You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনকারীর সাক্ষাৎকার- আবু নছর মােহাম্মদ গাজীউল হক - সংগ্রামের নোটবুক

আবু নছর মােহাম্মদ গাজীউল হক

আবু নছর মােহাম্মদ গাজীউল হক ১৯৪৮ সাল থেকে প্রত্যক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের পুরােভাগে থেকে যারা দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেন, তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে ঐতিহাসিক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়, জনাব গাজীউল হকই সে সভায় সভাপতিত্ব করেন। উক্ত সভায় তিনি সভাপতি হিসেবে এক চেতনাদীপ্ত ভাষণ দিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন।
১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাবেক নােয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়া থানার অন্তর্গত নিচিন্তা গ্রামে জনাব গাজীউল হক জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মাওলানা সিরাজুল হক ছিলেন একজন সুপরিচিত পীর।
স্থানীয় ছাগলনাইয়া হাই স্কুলে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত তাঁর পড়াশুনা চলে। তারপর ১৯৪২ সালে পিতা পরিবার-পরিজনসহ স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য বগুড়া চলে আসলে তিনি বগুড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর বগুড়া কলেজ থেকে আইএ পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে বিএ (অনার্স) ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৫১ সলে অনার্স পাস করেন। এরপর ১৯৫২ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন পাস করেন।
১৯৫৬ সাল থেকে জনাব গাজীউল হক বগুড়ায় আইন ব্যবসা শুরু করেন। পরে ১৯৭২ সালে স্থায়ীভাবে ঢাকা সুপ্রিম কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এখনও তিনি এ পেশায় নিয়ােজিত আছেন।
জনাব গাজীউল হক অতিতরুণ বয়স থেকেই রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট হন। প্রথম জীবনে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি বগুড়া ‘মুসলিম ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট এবং ডেমােক্রোটিক ইয়থলীগের’ বগুড়া জেলার জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৫১ সালে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার কারণে ৪ বছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগদান করেন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন। ঐ বছরই ন্যাশনাল কনভেনশনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রাদেশিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ভাসানী ন্যাপের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এবং ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ঐ পদে বহাল থাকেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত জনাব গাজীউল হক বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার কারণে ৮ বার কারাভােগ করেন। বাহ্যত বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থেকেও তিনি সুদীর্ঘ ১৮ বছর কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। ১৯৭০ সালের পর থেকে তিনি আর সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেননি।
ব্যক্তিগত জীবনে গাজীউল হক খুবই সদালাপী। তিনি ১ পুত্র ও ৪ কন্যার পিতা। নিজের আইন ব্যবসা নিয়ে তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত থাকেন। এত ব্যস্ততা সত্ত্বেও এ সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য তিনি প্রচুর সময় দিয়েছেন। আত্মপ্রচার এড়ানাের একটা সতর্ক প্রয়াস তার মধ্যে স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। আলােচনা প্রসঙ্গে বলা দু একটা কথা প্রকাশ না করার ইচ্ছা তিনি ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু সঠিক ইতিহাস প্রণয়নের প্রয়ােজনে আমরা তাও প্রকাশ করলাম। ভাষা আন্দোলনের এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সাক্ষাকার ইতিহাসের অনেক মূল্যবান উপকরণ জোগাবে বলে আমরা আশা করি।
প্রশ্ন : সাংগঠনিকভাবে বাংলা ভাষার দাবি কখন উত্থাপিত হয়?
উত্তর : ১৯৪৭ সালের ৬ এবং ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় খান সাহেব আবুল হাসনাতের বাসায় জনাব তাসাদুক হােসেনের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান যুবকর্মী সম্মেলনে ডেমােক্রেটিক ইয়থ লীগ’ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক যুব প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এই সম্মেলনেই প্রথম বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস ও আইন-আদালতের ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করার জন্য দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
প্রশ্ন : এই যুব সম্মেলনের উদ্যোক্তা কারা ছিলেন? উত্তর : জনাব তাসাদুক, জনাব শামসুল হক, জনাব মাে. তােয়াহা, জনাব অলি আহাদ, জনাব তাজউদ্দীন, জনাব আবদুর রহমান চৌধুরী (বর্তমানে বিচারপতি),* আতাউর রহমান (রাজশাহী), লিলি খান এঁরাই উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন। প্রশ্ন : এই সম্মেলন কি সারাপ্রদেশভিত্তিক ছিল?
উত্তর : হ্যা, এটা প্রদেশভিত্তিক সম্মেলন ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জেলা থেকে প্রায় দেড়শত প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যােগদান করেন। বগুড়া থেকে আমরা অধ্যাপক খায়েরের নেতৃত্বে ১০ জন প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যােগদান করি।
প্রশ্ন : আপনি বলছেন, এ সম্মেলনে বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তাহলে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়ার দাবি উত্থাপিত হয় কখন?
উত্তর : যুবকর্মী সম্মেলনে এই মর্মে একটা প্রস্তাব নেওয়া হয় যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে, তা জনগণই স্থির করবেন। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি প্রথম সুস্পষ্টভাবে তমদুন মজলিশ’ই পেশ করে। ১ সেপ্টেম্বর তমদুন মজলিশ গঠিত হয়। ১৫ সেপ্টেম্বর মজলিশ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
………………………………………………
* অবসর গ্রহণ করার পর মৃত্যুবরণ করেন।
………………………………………………

বাংলা না উর্দু’- এ নামে একটি পুস্তিকা বের করে। এ পুস্তিকাতে উর্দুর সাথে বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেয়ারসদাবি জানানাে হয়।
প্রশ্ন : ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ আপনি কোথায় ছিলেন?
