উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে
পূর্ণ এবং সর্বাঙ্গীন স্বাধীনতা না পেলে স্বাধীনতার সার্থকতা সামান্যই। সেরূপ স্বাধীনতা আমাদের পেতে হবে। এর অর্থ এই যে, ভাষাগত স্বাধীনতাও আমদের পাওয়া চাই। ভাষাগত স্বাধীনতা না পেলে বন্ধ-মুখ অবস্থাতেই স্বাধীনতা পাওয়া হবে। অতএব আমাদের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। পাকিস্তানের আট কোটি লােকের পাঁচ কোটি লােকে কথা বলে বাংলা ভাষায়। পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা বর্ধিষ্ণু, প্রগতিশীল এবং উন্নত ভাষা হচ্ছে বাংলা। অতএব আমাদের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না সে বিষয়ে কোনাে প্রশ্নই উঠতে পারে না।
তবু লক্ষ্য করেছি যে, কোনাে কোনাে লােকের ইচ্ছা উর্দু রাষ্ট্রভাষা হােক। পশ্চিম-পাকিস্তানের অধিবাসী বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে সামান্যই জানেন, অতএব তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলতে পাবেন। কিন্তু বাংলার লােক যে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলবেন এটা আশ্চর্যজনক।
এটা অসুস্থ মনােবৃত্তির পরিচায়ক এবং এরূপ মনােবৃত্তিকে সূচনায় নির্মূল করা কর্তব্য। স্বাধীনতার মর্ম যারা জানেন না, পাকিস্তানের ভাষাগুলাে সম্বন্ধে যাঁরা অজ্ঞ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি যাদের কিছুমাত্র দরদ নেই, এবং ভাষা-বিশেষকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করলে তার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ফল কি হতে পারে সে সম্বন্ধে যারা অজ্ঞ, একমাত্র তারাই বাংলাভাষী হয়েও অন্য ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলতে পারেন।
উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তার ফল কি রকম হবে, তা বিশেষভাবে বিবেচনা করে দেখা দরকার। আমাদের জাতির একটা বিলীয়মান যুগ থেকে আমরা এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।।
ইংরেজি রাষ্ট্রভাষা হওয়ার ফলে আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভাষা প্রভৃতির উপর ইংরেজির আধিপত্যের সীমা নেই। বর্তমান শতাব্দীর সূচনায়, এমন কি বােধ হয় এখনাে পল্লী-অঞ্চলের আনাচে-কানাচে ইংরেজি নাছারার জবান’রূপে। বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও এবং নাছারার জবান’ শিক্ষা হারাম বলে ফতওয়া থাকা সত্ত্বেও আমরা ইংরেজি বলতে পারলে কৃতার্থ জ্ঞান করি। কথায়-বার্তায় চিঠিপত্রে দৈনন্দিন জীবনের সর্বক্ষেত্রেই যথাসাধ্য এবং প্রাণপণে ইংরেজি ব্যবহার করে নেহাৎ না জানা থাকলে অন্তত অনাবশ্যক দু’একটা শব্দ ব্যবহার করে আমরা আত্মপ্রসাদ অনুভব করে থাকি।
যে-ভাষাকে নাছারার ভাষা বলে ঘৃণা করেছি, যে-ভাষা শিক্ষা হারাম জ্ঞান করেছি, সেই ভাষা আমাদের এরূপ দাস-মনােভাবের জন্ম দিতে পেরেছে। কিন্তু উর্দুর প্রতি আমাদের সেরূপ বিতৃষ্ণা নেই; এরূপ অবস্থায় উর্দু যদি রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হয়, তবে তার ফল বাংলাভাষীদের পক্ষে কিরূপ মারাত্মক হতে পারে তা বিশেষভাবে বিবেচ্য। রাষ্ট্রভাষা বলে আজ আমরা যেমন প্রাণপণে এবং যথাসাধ্য ইংরেজি বলার, ইংরেজি জানার এবং ইংরেজিতে লেখার চেষ্টা করি, অন্তত দু’একটা ইংরেজি শব্দ বলারও চেষ্টা করি, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলেও আমরা ঠিক তেমনি করব। বরং তার চেয়ে বেশি করব, কেননা ইংরেজির মতাে উর্দুর প্রতি আমরা বিতৃষ্ণা পােষণ করি না, এমনকি এ ভাষার প্রতি আমাদের বরাবরই একটা মােহ আছে। উর্দুভাষা লিখতে হয়ে যে বর্ণমালায়, তা কোরআনের ভাষা আরবীর বর্ণমালা; উর্দু শব্দকোষে আরবি ও ফারসি শব্দের