আবুল মনসুর আহমদের অগ্রন্থিত প্রবন্ধ
পূর্ব পাকিস্তানের জবান
সংগ্রহ : ইমরান মাহফুজ
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা সুনির্দিষ্টভাবে ভারতীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক আদর্শে পরিণত হয়েছে। কোনাে কারণেই ভারতীয় মুসলমান আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে না।
ভিন্ন নেতৃত্বের বাস্তববাদী দূরদর্শিতার গুণে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে জাতীয়তার যে সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে, তাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা সুস্পষ্টভাবে স্বীকৃত ও সম্ভব হয়ে উঠেছে। কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত রূপায়ণের ভাবি রূপ নিয়ে মুসলিম-বাংলার চিন্তা নাগরিকদের মধ্যে এখন থেকেই আন্দোলন-আলােচনা খুব স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটি যে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা অভিনয় করছে, সে সম্বন্ধে বাংলার মুসলমান এমনকি তাঁদের শিক্ষিতাংশও, আজও পুরােপুরি সচেতন হয়নি। বিশেষত এই ‘সােসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণস্বরূপ আজাদ সম্পাদক মাওলানা আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং সহসম্পাদক মাওলানা মুজিবর রহমান খা পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাঙ্গিক রূপায়ণে যে ভবিষ্যদ্রষ্টার দায়িত্ব বহন করে যাচ্ছেন, তা ভবিষ্যৎ বাংলা একদিন শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে, এ সম্বন্ধে আমার মনে তিলমাত্রও সন্দেহ নেই। বস্তুত পাকিস্তানবাসীকে একটা নিছক রাজনৈতিক এমনকি নির্বাচনী স্লোগান থেকে একটা ইনটেলেকচুয়াল আইডিয়ালিজমে রূপান্তরিত করেছে প্রধানত এই দুই ব্যক্তির মনীষা। আমি একাধিকবার স্বীকার করেছি এবং আজও অসংকোচে স্বীকার করছি যে প্রধানত তাঁদেরই প্রেরণায় আমি পাকিস্তানের আদর্শবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। কায়েদ-ই-আযমের মনে যা-ই থাক, বাংলায় পাকিস্তানবাদ নিশ্চয় পার্লামেন্টারি কচকচিতে খেই হারিয়ে ফেলত, যদি না এই দুজন ব্যক্তি নানা বিপদ ও অপ্রীতি অগ্রাহ্য করে নিশিদিন কলম চালিয়ে পাকিস্তানবাদকে এই ইনটেলেকচুয়াল রূপ দিতেন এবং অনেক প্রতিশক্তিশালী লােকের অপ্রীতি ও অসন্তোষভাজন হয়েও চরম বিপদের মুহূর্তেও সে আদর্শবাদের ঝাণ্ডা উঁচু রাখতেন।
এই দুই ব্যক্তিই আমার নিতান্ত আপনার জন। তবু ওপরের কথাগুলাে মমাটেই ব্যক্তিগত প্রশংসার মতাে শােনাবে না এ জন্য যে তারা মুসলিম-বাংলার ইনটেলেকচুয়াল রূপায়ণে যে বিপুল দান করেছেন ও করছেন, তার তুলনায় আমার মন্তব্য অতিশয়ােক্তি তাে নয়ই, যথেষ্টও নয়।
কিন্তু আমার আজকের আলােচনার জন্য এটা নেহাত দরকারি। কারণ তাঁরা শুধু পাকিস্তান রেনেসা সােসাইটিরই জীবনস্বরূপ নন, পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র জাতীয় দৈনিক আজাদ-এর কাণ্ডারিও বটে।
আমার আজকের আলােচ্য বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের জবান। আমার মতাে লেখকেরা মুসলিম-বাংলার শিক্ষিতাংশের সঙ্গে কথা বলেছে কালে-ভদ্রে। আর তাঁরা তাঁদের কাছে কথা বলছেন। রােজ সকালে আমরা পাকিস্তান চাইনি বরং গােড়ার দিকে ব্যক্তিগতভাবে আমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধতা করেছি। কারণ আমাদের রাষ্ট্রাদর্শের স্বপ্ন ছিল অন্য রকমের। ফলে পাকিস্তানবাদের ইনটেলেকচুয়াল আকৃতির জন্য সব প্রশংসা তাঁদেরই প্রাপ্য। আমাদের তাতে কোনাে অংশ নেই। এমনকি আমার বিশ্বাস, বাংলার লীগের বড় বড় পার্লামেন্টারি নেতারও তাতে কোনাে অংশ নেই। গােটা প্রশংসা আজাদ-এর।
