আমার দেখা ডা. বদরুল আলম
আ. জা. ম. তকীয়ূল্লাহ
ভাষা-আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অবদান খুবই স্মরণীয়। ১৯৫২ সালে শুধু ভাষা-আন্দোলন নয়, দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় মেডিকেল ব্যারাক। এই ব্যারাকের অতি পরিচিত মুখ ছিল বদরুল আলম। সাহিত্য-সংস্কৃতির সাথে জড়িত থাকার কারণে তার একটু বাড়তি পরিচিতি ছিল।
আমি ১৯৪৯ সাল থেকে আত্মগােপনে চলে যাই এবং ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত জেলে ছিলাম। ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনসহ ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ পর্যন্ত পুরাে আন্দোলনকে প্রাণবন্ত রাখতে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তখন ১১ মার্চকে সামনে রেখেই সকল আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে উঠত। আমি আত্মগােপন অবস্থায় বেশিরভাগ সময় ব্যারাকেই অবস্থান করতাম। মিরাজ উদ্দিন, আবদুল হাই, আব্দুস সালামের রুমেই রাত কাটাতাম। তখন সমস্ত আন্দোলনের মূল ঘাঁটিই ছিল মেডিকেল ব্যারাক। শহীদুল্লাহ কায়সারসহ আরও অনেকে কমিউনিস্ট নেতাদের প্রতিনিয়ত আনাগােনা ছিল এই ব্যারাকে। ১৯৫০ সালের কোনাে এক সময় ১২টি বােমা তৈরি করে আমি ব্যারাকে মিরাজ উদ্দিনের রুমে রেখে আসি। পুলিশ আক্রমণ করলে এর পাল্টা জবাব দেয়ার জন্যই এ উদ্যোগ নেয়া হয়। বােমাগুলাে কমিউনিস্ট পার্টির সহযােগিতায় আমরা কয়েকজন মিলে তৈরি করেছিলাম। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সালের আন্দোলনে মেডিকেল ছাত্র আমজাদ, আবদুল হাইসহ অনেককেই গ্রেফতার হন এবং তাদের কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তৎকালীন মেডিকেল কলেজের ছাত্র মােবারকেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ভাষাআন্দোলনে ও সাহিত্য-সংস্কৃতির কাজে এ সময় বদরুল আলমের তৎপরতাও আমি প্রত্যক্ষ করেছি।
শহীদ মিনার আজ আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিরাট স্থান দখল করে আছে। প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সনে। একুশে ফেব্রুয়ারি সরকার ছাত্রদের ওপর গুলি চালালে কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন। তাদের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়। শহীদ মিনার নির্মাণের একক কৃতিত্বের দাবিদার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের। এই শহীদ মিনারে মূল নকশাকার ছিলেন বদরুল আলম। পরে শহীদ মিনারটি সর্বস্তরের মানুষের তীর্থস্থানে পরিণত হয়। ওখানে অনেকে ফুল, টাকা-পয়সা এমনকি এক মহিলা নিজের গহনা পর্যন্ত দিয়ে দেয়। পর ২৬ তারিখ এটি ভেঙ্গে দেয়, ছাত্রজনতা আবার শহীদ মিনার তৈরি করে। আজকে শহীদ মিনার আমাদের জাতির সম্পদে পরিণত হয়েছে। | প্রথমে শহীদ মিনারের নকশাকার হিসেবে বদরুল আলমের নামটি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
স্বাধীনতার পর বদরুল আলমের সাথে আমার আবারও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি শিশুরােগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তার চেম্বার ছিল আজকের জি.পি.ও-এর উল্টোদিকে। আমি প্রায়ই তার চেম্বারে যাতায়াত করতাম।
১৯৭৪ সালের দিকে আমার মেয়ে শান্তা মারিয়ার চিকিৎসার জন্য তার চেম্বারে যাই। তিনি অত্যন্ত যত্ন সহকারে আমার মেয়েকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে তােলেন।
১৯৬৭ সালে আমি জনতা জুট মিলে ‘ইমপাের্ট ইনচার্জ হিসেবে যােগদান করি। এই মিলের মালিক মুজাম্মেল হক ছিলেন বদরুল আলমের স্ত্রী আফজালুন্নেসার দুলাভাই। সেই সূত্রেও বদরুল আলমের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। ব্যক্তি হিসেবে বদরুল আলম ছিলেন খুবই ভদ্র ও নম্র স্বভাবের। অকালেই তিনি চলে গেলেন। তাঁর বিদ্রোহী আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।
লেখক: ভাষাসংগ্রামী ও রাজনীতিক
সূত্র : প্রথম শহীদ মিনারের স্থপতি ডা: বদরুল আলম স্মারকগ্রন্থ