You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952 | প্রথম শহীদ মিনার- কর্নেল (অব.) ডা. এস. ডি. আহমদ - সংগ্রামের নোটবুক

প্রথম শহীদ মিনার
কর্নেল (অব.) ডা. এস. ডি. আহমদ

.. … ২৩ ফেব্রুয়ারি, ‘৫২। যেখানে গুলি হয়েছিল এবং মৃতদেহগুলাে পড়ে ছিল, আমরা তার নিকটেই (মেডিকেল ব্যারাক হােস্টেল এলাকায় এখন যেখানে হাসপাতালে বহির্বিভাগ) মৃতদেহগুলাে ছাড়াই স্মৃতি সৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেই। তখন আমাদের মধ্যে একজন মেধাবী ছাত্র ছিল। সে ভালাে আঁকতে পারত। গােলাম। মাওলা সাহেব বদরুলকে ডেকে পাঠান এবং বলেন ‘বদরুল একটা কাজ কর, স্মৃতি সৌধের একটা ডিজাইন (স্কেচ) একে নিয়ে আয়। বদরুল ঘণ্টাখানেক পরে প্রথম শহীদ মিনারের স্কেচ এঁকে নিয়ে আসে। আমরা ওটা দেখলাম। মাওলা ভাই, আমি আলীম চৌধুরী ও অন্য কয়েক জায়গায় সামান্য পরিবর্তন করে নিয়ে আসতে বলি। বদরুল আধ ঘণ্টা পরে ডিজাইনটা পরিবর্তন (modify) করে নিয়ে আসে এবং তা অনুমােদিত হয়।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গােলাম মাওলা সাহেব আমাদের সকলকে ডেকে বললেন, ‘স্মৃতি সৌধ তৈরি করতে হলে আমাদের এখনই কাজ শুরু করতে হবে। সেই সময়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবন তৈরির জন্য প্রচুর ইট, বালি, সিমেন্ট রাখা হয়েছিল। ব্যস আমরা কাজে গেলে গেলাম, আমরাই মজুর, রাজমিস্ত্রি, আমরাই জোগালি। সারারাত (২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২) খেটেখুটে সকালে (২৪ ফেব্রুয়ারি) শহীদ মিনারে নির্মাণ কাজ শেষ করলাম। কাজের উত্তেজনায় রাতে টের পাইনি, সকালে রুমে গিয়ে দেখি হাত মুঠ করতে পারি না। ঠাণ্ডায় জমে গেছে। কাঁচা অবস্থায়ই আমরা শহীদ মিনারের প্লাস্টার লাগিয়ে ফেলি এবং একটি ফটো তুলি। এই ফটোটি প্রফেসর আফজালুন্নেসার নিকট থাকতে পারে। তিনি মরহুম বদরুল আলমের স্ত্রী। সকাল থেকে দলে দলে লােক এসে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য স্মৃতি সৌধের বেদীমূলে পুষ্প অর্পণ করে। শহীদ মিনার সারাদিন (২৪ ফেব্রুয়ারি) রইল। ২৫ তারিখ সকালে সশস্ত্র পুলিশ মেডিকেল কলেজ এলাকা কর্ডন করে রেখেছে। আর ট্রাক ভর্তি সশস্ত্র পুলিশ আসছে। একটা ট্রাকে করে আনা হয়েছে একটা মস্ত বড় মােটা কাছি, বেলচা, শাবল, গাঁইতি ইত্যাদি। পুলিশ সদ্য তৈরি শহীদ মিনারের চারদিকে দীর্ঘ মােটা দড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে দড়ি ধরে টানতে থাকে সম্মিলিতভাবে। কাঁচা ছিল বিধায় শহীদ মিনার ভেঙ্গে পড়ে, অন্যথায় তিনভাগ বালু ও একভাগ সিমেন্ট দিয়ে তৈরি শহীদ মিনার ডিনামাইটের সাহায্য ব্যতীত ভাঙ্গা মনে হয় সম্ভব হতাে না। শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্তর পুলিশ গাইতির সাহায্যে তুলে ফেলে। ৭ ফুট গভীরে প্রােথিত ছিল ভিত্তি। সেটার তুলে পাশে রাখা মাটি দিয়ে গর্তটা ভরে দুরমুজ দিয়ে এলাকাটা সমান করে দেওয়া হয়। সূত্র: ভাষা সৈনিক ডা. গােলাম মাওলা স্মৃতিসংসদ কর্তৃক প্রকাশিত স্মরণিকা, ২৯ মে, ২০০৮।