বহুল সমাবেশ এবং উর্দুভাষায় গড়ে উঠেছে একটা সমৃদ্ধ ইসলামী সংস্কৃতিমূলক সাহিত্য। এইসব কারণে উর্দু বাংলার মুসলিম জনসাধারণের কাছে পবিত্র ভাষারই সামিল। উর্দু ভাষায় খােবা পর্যন্ত পঠিত হয় এবং সে খােতবার মূল্য তাদের কাছে আরবি খােতবার মূল্যের চেয়ে বােধ হয় কম নয়। শখ করে এবং বীরত্ব দেখাবার জন্যও অনেক সময়ে অসময়ে উর্দুজ্ঞান জাহির করে থাকেন। উর্দু রাষ্ট্রভাষা না হওয়া সত্ত্বেও উর্দুর এরূপ আধিপত্য। যদি উর্দু একবার রাষ্ট্রভাষা বলে ঘােষিত হয়, সকলের পক্ষে অবশ্যশিক্ষণীয়-ভাষা বলে গণ্য হয়, যদি রাষ্ট্রভাষিক মর্যাদাহেতু উত্তম উর্দু জানার প্রতিযােগিতা একবার আরম্ভ হয়, তবে অল্পদিনের মধ্যেই আমরা বাংলা ভালাে করে জানতে, বলতে ও লিখতে চাইব না: যেমন বর্তমানে বাংলা উত্তমরূপে শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করি না, যথাসাধ্য বাংলা বলি না, লিখি না।। মাতৃভাষা উত্তমরূপে জানা, বলা এবং লেখা যে গৌরবজনক তা ভাবতেই পারি না, কিন্তু ইংরেজি জানা, বলা ও লেখা গৌরবজনক তা সার্বজনীনভাবে মান্য করে চলি। বাংলা যে জানি তা ভুলে থাকতে চাই। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলেও আমরা তেমনি বাংলা ভুলে থাকতে চাইব এবং উত্তম উর্দু জানা, বলা ও লেখার জন্য পরস্পরের মধ্যে প্রতিযােগিতা শুরু করে দেব।
কিন্তু তার চেয়েও বড় বিপদ এই যে, একদিন আমরা হয়ত বাংলা ভাষাকেই ভুলে যাব। বাংলা যে বাস্তবিকপক্ষে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই ভাষা, একথা কেউ কেউ অস্বীকার করতে চান। তাঁরা বলতে চান যে, বাংলা সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত এবং সংস্কৃত হিন্দুর ভাষা, পৌত্তলিকতার ভাষা, পক্ষান্তরে উর্দু মুসলমানদের ভাষা, আরবি-ফারসির সঙ্গে এর সাদৃশ্য অতএব মুসলমানদের ভাষা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করতে হবে, হিন্দুর ভাষা বাংলা নেওয়া চলবে না। বাংলা ও উর্দুর প্রতি এরূপ মনােভাব নিয়ে কিছুদিন চললেই মাতৃভাষারূপে উর্দুকে গ্রহণ করা এবং বাংলাকে বর্জন করা আমরা কর্তব্য মনে করে বসব।
যারা বলেন যে, বাংলা হিন্দুর ভাষা এবং পৌত্তলিকতার ভাষা, মুসলমানদের ভাষা নয়, তাঁরা কেউ এই ভাষা সম্বন্ধে জ্ঞান রাখেন না। বাংলা ভাষার চর্চা করা গোঁড়া ব্রাহ্মণ একদিন রৌরব নরকের পথে প্রশস্ত করার উপায় বলে বর্ণনা করেছিলেন। সেদিন মুসলিম শাসকবর্গের পৃষ্ঠপােষকতার ফলেই বাংলা ভাষা সমৃদ্ধি এবং সম্মানের স্থান লাভ সম্ভব হয়েছিল। বাংলা ভাষা সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন নয়, কিন্তু সে কথা থাক। সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন বলেই যদি বাংলা মুসলমানদের ভাষা না হয়ে হিন্দুদের ভাষা হয়, তবে দুনিয়ার কোনাে মুসলমানকেই মুসলমান বলা চলে না, কেননা এমন একদিন ছিল, যেদিন তাদের কোনাে পূর্ব-পুরুষই মুসলমান ছিল না।
বাংলা হিন্দু ও মুসলমান উভয়েরই ভাষা এবং হিন্দু বাংলাভাষী অপেক্ষা মুসলিম বাংলাভাষীর সংখ্যা বেশি। বাংলা ভাষা পৌত্তলিকতারও ভাষা নয়, বাংলা একটা ভাষা মাত্র, যেমন আরবি ফারসি উর্দু বিভিন্ন ভাষা। কোনাে সচেতন খাঁটি মুসলমানের ভাষাই পৌত্তলিকতার প্রভাবযুক্ত নয়। এরূপ প্রভাব যদি বাংলা ভাষায় বেশি থেকে থেকে, তবে তার কারণ প্রধানত হিন্দুরাই বাংলা ভাষার চর্চা করেছেন, বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে মুসলমানদের অংশ অপ্রধান। মুসলমানেরা প্রধান অংশ নিলেই এই প্রভাব হ্রাস পেতে থাকবে, যেমন আরবি ও ফারসি ভাষার বেলায় ঘটেছে। আরবি ও ফারসি মূলত ছিল পৌত্তলিক জাতি ও সংস্কৃতির ভাষা, ইসলামের প্রভাবে এই ভাষা দুটি হলাে ইসলামী ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভাষা। মাত্রা এইটুকুই হলাে বাংলা ভাষার সঙ্গে আরবি, ও ফারসি ও উর্দুর পার্থক্য। বাংলা ইসলামীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার বাহন হতে পারেনি যেহেতু মুসলমানেরা একে সেভাবে গ্রহণ করেনি, এবং অপর তিনটি ভাষা মুসলমানদের দানে ও তাদের সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, তা নইলে এই ভাষাগুলাের মধ্যে উচ্চ-নিম্ন কোনাে ভেদ নেই, কোনাে ভাষাই কোনাে ভাষা থেকে পবিত্রতর বা অপবিত্রতর নয়।
পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসীরা আজ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। স্বাধীন হওয়ার ফলে তাদের শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতা দূর হবে, সাহিত্য-ক্ষেত্রে তারা দ্রুত অগ্রসর হবে এবং যেহেতু ঐ অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগুরু এই কারণে বাংলা সাহিত্য মুসলিম সংস্কৃতিরও বাহন হয়ে উঠবে। অতএব মুসলিম সংস্কৃতির ভাষাগত এলাকা পূর্বাপেক্ষা বিস্তৃততর হবে।
উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে তা হবে না। সাহিত্যেক্ষেত্রে আমরা বর্তমানে যেরূপ পশ্চাদপদ আছি, ভবিষ্যতে তার চেয়েও বেশি পশ্চাদপদ হয়ে পড়ব। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলা সাহিত্যের অপেক্ষা উর্দু সাহিত্যের পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং তার ফলে লেখক-সম্প্রদায় বাংলা অপেক্ষা উর্দুতেই সাহিত্য-চর্চায় অধিকতর মনােযােগী হবেন। ইংরেজি ভাষার পাঠকসংখ্যা বেশি হওয়ায় যদুনাথ সরকার সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত প্রমুখ লেখকগণ ইতিহাস দর্শন ইত্যাদি লিখলেন ইংরেজিতে। তার ফলে বাংলা সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হলাে। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলেও বাংলা সাহিত্য তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তারপর উর্দু আমাদের মাতৃভাষা নয়। অতএব আমরা যতই মনেপ্রাণ উর্দু সাহিত্যের চর্চা করি না কেন, উর্দুভাষীদের মতাে উৎকর্ষের অধিকারী আমরা কখনই হতে পারব না, আমরা চিরদিন পশ্চাদপদ হয়ে রইব। | পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা মনােনীত করার আগে এসব ফল চিন্তা করে দেখতে হবে। আরাে চিন্তা করে দেখতে হবে যে, একই রাষ্ট্রের অধিবাসী হওয়ার দরুন আমাদের নিবিড়ভাবে জানা পশ্চিম-পাকিস্তানের নাগরিকদের অবশ-কর্তব্য। তা যদি হয়, তবে আমাদের ভাষা শিক্ষা করা পশ্চিম-পাকিস্তানের নাগরিকদের অবশ্যকর্তব্য। বাংলা ভাষা যদি তাদের শিখতেই হয়, তবে সমগ্র পাকিস্তানের জন্য বাংলা-ভাষাকে রাষ্ট্রভাষারূপে মনােনীত না করার কোনােই কারণ নেই, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবেই, তাতে তা কোনাে প্রশ্নই উঠতে পারে না।
এ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য আমি অন্যত্র বলেছি। এখানে শুধু এটুকুই বলব যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা স্থির করার সময় ভাষাতাত্ত্বিকদের অভিমত নিতে হবে। একটা রাষ্ট্রের সব কাজই রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা হতে পারে না। রণনীতি নির্ধারণের জন্য যেমন রণবিশারদের অভিমত নেওয়া প্রয়ােজন, শিক্ষা-ব্যবস্থার জন্য যেমন শিক্ষাবিদের, অর্থনীতির জন্য যেমন অর্থনীতিবিদের, তেমনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা স্থির করার জন্য তাঁদের অভিমত নিতে হবে, যারা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা করেন। এ বিষয়ে শুধু রাজনীতিকদের অভিমত গ্রহণীয় হতে পারে না। সব বিষয়েই তারা বিশারদ নন।
সূত্র: ইত্তেহাদ, ২৭শে জুলাই ১৯৪৭