাে বিবেচনা করে আমাকে অবশ্যই এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় যে,
(১) পুলিশের পক্ষে গুলি করা অত্যাবশ্যক ছিল;
(২) পরিস্থিতির বিবেচনায় পুলিশ কর্তৃক শক্তি প্রয়ােগ করা যৌক্তিক ছিল।
৫২. এটা দুঃখজনক যে, নির্দিষ্ট কিছু সংস্থা ও সংগঠন তদন্তকালের সীমাবদ্ধতা
উল্লেখপূর্ব উক্ত তদন্ত বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি তারা এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতেন, তাহলে অফিসিয়াল সাক্ষীদের নিঃসন্দেহে আরও প্রজ্ঞাপূর্ণ এবং কার্যকর জেরার মুখােমুখি হতে হতাে। তাছাড়া পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগগুলাের ক্ষেত্রে আরাে ওয়াকিবহাল হতে পারলে আরাে কার্যকর সওয়াল-জবাব সম্ভব হতাে। যা-ই হােক, আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি জনাব হামুদুর রহমানের কাছে, যিনি আমাকে যােগ্য সহযােগিতা প্রদান করেছেন এবং তার মক্কেলদের মামলা উপস্থাপনার ক্ষেত্রে অসধারণ নিষ্ঠা ও সততার পরিচয় দিয়েছেন। ঋণ স্বীকার করছি জনাব আবদুল গণির কাছে, যিনি ভয়ানক প্রতিকূল পরিস্থিতি ও শত বাধা-বিপত্তির মুখেও তার সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমাকে অবশ্যই অভিনন্দন জানাতে হবে হাইকোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার জনাব এস আর ওসমানী বি.এল.কে. যিনি তদন্তকালে আমার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেছেন। স্মরণ করছি ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সিনিয়র প্রতিবেদক জনাব মােহব্বত আলীর অকুণ্ঠ কঠোর পরিশ্রম, যিনি তার সহকর্মীদের (মাে. লতিফুর রহমান, সৈয়দ বজলুর রহমান, আব্দুস সামান, আব্দুল মােহাইমেন এবং ওসমান আলী) নিয়ে সাক্ষীদের বিবৃতিগুলাের প্রতিলিপি তৈরি করার সশ্রম ও নিষ্ঠাসাধ্য কাজের পাশাপাশি এই প্রতিবেদন টাইপ করেছেন। স্মরণ করছি সচিবালয় কর্মী জনাব দীন মােহাম্মদ যিনি জনাব এ. আর. ওসমানীকে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সাচিবিক কাজে সহযােগিতা করেছেন।
টি.এইচ. এলিস

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!