প্রশংসা যেমন তাদের, দায়িত্বও প্রধানত তাঁদেরই। এর কারণ আগেই বলেছি যে তারা রােজ দেশবাসীর সঙ্গে আছেন আরেক কারণ এই যে মুসলিম বাংলার শিক্ষিতগণের মনে, আসনে তাদের দোসর নেই।
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক রূপায়ণ নিয়ে যথেষ্ট না হলেও অনেক আলােচনাই তারা করেছেন। আমরাও সে আলােচনায় অংশগ্রহণ করেছি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা কী হবে, এ নিয়ে সােজাসুজি আলােচনা তারা আগে করেননি। করেননি বােধ হয় এ জন্য যে, পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক আজাদ বাংলা ভাষার কাগজ এবং তারাও তা-ই ধরে নিয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা যে বাংলা হবে, এ সভ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েই আছে।
হয়েই ছিল সত্য বাংলার মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা হবে কি উর্দু হবে—এ তর্ক খুব জোরেশােরেই একবার উঠেছিল। মুসলিম-বাংলার শক্তিশালী নেতাদের বেশির ভাগ উর্দুর দিকে জোর দিয়েছিলেন। নবাব আবদুর রহমান মরহুম, স্যার আবদুর রহিম, মাে, মনসুর হক, ডা. আবদুল্লাহ, সােহরাওয়ার্দী, মাওলানা আবুল কাসেম মরহুম প্রভৃতি প্রভাবশালী নেতা উর্দুকে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম-বাংলার সৌভাগ্য এই যে উর্দুপ্রীতি যাদের বেশি থাকার কথা, সেই আলেম সমাজই এই অপচেষ্টার বাধা দিয়েছিল। বাংলার আলেম সমাজের মাথার মণি মাওলানা মােহাম্মদ আকবর খাঁ, মাওলানা আবদুল্লাহেল বাকী, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী উর্দুবিরােধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁদের প্রয়াসে শক্তি জুগিয়েছিলেন মরহুম নবাব আলী চৌধুরী। সেই লড়াইয়ে তাঁরাই জয়লাভ করেছিলেন। বাংলার ওপর উর্দু চাপানাের সে চেষ্টা তখনকার মতাে ব্যর্থ হয়।
কিন্তু নির্মূল হয়নি। বাংলার বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে কলকাতায়, মাঝে মাঝে উর্দুর কনফারেন্স করে উর্দুওয়ালারা নিজেদের আন্দোলনকে জিইয়ে রেখেছিলেন। সম্প্রতি পাকিস্তান আন্দোলনের ফলে মুসলমানদের স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদ তাদের রাজনৈতিক আদর্শের বনিয়াদে পরিণত হওয়ায় উর্দুওয়ালারা আবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। সম্প্রতি মর্নিং নিউজ ও স্টার-অব-ইন্ডিয়া এ ব্যাপারে কলম ধরেছে। জনকতক প্রবন্ধ লেখকও তাতে জুটেছেন তাঁরা বলছেন : পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা স্বভাবতই উর্দু হবে।
মুসলিম লীগ মুসলমানদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান বলে অধিকাংশ মুসলমান দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে। বাংলায় লীগ-সমর্থক মুসলিম দৈনিক খবরের কাগজের মধ্যে একটি মাত্র বাংলা; দুটি ইংরেজি আর সব উর্দু। এই দুটি ইংরেজি কাগজও যদি উর্দুর এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তবু আমরা আশা করতে পারতাম যে এক আজাদই ওই দুটি ইংরেজি ও চার-পাঁচ উর্দু দৈনিকের প্রচারের মুখে দাঁড়াতে পারবে, যদি-না অন্য কতকগুলাে ব্যাপারও আমাদের মুখালেফ হতাে।
