You dont have javascript enabled! Please enable it! একুশ শতকে বাংলাভাষা- রফিকুল ইসলাম - সংগ্রামের নোটবুক

একুশ শতকে বাংলাভাষা
রফিকুল ইসলাম

একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বিশ্বের প্রধান ছয়টি ভাষার মধ্যে অন্যতম বাংলাভাষা। বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যার অনুপাতে এই বিন্যাস। বাংলা মূলত দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের ভাষা যেমন বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন ঝাড়খণ্ড, বিহার ও ওড়িশার সীমান্তবর্তী অঞ্চল। বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং অসম রাজ্যের বারাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার শিলচর, করিমগঞ্জ, কামরূপ, গােয়ালপাড়া ও ধুবড়ি প্রভৃতি অঞ্চল বাংলাভাষী। মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলের রােসাং অধিবাসীরাও বাংলাভাষী। উপমহাদেশের বাইরে যুক্তরাজ্য, ইতালি এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাভাষীদের স্থায়ী আর মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যে অস্থায়ী আবাস গড়ে উঠেছে। মােটকথা বাংলাভাষার সীমানা বর্তমানে দক্ষিণ-এশিয়া ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সম্প্রসারিত। একুশ শতকে বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি ভাষা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসম রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা বাংলা। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পৃথিবীর বাংলাভাষীর সংখ্যা আনুমানিক তিরিশ কোটির কম হবে না। বাংলা বর্ণমালা বাঙালি মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টান নির্বিশেষে সব সম্প্রদায় কর্তৃক ব্যবহৃত হয়। বাংলাভাষার বহু আঞ্চলিক বৈচিত্র্য বা উপভাষা থাকলেও তার একটি সর্বজনীন প্রমিতরূপ রয়েছে যা বিভিন্ন রাষ্ট্রসীমা অতিক্রমকারী এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাঙালির আনুষ্ঠানিক এবং ইলেকট্রোনিক প্রচারমাধ্যমের ভাষা। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশ শতক তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লবের যুগ। বাংলাভাষা একুশ শতকে তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর একটি আধুনিক ভাষা। বিশ্বের বাংলাভাষী মানুষের প্রকাশনাশিল্প ও বর্তমানে কমপিউটার প্রযুক্তিনির্ভর। যােগাযােগের ভাষা হিসেবে বাংলা একুশ শতকে মােবাইল ও ইন্টারনেট-নির্ভর। বিশ্বের বাংলাভাষী অঞ্চলের বেতার ও টেলিভিশনসহ প্রচার মাধ্যমগুলাের ভাষা মূলত বাংলা হলেও বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, শিলচর, লন্ডন, নিউইয়র্ক, টরেন্টো প্রভৃতি অঞ্চলের বাংলাভাষী টেলিভিশনগুলাের ভাষাবৈচিত্র্য লক্ষণীয়। যদিও একটি আন্তর্জাতিক প্রমিত বাংলা উচ্চারণ সর্বজনগ্রাহ্য। বর্তমানে বাংলাসাহিত্য চর্চার প্রধান দুটি কেন্দ্র-কোলকাতা ও ঢাকা। এছাড়া আগরতলা, শিলচর, লন্ডন ও নিউইয়র্ককে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যচর্চা বিকশিত হয়ে উঠছে।
পৃথিবীর বাংলাভাষী অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মাধ্যম এবং ব্যবসাবাণিজ্যের ভাষায় ইংরেজির প্রাধান্য বর্ধমান। মােবাইলের মাধ্যমে সংবাদ আদান প্রদানের ইংরেজি বর্ণমালার ব্যবহার প্রায় সর্বজনীন। বলা যেতে পারে, মােবাইল ফোনে বর্তমানে রােমান হরফে বাংলা চলছে। ফেসবুকের ক্ষেত্রে তা আরও প্রকট। এসব মাধ্যমে বাংলাভাষীদের মাতৃভাষাপ্রীতি কোনরূপ প্রভাব তেমন লক্ষ করা যাচ্ছে না। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে পরিচালিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও বাংলাভাষার প্রতি চরম উদাসীনতা লক্ষণীয়।
বাংলা সাহিত্যচর্চায় পশ্চিমবঙ্গে কী হচ্ছে বাংলাদেশের সাহিত্যানুরাগীরা সে বিষয়ে খবর রাখার চেষ্টা করলেও পশ্চিমবঙ্গে বংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না।
