You dont have javascript enabled! Please enable it!

 ভাষা আন্দোলনকারীর সাক্ষকার
প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম

প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোনের একজন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তাঁর উদ্যোগে এবং নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাতকারী সংগঠন ‘পাকিস্তান তমদুন মজলিশ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি প্রকাশ করেন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সম্বলিত প্রথম পুস্তিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের তরুণ অধ্যাপক। তাঁর নিরবচ্ছিন্ন চেষ্টায় ১৯৪৭ সালে যে সূচনা হয় ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে, তা গণআন্দোলনে পরিণত হয়। তিনি ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক সৈনিক’-এরও প্রতিষ্ঠাতা। ভাষা আন্দোলনে তাঁর ব্যতিক্রমী ভূমিকা তাঁকে বিরল ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
জনাব আবুল কাসেম ১৯২০ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ থানার ছেবন্দী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মতিয়র রহমান। তিনি চট্টগ্রামের বরমা হাই স্কুল থেকে ১৯৩৯ সালে প্রথম বিভাগে তিনটি লেটারসহ ম্যাট্রিক পাস করেন ও বৃত্তি লাভ করেন। ১৯৪১ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই. এস-সি, ১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি. এস-সি (অনার্স) এবং ১৯৪৫ সালে এম. এসসি পাস করেন।
১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে কার্যরত ছিলেন। পরবর্তীকালে কিছুকাল চট্টগ্রাম নৈশ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে কার্যকরী করার লক্ষ্যে ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকায় বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কলেজে তিনি বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলা কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। ১৯৮২ সাল হতে তিনি অবসর জীবনযাপন করেন। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ১৯৫৪-৫৬ সাল পর্যন্ত খেলাফতে রব্বানী পার্টি ও যুক্তফ্রন্টের মনােনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন।
জনাব কাসেম বাংলা একাডেমি, পূর্ব-পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড প্রভৃতি বহু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি উচ্চতর শ্রেণীর জন্য প্রয়ােজনীয় ৩৬টি বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং ইসলামী সাহিত্যসহ বহু গ্রন্থের প্রণেতা। তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থগুলাে হলাে— ‘একুশ দফার রূপায়ন’, ‘আধুনিক চিন্তাধারা’, ‘সাহিত্য ও দর্শন’, ‘সংগঠন’, ‘মুক্তি কোন পথে’, ইসলাম কি দিয়েছে ও কি দিতে পারে’, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু, একমাত্র পথ’, ‘বিবর্তনবাদ’, ‘শ্রেণী, সংগ্রাম’, ‘শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি’, ‘ইসলামী রাষ্ট্রনীতি’, ‘বিজ্ঞান বস্তুবাদ ও আল্লাহর অস্তিত্ব’, ‘কোরানিক অর্থনীতি’, ‘আমাদের ভাষার রূপ প্রভৃতি। ব্যক্তি জীবনে তিনি সহজ, সরল, সদালাপী এবং বিনয়ী। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের এ সাক্ষাৎকার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনায় নির্ভরযােগ্য ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে তথ্য ও উপকরণ যােগাবে বলে আমরা আশা করি।
প্রশ্ন : কিভাবে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে? দেশ বিভাগের পর রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত চিন্তা ভাবনা ও পরিবেশ কেমন ছিল?
উত্তর : ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ‘তমদুন মজলিশের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সনের আগস্ট মাসের পর পরই ১ সেপ্টেম্বর-এ আমারই উদ্যোগে এবং প্রচেষ্টায় ১৯ নম্বর আজিমপুর-এ ‘পাকিস্তান তমদুন মজলিশ’ নামে এ বিপ্লবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং ১৯ নম্বর আজিমপুরে থাকি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার কথা আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকি, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার কথা আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকি, এ বিষয়ে আমি প্রথমে আলাপ করি বন্ধুবর অধ্যাপক এ, কে, এম, আহসানের সঙ্গে (পরবর্তীকালে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য)। তিনিও আমার সঙ্গে ১৯ নম্বর আজিমপুর-এর বাসায় থাকতেন। এরপর এ বিষয়ে আলােচনা করি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের তখনকার ছাত্র সৈয়দ নজরুল ইসলাম (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট) ও শামসুল আলমের (পরবর্তীকালে বিশিষ্ট সরকারি কর্মচারী) সঙ্গে। ১ সেপ্টেম্বর তমদুন মজলিশের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও শামসুল আলম প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। পরে আজিজ আহমদ (মরহুম), অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া, নঈমুদ্দীন, সানাউল্লাহ নূরী প্রমুখ তমদুন মজলিশে যােগ দেন।
দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হতে পারে কিনা এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার মতাে খুব কম লােকই ছিল। শুধু তাই নয়, অনেকে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে উর্দুর সমর্থক ছিলেন। তার ঐতিহাসিক কারণও ছিল। অখণ্ড ভারতে বর্ণহিন্দুরা কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার মাধ্যমে হিন্দিকে যেমন ভবিষ্যত রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার রকমের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। তেমনি মুসলমানরাও হিন্দীর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের যুক্তি ও দাবি পেশ করে সােচ্চার হয়ে উঠেন। এ ব্যাপারে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দের হিন্দির প্রতি সমর্থন মুসলমানদেরকে উর্দুর প্রতি ঠেলে দেওয়া ত্বরান্বিত করে। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের শাসক মহল হতে একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অবহেলা করা হয় অপর দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে প্রথমে।
পূর্ব-পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) শিক্ষিত সমাজ চরম উদাসীন থাকে।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবির প্রতি সচেতনা সৃষ্টি ও জনমত গড়ে তােলার জন্য তমদুন মজলিশের প্রাথমিক কর্মসূচিগুলাে কি ছিল?