… … নাটকেও মেডিকেল কলেজের নাম ছিল। বছরে তিনটি নাটক হতাে। একটা করত ছাত্ররা, একটা করত জুনিয়র অবস্থানের ডাক্তাররা, আর একটা হতাে সম্মিলিতভাবে আর এতে বাইরে থেকেও উৎসাহী দু’একজন অংশ নিতেন। যেমন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আর আই চৌধুরী প্রমুখ। তখনকার দিনে নাটকে ছেলেরাই মেয়ে সেজে নারী চরিত্রে অভিনয় করত। ডাক্তারদের নাটকে অবশ্য নার্সরা থাকত নারী চরিত্রগুলাে রূপায়ণে। আমিও কয়েকটা নাটকে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছি।
মঞ্চ নাটকের অনেক সামগ্রী, যেমন— ড্রপসিন, ঘরবাড়ি, বাগান, যুদ্ধের শিবিরের সিন, সাইড উইংস ইত্যাদি নিজেরাই বানিয়ে নিলাম। তার জন্য কাঠ কিনতে গেলাম নদীর ওপারে জিঞ্জিরা বাজারে, কাপ কিনতে ইসলামপুরে এবং অন্যসব সামগ্রীর জন্য ঢাকার চকবাজারের। আমাদের মধ্যে একজন ছিল অঙ্কন শিল্পে অত্যন্ত দক্ষ। এই এমেচার বা শৌখিন শিল্পী ছিল ১৯৪৭ ব্যাচের ছাত্র বদরুল আলম (পরবর্তীকালে শিশু রােগের প্রফেসর এবং বর্তমানে প্রয়াত) আমার অনুরােধে বদরুল আলম অনেক শ্রমে এবং বহু সময় ব্যয় করে কাপড়ের ওপর সব প্রয়ােজনীয় ছবি নিখুঁতভাবে এঁকে দিল।
… ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ আমরা সবাই হােস্টেলের মধ্যে আবদ্ধ। বাইরে যাওয়া যায় না, রাইফেল নিয়ে পুলিশ প্রহরায়। ভিতরে বসে স্থানে স্থানে জটলা করছি। এমনিভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল। ভিপি গােলাম মাওলা আর আমাকে ঘিরে পাঁচ নম্বর ব্যারাকের বারান্দায় ছাত্রদের আলােচনা চলেছে ঘটনাপ্রবাহের ওপর। এখন আর কী করা যায় তাই বলাবলি করছি সবাই। এমনি সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এল একটা প্রস্তাব। যুগান্তর আনয়নকারী এক ঐতিহাসিক প্রস্তাব! প্রস্তাবে বলা হলাে, আচ্ছা, শহীদদের লাশ আমরা নাই বা পেয়েছি, তাতে কী? শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমরা তাে আমাদের হােস্টেলের ভিতর একটা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ বানাতে পারি। আমরা সবাই একমত হয়ে বলে উঠলাম—উত্তম, অতি উত্তম প্রস্তাব।
মেডিকেল কলেজের নতুন বিল্ডিং তৈরি করার জন্য কলেজের হােস্টেল আর তার পাশে হাসপাতালের খালি জায়গাতে রাখা ছিল ইট আর বালির বিরাট স্তুপ। আর টিনের একটা ছাপরা ঘরের মধ্যে ছিল অনেক বস্তা সিমেন্ট। এগুলাের মালিক ছিল ঠিকাদার পিয়ারু সরদার। আমরা স্থির করলাম এই সমস্ত ইট, বালি, সিমেন্ট দিয়ে ওই রাতেই শহীদ মিনার তৈরি করব। মালিকের অনুমতির জন্য ভিপি গােলাম মাওলা দুজন আর চাবি নিয়ে ছাত্র দুজন ফিরে এল। তারা বলল, পিয়ারু সরদার বলেছে, ‘মিঞারা, তােমরা যা প্রয়ােজন তা নাও। কিন্তু প্রয়ােজনের অতিরিক্ত জিনিস যেন বিনা কারণে নষ্ট না হয়।