উত্তর : আমি তখন বগুড়া আজিজুল হক কলেজের ছাত্র। ফেরুয়ারি মাসে ঢাকায় ছাত্রদের মধ্যে ভাষার দাবি বেশ দানা বেঁধে উঠে। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকার বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। আমরা সংবাদ পেয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি বগুড়া কলেজে ভাষার দাবিতে প্রথম সভা করি। ঢাকা থেকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ভাষার দাবিতে প্রদেশব্যাপী হরতালের আহ্বান জানালে আমরা বগুড়ার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১১ মার্চ হরতাল পালন করি। এদিন ভাষার দাবিতে মিছিল করি এবং মিছিল শেষে বগুড়া জেলা স্কুল প্রাঙ্গণে এক বিরাট ছাত্র-জনসভা করি। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সে সভায় সভাপতিত্ব করেন। প্রশ্ন : ডক্টর শহীদুল্লাহ সেখানে কি করতেন? উত্তর : এ সম্পর্কে একটি সুন্দর কথা মনে পড়ছে। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তখন বগুড়া কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। আমরা যখন মিছিল করে এগিয়ে যাচ্ছি তখন দেখি যে, ডক্টর শহীদুল্লাহ রিক্শায় করে কলেজের দিকে যাচ্ছেন। আমরা তার রিকশা থামিয়ে তাঁকে আমাদের মিছিলের নেতৃত্ব দিতে অনুরােধ করি। তিনি রিকশা থেকে নামলেন। সঙ্গে সঙ্গে মিছিলের ছাত্ররা তুমুল করতালির মাধ্যমে তাঁকে অভিনন্দিত করে। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ স্টাইলে বললেন, ‘মানে কি যে আঁ, আমাকে কি করতে হবে? আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, স্যার, আপনাকে এ মিছিলের নেতৃত্ব দিতে হবে। এটা আমাদের দাবি।’ তিনি খানিকটা ভাবলেন, তারপর একটু হেসে আমার হাতে তার ব্যাগটি দিয়ে বললেন, ‘মানে কি যে অ্য, পীর সাহেব, তাহলে তুমি আমার বােঝাটা নাও। আমি তােমার বােঝার দায়িত্ব নিলুম। মিছিলের শেষে তিনি সেদিনের ছাত্র-জনসভায় সভাপতি হিসেবে ভাষার দাবিতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা সত্যিই অপূর্ব ছিল। (গাজীউল হক সহেবের পিতা পীর ছিলেন বলে ডক্টর শহীদুল্লাহ তাঁকে। ‘পীর সাহেব’ বলে ডাকতেন।)
প্রশ্ন : আপনি বলেছেন, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে প্রদেশব্যাপী হরতালের আহ্বান জানায়। ১৯৪৮ সালেই কি ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল? ১৯৫২ সালে গঠিত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ হতে এটা কি ভিন্ন ছিল?
উত্তর : ১৯৪৮ সালে গঠিত ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এবং ১৯৫২ সালে গঠিত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ’ সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। ১৯৪৮ সালের সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া। তিনি তমদুন মজলিশের সদস্য ছিলেন। আর ১৯৫২ সালে গঠিত ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন জনাব কাজী গােলাম মাহবুব।
প্রশ্ন : ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কি তমদুন মজলিশের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল?
উত্তর : তমদুন মজলিশ এবং গণতান্ত্রিক কর্মীদের উদ্যোগে এ পরিষদ গঠিত হয়।
১৯৪৮ সালেই এর বিলুপ্তি ঘটে। অবশ্য পরে ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। জনাব আবদুল মতিন এ কমিটির আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি এর আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করেন। এ কমিটির উদ্যোগে ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালের ১১ মার্চকে রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল পালিত হয়।
প্রশ্ন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ কেন গঠিত হয়?
উত্তর : ১৯৪৯ সালের শেষের দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খান ঢাকা সফরে আসেন। তার আগমন উপলক্ষে ঢাকার ছাত্রসমাজে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কারণ ঢাকা আসার কিছুদিন আগে করাচীতে গণপরিষদের বৈঠকে জনাব লিয়াকত আলী খান, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। তাই এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে জনাব লিয়াকত আলী খানকে কালাে পতাকা দেখানাের মনােভাব পরিলক্ষিত হয়। অবশেষে ডা. মাহমুদ হােসেনের (তদানীন্তন ফজলুল হক হলের প্রভােস্ট) পরামর্শক্রমে স্থির হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জিমনেসিয়াম গ্রাউন্ডে’ লিয়াকত আলী খানের যে ছাত্রসভা হবে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের জিএস জনাব গােলাম আযম (অধ্যাপক গােলাম আযম) ছাত্রদের পক্ষ থেকে একটা মানপত্র পাঠ করবেন। সে মানপত্রে উর্দুর সাথে বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিসেবে গ্রহণ করার জোরালাে দাবি সন্নিবেশিত থাকবে।
সিদ্ধান্ত অনুসারে জনাব গােলাম আযম সে জনসভায় ছাত্রদের পক্ষ থেকে মানপত্র পাঠ করেন। গােলাম আযম সাহেব যখন মানপত্রে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি পাঠ করছিলেন, তখন ছাত্ররা তুমুল করতালির মাধ্যমে এ দাবির প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে। এতে বাহ্যত লিয়াকত আলী খান ক্ষুব্ধ হন।
লিয়াকত আলী খান চলে যাওয়ার পর পরবর্তী পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষার স্তিমিত আন্দোলনকে জোরালাে করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।*
………………………………………………
* ‘৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর লিয়াকত আলী খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘জিমনেসিয়াম গ্রাউন্ডে’ ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। – মাে. কা.
………………………………………………

প্রশ্ন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি আহূত’ ১৯৫০ ও ১৯৫১ এর ১১ মার্চের বিশ্ববিদ্যালয় হরতাল কি সফল হয়েছিল? ছাত্রদের মধ্যে সে সময় ধর্মঘটের প্রশ্নে কোন ভিন্নমত ছিল কি?
উত্তর : ১৯৫০ এবং ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্থকভাবে হরতাল
পালিত হয়। এসব হরতালে সাধারণ ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল। ধর্মঘট সম্পর্কে ভিন্নমতের কথা বলছেন, না, ছাত্রদের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনাে মতভেদ ছিল না। তবে দু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়। আমার মনে পড়ছে, ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ সংগ্রাম কমিটি আহূত হরতালে সব সাধারণ ছাত্রই সাড়া দেয়। শুধুমাত্র একজন ছাত্র ভিন্নমত প্রকাশ করে। সে ছিল তদানীন্তন আর্টস ফেকাল্টির ডীন ডা. সাদানীর ভাতিজা। হরতাল উপেক্ষা করে সে ক্লাস করছিল। তাতে ছাত্ররা ক্লাস থেকে মধুর রেস্তোরাঁয় ডেকে আনে। সেখানে মতিন সাহেবসহ আমরা সবাই তাকে ছাত্রঐক্য প্রশ্নে বুঝাবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সে কিছুতেই আমাদের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছিল না। ঠিক এ সময় হাসান হাফিজুর রহমান (কবি হাসান হাফিজুর রহমান) উত্তেজিত হয়ে চট করে তার পা থেকে সেন্ডেল খুলে দু’ঘা লাগিয়ে দেন। তারপর নুর নবী (বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাড়ভােকেট) সজোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে চড়ে বসে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা বিস্মিত হয়ে পড়ি। মতিন সাহেবসহ আমরা সবাই মিলে তাকে ছাড়িয়ে দিই। অবশ্য এ ধরনের ঘটনা আর কখনাে ঘটেনি।
প্রশ্ন : আপনি কখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন?