এমনকি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যানুরাগীরা আগরতলা, শিলচর বা করিমগঞ্জের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী নয়। লন্ডন, নিউইয়র্ক বা টরেন্টোভিত্তিক বাংলা সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে ঔৎসুক্য আছে বলে মনে হয় না। বিষয়টি সবচেয়ে একটি টেলিভিশন মাধ্যমের ক্ষেত্রে। উপমহাদেশে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু ১৯৬৫ সালে ঢাকা থেকে। কোলকাতায় টেলিভিশনের অনুষ্ঠান শুরু হয় তার দশ বছর পরে ১৯৭৬ সালে। শুধু এই দশ বছর নয় পরবর্তী একদশকেও ঢাকা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসম রাজ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিল। ত্রিপুরা ও অসম কোলকাতা অপেক্ষা ঢাকা টেলিভিশন অনেকদিন আকর্ষণীয় ছিল। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতে বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি টিভির অনুষ্ঠান পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও অসমে কেবল ডিলাররা গ্রহণ করেন না। কেবল ডিলারদের উদ্যোগী হওয়া উচিত। এটা কি বিস্ময়কর নয় যে, বাংলাদেশে ভারতের বই পুস্তক আমদানি বা টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার ক্ষেত্রে কোনাে বাধা না থাকলেও ভারতে বাংলাদেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখা যায় না বা বই-পুস্তক পাওয়া যায় না। একুশ শতকের অবাধ তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে এটা কি একটা অযৌক্তিক ও অবিশ্বাস্য ব্যাপার নয়? এতে বাংলাদেশের কেননা ক্ষতি হয়নি। কিন্তু প্রতিবেশী বাংলাভাষী অঞ্চলের জন্য তা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক।
বাংলাভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির অতীত গৌরব কোলকাতা-কেন্দ্রিক। এর একটি কারণ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংঘাত ও সমন্বয়ভিত্তিক উনিশ শতকের নবজাগরণ। কিন্তু বিশ শতকের অপরাহ্ন থেকে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ঢাকা-কেন্দ্রিক বাংলাভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় বাংলাভাষার রাষ্ট্রভাষার মর্যাদালাভ যুগান্তকারী ঘটনা এবং এ দৃষ্টান্ত অবশ্যই বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একুশ শতকে যার লক্ষণ খুবই স্পষ্ট। বাংলাভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ঢাকা তথা বাংলাদেশের উপর। এক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রসঙ্গক্রমে প্রচারমাধ্যমের কথাও এসে পড়ে। ঢাকাকেন্দ্রিক স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলাের অনুষ্ঠান ভারত ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবারাত্রি প্রচারিত হচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলা সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ রূপরেখা স্থির হয়ে যাচ্ছে। বলা যেতে পারে, একুশ শতকে বাংলাভাষার এক নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলার অতীত গৌরবের কিছুই উপেক্ষিত তাে হচ্ছেই না, বরং বর্তমান বাস্তবতার উপর নিভর করে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার সাধনা চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ আজ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। তাদের জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। ফলে এক নতুন সাংস্কৃতিক অভিযাত্রার সূত্রপাত ঘটেছে। বাংলাদেশ বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ অগ্রযাত্রায় অনেক কঠিন ও জটিল বাধাবিপত্তি তাকে অতিক্রম করতে হচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সে তা পেরিয়ে যাচ্ছে। বাংলাভাষা বাংলাভাষীদের কঠিন জীবন সংগ্রাম ও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রগঠনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেরণা। এ সাধনায় বাংলাভাষাও নতুন রূপ লাভ করছে। সে বিশ্বভাষায় রূপান্তরিত হচ্ছে।

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও দলিল – সাহিদা বেগম