এখন, তৈরি করার আগে এর একটা নকশা চাই। আমাদের হােস্টেলের ছাত্রদের মধ্যে বদরুল আলম ছিল একজন ভালাে অঙ্কনবিদ। তাকে বলা হলাে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের একটা নকশা এঁকে দিতে। কে একজন বলল, ১৯৪৬ ব্যাচের সাঈদ ভাইয়েরও এ সম্পর্কে ভালাে আইডিয়া আছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা দুজন একটা নকশা এঁকে আনল। নকশা দেখে তার দুজায়গায় দুটো বাঁক আর পছন্দ করলাম না। এ দুটো রেখা আমরা একটু অন্য রকম করে আঁকতে বললাম। অল্পক্ষণের মধ্যে নকশায় সেই পরিবর্তনগুলাে করে আবার তারা নিয়ে এল। ভিপি মাওলা সাহেব এবং আমি বললাম, হ্যা, এবার বানানাে যায়।
শহীদ মিনার তৈরি শুরু হলাে। ভিপি আমাকে বললেন, আপনি তাে একজন ইঞ্জিনিয়ার, ড্রইং সম্পর্কে আপনার ট্রেনিং আছে। নকশা অনুযায়ী তৈরি হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব এবং কাজের সার্বিক পরিচালনার ভার রইল আপনার ওপর। মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে উপস্থিত প্রায় সব বাঙালি ছাত্রই পালাবদল করে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির কাজে অংশ নিল। আর আমাদের মধ্যে পনের-বিশ জনের একদল তাে সারারাত ধরেই কাজ করলাম।
কাছাকাছি এক মহল্লা থেকে একজন অভিজ্ঞ রাজমিস্ত্রি আনা হয়েছিল তার কাজের যন্ত্রপাতিসহ। সেই রাজমিস্ত্রির পরিচালনা অনুসারে আমরা ছাত্ররাই সব কাজ করলাম। ভিতের গর্ত খোঁড়া, ইট, বালি, সিমেন্ট বয়ে আনা, পানি আনা, বালি, সিমেন্ট মিশিয়ে পানি দিয়ে গুলে দেয়া, রাজমিস্ত্রির সঙ্গে সঙ্গে ইট গাঁথা ইত্যাদি যাবতীয় কাজ। তেইশ ফেব্রুয়ারির সেই রাতটা ছিল বেশ ঠাণ্ডা। ঝিরঝির করে হাওয়া চলছিল আর মাঝে মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। চব্বিশে ফেব্রুয়ারি ভাের হওয়া পর্যন্ত আমরা শহীদ মিনার তৈরির কাজ শেষ করলাম। শুধু মিনারের চূড়ান্ত এক ফুট খানিক অসমাপ্ত রইল। বলা হলাে, পরে ওইটুকু সমাপ্ত করা হবে। আমাদের হাতে তৈরি এই শহীদ মিনারের ভিত ছিল পাঁচ ফুট গভীর, পাদদেশ ছিল ছয় ফুট লম্বা, ছয় ফুট চওড়া, আর উচ্চতা এগার ফুট। সমস্ত রাত ঠাণ্ডার মধ্যে কাজ করে আমাদের অনেকেরই হাত ফুলে গিয়েছিল। আর কিছু ছেলের হাতে ফোস্কাও পড়েছিল।
চব্বিশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার উদ্বোধন করা হলাে। উদ্বোধন করলেন শহীদ শফিউয়ের শােকার্ত গর্বিত পিতা। তারপর শহীদ মিনার দেখার জন্য এবং ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মানুষের ঢল নামল, সর্বস্তরের নারী পুরুষ ফুলে ফুলে শহীদ মিনার চত্বর ছেয়ে গেল। এ রকম চলল তিন দিন ধরে। শহীদ মিনারে এলেন দৈনিক আজাদের সম্পাদক লেখক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। তাকে দিয়ে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলাম শহীদ মিনার। মানুষের স্রোত আসতে থাকল সমস্ত দিন ধরে।

সূত্র : প্রথম শহীদ মিনারের স্থপতি ডা: বদরুল আলম স্মারকগ্রন্থ