উত্তর : সম্ভবত ১৯৪৮ সালের জুনের দিকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে (অনার্স) ভর্তি হই।
প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আপনি এখানকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে কিভাবে সংশ্লিষ্ট হন?
উত্তর : পূর্ব থেকেই আমি গণতান্ত্রিক যুবলীগের (Democratic Youth League) সূত্রে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলাম। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়ি।
প্রশ্ন : আপনার আগমনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোেগ্য আন্দোলন কি ছিল? উত্তর : চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন। এ আন্দোলনে ছাত্ররাও অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে নঈমুদ্দীনসহ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু নেতা কর্তৃপক্ষের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। এ জন্য নঈমুদ্দীন ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন।
প্রশ্ন : এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কি?
উত্তর : হ্যা, কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেন। পরে অলি আহাদ ছাড়া প্রত্যেকের ওপর থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। জনাব আলি আহাদকে বিকম পরীক্ষা দিতে দেয়া হলেও আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রেগুলার’ ছাত্র হিসেবে ভর্তি করা হয়নি। এমনকি বিকম, পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করলেও তাঁকে এমকম-এ ভর্তি হওয়ার সুযােগ দেয়া হয়নি।
প্রশ্ন : এ সময় আর কোনাে উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটেছিল কি, যা ছাত্র আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল?
উত্তর : ‘দাঙ্গা প্রতিরােধ আন্দোলন’, ‘নাে ফি ক্যাম্পেইন’, ‘পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন’– এসব ঘটনা এ সময় ছাত্র আন্দোলনকে সংগঠনের দিক থেকে বেশ প্রভাবিত করে। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোলকাতায় সংঘটিত দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গা প্রতিরােধের জন্য আমরা ছাত্ররা প্রতিরােধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। অতি দুঃখজনক যে,পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র দাঙ্গা প্রতিরােধে অংশগ্রহণ করে। বাকি অংশ নির্লিপ্ত থাকে। এ নির্লিপ্ততা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রভাবের বাইরে ছাত্রদের মধ্যে একটা থার্ড ফোর্স সংগঠিত করার অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীকালে এই থার্ড ফোর্সই একুশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। এপ্রিল মাসে সংঘটিত হয় ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ‘ননা ফি ক্যাম্পেইন। এ আন্দোলন আংশিক সাফল্য লাভ করে। এ আন্দোলনের সূত্র ধরে ছাত্রদের উদ্যোগে ফজলুল হক হলের অডিটোরিয়ামে ‘পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন’ নামে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে ছাত্রদের শিক্ষার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলােচনা হয়। শিক্ষার প্রধান বাহন হিসেবে বাংলা ভাষার প্রশ্নটিও উত্থাপিত হয়।
প্রশ্ন : এ সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্যে কারা ছিলেন?
উত্তর : উদ্যোক্তাদের মধ্যে মােহাম্মদ তােয়াহা, তাসাদ্ক, অলি আহাদ, আবদুল মতিন এঁরাই পুরােভাগে ছিলেন।
প্রশ্ন : ছাত্রদের মধ্যে থার্ড ফোর্সের সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্ররা কি কোনাে গ্রুপ হিসেবে পরিচিত ছিল?
উত্তর : এ প্রসঙ্গে আপনাকে পূর্বের ঘটনার সূত্র ধরে বলতে হয়। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে মূলত ছাত্রদের তিনটি গ্রুপ ছিল। একটি গ্রুপ খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবের সমর্থক, আরেকটি সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সমর্থক এবং অপরটি কমিউনিস্ট বা বামপন্থী প্রভাবিত। বামপন্থী প্রভাবিত এবং
প্রগতিশীল মনােভাবসম্পন্ন ছাত্র গ্রুপটিই পরবর্তী পর্যায়ে থার্ড ফোর্স হিসেবে সংগঠিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে। যদিও তারা দলগতভাবে ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল না, তবুও সত্যিকারে ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন আন্দোলন এবং কর্মকাণ্ডে তাদের তৎপরতা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ইউনিভার্সিটির সেরা সেরা ছাত্ররা এই ‘থার্ড ফোর্স বা তৃতীয় শক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। ইউনিভার্সিটির হল ইলেকশানগুলােতে এই থার্ড ফোর্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রশ্ন : ইউনিভার্সিটি হল ইলেকশনে কি আপনারা নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করাতেন?
উত্তর : হ্যা ,আমরা নিজেদের মনােনীত প্রার্থী দাঁড় করাবার চেষ্টা করতাম। ১৯৫০ সালে এসএম, হলের ইউনিয়ন ইলেকশানে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী ছিলেন (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক), আর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিসিয়াল ভিপি প্রার্থী ছিলেন কাজী গােলাম মাহবুব। থার্ড ফোর্স’ হতে আমাদের প্রার্থী ছিলেন মােস্তফা নুরউল ইসলাম (জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)। যদিও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে আমাদের নির্বাচনী মৈত্রীজোট ছিল, কিন্তু তবু গােলাম মাহবুব এবং মােস্তাফা নূরউল ইসলামের মনােনয়ন নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। এ নিয়ে ভােটাভােটি হয়। ভােটাভােটিতে কাজী গােলাম মাহবুব সমর্থকরা হেরে যায়, মােস্তফা নূরউল ইসলামের মনােনয়নই টিকে যায়। নির্বাচনের সময় দেখা যায় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের একটা বিশেষ অংশ মােস্তফা নূরউল ইসলামকে সমর্থন করা থেকে বিরত থাকে। তবুও মােস্তফা নূরউল ইসলাম জয়ী হন। এটাই প্রগতিশীল বামপন্থীদের প্রথম বিজয়। অনুরূপভাবে ১৯৫১ সালে এসএম হলের ইলেকশনে থার্ড ফোর্সের ভি, পি, প্রার্থী ছিলেন হাবিবুর রহমান শেলী (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি)। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রার্থী ছিলেন মুজিবুল হক (বর্তমানে শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারি) এবং পূর্ব পাকিস্তান। মুসলিম ছাত্রলীগের প্রার্থী ছিলেন আনােয়ারুল হক চৌধুরী (ডেপুটি এটর্নি জেনারেল) নির্বাচনে হাবিবুর রহমান শেলী নির্বাচিত হন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ জোট বেঁধে বাজেট ফেল করিয়ে দেয়। ফজলুল হক হলেও ‘থার্ড গ্রুপ ক্যান্ডিডেট দাঁড় করায়। এ কেবিনেটে ভি, পি প্রার্থী ছিলেন শামসুল আলম এবং জিএস আনােয়ারুল হক খান। নির্বাচনে থার্ড গ্রুপে’র ফুল কেবিনেট রিটার্ন করে।
প্রশ্ন : এই ‘থার্ড গ্রুপের ছাত্ররা ভিন্ন কোন সংগঠন গড়ে তােলেনি কেন?
উত্তর : ১৯৫১ সালে এই থার্ড গ্রুপের প্রত্যক্ষ উদ্যোগেই যুবলীগের জন্ম হয়। সম্ভবত এই যুবলীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন মাহমুদ আলী (সিলেট) এবং সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ।
প্রশ্ন : এই যুবলীগ কি ১৯৪৮ সাল গঠিত ‘ডেমােক্রেটিক ইয়থ লীগ থেকে ভিন্ন সংগঠন ছিল?
উত্তর : হ্যা, ভিন্ন সংগঠন।
প্রশ্ন : ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেবের উর্দুর স্বপক্ষে ভাষণ দানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে কি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়?
উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ে আমতলায় ৩০ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের খালেক নেওয়াজ সে প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। পরে মিছিল বের করার প্রস্তাব উঠলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মীদের মিছিল বের করার বিরােধিতা সত্ত্বেও প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। মিছিল ফুলার রােড দিয়ে ঘুরে বর্ধমান হাউসের (বর্তমান বাংলা একাডেমি ও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের সরকারি বাসভবন) সম্মুখ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শেষ হয়। মিছিল শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বান জানানাে হয় এবং ৪ ফেব্রুয়ারিকে সফল করার জন্য ৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ছাত্রদের প্রস্তুতি বৈঠক বসে।
প্রশ্ন : ৩ ফেব্রুয়ারি কি কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়?
উত্তর : ৩০ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিবাদ মিছিলের বিরােধিতায় তাদের আন্দোলন বিমুখতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে এবং তাদের প্রতি আমাদের প্রবল সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তাই স্থির হয়, ৪ ফেব্রুয়ারিকে সফল করার জন্য সজাগ এবং তৎপর থাকতে হবে। অন্য কোন নাম প্রস্তাবের পূর্বেই সভাপতি হিসেবে আমার নাম প্রস্তাব করতে হবে বলেও স্থির হয়। আরাে ঠিক হয়, এমআর আখতার মুকুল (চরমপত্রের পাঠক) প্রস্তাব করবেন এবং কমরুদ্দীন শহুদ সমর্থন করবেন। পরে সভাপতির সংক্ষিপ্ত ভাষণের পর মিছিল বেরুবে।
প্রশ্ন : ৪ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি সফল হয়েছিল কি?
উত্তর : হ্যা, সফল হয়েছিল। মিছিল বিরােধী পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্যদের কোনাে প্রকার সুযােগ না দেওয়ার জন্য প্রগতিশীল থার্ডগ্রুপের ছাত্ররা তৎপর ছিল। মধুর রেস্তোরা হতে একটি ছােট টেবিল নিয়ে আসা হয়। টেবিলে দাঁড়িয়ে এমআর আখতার মুকুল সভাপতিত্ব করার জন্য আমার নাম প্রস্তাব করে। তার প্রস্তাব করার সময় নূরুল আলম (জনাব আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের পুত্র) এমআর আখতার মুকুলের প্যান্ট ধরে টেনে টেবিল থেকে নামিয়ে দিয়ে সভাপতি হিসেবে আমার নাম বলতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে এম. আর আখতার মুকুল আমার নাম প্রস্তাব করে ফেলে এবং পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চির মতাে লম্বা কমরুদ্দীন শহুদ টেবিলে দাঁড়াবার সুযােগ না পেয়ে নিচে দাঁড়িয়েই আমার নাম সমর্থনের ঘােষণা দেয়। মুকুল টেবিল থেকে নেমে পড়লে কর্মী এবং সমর্থকদের তৎপরতায় আন্দোলনের স্বার্থে আমাকে চট করে টেবিলের ওপর গিয়েই সভাপতির আসন গ্রহণ করতে হয়। সংক্ষিপ্ত দু’একটি কথা বলেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিছিলের কথা ঘােষণা করি। মিছিল সারা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিল শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে সফল করার কথা ঘােষণা করা হয়।
প্রশ্ন : শেখ মুজিব কি তখন জেলে ছিলেন?
উত্তর : শেখ মুজিব তাে এর বহু পূর্ব থেকেই গ্রেফতার হয়ে জেলে ছিলেন। ঢাকা জেলে থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বীয় মুক্তির দাবিতে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। স্থানান্তরের পূর্বে তাঁর অনশনের কথা আমাদের কাছে পৌছলে ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দোতালায় ক্লাস রুমে ছাত্রসভা করে তার মুক্তি দাবি করি। সে সভায় রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় রাজবন্দি মুক্তি আন্দোলন কমিটি গঠন করি। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন জনাব জিল্লুর রহমান (আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক) পরে বাংলাদেশের রপতি। আমাকে এ কমিটির আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, ১৯৫২ সালের মার্চে মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত তিনি ফরিদপুর জেলেই আটক ছিলেন। জনাব মহিউদ্দিনও তখন ফরিদপুর জেলে আটক ছিলেন এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে অনশন করে যাচ্ছিলেন।*
প্রশ্ন : ১৯৭৩ সালে জনাব আবদুস সামাদ আজাদ এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় জনাব শেখ মুজিবুর রহমান নাকি ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের জানালা দিয়ে সামাদ সাহেবকে ১৪৪ ধারা ভাংগার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে কে. জি. মােস্তফাও অনুরূপ সাক্ষাৎকারে সামাদ সাহেবের কথা সমর্থন করেছিলেন। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
উত্তর : (বিস্ময়ের সাথে) এটা কি করে সম্ভব! ২০ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩টায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। শেখ মুজিব এর পূর্বেই ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত হন। সামাদ সাহেব কি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জানালা দিয়ে শেখ মুজিবের মৌখিক নির্দেশ পেলেন? এটা আমার বােধগম্য হচ্ছে না। এ সম্পূর্ণ অবাস্তব কথা।
প্রশ্ন : এবার আমরা পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আপনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্য ছিলেন কি?
উত্তর : না, আমি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্য ছিলাম না।
………………………………………………
* ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেল হতে মুক্তি লাভ করেন এবং স্বাস্থ্যগত কারণে কিছুদিন ফরিদপুরে তাঁর গ্রামের বাড়িতেই অবস্থান করেন। — (ইত্তেফাক ৫ মার্চ, ১৯৫২ দ্রষ্টব্য)।
………………………………………………

প্রশ্ন : একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রশ্নে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের মিটিং-এ কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল?
উত্তর : ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে দিনের মিটিং-এ পনেরাে জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। জনাব আবুল হাশিম উক্ত মিটিং-এ সভাপতিত্ব করেন। ১১ জন ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে এবং ৪ জন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ভােট দিয়েছিলেন। ৪ জন হলেন জনাব অলি আহাদ, আবদুল মতিন, মরহুম ডা. গােলাম মাওলা এবং শামসুল আলম। জনাব তােয়াহা ভােট দানে বিরত থাকেন। কর্মপরিষদের আরাে সিদ্ধান্ত হয় যে, জনাব শামসুল হক সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পরিষদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করবেন। যদি ছাত্ররা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত না মেনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে, তবে স্বাভাবিকভাবেই কর্মপরিষদের বিলুপ্তি ঘটবে।
প্রশ্ন : জনাব তােয়াহা কেন ভােটদানে বিরত ছিলেন?
উত্তর : কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশ ছিল না বলে তিনি ভােটদানে বিরত থাকেন।
প্রশ্ন : সে সময় থেকেই কি জনাব তােয়াহা কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন?
উত্তর : (মৃদু হেসে) হ্যা, তখন থেকেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন। আমরা অনেকেই তখন কর্মপরিষদের সাথে জড়িত ছিলাম।
প্রশ্ন : সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্তকে আপনি গণতান্ত্রিক মনে করেন কি?
উত্তর : প্রক্রিয়াগত দিক থেকে কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অবশ্যই গণতান্ত্রিক ছিল। কিন্তু দেশের বৃহত্তর জনসাধারণের এবং সংগ্রামী ছাত্রসমাজের মানসিকতা সে সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হয়নি। কর্মপরিষদ সে মানসিকতার মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, নতুবা সচেতনভাবে তা উপেক্ষা করেছেন।
প্রশ্ন : সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত জানানাের জন্য যে দু’জন ছাত্র প্রতিনিধি পাঠানাে হয়েছিল, আপনি তাদের নাম বলতে পারেন কি?
উত্তর : হ্যা, আবদুল মােমিন (আওয়ামী লীগের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী) এবং শামসুল আলমকে (যে সময়ের ফজলুল হক হলের ভিপি) পাঠানাে হয়েছিল।
প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কোথায় কিভাবে এ সিদ্ধান্ত নেয়?
উত্তর : মূলত সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্ররা ২০শে ফেব্রুয়ারি ১৭৬ নম্বর কক্ষে জনাব ফকির শাহাবুদ্দিনের (প্রাক্তন এটর্নি জেনারেল) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে মত প্রকাশ করে। অনুরূপভাবে ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে জনাব আবদুল মােমিনের সভাপতিত্বে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার স্বপক্ষে মত প্রকাশ করে। এই সভায় জনাব শাহাবুদ্দীনকে সিদ্ধান্তের কথা জানানাের জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বৈঠকে পাঠানাে হয়।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বৈঠকে ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর আপনাদের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল? আপনারা কি ভিন্ন কোনাে কর্মপন্থা নিয়েছিলেন?
উত্তর : আমরা বিভিন্ন হলের প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের নিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য এবং ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি স্থির করার জন্য বিশেষ বৈঠকে মিলিত হই। ফজলুল হক হলের পুকুরের পূর্ব ধারের সিঁড়িতে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে পরদিন (অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি) যে কোনাে মূল্যে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
প্রশ্ন : এ বৈঠকে কতজন উপস্থিত ছিলেন? সবাই কি ছাত্র?
উত্তর : এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এগারাে জন। এঁরা হলেন- ১. হাবিবুর রহমান শেলী (বর্তমানে হাইকোর্টের বিচারপতি), ২. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর), ৩. মােহাম্মদ সুলতান (ন্যাপের এক সময়ের ভারপ্রাপ্ত জেনারেল সেক্রেটারি এবং ইয়থ লীগের সেক্রেটারি), ৪. এসএ বারী এটি (ন্যাপ মশিয়ুর গ্রুপ- এর সেক্রেটারি) ৫. আবদুল মােমিন (আওয়ামী লীগের প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী), ৬. জিল্লুর রহমান (আওয়ামী লীগের প্রাক্তন জেনারেল সেক্রেটারি), ৭. এমআর আখতার মুকুল (চরমপত্রের পাঠক) ৮. কমরুদ্দীন শহুদ (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অ্যাসােসিয়েট প্রফেসর), ৯. আনােয়ারুল হক খান (ফজলুল হক হলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকালে অস্থায়ী সরকারের তথ্য সচিব) ১০. আনােয়ার হােসেন ১১. আমি।
প্রশ্ন : আনােয়ার হােসেন সাহেবের তাে কোনাে পরিচয় দিলেন না? তিনি পরবর্তীকালে কি করতেন?
উত্তর : তার সম্পর্কে কিছু বলা সত্যিই দুঃখজনক। তিনি বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ইকবাল হলে থাকতেন। ভাষা আন্দোলনের চার পাঁচ মাস পর জানা যায়, তিনি আসলে পুলিশের গােয়েন্দা বিভাগের লােক এবং সাবইন্সপেক্টর র্যাঙ্কের একজন অফিসার। আউয়াল নামক একজন ছাত্র (এফ, ডি, সি-র প্রাক্তন ডাইরেক্টর জেনারেল জনাব বাহাউদ্দিন সাহেবের ভাগ্নে) প্রথমে খালেক নেওয়াজ খান এবং কে জি মােস্তফাকে এ খবর দেন। আউয়াল জানান যে তিনি আনােয়ার হােসেন সাহেবকে তকালে তােপখানা রােডে অবস্থিত আই, বি, অফিসে যাতায়াত করতে দেখেছেন। শুধু তাই নয়, একদিন আইবি, অফিসে প্রবেশ করার সময় পুলিশের সেন্ট্রি যে তাকে ‘সেলিউট করেছে তাও দেখেছেন। এ তথ্য জানার পর খালেক নেওয়াজ খান, কে, জি, মােস্তফা ও অন্য ছাত্ররা তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেন এবং তাঁর বাক্স খুলে গােয়েন্দা বিভাগের আইডেন্টিটি কার্ড খুঁজে পান। এরপর ছাত্ররা মারধর করে তাঁকে সে রাতেই হল থেকে তাড়িয়ে দেয়।
প্রশ্ন : গভীর রাতের ছাত্রবৈঠকে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়?
উত্তর : প্রথমে সবাই একমত হলাম, যে কোনাে মূল্যের বিনিময়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গতে হবে। তারপর প্রশ্ন এল—বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় কে সভাপতিত্ব করবেন? সিদ্ধান্ত হলাে আমাকে সভাপতিত্ব করতে হবে। যদি আমি সভা আরম্ভের পূর্বে গ্রেফতার হই তবে যথাক্রমে এম আর আখতার মুকুল এবং ওরও গ্রেপ্তারজনিত অপরাগতায় জনাব কমরুদ্দীন শহুদ সভাপতিত্ব করবেন। আরাে সিদ্ধান্ত হয়, সভায় শুধুমাত্র শামসুল হক সাহেব এবং তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আবদুল মতিনকেই বক্তব্য রাখার সুযােগ দেয়া হবে। এরপর সভাপতি হিসেবে আমি বা যিনি সভাপতিত্ব করবেন, তিনি বক্তব্য রেখে ১৪৪ ধারা ভাষার পক্ষে সিদ্ধান্ত ঘােষণা করবেন। রাতের বৈঠকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, হাবিবুর রহমান শেলী ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য প্রথম ‘ব্যাচে’র নেতৃত্ব দেবেন।
প্রশ্ন : প্রথম ব্যাচে’ নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য জনাব হাবিবুর রহমান শেলীকেস কেন নির্বাচিত করা হয়?
উত্তর : হাবিবুর রহমান শেলী ছিলেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রদের অন্যতম। ইতিহাসে অনার্স এবং এবং এমএ দুটো পরীক্ষাতেই তিনি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। এছাড়া তাঁর বিনম্র ব্যবহার এবং আচরণের জন্য তিনি সাধারণ ছাত্রদের প্রিয় ছিলেন। সে কারণেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, তিনি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার নেতৃত্ব দিলে সাধারণ ছাত্ররা অধিক মাত্রায় উদ্বুদ্ধ হবে। জনাব হাবিবুর রহমান শেলীও তার সম্ভাবনায় ও প্রতিশ্রুতিশীল ‘ক্যারিয়ারের কথা আদৌ না ভেবে মােহের উর্ধে উঠে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করেছিলেন।
প্রশ্ন : আপনি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কখন যান?
উত্তর : সে দিন রাতে বৈঠকের শেষে অন্যেরা চলে যাওযার পর জনাব আবদুল মমামিন, মােহাম্মদ সুলতান এবং এমআর আখতার মুকুলসহ পরামর্শ হলাে যে, রাতেই আমাকে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে চলে যেতে হবে। সে পরামর্শ অনুযায়ী রাত প্রায় সাড়ে তিনটায় আমি মেডিকেল কলেজের হােস্টেলের ব্যারাক দিয়ে ঢুকে মধুর রেস্তোরার পাশে ছােট পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে ঢুকি এবং মধুর রেস্তোরায় শুয়ে থাকি। পরদিন সকালে ৭টা ৮টার মধ্যে পূর্ব রাত্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন হলের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমায়েত হতে থাকে। এছাড়া ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, প্যাগােজ স্কুল, ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুল এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সংগঠিত করে নিয়ে আসার জন্য পাঠানাে হয়।
প্রশ্ন : পরদিন সকাল বেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলুন না।
উত্তর : পূর্বেই বলেছি, সকাল বেলা ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জমায়েত হতে থাকে। সকাল সাড়ে আটটায় জনাব শামসুল হক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসেন। তাঁর আসার পর থেকেই ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। কেননা তার আসার পূর্ব থেকেই ছাত্ররা গ্রুপে গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গা সম্পর্কে উত্তপ্ত আলােচনায় রত ছিল এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সিদ্ধান্তের বিরদ্ধে মত প্রকাশ করছিল। পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাকর ছিল। এ সময় পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘিরে রেখেছিল এবং এটা স্বাভাবিকভাবেই ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনার সঞ্চার করে। আবার শামসুল হক সাহেব মধুর রেস্তোরায় বসে কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ছাত্রদেরকে বুঝাবার চেষ্টা করলে হাসান হাফিজুর রহমান এতাে উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে, তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে শামসুল হক সাহেবের মাথা থেকে জিন্নাহ ক্যাপটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেন এবং চীকার P65 76019, ‘You have no right to say anything here, get out.’ এছাড়া আমানুল্লাহ খান এবং শহীদ নামে আরেকজন ছাত্র একটা বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার স্বপক্ষে বক্তৃতা জুড়ে দেন। এসব কারণে এটার উত্তপ্ত, বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়।
প্রশ্ন : পরিশেষে একুশে ফেব্রুয়ারি আমলার সভায় আপনিই কি সভাপতিত্ব করেছিলেন? এ নিয়ে কোনাে বিতর্ক হয়েছিল কি?
উত্তর : হ্যা, আমিই সভাপতিত্ব করেছিলাম, এ নিয়ে কোনাে বিতর্ক হয়নি। সভা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর সৈয়দ মােয়াজ্জেম হােসেন। চৌধুরীকে সভাপতিত্ব করার জন্য ছাত্রদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। প্রথমে তিনি রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু পরে ডক্টর জুবেরীর পরামর্শে তিনি ছাত্রদেরকেই সভাপতিত্ব করতে বলেন।
প্রশ্ন : সভায় ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা কত ছিল?
উত্তর : সভায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রী মিলে প্রায় দেড় হাজার থেকে দু’হাজারের মতাে ছিল।
প্রশ্ন : সভায় কে কে বক্তব্য রাখেন? তাঁদের মতামত কি ভিন্ন ভিন্ন ছিল?
উত্তর : শামসুল হক, আবদুল মতিন এ দু’জনই বক্তৃতা করেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা
কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে জনাব শামসুল হক পরিষদের পূর্বদিনের ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত পেশ করেন। এরপর বক্তৃতা করেন জনাব আবদুল মতিন। তিনি পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে বক্তব্য রাখেন এবং ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার স্বপক্ষে নিজ মত প্রকাশ করেন। এরপর সভাপতি হিসেবে আমি আমার বক্তব্য রাখি এবং পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যখন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার স্বপক্ষে সিদ্ধান্ত ঘােষণা করি। তখন সাধারণ ছাত্ররা একবাক্যে সমর্থন করে। আমি পাঁচ জন পাঁচ জন করে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার কথা বলি, কিন্তু আবদুস সামাদ সাহেব একটি সংশােধনী এনে বলেন, ১০ জন করে ব্যাচ গঠন করা উচিত এবং সত্যাগ্রহীরা’ অ্যাসেম্বলীর দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। সভায় ছাত্র সাধারণের মত নিয়ে এ সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হয়।
প্রশ্ন : পরিশেষে কিভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রচেষ্টা চলে?
উত্তর : স্থির হয় ১০ জনের ব্যাচ’ করে ছাত্ররা বেরিয়ে যাবে। প্রথম ব্যাচ’ বের হয় হাবিবুর রহমান শেলীর নেতৃত্বে। দ্বিতীয় ব্যাচ’ ইব্রাহীম তাহা এবং আবদুস সামাদের যৌথ নেতৃত্বে এবং তৃতীয় ব্যাচ’ আনােয়ারুল হক খান ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খানের যুক্ত নেতৃত্বে। এই তিনটি ব্যাচ শাফিয়ার নেতৃত্বে বের হয়। এবং মেয়েরা প্রায় বিনা বাধায় রাস্তায় দিয়ে অগ্রসর হয়ে মধুর রেস্তোরার পূর্ব ধার পর্যন্ত এগিয়ে যায়। তারপর পুলিশের কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া ও লাঠিচার্জ শুরু হয়। পুলিশের আক্রমণের মুখে মেয়েরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। রওশন আরা বাচ্চু, সুফিয়া ইব্রাহীমসহ কয়েজন পুলিশের লাঠির আঘাতপ্রাপ্ত হন।
প্রশ্ন : মেয়েদের ব্যাচে কারা কারা ছিলেন, আপনার স্মরণ আছে কি?
উত্তর : শাফিয়া, সুফিয়া ইব্রাহীম, রওশন আরা বাচ্চু, শামসুন নাহার, হালিমা, বাকি সবার নাম এখন আর স্মরণ নেই। এদের মধ্যে শাফিয়া এবং রওশন
আরা বাছুই ছিলেন রাজনৈতিক দিক থেকে অধিকতর সচেতন।
প্রশ্ন : ছেলেদের আর কোন ‘ব্যাচ’ বের হয়েছিল কি?
উত্তর : মেয়েদের ‘ব্যাচ’ অগ্রসর হওয়ার পর পরই সৈয়দ ফজলে আলী (চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট) এবং শামসুল হকের (রাশিয়ায় প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত) নেতৃত্বে চতুর্থ ব্যাচ’ অর্থাৎ মেয়েদের ‘ব্যাচ’সহ পঞ্চম ‘ব্যাচ’ বের হয়। তারপর পুলিশের বাধা ও আক্রমণ উপেক্ষা করে অব্যাহতভাবে ছাত্ররা গ্রুপে গ্রুপে বেরুতে থাকে। এ সময় পুলিশের লাঠিচার্জ হতে থাকে। কাঁদানে গ্যাসও নিক্ষিপ্ত হয়। নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাসে সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা প্রায় ধোয়াময় হয়ে যায়। এ সময় একটি কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে আমার বুকে লাগে। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে জেনেছি জুলমত আলী খানসহ কয়েকজন বন্ধু আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমার অজ্ঞান হওয়ার খানিক পূর্বে দেখেছি ছাত্ররা ইট-পাটকেল ছুঁড়ে পুলিশের সাথে রীতিমতাে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। একদল ছাত্র মেইন গেইট দিয়ে বের হতে না পেরে মেডিকেল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পূর্বধারের ছােট্ট পাচিলটি ভেঙ্গে মেডিকেল কলেজের গেইটের দিকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। মােটকথা পরিস্থিতি তখন পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। পরে শুনেছি হাসান হাফিজুর রহমানের মতাে ছাত্র অন্য ছাত্রদের ইট-পাটকেল ছোঁড়া থেকে নিবৃত্ত করতে গিয়ে নিজেই পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়ার কাজে লেগে যায়।
প্রশ্ন : এ সময় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের প্রতিনিধি জনাব শামসুল হকের কি ভূমিকা ছিল?
উত্তর : আমতলায় ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর শামসুল হক সাহেব সে সিদ্ধান্ত মেনে নেন এবং সংগ্রামে পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করেন।
প্রশ্ন : সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের বৈঠকে কেন ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের অঙ্গদল ছিল তদানীন্তন আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং তার অঙ্গ ছাত্রদল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের একটি প্রধান অংশের যুক্তি ছিল এ আন্দোলনকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না, যার সুযােগ নিয়ে মুসলিম লীগ নির্বাচন পিছিয়ে দিতে পারে। তদানীন্তন কমিউনিস্ট পার্টিও আওয়ামী মুসলিম লীগের সিদ্ধান্তের বিরােধী কোনাে বক্তব্য দিতে প্রস্তুত ছিল না।
প্রশ্ন : তাহলে কর্মপরিষদের মিটিং-এ কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তের জন্যেই কি তােয়াহা সাহেব ভােট দানে বিরত থাকেন?
উত্তর : হঁ্যা, কারণ কর্মপরিষদের সভায় তােয়াহা সাহেব ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে মত দিলেও ভােটাভুটির সময় পার্টির সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যই ভােট দানে বিরত থাকেন।
প্রশ্ন : আপনিও তাে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রশ্নে আপনার ওপর পার্টির কোনাে নির্দেশ ছিল না?
উত্তর : (মৃদু হেসে) সে সব কথা লিখে কাজ নেই। ১৪৪ ধারা না ভাঙ্গার জন্যই আমার ওপর কঠোর নির্দেশ ছিল। তখন তাে এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নিজস্ব কোনাে কর্মপদ্ধতি ছিল না। প্রকৃতপক্ষে তখনকার কমিউনিস্ট পার্টি ছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির লেজুড়বিশেষ’। আর ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কমরেডরা (কর্মকর্তারা) তাে ছিলেন প্রায় সবাই হিন্দু। তাঁরা আদর্শের দিক থেকে যতটুকু কমিউনিস্ট ছিলেন, তার চেয়ে বেশি ছিলেন হিন্দু।
প্রশ্ন : তখন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ছিলেন কে?
উত্তর : সম্ভবত রনদীতে।
প্রশ্ন : পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট কে ছিলেন?
উত্তর : এখানে তাে কোনাে পার্টির প্রেসিডেন্ট ছিল না। সেক্রেটারি ছিলেন সাজ্জা জহীর।
প্রশ্ন : আমতলার মিটিং-এ আপনি সভাপতিত্ব করলেন, কিন্তু ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সময় আপনি প্রথম ব্যাচে ছিলেন না কেন?
উত্তর : প্রথমেই বলেছিলাম যে, সিদ্ধান্ত ছিল প্রথম ব্যাচে নেতৃত্ব দেবেন হাবিবুর রহমান শেলী। আমি নিজে প্রতিটি ব্যাচ’ কে সংগঠিত করে বের করে দিচ্ছিলাম। এমন অবস্থায় আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। এছাড়া সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলনের স্বার্থে আমাদেরকে বের হতে দেয়নি।
আপনি কি কেহুটা স্তিমিত হয়ে ঝাতে চাচ্ছেন
প্রশ্ন : আপনি কি গ্রেফতার হয়েছিলেন?
উত্তর : না, আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পর আমি আত্মগােপন করি।
প্রশ্ন : এই আত্মগােপন বলতে আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন?
উত্তর : বামপন্থী আন্দোলনের স্বার্থে আমাকে আত্মগােপন করতে হয়।
প্রশ্ন : আপনার নামে কোন গ্রেফতারি পরওয়ানা বের হয়েছিল কি?
উত্তর : হ্যা, প্রায় চার মাস পর জানতে পারি সে গ্রেফতারি পরওয়ানা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রশ্ন : অনেকে জেলে রইলাে অথচ আপনাদের হুলিয়া প্রত্যাহার করা হলাে, কেন?
উত্তর : এপ্রিল মাসের শেষে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রদের জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত সবার গ্রেফতারি পরওয়ানা প্রত্যাহার করা হয়।
প্রশ্ন : অনেককে জেলে রেখে আপনাদের ছেড়ে দেয়া হলাে, তাতে কি মনে হয় যে, সরকারের দৃষ্টিতে আপনারা বিপজ্জনক ছিলেন না? উত্তর : হয়তাে তাই।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা চলছে?
উত্তর : আমি মনে করি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা চলছে এবং তা দু’দিক থেকে। একদিকে কিছু নূতন দাবিদারকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে এবং অন্যদিকে কারাে কারাে নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারার কাঠামােতে ফেলার জন্য এ মহান আন্দোলনের ইতিহাসকে ভিন্ন রূপ দেয়ার চেষ্টা করছেন অনেকে।
প্রশ্ন : সাক্ষাৎকারে কেউ কেউ বলেছেন, জনাব অলি আহাদ বামপন্থী ছিলেন না, বামপন্থীরা তাকে ব্যবহার করছে। আপনার অভিমত কী?
উত্তর : না, আমি মনে করি জনাব অলি আহাদ সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য শুধুমাত্র সত্যের অপলাপই নয়, বরং তাঁর সম্পর্কে এটা একটা অত্যন্ত নির্দয় মন্তব্য। জনাব অলি আহাদ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সেরা ছাত্রদের একজন ছিলেন। ১৯৪৭ সাল থেকে এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে ১৯৪৮ সালে যখন পূর্ব পাকিস্তান। মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়, তখন ‘মুসলিম’ শব্দের দরুন প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রদায়িক রূপ প্রকাশ হওয়ায় তিনি সংগঠনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে একজন হয়েও শেষ পর্যন্ত সংগঠনে যােগ দেননি। ১৯৫১ সালে যে যুবলীগ গঠন করা হয়, অলি আহাদ সাহেব ছিলেন তার সাধারণ সম্পাদক। সাম্প্রদায়িকতা এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতাকে আমি একজন রাজনৈতিক কর্মীর চিন্তাধারার মাপকাঠি মনে করি। সে বিচারে তিনি নিশ্চিতভাবে একজন বামপন্থী ছিলেন।
প্রশ্ন : কাজী গােলাম মাহবুব সাহেবের সাক্ষাৎকারে জানতে পারলাম, মৌলবী ফরিদ আহমদ ভাষা আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, এ সম্পর্কে আপনি কিছু বলতে পারেন কি?
উত্তর : আমি যতদূর জানি, জনাব ফরিদ আহমদ ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে ঢাকা শহরের ছাত্রদের যে সাধারণ সভা হয়, তাতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে লিখিত প্রস্তাব পেশ করে বক্তৃতা করেন। ফরিদ আহমদ সাহেব তখন একদিকে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র ছিলেন, তেমনি অন্যদিকে ঢাকা গভর্নমেন্ট কলেজের ইংরেজির অধ্যাপকও ছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার জন্য তদানীন্তন চিফ সেক্রেটারি জনাব আজিজ আহমদ তাকে সতর্ক করে দিলে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপকের পদ থেকে ইস্তফা দেন।
প্রশ্ন : অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেব বরকত পুলিশের গােয়েন্দা ছিলেন বলে যে তথ্য প্রকাশ করেছেন, সে সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
উত্তর : শহীদ বরকতের সাথে শ্রদ্ধেয় রাজ্জাক সাহেবের ব্যক্তিগত পরিচিতি কতটুকু ছিল আমার জানা নেই, কিন্তু আমরা যেমন আমি, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু নাসের মােহাম্মদ ওয়াহেদ (সিটি ‘ল’ কলেজের উপাধ্যক্ষ) বরকতকে ব্যক্তিগতভাবে জানি। বরকত সম্পর্কে এ ধরনের কথা আদৌ সত্য নয়, হতে পারে না। রাজ্জাক সাহেব যে পুলিশ অফিসারের সূত্র উল্লেখ করে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন তা কোনােক্রমে সত্য হতে পারে না। কারণ পুলিশ কখনাে কোনাে অবস্থায় তাদের গােপন ‘সাের্সে’র নাম প্রকাশ করে না। সে জীবিত হউক কি মৃত হউক।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জুন, ১৯৭৮,
সূত্র : সূত্র: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মােস্তফা কামাল