প্রথমত, ধরুন বাংলার নেতাদের কথা। লীগ মন্ত্রিসভাই বলুন, প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটিই বলুন, লীগ রিলিফ কমিটিই বলুন, মুসলিম চেম্বার অব কমার্সই বলুন, প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগের অ্যাডহক কমিটিই বলুন, নিখিল ভারতীয় যেকোনাে ব্যাপারে মুসলিম-বাংলার প্রতিনিধিত্বই বলুন, কলকাতা করপােরেশনের মেয়র, ডিপুটি মেয়রগিরির যােগ্য মুসলমান বাছাইয়ের ব্যাপারই বলুন, এসব ব্যাপারের যেকোনােটিতে আমরা যখন মুসলিম বাংলার বাছাই করা আধডজন নেতার নামের মােকাবিলা হই, তখন যাদের আমরা দেখি, তারা শুধু যে নিজেরাই বাংলা বলেন না তা নয়; লাটসাহেবের সামনে বরং বাংলায় মনােভাব প্রকাশের ভরসা করতে পারেন।
কিন্তু এই সব নেতার সামনে যে ভরসা নেই। সােজা কথায়, মুসলিম-বাংলার তকদিরের রাজমিস্ত্রি, ইঞ্জিনিয়ার এবং শুভ রসিয়ারেরা সবাই উর্দুভাষী।
তার বাদে ধরুন, বাংলার রাজধানী কলকাতার কথা। কলকাতা ভারতবর্ষের আন্তর্জাতিক শহর। এখানকার রাস্তার ভাষা উর্দু। এ শহরের বাংলা খবরের কাগজের সংখ্যার চেয়ে উর্দু-হিন্দি খবরের কাগজের সংখ্যা কম নয়। মুসলমানদের বেলা এটা আরও গুরুতর। অর্থাৎ কলকাতাবাসী অধিকাংশ মুসলমানের ঘরের ভাষাও উর্দু। তাঁদের বাংলা খবরের কাগজের চেয়ে উর্দু খবরের কাগজের সংখ্যা বেশি। তাহজিব, তমদুন ও শিক্ষাগত ব্যাপারে রাজধানীর প্রভাব দেশের জনসাধারণের ওপর কত বেশি, সেটা সবাই জানেন। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে মুসলিম-বাংলার ভাষাগত ভাগ্যনির্ণয়ের ব্যাপারে রাজধানীর প্রভাব বাংলা ভাষার মুখালেক।
এর সঙ্গে বিচার করতে হবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বর্তমান নেতা হিন্দু ভ্রাতৃগণের ভাবগতিক এবং বাংলার শিক্ষা বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তাদের শিক্ষানীতির কথা। বাংলার মুসলমানের জবানি বাংলা তাঁদের কাছে অস্পৃশ্য; মুসলমানদের নিত্য ব্যবহার্য শব্দ বাংলা সাহিত্যে অপাঙক্তেয়। হিন্দুর মন্দিরের মধ্যে তুর্কি টুপি পাওয়া গেলে যেমন হইচই লেগে যাবে বলে অনুমান করা যেতে পারে, বাংলা বইয়ে ‘আল্লাহ’, ‘খােদা’ ও ‘পানি দেখা গেলে হইচই তার চেয়ে কম শুরু হয় না। তাদের খুব জোরের কথা এবং সুস্পষ্ট অভিমত এই, বাংলা ভাষায় ‘ওসব আরবি-ফারসি শব্দ চলবে না। আমি পানি খাব’, ‘আমরা আল্লাহর এবাদত করি’– এটা তাদের মতে শুদ্ধ বাংলা নয়। পরীক্ষার কাগজে ওসব লিখলে। নম্বর কাটা যাবে। মুসলমানেরা ইচ্ছে করলে ওভাবে কথা বলতে পারে বটে, কিন্তু লেখার সময় শুদ্ধ বাংলায় লিখতে হবে আমি জল খাব;, আমরা ভগবানের উপাসনা করি। কাজেই দেখা যাচ্ছে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বর্তমান দিকপালদের মতে, মুসলমানদের মুখের ভাষা বাংলা নয়। এখানে বাংলা | বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা, বাংলা সাহিত্যের মুরব্বিরা উর্দুওয়ালাদের সঙ্গে একমত। কাজেই এ অবস্থাটাও উর্দুরই অনুকূল।
ওপরে যে চারটি অবস্থার বর্ণনা করা গেল, তার প্রতিটিই গুরুতর। আর চারটির সমবেত শক্তিতে নিশ্চয়ই গুরুতর। কিন্তু তাদের গুরুত্ব যে শেষ পর্যন্ত মুসলিম-বাংলার ভাব-নির্ধারণে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে, এটা আজও তেমন সুস্পষ্ট নয়। সুস্পষ্ট নয় বলেই বিপদ আরও বেশি। এরূপ ক্ষেত্রে বিপদ এমন হঠাৎ আসবে যে তখন ঠেকানাে দায় হবে। ঠেকানাে দায় হবে দুটি কারণে। যারা উর্দু প্রবর্তনের বিরােধী, তাঁদের মনােভাবটা উপেক্ষার মনােভাব। তাঁরা ভাবেন, ‘ওসব কিছু না। মুসলিম-বাংলার ওপর উর্দু চাপানাের চেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। ব্যর্থ হতে যে বাধ্য, সে সম্পর্কে দুই মত নেই। কিন্তু চেষ্টা যে হতে পারে এবং সে চেষ্টার অনুকূলে পরিবেশও যে চমৎকার, ওপরে আমি শুধু তারই উল্লেখ করেছি।
