রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব
মাহবুব জামাল জাহেদী
পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে, ইহা লইয়া প্রচুর আলােচনা চলিতেছে। এই সমস্যাকে কেন্দ্র করিয়া যে সকল বিভিন্নমুখী চিন্তাধারার প্রকাশ হইতেছে, তাহা মুসলিম বাংলার জনগণের প্রাণিপ্রাচুর্যেরই প্রাণপ্রাচুর্যেরই পরিচয় বহন করে। আলােচনার আলােকেই প্রকৃত পথের সন্ধান পাওয়া যায়, সুতরাং এই তর্ক-বিতর্কে আশঙ্কিত হইবার কোনাে কারণ নেই। প্রধানত বাংলা ও উর্দুকে লইয়াই। এখন বিতর্কের উদ্ভব হইয়াছে। এবং প্রকৃতপক্ষে অন্য কোনাে ভাষা পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইতে পারে না। প্রত্যেক ভাষার সমর্থনেই অনেকে অনেক জোরালাে যুক্তিতর্ক উপস্থাপিত করিয়াছেন। এবং এই প্রসঙ্গে যে বিতর্কের সৃষ্টি করা হইয়াছে, তাহাতে উচ্ছাসও প্রচুর পরিমাণে আছে। কিন্তু প্রশ্নটি আদৌ উচ্ছাস-সাপেক্ষ নহে। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে প্রত্যেকটি ভাষার দাবি বিচার করিতে হইবে। এই জন্যই প্রথমেই রাষ্ট্রীয় ভাষার উপযােগী গুণাবলীর নির্ণয় প্রয়ােজন। নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত একটি ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষার আসন পাইবার উপযুক্ত বলিয়া মনে করা যাইতে পারে:
১. ভাষাভাষীর সংখ্যা মুষ্টিমেয় হইলে চলিবে না।
২. এই ভাষাভাষীর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন হইবে।
৩. এই ভাষার মাধ্যমে ইসলামের ভাবধারাকে ভাষাভাষীর মধ্যে পরিস্ফুট করিয়া তুলিতে হইবে।
৪. এই ভাষার ব্যাকরণ, বর্ণমালা ও লিপি জটিলতা-বর্জিত হইবে।
পাকিস্তানের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লােক বাংলা ভাষায় কথাবার্তা বলিয়া থাকে; সুতরাং উপরােক্ত আদর্শে বাংলার দাবিই অগ্রগণ্য। গণতান্ত্রিক যুগে যদি গভভােটে এই ভাষা সমস্যার সমাধানের প্রস্তাব উঠিত, তবে নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষাই হইত সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু এই প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর অবিচার করা হয়। রাষ্ট্রের একটি বিশিষ্ট অংশের সুবিধার্থে অন্য অংশে অসুবিধার সৃষ্টি করা কোনাে রাষ্ট্রেরই কাম্য নহে এবং হওয়া উচিত নহে। প্রাদেশিক রাষ্ট্রে প্রাদেশিক ভাষারই সর্বময় কর্তৃত্ব করা উচিত। অন্যান্য ছােটখাট ভাষা যথা, পশতু, সিন্ধি, পাঞ্জাবি প্রভৃতির রাষ্ট্রভাষারূপে পরিগণিত হইবার দাবিকে নিতান্তই জিন্ বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। এবং উর্দু ভাষাভাষীর সংখ্যাও বাংলার তুলনায় নিতান্তই স্বল্প। ইহা ব্যতীত উর্দু ভাষা বাংলার অধিকাংশ জনগণের নিকটই যে-কোনাে বিদেশী ভাষার ন্যায়ই দুর্বোধ্য ঠেকিতে বাধ্য। সুতরাং এইদিক হইতে বিচার করিলে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হইবার কোনাে দাবিই যুক্তিযুক্ত হয় না।
রাজনীতি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাভাষীর প্রতিপত্তি প্রাচীনকাল হইতেই প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। এই সৰ্বজনবিদিত প্রতিপত্তি দর্শনেই মহামতি গােখেলে বলিয়াছিলেন, What Bengal thinks today, India thinks tomorrow.
হৃত-গৌরব ফিরিয়া পাইবার জন্য বাংলার মুসলমান চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে; ইহার প্রভূত প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে। এই দিক হইতে বিচার করিলে কিছুকাল পূর্বে উর্দু ভাষার কোনাে দাবিই খাটিত না। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের অবস্থা বিপর্যয়ের সুযােগ গ্রহণ করিয়া ঐ ভাষাভাষীরা তাহাদের দাবিকে শক্ত করিয়া তুলিতেছে। কিন্তু নিরপেক্ষভাবে এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে ইংরেজি ভাষার দাবি অবশ্যই অগ্রগণ্য, কারণ এতদিন রাজনীতি ক্ষেত্রে ইংরাজিরই প্রাধান্য ছিল। তবে বৈদেশিক কোনাে ভাষাই পাকিস্তানের কোনও রাষ্ট্রেরই রাষ্ট্রীয় ভাষা হইতে পারে না। এই জন্য ইংরাজির দাবি মানিয়া লওয়া যায় না। সুতরাং উর্দুও যে প্রকৃতপক্ষে এই দেশীয় ভাষা এই কথাও বলা চলে না। উর্দু হইল তুর্কি শব্দ-মানে ‘শিবির। সৈন্যদের মধ্যে আলাপ-আলােচনার সুবিধার্থে সম্রাট আকবর এই ভাষার উদ্ভাবন করেন— শিবিরজাত বলিয়াই এই ভাষার এই নাম। সুতরাং দেখা যাইতেছে, উর্দু ভাষা প্রকৃতপক্ষে দেশের ভাষা নয়। বিভিন্ন দেশীয় শব্দভাণ্ডার হইতে চয়ন করিয়া এই ভাষার শব্দসম্ভার সমৃদ্ধিশালী করা হইয়াছে। স্বকীয়ত্ব বলিতে এই ভাষার কিছুই নাই। এই ভাষার দাবি অগ্রগণ্য হইতে পারে না।
আবার কেহ কেহ এই ভাষাকে মুসলমানি ভাষা হিসেবে দাঁড় করাইয়া ইহাকে রাষ্ট্রভাষারূপে চালাইতে চেষ্টা করিতেছেন। এই প্রচেষ্টা যে নিতান্তই ভাবপ্রবণতা, একথা কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। কারণ, প্রথমত মুসলমানী ভাষা বলিয়া কোনাে স্বতন্ত্র ভাষার অস্তিত্ব নাই। তাহা হইলে মুসলমানগণ যে ভাষায় কথাবলে সেই ভাষাকেই মুসলমানী ভাষা বলা যাইতে পারে। ইহা হইতে পারে, ইসলামের শিক্ষা, সংস্কৃতি যে ভাষার মাধ্যমে প্রকটিত হইয়া উঠিয়াছে তাহাকেই মুসলমানী ভাষা বলা চলে। কিন্তু এই ব্যাখ্যা মতে আরবি ভাষাকেই একমাত্র মুসলমানী ভাষা বলা যাইতে পারে। সুতরাং মুসলমানী ভাষা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইতে এই যুক্তি তাহার ফল কি হইবে, উহা সহজেই অনুমান করা যায়। তাহা হইলে দেখিতে পাই যে, ইসলামের ঐতিহ্যিক বাহনের দাবিতে রাষ্ট্রভাষা হইবার যােগ্যতা বাংলারও নাই, উর্দুরও নাই। তবে পূর্ব প্রদর্শিত কারণে উর্দু হইতে বাংলার দাবিই বেশি যুক্তিসঙ্গত।
দেখা যাইতেছে যে, ইসলামের ভাবধারাকে বাঙালির সাহায্য নিতেই হইবে। যে কিন্তু এই কথা অনস্বীকার্য যে, বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ইসলামিক ভাবধারা ও কৃষ্টির প্রচার করিতে হইরে বাংলা ভাষাই কার্যকরী হইবে বেশি। কারণ মাতৃভাষার সাহায্যে কোনাে কিছু শিক্ষা না দিয়া একটা নতুন ভাষা শিখাইয়া ঐ ভাষার সাহায্যে এই শিক্ষা দিতে যাওয়া বােকামি হইবে মাত্র। নতুন কোনাে ভাষা শিক্ষা করিতেই এখন আমাদের অন্ততপক্ষে ৮/১০ বৎসর সময় অতিক্রান্ত হইয়া যাইবে এবং ইতিমধ্যে এতদ্দেশীয় মুসলমানগণ স্বীয় ঐতিহ্যিক চেতনােপলব্ধির ক্ষেত্রে হইতে ব পিছনে পড়িয়া থাকিবে। তাছাড়া বাংলাভাষায় বহু পূর্ব হইতে আরবি ও ফারসি ভাবধারার চর্চা হইতেছে। প্রাচীন যুগে রচিত পুঁথিগুলাে ছিল এই বিষয়ের পুরােধা; বর্তমানেও বহু জ্ঞানী ব্যক্তিবর্গ নানা পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করিয়া এই প্রচার কার্য চালাইতেছেন। অবশ্য এই কথা স্বীকার না করিয়া উপায় নাই যে, এই প্রচারকার্য বাংলা ভষায় যথেষ্ট কম হইয়াছে। কিন্তু একদিন এইরূপ না হইয়া উপায় ছিল না। একেতাে আমাদের রাজভাষা ছিল বিজাতীয় ও বিধর্মীয়, তার উপর বাংলা ভাষার উপর কর্তৃত্ব করিত হিন্দুগণ; সুতরাং নিজ ইচ্ছামতাে প্রচারকার্য চালাইতে পারা যাইত না। এখন যদি আবার বাঙালির উপর উর্দু ভাষাভাষীদের কর্তৃত্বভার আনিয়া চালাইয়া দেওযা হয়, তবে উহাকে মরার উপর খাড়ার ঘা বই আর কিছুই বলা চলিবে না।
ইহা ব্যতীত ব্যাকরণের দিক দিয়াও উর্দু অপেক্ষা বাংলার দাবি যুক্তি সাপেক্ষ। প্রকৃত উর্দু অর্থাৎ সাহিত্যিক উর্দু অত্যন্ত জটিল। ক্রিয়াপদের লিঙ্গভেদ হইতে আরম্ভ করিয়া ব্যাকরণের অন্যান্য জটিলতা এত অধিক যে, স্বল্পায়াসে এই ভাষা শিক্ষা করা যায় না। পক্ষান্তরে বাংলা ভাষার জটিলতা উর্দু হইতে বহু অংশে কম। একথা অবশ্য ঠিক যে, বাংলা শিক্ষার্থীর পক্ষে র, ডু, ষ, স, শ, ন, ণ প্রভৃতির পার্থক্য সঠিক অনুধাবন করা কষ্টকর। কিন্তু ইদানীং ভাষাবিদগণ প্রাচীন বর্ণমালা, ব্যাকরণ ও বানান প্রথার আমূল পরিবর্তনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, যার ফলে আশা করা যায়, সুসংস্কৃতি হইয়া বাংলা ভাষা, বর্ণমালা, ব্যাকরণ ও বানানের দিক হইতে ইংরাজির ন্যায়ই সহজ এবং সকলের বােধগম্য হইবে। ইতিমধ্যেই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা বানান পদ্ধতির সংস্কার সাধন করা হইয়াছে, ফলে বানান এখন যথেষ্ট সহজ হইয়া গিয়াছে। অবশ্য এই প্রথা এখনও ব্যাপকভাবে সাহিত্য ও পাঠ্যপুস্তকে প্রচারিত হয় নাই। কিন্তু আবশ্যকবােধে প্রচলিত করিয়া লইতে বেশি দেরী হইবারও কোনাে কারণ নাই। অপর দিকে উর্দুর ব্যাকরণের জটিলতার কথা ছাড়িয়া দিলেও বর্ণমালাগত দুর্বোধ্যতাও উপেক্ষণীয় নয়। বে, ড়ে, দাল, যাল প্রভৃতি শব্দের বাছলতার দরুন প্রথম শিক্ষার্থীর পক্ষে উর্দু শিক্ষা দুরূহ হইয়া পড়ে। এবং এই সব দুর্বহ দুরূহতাকে সরল করিবার কোনাে প্রয়াসই অদ্যাবধি ঐ ভাষার পণ্ডিতগণ করেন নাই। উর্দু অর্থাৎ চলিত বাজারি উর্দুর ব্যকারণগত জটিলতা অপেক্ষাকৃত কম হইলেও ইহাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্থান দেওয়া যাইতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে উহা কোনাে ভাষাই নয়-বাংলা, হিন্দি, ইংরাজি প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষার শব্দাবলীর সমাহারে গঠিত এক আজব চিজ বলা যাইতে পারে। যে ভাষার কোনাে স্বকীয়ত্ব নাই, কোনাে সাহিত্য নাই, সে ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা জাতির বা দেশের পক্ষে কলঙ্কজনক বই কি। এমতাবস্থায় বাংলা ভাষার দাবির যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সন্দিহান হইবার কোনও কারণ নাই।
এখন প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হইলে পশ্চিম পাকিস্তান ও কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত এই রাষ্ট্রের যােগসূত্র কি প্রকারে স্থাপিত হইবে। এই প্রশ্নের উত্তর প্রধানত নির্ভর করে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর। কোনাে কোনাে বিষয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রসমূহের উপর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব থাকিবে সেই বিষয়টি পরিষ্কার হইলেও এই প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যাইবে। বর্তমান ব্যবস্থা মতে অর্থাৎ দেশরক্ষা, অর্থ বিভাগ এবং পররাষ্ট্র বিভাগের উপর যদি কেন্দ্রের সহিত দোভাষী অনুবাদকের সাহায্যে কাজ অনায়াসেই সমাধা করা যায়। বর্তমানে প্রাদেশিক সরকারের অনুবাদ বিভাগের মতাে একটি বিভাগ খুলিলেই সব গােলমাল চুকিয়া যাইবে এবং অন্যান্য প্রদেশের সহিতও এই উপায়েই যােগসূত্র অক্ষুন্ন রাখা যাইবে। শুধু যে বাংলা দেশের জন্যই কেন্দ্রীয় অফিসে অনুবাদকের দফতর বলিতে হইবে, এমন নয়। কেন্দ্রের রাষ্ট্রভাষা যে উন্নত উর্দু কিংবা বাংলা হইবে একথা অবধারিত। সুতরাং বিদেশী রাষ্ট্রের সহিত যে সংবাদ আদান-প্রদান করিতে হইবে, তাহার জন্যও অনুরূপ দফতরের প্রয়ােজন। হইবে। এবং হিন্দুস্তান রাষ্ট্রের মধ্যেও অনুরূপ ব্যাবস্থা করতে হইবে। কারণ হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে হিন্দি বা হিন্দুস্তানি।
আপাত দৃষ্টিতে আরও একটি বিষয়েও আমাদের অসুবিধা হইবে বলিয়া মনে হয়। সেটি হইল সৈন্য বিভাগে ভাবের আদান-প্রদান। পূর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীরা স্ব স্ব প্রদেশে স্বীয় প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষায়ই কথাবার্তা বলিতে পারিবে। কিন্তু যখন এই দুই প্রদেশের সেনাবাহিনী প্রয়ােজনানুসারে একত্রিত হইবে, তখনই অসুবিধা হইবে বেশি। পারস্পরিকভাবে আদান-প্রদান ছাড়াও আদেশ দেওয়া (command) লইয়াও অসুবিধা ভােগ করিতে হইবে মনে হয়। কারণ, বর্তমানে বিভিন্ন দেশীয় সেনানী লইয়া সেনাবাহিনী গঠিত হইলেও আদেশকার্য চালানাে হয় ইংরাজিতে। কিন্তু তখন ইংরাজি বর্জন করা হইবে। এই সমস্যা গুরুতর হইলেও অতি সহজেই ইহার সমাধান করা যায়। যদি আমরা আদেশ বিধিগুলাের (commandments) আরবি ভাষা প্রচলন করি, তবেই অসুবিধা নিরসন হয়। আরবিতে আদেশ দিলে উহা ইংরেজি হইতেও শক্তিশালী হইবে। কারণ আরবি ভাষায় যে ঝংকার, যে দ্যোতনা আছে, সে দ্যোতনা ও ঝংকার ইংরাজি ভাষায় নাই। দুই রাষ্ট্রের অধিবাসীগণ পরস্পরের সহযােগিতা করিলেই এই সমস্যা এবং অনুরূপ সকল সমস্যারই সমাধান সহজসাধ্য হইয়া যাইবে। নিজস্ব জিদ বজায় রাখিবার জন্য গোঁড়ামির আশ্রয় গ্রহণ করা কাপুরুষােচিত ব্যবহার বলিয়াই অভিহিত হইবে। পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য না থাকিলে কোনাে রাষ্ট্রেরই উন্নতি বিধান সম্ভবপর হইবে না, একথা সুনিশ্চিত।
৪প্রথম প্রথম অসুবিধা হইবেই, কিন্তু ধীরে ধীরে যখন জনসাধারণ এবং কর্মীগণ নূতন পরিবেশের সহিত নিজকে খাপ খাওয়াইয়া লইতে পারিবেন, তখন কোনাে অসুবিধাই বােধ করিতে হইবে না।
পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুগণ পূর্ববঙ্গ হইতে দ্বিধা-বিভক্ত হইয়া গিয়া যেমন স্বীয় সত্তা বিসর্জন দিল, পূর্ববঙ্গের মুসলমানগণও অনুরূপ অবস্থার সম্মুখীন হইবে, যদি উর্দুকেই সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। হিন্দুস্তানের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দুস্তানি হইবে, ইহা নিশ্চিত এবং তাহা হইলে বাংলা সাহিত্যে পশ্চিমবঙ্গের যা দান তাহাও নিঃশেষ লােপ পাইবে। তাহাদের সংস্কৃতি, তাহাদের আভিজাত্য সকলই খর্ব হইয়া যাইবে। পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা ইহাই হইবে। যদি রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হয়, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলার মুসলমানগণ কখনই ইহা ঘটিতে দিবে না…।
উর্দুও আমরা শিখিব আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের শিক্ষা-সংস্কৃতি জানিতে হইবে বলিয়া। কিন্তু তাহাদিগকেও বাংলা শিক্ষা করিতে হইবে, নতুবা তাঁহারা একদেশদর্শিতার পরিচয় প্রদান করিবেন।
সূত্র: ইত্তেহাদ, ২০ জুলাই ১৯৪৭