উত্তর : তমদুন মজলিশের প্রাথমিক কর্মসূচিগুলাের মধ্যে ছিল ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে সাহিত্য সভা ও সেমিনার অনুষ্ঠান। এসব সাহিত্য সভা ও সেমিনারে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও ছাত্ররা অংশগ্রহণ করতেন। তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত লনে ও ফজলুল হক মুসলিম হলের মিলনায়তনের সাধারণ সভা ও সাহিত্য সভার আয়ােজন হয়েছিল বহু বার। এ ছাড়া জনমত সৃষ্টির জন্য বিবৃতি ও হ্যান্ডবিল প্রকাশ করা হতাে। এরপর ১৫ই সেপ্টেম্বর আমার চেষ্টায় ও সম্পাদনায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সম্বলিত প্রথম বই- ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু তমদুন মজলিশ কর্তৃক বংশালের বলিয়াদি প্রিন্টিং প্রেস হতে মুদ্রিত ও ১৯, আজিমপুর হতে প্রকাশিত হয়। এই বই-এর লেখক ছিলাম আমরা তিনজন অধ্যাপক কাজী মােতাহার হােসেন, ইত্তেহাদ’ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ ও আমি নিজে। প্রবন্ধগুলােতে যথার্থ যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করা হয় বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়ার উপযুক্ত। বইটির মুখবন্ধে আমার যে প্রস্তাবটি সন্নিবেশিত হয় তাতে বলা হয়- প্রস্তাব :
১। বাংলা ভাষা-ই হবে (বর্তমান পূর্ববাংলা)
(ক) পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন।।
(খ) পূর্ব-পাকিস্তানের আদালতের ভাষা।
(গ) পূর্ব-পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।
২। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি- বাংলা ও উর্দু।
৩। (ক) বাংলা-ই হবে পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা। পূর্ব-পাকিস্তানের শতকরা একশ জনই এ-ভাষা শিক্ষা করবেন।
(খ) পূর্ব-পাকিস্তানের উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা। যারা পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকরি ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত হবেন শুধু তারাই ও-ভাষা শিক্ষা করবেন। ইহা পূর্বপাকিস্তানের শতকরা ৫ হতে ১০ জন শিক্ষার করলেও চলবে। মাধ্যমিক স্কুলের উচ্চতর শ্রেণীতে এই ভাষাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শিক্ষা দেওয়া যাবে।
(গ) ইংরেজি হবে পাকিস্তানে তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা। পাকিস্তানের কর্মচারী হিসেবে যারা পৃথিবীতে অন্যান্য দেশে চাকরি করবেন বা যারা উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষায় নিয়ােজিত হবেন তারাই শুধু ইংরেজি শিক্ষা করবেন। তাদের সংখ্যা পূর্বপাকিস্তানে হাজারে একজনের চেয়ে কখনাে বেশি হবে না। ঠিক এ নীতি হিসেবে পশ্চিম-পাকিস্তানের প্রদেশগুলােতে (স্থানীয় ভাষার দাবি না উঠলে) উর্দু প্রথম ভাষা, বাংলা দ্বিতীয় ভাষা আর ইংরেজি তৃতীয় ভাষার স্থান অধিকার করবে।
৪। শাসনকাজ ও বিজ্ঞান শিক্ষার সুবিধার জন্য আপাতত কয়েক বছরের জন্য ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই পূর্ব-পাকিস্তানের শাসন কাজ চলবে। ইতিমধ্যে প্রয়ােজনানুযায়ী বাংলা ভাষার সংস্কার করতে হবে। দেশের শক্তির যাতে অপচয় না হয় এবং যে ভাষায় দেশের জনগণ সহজে ও অল্প সময়ে লিখতে, শিখতে ও বলতে পারে সে ভাষা-ই হবে রাষ্ট্রভাষা। এই অকাট্য যুক্তিই উপরােক্ত প্রস্তাবের প্রধান ভিত্তি। আর না হয় ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ যেমন জনগণের মত না নিয়ে বা তাদের সুবিধা-অসুবিধার দিকে লক্ষ্য না রেখে ইংরেজিকে আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিল শুধু উর্দু কিংবা বাংলাকে সমস্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করলে ঠিক সেই সাম্রাজ্যবাদী অযৌক্তিক নীতিরই অনুসরণ করা হবে। অথচ এই অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক প্রচেষ্টাই আজ কোন কোন মহলে দেখা দিয়েছে। ইহা সত্যিই বড়। লজ্জাকর ও দুর্বল মনের অভিব্যক্তি। একে সর্ব প্রকারে বাধা দিতে হবে। এর বিরুদ্ধে বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এর সূচনা হিসেবে আমরা কয়েকজন লব্ধ প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকের প্রবন্ধ প্রকাশ করছি এবং সঙ্গে সঙ্গে পুর্ব-পাকিস্তানের প্রত্যেককে এই আন্দোলনে যােগ দেবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। প্রত্যেক স্কুলে, কলেজে এবং প্রত্যেক শহরে সভা করে অপর ভাষাকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেবার বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস করে কায়েদে আজম ও অন্যান্য নেতার নিকট পাঠাতে হবে। গণপরিষদে প্রত্যেক সদস্যের নিকট ডেপুটেশন গিয়ে তাঁরা যেন বাংলাভাষার বিরুদ্ধে মত দিয়ে বাঙালির আত্মহত্যার পথ সুগম না করেন তা স্পষ্ট করে বুঝাতে হবে। কায়েদে আযম জিন্নাহ প্রত্যেক প্রদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে নিয়েছেন। এমনকি লাহাের প্রস্তাবেও পাকিস্তানের প্রত্যেক ইউনিটকে সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কাজেই প্রত্যেক ইউনিটকে তাদের নিজ নিজ প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নির্ধারণ করবার স্বাধীনতা দিতে হবে।’
(পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’– পৃষ্ঠা ৩-৫)। রাষ্ট্রভাষা বাংলার সুস্পষ্ট দাবি সম্বলিত এসব প্রস্তাবাবলী নিয়ে আন্দোলন সংগঠনের জন্য আমরা সকল তৎপরতা ও শক্তি নিয়ােজিত করি। তমদুন মজলিশের নেতা, কর্মী ও অনুরাগীদের নিয়ে দেশের সর্বত্র মজলিশের শাখা গঠন ও ভাষা আন্দোলনের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই। পর্যায়ক্রমে প্রথমে ঢাকায় এবং পরে বিভিন্ন জেলায় ধীরে ধীরে ভাষা আন্দোলনের মানসিক পরিবেশ গড়ে উঠতে থাকে। বইটিতে জনাব আবুল মনসুর আহমদ ‘বাংলাই হবে রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কারণ ও যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। প্রবন্ধটিতে বলা হয়: ‘ঢাকা তমদুন মজলিশের তরফ হইতে বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিবার যে চেষ্টা চলিতেছে, সে চেষ্টায় আমার আন্তরিক সহানুভূতি আছে। আমি অন্যান্য কারণের মধ্যে নিম্নলিখিত কারণসমূহে বাংলাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে চাই :
(১) জনগণের ভাষা ও রাষ্ট্রভাষা এক না হইলে প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিতে পারে না।
(২) উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত ও সরকারি চাকরির ‘অযােগ্য বনিয়া যাইবেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ফারসির জায়গায় ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি সরকারি কাজের ‘অযােগ্য করিয়াছিল।
(৩) উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলেও বাংলাকেই শিক্ষার মিডিয়াম রাখা হইবে বলিয়া যে প্রচার করা হইতেছে, উহা কার্যত ভাওতা ও রাজনৈতিক প্রবঞ্চনায় পরিণত হইবে, কারণ জীবনের সকল ক্ষেত্রে যােগ্যতার
মাপকাঠি হইবে রাষ্ট্রভাষায় জ্ঞানের বিস্তৃতি ও গভীরতা।
(৪) উর্দু বাংলার চেয়ে সহজ বলিয়া যে কথা বলা হইতেছে উহা প্রচারণা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে উর্দু বাংলার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
(৫) উর্দুর সুপ্রচলিত ও সুদৃশ্য লখনৌভী হরফের ছাপা, মুদ্রণ, টাইপ রাইটিং প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক কাজের অনুপযােগী। কলিকাতা ও মিসরী হরফ ভ্রম— প্রমাদপূর্ণ ও কষ্টে শিক্ষণীয়। উভয় ছাপারই হরফের রূপান্তর বড় বেশি জটিল।
(৬) বাংলা-ভাষা সংস্কৃত-ঘেঁষা ও হিন্দু প্রভাবপূর্ণ, এ অভিযােগ ভ্রান্ত।
বাংলা ভাষা মুসলিম কৃষ্টির উপযােগী নয়, এ অভিযােগও ঠিক নয়। আমরা যে বাংলাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে চাই, সেটা ‘ব্যাকরণ মঞ্জুষার’ বঙ্গভাষা নয়, জনগণের মুখের বাংলা জবান।।
(৭) হরফ সম্বন্ধে আমাদের কোনাে গোঁড়ামী নাই। বিজ্ঞানের নিক্তিতে ওজন করিলে যদি বাংলা হরফ অযােগ্য প্রমাণিত হয় এবং সম্ভাব্য রদ। বদলেও যদি উহা যথেষ্ট যােগ্যতা লাভ না করে, তবে আমরা রােমান হরফ নিতে রাজী আছি। উর্দুওয়ালারাও যদি আরবির বদলে রােমান হরফ নিতে রাজী হন, তবে উর্দুর পক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তিই খসিয়া পড়ে। কারণ আরবি হরফে লেখা হয়, এটাই উর্দুর পক্ষে মুসলিমগণের মনে সবচেয়ে বড় আবেদন। উপরে আমি যে সাতটি যুক্তি দিলাম, তাছাড়াও অনেক যুক্তি আছে, বাস্তব জীবনে যার মূল্য কম নয়। গণপরিষদে যদি উর্দু-বাংলার যােগ্যতার ও দাবির বিচার উঠে, তবে সেখানে বাংলার পক্ষে ওকালতি যাতে যােগ্য ও যথেষ্ট হয়, তার চেষ্টা প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদেরই করিতে হইবে। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের ইনটেলিজেন্শিয়া হিসেবে তাদের দায়িত্ব অপরিসীম।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?’– বইটি ক্যাম্পাসে কেমন সাড়া জাগিয়েছিল?
উত্তর : সত্যিকারে বলতে কি, এ বইটি কেনার মতাে ৫ জন লােকও প্রথমে ক্যাম্পাসে পাওয়া যায়নি। মজলিশের কর্মীদেরকে সঙ্গে করে বইটি নিয়ে অনেক জায়গায় ছুটে গিয়েছি কিন্তু দু’এক জায়গায় ছাড়া প্রায় সব জায়গা হতেই নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছি। পাকিস্তান লাভের সফলতা তখন সারা জাতিকে মােহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এ সময় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে একাধিক ভাষার প্রশ্ন তােলা যে কত ‘মারাত্মক ক্ষতিকর’, আর বিশেষ করে পাকিস্তানের জন্য ২টি রাষ্ট্রভাষা যে কত বড় ‘অবাস্তব প্রস্তাব তাই যেন সেদিন সকলে বুঝাবার চেষ্টা করতেন। কেউ বলতে চাইতেন এটা ‘পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। ক্যাম্পাসে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা কেন্দ্র মুসলিম হল’ ও ‘ফজলুল হক হলেও আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে বৈঠক করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। শুধু তাই নয়, আমরা রুমে রুমে গিয়েও ব্যক্তিগত আলােচনা চালিয়েছি। কিন্তু দু’একজন ছাড়া প্রায় ছাত্রই এ বিষয়ে বিরূপ ভাব দেখিয়েছেন। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলেই বা কি, এ নিয়ে মাথা ঘামাবার কিছু নেই’ —এই ছিল তখনকার সাধারণ মনােভাব।
প্রশ্ন : ক্যাম্পাসের বাহিরে তখন আপনাদের কোনাে তৎপরতা ছিল কি?
উত্তর : হ্যা, এ সময় ক্যাম্পাসের বাহিরেও আমরা তমদুন মজলিশের পক্ষে রাষ্ট্রভাষার দাবির প্রশ্নে গণসংযােগের চেষ্টা করি। আমরা কিছু সরকারি কর্মচারী ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা চালিয়ে কিছুটা সাফল্য অর্জন করি। এ সময় দেশের নামকরা ব্যক্তিদের দস্তখত নিয়ে একটি মেমােরেন্ডাম তৈরি হয়, আমরা সারা শহরের অলিতে-গলিতে ঘুরে অনেক চেষ্টার পর বেশ কিছু দস্তখত সংগ্রহ করি। মেমােরেন্ডামটি সরকারের নিকট পেশ করা হয় এবং তার কপি কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তখনকার স্থানীয় পত্রিকাগুলাে এ বিষয়কে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এ ব্যাপারে বিশেষ সাহায্য করেছিল জনাব আবুল মনসুর আহমদ সম্পাদিত কোলকাতার ‘ইত্তেহাদ ও বিশিষ্ট সমাজকর্মী আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী সম্পাদিত ঢাকার সাপ্তাহিক ‘ইনসাফ’। তখনাে ‘সৈনিক’ বের হয়নি। এ কথা মনে রাখার মতাে যে, এ সময় মেমােরেন্ডামে অনেক সরকারি কর্মচারী দস্তখত করেছিলেন। এমনকি ডি. আই. জি জনাব আবুল হাসনাৎও এতে দস্তখত করে সমর্থন জানিয়েছিলেন। জনাব হবীবুল্লাহ বাহার, আফজাল সাহেবসহ কয়েকজন মন্ত্রী ও সময় গােপনে ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করতেন।
প্রশ্ন : ‘সৈনিক’ কখন বের হয়? কোন সময় থেকে ‘সৈনিক’ তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে শুরু করে?
উত্তর : সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর, বাংলা ১৩৫৫ সালের ২৮ কার্তিক। রেল কর্মচারী লীগের কয়েকজন নিষ্ঠাবান বিশিষ্ট কর্মীর সহায়তায় আমি এই বিপ্লবী পত্রিকাটি তমদুন মজলিশের উদ্যোগে প্রকাশ করি। সৈনিক’ প্রকাশের জন্য রেল কর্মচারী লীগের যে কয়েকজন বিশিষ্ট কর্মীর সহায়তা পেয়েছি তার মধ্যে মাহবুবুল হক, এম. এস, হক ও আবুদল হাই প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। তমদুন মজলিশের মুখপত্ররূপেই ‘সৈনিক’ আত্মপ্রকাশ করে। ভাষা আন্দোলনে তার ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্য ‘সৈনিক’ জনগণের প্রিয় হয়ে উঠে। ভাষা আন্দোলন’, তমদ্দুন মজলিশ’ আর ‘সৈনিক’—এই তিনটি নামকে তখন পৃথক করে ভাবা যেতাে না। ১৯৪৮ সালে ‘সৈনিক’ আত্মপ্রকাশের সময় সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন শাহেদ আলী ও এনামুল হক। পরে শাহেদ আলী সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হন। পরবর্তীকালে আবদুল গফুর ‘সৈনিকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ৫০-৫১ সালের দিকে তিনি সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন। এক সময় হাসান ইকবালও ‘সৈনিকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ১৯ নং আজিমপুর-এর তমদুন মজলিশের অফিসই ছিল ‘সৈনিক’-এর অফিস। ১৯৪৯। সালে ‘সৈনিক’ প্রকাশিত হতে থাকে ৪৮ নং কাপ্তান বাজার থেকে। আত্মপ্রকাশের সময় থেকে ‘সৈনিক পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ববাংলার) সকল প্রকার অধিকার ও বাংলাভাষার বিরুদ্ধে সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সজাগ ছিল। সৈনিক সংবাদ, নিবন্ধ, প্রতিবেদন, বিজ্ঞপ্তি, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, কবিতা, গান, কার্টুন ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে তুলে ধরতে গিয়ে আপসহীন অগ্রসেনানীর ভূমিকা পালন করে।
প্রশ্ন : তমদুন মজলিশের উদ্যোগে ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পক্ষে উল্লেখযােগ্য সেমিনার, আলােচনা ও সাহিত্য সভা সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর : তমদুন মজলিশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমরা এর উদ্যোগে ক্যাম্পাসে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে মতামত গড়ে তুলতে চেষ্টা করে আসছিলাম। পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল হলে আমরা তমদুন মজলিশের উদ্যোগে ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন হলগুলােতে নিয়মিত আলােচনা ও সাহিত্য সভা অনুষ্ঠান করতে থাকি। এসব সভা রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে বেশ সহায়ক হয়। ১৯৪৭ সনের অক্টোবর মাসে ফজলুল হক হলে তমদুন মজলিশের উদ্যোগে একটি ব্যাপক আয়ােজনে আমরা এ ধরনের একটি সভা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করি। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন তখনকার মন্ত্রী হবীবুল্লাহ বাহার আর বক্তৃতা করেন কবি জসীম উদদীন, কাজী মােতাহার হােসেন এবং আরাে কয়েকজন মন্ত্রী। এ সভা ক্যাম্পাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে বেশ প্রাণের স্পন্দন জাগিয়েছিল। মন্ত্রীদের মধ্যে তখন রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে দুটি দলের সৃষ্টি হয় একটি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন সাহেব ও হামিদুল হক সাহেবকে কেন্দ্র করে, এঁরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরােধী ছিলেন। অপর দলটি ছিল- হবীবুল্লাহ বাহার ও আফজাল সাহেবসহ আরাে দু’একজন মন্ত্রীকে নিয়ে। পূর্বেই বলেছি এঁরা গােপনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সমর্থন করতেন। ফজলুল হক হলের সভাতেই প্রথম আমার বিশেষ অনুরােধে হবীবুল্লাহ বাহার সাহেব। কয়েকজন মন্ত্রীসহ অংশগ্রহণ করেন এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যথাযােগ্য মর্যাদা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। তাদের বক্তব্য তখনকার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলে রাজনৈতিক কারণে তারা নিশ্ৰুপ হয়ে যান। অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁরা সকলেই বাংলা ভাষাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন।
প্রশ্নঃ তমদুন মসলিশের উদ্যোগে ফজলুল হক হলের এই সাহিত্য সভাটি কি অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, না ১২ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল? কারণ এ সাহিত্য সভার একটি রিপোের্ট প্রকাশ হয়েছিল কোলকাতার দৈনিক আজাদের ১৯৪৭-এর ১৩ নভেম্বর-এর সংখ্যায়। উক্ত রিপাের্ট দেখা যায় সাহিত্য সভাটি ১২ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এ ছাড়া ১৯৪৭-এর ১৫ নভেম্বর- এর আজাদে প্রকাশিত ফজলুল হক হলের সাহিত্য সভাটি সম্পর্কে অপর এক রিপাের্টে বলা হয়, সভাটি জনাব নূরুল আমীন উদ্বোধন করেছিলেন। এবং তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য রাখেন। এ সম্পর্কে আপনার কি স্মরণে আসছে?
উত্তর : (গভীরভাবে স্মৃতিচারণের চেষ্টা করে প্রিন্সিপাল কাসেম বলেন] ফজলুল হক হলের আলােচ্য সভাটি অক্টোবরে আয়ােজন করেছিলাম বলেই আমার স্মরণে আসছিল। মাস ও তারিখের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। আমার ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ও কাগজপত্রগুলাে ভাষা আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী শওকত আলীর কাছ থেকে হারিয়ে যাওয়ায় পরবর্তীকালে এ সাহিত্য সভার মাস ও তারিখটি আমি যাচাই করতে পারিনি। তাই আমার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’- পুস্তিকাতে এবং অন্যান্য সাক্ষাৎকারগুলিতেও তাৎক্ষণিক স্মৃতি থেকে অক্টোবর মাসের কথাই উল্লেখ করেছি। তবে সাহিত্য সভার বিবরণ ইত্তেহাদ’, ‘আজাদ’ ও ‘ইনসাফ’- সহ তখনকার কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, সুতরাং পত্রিকায় প্রকাশিত রিপাের্টের তারিখই সঠিক হবে। সাহিত্য সভাটি নূরুল আমীন উদ্বোধন করেছিলেন বলে আমার স্মরণে আসেনি, তাই তার নাম উল্লেখ করিনি। বয়সের ভারে এবং শারীরিক অসুস্থতার জন্য ক্রমে স্মৃতি শক্তি খাটো হয়ে আসছে। এ সম্পর্কিত সঠিক তথ্যের জন্য তখনকার ‘ইত্তেহাদ’, ‘আজাদ’ এবং ইনসাফ’-পত্রিকার রিপাের্টগুলাের ওপর নির্ভর করা যেতে পারে। নূরুল আমীন সাহেবের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির প্রশ্নে সেক্রেটারিয়েটে এবং তার বাসভবনে বহুবার আমার আলাপ আলােচনা হয়েছে। তিনি কখনাে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির বিরােধিতা করেননি। তবে তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চালুর পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে বই পত্রের অভাব ও সমস্যার কথা প্রকটভাবে তুলে ধরতেন।
প্রশ্ন : আপনার ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ও কাগজপত্র জনাব শওকত আলীর নিকট কিভাবে যায়?
উত্তর : বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রস্থল ‘সৈনিক’ ও ‘তমদুন মজলিশ’-এর দফতর, আমার উনিশ নম্বর আজিমপুরের বাসাটিতে পুলিশী হামলা বা অভিযান চলবে আশংকায় আমি ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ও কাগজপত্র তমদুন মজলিশ ও ভাষা আন্দোলনের বিশিষ্ট কর্মী মতিয়ুর রহমানের কাছে (পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জেনারেল সেক্রেটারি, পরবর্তীকালে ডক্টর মতিয়ুর রহমান বাংলা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হন) নিরাপদে রাখার জন্য দেই। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত তিনটার দিকে পুলিশ আমার উনিশ নম্বর আজিমপুরের বাসাটি প্রায় ঘিরে ফেলে। আমি এবং আবদুল গফুর পুলিশের দৃষ্টির আড়ালে বাসা থেকে সরে যেতে সক্ষম হই এবং প্রায় দুই মাস বিভিন্নস্থানে আত্মগােপন করে থাকি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, ঢাকায় ফিরে আসার পর মতিয়ুর রহমানের নিকট ভাষা আন্দোলনের ফাইল ও কাগজপত্রের খোঁজ নিলে সে জানায়, ‘ফাইল ও কাগজপত্র সে শওকত আলীর কাছে রেখেছিল। কিন্তু শওকত আলীর কাছ থেকে সেগুলাে। আর ফিরে পাওয়া যায়নি। শওকত আলীর বক্তব্য অনুযায়ী ফাইল এবং কাগজপত্রগুলাে তার কাছ থেকে খােয়া গেছে। পরে পত্রিকায় বিশেষ হারানাে বিজ্ঞপ্তি দিয়েও সেই ঐতিহাসিক ফাইল এবং কাগজপত্র আর পাওয়া যায়নি।
প্রশ্ন : তমদুন মজলিশ গঠনের চিন্তা কিভাবে আপনার মানসিকতায় স্থান লাভ করে?
উত্তর : ১৯৪৭ সনের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অনুভব করলাম দেশে আদর্শিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট শূন্যতা • ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তােলার জন্য চরিত্রবান, আদর্শিক এবং অধিকার সচেতন যুব সমাজ গড়ে তােলার প্রয়ােজন। হৃদয়ের এই একান্ত বিশ্বাস এবং আবেগ থেকেই তমদুন মজলিশ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তমদুন মজলিশ গঠন করি। প্রথম থেকেই আমরা অনুভব করি ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র আদর্শিক সংগঠন ব্যতীত উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে না। সমাজে সুবিচার ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও এ ধরনের আদর্শিক সংগঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। আবার এ ধরনের সংগঠন যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হয় না তা হলে দেখা যায় যে সংগঠনই আদর্শের আবরণে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবিচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বাহন হয়ে ওঠে। তাই তৎকালীন স্বাধীন পাকিস্তানে তমদুন মজলিশের আত্মপ্রকাশ ছিল প্রগতিবাদী আদর্শ-কর্মী সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী প্রচেষ্টা। বস্তুত ‘পাকিস্তান তমদুন মজলিশ’ ছিল আদর্শবাদী কর্মীদের বৈজ্ঞানিক সংগঠন। চিন্তা-বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক উজ্জীবন মারফত সর্বমানবীয় কল্যাণধর্মী আদর্শ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েমই মজলিশের লক্ষ্য ছিল। প্রথমে একেবারে শূন্য থেকেই শুধুমাত্র গভীর বিশ্বাস ও হৃদয়ের আবেগকে নিয়ে কাজ শুরু করতে হয়। মনে পড়ে, প্রথমে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র শামসুল আলম, শুরু করতে হয়। মনে পড়ে, প্রথমে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র শামসুল আলম (পরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দ্বিতীয় আহ্বায়ক) ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট) তমদুন মজলিশের সদস্যভুক্ত করতে সমর্থ হই। পরবর্তীকালে যারা যােগ দেন তাঁরা হলেন, মুসলিম ছাত্রলীগ নেতা আজিজ আহমদ, নঈমুদ্দীন আহমদ, তিনি ঢাকা বিদ্যালয়ের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া (পরে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রথম আহ্বায়ক), জগন্নাথ কলেজের ছাত্রনেতা সানাউল্লাহ নূরী এবং আরাে অনেকে।
প্রশ্ন : তমদুন মজলিশের অফিস কোথায় ছিল?
উত্তর : প্রথম দিকে তমদুন মজলিশের সাংগঠনিক কাজ ও ভাষা আন্দোলনের যাবতীয় কাজের জন্য আমার বাসা ১৯ নম্বর আজিমপুর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত রশিদ বিল্ডিং-এর নীচতলার একটি ছােট কামরা এই উভয় স্থানই প্রধান অফিসরূপে ব্যবহার করতাম। পরে রশিদ বিল্ডিং-এর দোতালায় একটি কামরা ভাড়া করে তমদুন মজলিশের অফিস স্থাপন করি। মসলিশের এই অফিস থেকেই তখন ভাষা আন্দোলনের সব কাজ পরিকল্পিত ও পরিচালিত হত। ভাষা আন্দোলনের
অনেক ঐতিহাসিক সিন্ধান্ত এ অফিসেই গৃহীত হয়।
প্রশ্ন : প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কখন গঠিত হয়? কোন পরিস্থিতিতে এ সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়?
উত্তর : ফজলুল হক হলে তমদুন মজলিশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সভার পর ‘রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তমদুন মজলিশের উদ্যোগে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পােস্টকার্ড, মানি অর্ডার ফরম, রেলের টিকিট ও টাকায় বাংলা ব্যবহার না করে ইংরেজি ও উর্দুর ব্যবহার, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সিলেবাস হতে বাংলাকে বাদ দেয়া, শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল রহমানের উর্দুর পক্ষে ওকালতি আমাদের শংকিত করে তােলে। অথচ ছাত্র, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী সমাজের কেউ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি নিয়ে তৎপর নন। এই উদাসীনতার সুযােগে শুধু উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করা হবে এই আশংকায় আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। সুতরাং এই এক তরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে গণ আন্দোলন সৃষ্টির জন্য তমদুন মজলিশের উদ্যোগে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। তমদুন মজলিশের বিশিষ্ট কর্মী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নূরুল হক ভূঁইয়াকে এ সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়।
প্রশ্ন : প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কাজের সূচনা হয় কিভাবে?
উত্তর : রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর পরই প্রথমে আমরা রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আলােচনার জন্য কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী জনাব ফজলুর রহমানের সঙ্গে নাজিরাবাজার মাওলা সাহেবের (ফজলুল হক সাহেব) বাসায় সাক্ষাৎ করি। শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান সাহেব করাচী থেকে ঢাকা এলে নাজিরাবাজার মাওলা সাহেবের বাসায় অবস্থান করতেন। তাঁর সঙ্গে আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির প্রশ্নে তুমুল বিতর্ক হয়। ফজলুর রহমান সাহেব আমাদের সঙ্গে অনেকটা রুক্ষ ও অপমানজনক ব্যবহার করেন। এই ঘটনা আমাদের খুবই বিক্ষুব্ধ করে তােলে। আমরা সংগ্রাম পরিষদের নামে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির স্বপক্ষে মেমােরেন্ডাম পেশ করার জন্য কাজে নেমে যাই। কয়েক সপ্তাহের চেষ্টায় অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির পক্ষে কয়েক হাজার দস্তখত সংগ্রহ হয়। এই মেমােরেণ্ডাম আমরা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিকট পেশ করি। বিভিন্ন পত্রিকাতেও মেমােরেণ্ডাম পেশের সংবাদ প্রকাশিত হয়। এই মেমােরেন্ডাম বা স্মারকপত্রতে ‘বাংলা ভাষাকে ভারতবর্ষের মধ্যে অন্যতম সম্পদশালী ভাষা এবং বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষাগুলাের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে উল্লেখ করে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান উভয় সরকারকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার আহ্বান জানানাে হয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে অতি সত্বর বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার বাহন হিসেবে ঘােষণা করার অনুরােধ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান ও কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের বাংলাভাষী মন্ত্রীরাও এ স্মারকলিপির প্রস্তাব সমর্থন করেন। কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিল্পী, রাজনীতিক, আইনজীবী, আলেম-ওলামা, ডাক্তার, ছাত্রনেতাসহ সমাজের প্রায় সকল শ্রেণীর লােক এই স্মারক লিপিতে স্বাক্ষর করেন।
প্রশ্ন : পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের উচ্চতর সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সিলেবাস হতে বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়ার প্রতিবাদে তখনকার সংবাদপত্রে আপনার কোনাে বিবৃতি দানের কথা মনে পড়ে কি?
৪৮৭
উত্তর : হ্যা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব মি. গুড ইন বিভিন্ন বিশ্বদ্যিালয়ের কাছে ১৯৪৭ এর নভেম্বরে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার বিষয়ের সিলেবাস সম্পর্কে একটি সার্কুলার পাঠান। আমি এই সার্কুলারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে পড়ার সুযােগ পাই। এই সার্কুলারে পরীক্ষার জন্য ৩১টি বিষয়ের মধ্যে ৯টি ছিল ভাষা। এই সকল ভাষার মধ্যে উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চসহ মৃত ভাষা ল্যাটিন ও সংস্কৃতও স্থান পায়। কিন্তু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। এটা ছিল বাংলা ভাষার প্রতি চরম অবহেলা ও অবমাননাস্বরূপ। সার্কুলার-এর বিষয় উল্লেখ করে বাংলা ভাষার প্রতি চরম অবহেলার প্রতিবাদ করে কোলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদে আমি কঠোর ভাষায় এক বিবৃতি প্রদান করি। সম্ভবত ডিসেম্বরের শেষ দিকে ঐ বিবৃতি এবং ইত্তেফাদ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের লেখা তীব্র সমালােচনামূলক সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য সরকার-এর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে জানানাে হয় ভুলক্রমে বাংলা বাদ পড়েছে। আমাদের ক্ষোভ দ্বিগুণ হয় এই ভেবে যে ভুলক্রমে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা কি করে বাদ পড়তে পারে।
প্রশ্ন : করাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে গৃহীত প্রস্তাবের প্রতিবাদে ইউনিভার্সিটির বেলতলায় ১৯৪৭ এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কোনাে সভার কথা আপনার মনে পড়ে কি?
উত্তর : হ্যা, করাচীর শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত উর্দুর স্বপক্ষে গৃহীত প্রস্তাব পত্রিকায় দেখার পর ক্যাম্পাসে এবং সচেতন বুদ্ধিজীবী মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঢাকার উর্দুর সমর্থক পত্রিকা মর্নিং নিউজ এ খবর ফলাও করে প্রচার করে। শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের প্রতিবাদে ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণের বেলতলায় এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। আমিই ঐ সভার সভাপতিত্ব করি। সম্ভবত ইউনিভার্সিটির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে এটাই প্রথম প্রতিবাদ সভা।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কখন কিভাবে সম্প্রসারিত হয়?
উত্তর : বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম এবং কোর্ট কাচারি ও অফিসসহ সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ফজলুল হক হলে তমদুন মজলিশের উদ্যোগে এক আলােচনা সভার আহ্বান করি। এ সভাতেই তমদুন মজলিশ, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, ‘ইনসাফ’, ‘জিন্দেগী’ ও ‘দেশের দাবি’ পত্রিকার প্রতিনিধি নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সম্প্রসারণ ও পুনর্গঠন করা হয়। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বিশিষ্ট তমদুন মজলিশ কর্মী শামসুল আলমকে এই সম্প্রসারিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়।
প্রশ্ন : এ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগেই কি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়?
উত্তর : হ্যা, ৭ই মার্চ ফজলুল হক হলে এ সংগ্রাম পরিষদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১১ই মার্চ ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট ও প্রদেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের কর্মসূচি নেয়া হয়। ১১ই মার্চের কর্মসূচি সার্বিকভাবে সফল হয়। ঢাকার রাজপথ ছাত্রজনতার রাষ্ট্রভাষার দাবির স্লোগানের মুখরিত হয়। পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসে অনেক ছাত্র আহত হয় এবং বহু ছাত্র গ্রেপ্তার হয়। ১১ই মার্চের আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রভাষার দাবি নতুন গতি লাভ করে। এ পর্যন্ত মজলিশের পক্ষে আমরাই এককভাবে আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এ আন্দোলনকে সাহায্য করার জন্য আমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে যাই। কিন্তু তখন লীগ, কংগ্রেস, কম্যুনিস্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশন (তখনকার বামপন্থী ছাত্র প্রতিষ্ঠান) এদের প্রত্যেকের কাছ থেকে আমাদের নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়। মুসলিম লীগ একে মােটেই আমল দেয়নি, কংগ্রেস কর্মীরা এর নাম শুনে আঁতকে উঠেন। ঢাকা জজ কোর্টের পেছনে কম্যুনিস্ট পার্টির যে বিরাট অফিস ছিল, তাতে একদিন ক্যুনিস্ট পার্টির এক মিটিং ছিল। কমরেড মােজাফফর আহমদ এ বৈঠকে নেতৃত্ব করছিলেন। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ হতে আমি কয়েকজন কর্মীসহ তাঁর নিকট উপস্থিত হলে তিনি পার্টির তরফ হতে আমাকে জানিয়ে দেন যে এ আন্দোলনকে সমর্থন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, তিনি মেমােরেনডামে দস্তখত করতেও অস্বীকার করেন। ছাত্র ফেডারেশনও এতে যােগদান করতে অস্বীকার করে।
প্রশ্ন : এ সময় ভাষা আন্দোলন বিরােধী তৎপরতা কেমন ছিল? এ তৎপরতা কারা চালাতেন? প্রতিবন্ধকতা ও ষড়যন্ত্রের মধ্যে আন্দোলন কিভাবে বিস্তার লাভ করে?
উত্তর : আন্দোলন এভাবে দানা বেঁধে উঠার সাথে সাথে একে গােড়াতেই পণ্ড করে দিয়ে এর মাধ্যমে স্বার্থোদ্ধারের জন্য জোর চেষ্টা চলতে থাকে। সরকারি এজেন্ট বলে সন্দেহ করা হয়েছিল এমন কয়েকজন ব্যক্তি বড় বড় সংগ্রামী কথা বলে সংগ্রাম পরিষদে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করতে থাকে তারা নানা রকম অবান্তর কথা তুলে ছাত্র ও কর্মীদের মধ্যে বিরােধ ও বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পায়। অন্যদিকে কয়েকজন এমএলএ. এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য মেতে উঠেন। এঁদের অনুসারী বহু ছাত্রও এ কাজে নিযুক্ত হয়। ভাষা-আন্দোলনকে তলিয়ে একে ‘মন্ত্রিত্ব-সংকট আন্দোলনে পরিণত করার জন্য তাঁরা উঠে পড়ে লেগে যান। বলাবাহুল্য, কিছু দিন আগেও এঁরা ভাষা আন্দোলনকে অবাঞ্ছিত বলে মনে করতেন। এ সময়ে বড় বড় বক্তৃতা দিয়ে মােহাম্মদ আলী সাহেব, তােফাজ্জল আলী সাহেব ও নছরুল্লা সাহেব প্রমুখ এমএলএ. বাংলাভক্ত হয়ে ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হতে চেষ্টা করেন ও অন্যদিকে নাজিমুদ্দিন সাহেবকে এই জনপ্রিয়তা দেখিয়ে আন্দোলনকে থামাবার শক্তি রাখেন বুঝিয়ে মন্ত্রিত্ব পাবার তদবির করতে থাকেন।
তৃতীয় আর একদল এ আন্দোলনকে স্যাবােটাজ করার চেষ্টা করে। বলাবাহুল্য এরা কমবেশী ছাত্র ফেডারেশনের সভ্য ছিল। এতদিন এরা কোনাে কাজেই এগিয়ে আসেনি। অথচ আন্দোলন যখন বেশ গতি লাভ করেছে তখন এরা গােপনে পাকিস্তান-বিরােধী ও ধংসাত্মক কয়েকটি হ্যান্ডবিল ও পােস্টার দিয়ে জনগণকে আন্দোলন-বিরােধী করে তােলে। জনসাধারণ তখন সন্দেহ করতে শুরু করে যে, এ আন্দোলন নিশ্চয়ই ভারতের প্ররােচিত। এমন হয়েছে যে কয়েকজন ছাত্র ফেডারেশন কর্মীকে উত্তরবঙ্গে প্রচারের জন্য যাতায়াত খরচ দিয়ে পাঠানাে হয়েছিল। কিন্তু ঐ কর্মীরা ভাষা আন্দোলনের জন্য তাে কোন কাজই করেনি বরং সে টাকার কোন হিসাবও দিতে পারেনি। এভাবে সরকারি গুপ্তচর, মন্ত্রীত্বলােভরা আর তথাকথিত প্রগতিশীলরা এক জোট বেঁধে ভাষা-আন্দোলনকে স্যাবােটেজ করার বা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার কাজে লেগে যান-আর নানারূপ অবান্তর প্রচার করে জনমত বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন। অনেক এমএলএ. বড় বড় কথা বলে নেতা বনে যান— আর তারা আন্দোলনের সুযােগে রাষ্ট্রদূতের পদ বা মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। এরাই মন্ত্রীত্ব পেয়ে প্রকাশ্যভাবে বাংলার বিরুদ্ধাচরণ করতেও লজ্জাবােধ করেননি। ইতিমধ্যে সংগ্রাম পরিষদে বিভিন্ন গ্রুপ এবং বিভিন্ন কলেজ ও স্কুলের প্রতিনিধি নিয়ে একে আরও সম্প্রসারিত করা হয়। সত্য কথা বলতে কি সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছাত্র ও কর্মীদের এত চেষ্টা সত্ত্বেও জনসাধারণ এ আন্দোলনের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। তার সঙ্গে যােগ হয় সরকারি প্রচার। অতিপ্রগতিশীলদের কয়েকটি গােপন পােস্টারকে ভিত্তি করে নির্লজ্জভাবে মজলিশকর্মীদের ওপর হামলা হয়।

সাক্ষাৎকার: সেপ্টেম্বর ১৯৭৮
সূত্র: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মােস্তফা কামাল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!