অপর যে কারণে উর্দু প্রবর্তনে অপচেষ্টা ঠেকানাে দায় হবে, তা এই যে কার্যত এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ লােকের সংখ্যা কম হবে না। তারা সমাজের চিন্তাহীন অংশ; যেকোনাে অবস্থায় আত্মসমর্পণ করার মতাে নির্বিরােধ তাদের প্রকৃতি। তাঁরা ভাবেন, হােক না উর্দু, দোষ কী তাতে? নিতান্ত তর্ক উঠলে তারা জবাব দেবেন, মুসলমান জনসাধারণের শতকরা ৯৫ জনই যখন নিরক্ষর, তখন তাদের উর্দু শেখানাে যা, বাংলা শেখানাের তা-ই বলা দরকার, এটা গুরুতর রকমের ভুল যুক্তি। একটু পরেই এই যুক্তির গলদ দেখানাে হবে।
পাকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটি মুসলিম-বাংলার ইনটেলেকচুয়াল মুভমেন্টের প্রতীক। এই সােসাইটি স্বভাবতই ওই বিপদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন। সােসাইটির একাধিক বৈঠকে এ সদস্যার আলােচনাও হয়েছে। হাজিরানে মজলিশের বিপুল মেজরিটি উর্দুর বিরুদ্ধে মত এজাহার করেছে। কিন্তু উর্দুর পক্ষে যাঁরা বলেছেন, তাঁদের সংখ্যা ও যুক্তিও নিতান্ত তুচ্ছ ছিল না। রেনেসাঁ সােসাইটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়, কাজেই তাতে ভােটাভুটিও হয় না; কোনাে জাবেদা প্রস্তাবও গৃহীত হয় না। এখানে যুক্তিতর্কের দ্বারা শুধু প্রচার করা হয়। এখানে মাইনরিটি মেজরিটির মতাে মেনে চলতে বাধ্য নয়। মেজরিটি পক্ষের যুক্তিতর্কের ফলে মাইনরিটি দলের কতকজন তাঁদের মতাে বদলিয়েছেন, তার ঠিকঠিক হিসাব ধরাও সম্ভব নয়। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে, মুসলিম-বাংলার চিন্তকদের মধ্যে যতই ছােট হােক এক দল রয়েছে, যারা উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা করার পক্ষপাতী।
এ থেকে নিশ্চয় এটা বােঝা উচিত হবে যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এমনকি তার আগে থেকেই, বাংলায় উর্দু অভিধান হওয়া মােটেই অবাস্তব কল্পনামাত্র নয়; এবং সে চেষ্টা হলে তাতে বাধা দেওয়াও খুব সহজ হবে না।
তবে কি সে চেষ্টা সফল হবে? তা-ও হবে না। হলে উর্দুর বিরুদ্ধে আমাদের কোনাে আপত্তিই হতাে না। কারণ বৈজ্ঞানিক মনে ভাষা সম্বন্ধে কোনাে কুসংস্কার নেই। মুক্তবুদ্ধির মানুষের কাছে ভাষায় ভাষায় পক্ষপাতিত্বের কোনাে ইতর-বিশেষ থাকা উচিতও নয়। ভাষার বিচার হবে শুধু বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে। ছাপাখানা, টাইপ-রাইটিং, টেলিগ্রাফ, পরিভাষা, আন্তর্জাতিকতা ও বর্ণমালার নিতিক বৈজ্ঞানিকতা প্রভৃতি আধুনিক গুণাবলির দ্বারা ভাষার ভালাে-মন্দের বিচার হতে পারে, অন্য কিছুতে নয়। কাজেই এসব গুণ-নির্বিশেষে এবং দোষগুণ-নিরপেক্ষভাবে উর্দুর বিপক্ষে বা বাংলার পক্ষে আমাদের মনে কোনাে পক্ষপাতিত্ব নেই।
ভাষা হিসেবে আমরা উর্দুর নিন্দুক নই। আমরা শুধু বাংলার ওপর উর্দু চাপানাের প্রয়াসের বিরােধী। আমাদের এ বিরােধের কারণ এই নয় যে বাংলা ভাষা ভাষা হিসেবে উর্দুর চেয়ে উৎকৃষ্ট সে তর্কই আমরা এখানে তুলব না। উর্দু প্রবর্তনের চেষ্টার বিরােধী আমরা অন্য কারণে। সে কারণগুলােই এই আলােচনায় আমি দেখানাের চেষ্টা করব।
সবচেয়ে বড় কারণ এই যে, কোনাে জাতির মাতৃভাষা বদলিয়ে এক ভাষা থেকে অপর ভাষায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এটা একেবারেই অসম্ভব সে জাতিতে, যে জাতির লােকসংখ্যা প্রায় চার কোটি। বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানের সংখ্যা তা-ই। তাদের সবাকে বাংলা ছাড়িয়ে উর্দু শেখানাের চেষ্টা পাগলামি মাত্র।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম