অধ্যাপক গােলাম আযম
অধ্যাপক গােলাম আযম ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। রাষ্ট্রভাষার দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য এ আন্দোলনের গােড়ার দিকে যে ক’জন ছাত্রনেতা নিরলস সংগ্রামে রত হন, তিনি ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি যখন উত্থাপিত হয়, তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসুর) জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি) নির্বাচত হন। স্বভাবতই ডাকসুর জিএস এবং পুরােভাগের ছাত্রনেতা হিসেবে ভাষা আন্দোলনে তাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়। ১৯৪৪ সালে আইএ, পাস করার পর জনাব গােলাম আযম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে বিএ, পাস করার পর ১৯৪৬ – ৪৭ শিক্ষাবর্ষে তিনি যখন এম, এ- র ছাত্র তখন ফজলুল হক মুসলিম হলের জি, এস, নির্বাচিত হন। ১৯৪৭-৪৮ শিক্ষাবর্ষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৪৮- ১৯৪৯ সালেও তাঁদের সংসদ কার্য পরিচালনা করে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমন্যাসিয়াম মাঠে এক বিরাট ছাত্রসমাবেশে ভাষণ দেন। সে ঐতিহাসিক ছাত্রসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ‘ডাকসুর জিএস গােলাম আযম ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত করতালির মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সম্বলিত মেমােরেন্ডাম পাঠ করেন এবং তা লিয়াকত আলী খানকে প্রদান করেন।
অধ্যাপক গােলাম আযম ১৯২২ সালের ৭ই নভেম্বর মােতাবেক ১৩২৯ বাংলা সনের ৫ই অগ্রহায়ণ ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস সাবেক কুমিল্লা জেলার নবীনগর থানার অন্তর্গত বীরগাঁও-এ। শিক্ষাজীবনে পূর্বাপর তিনি কৃতী ছাত্র ছিলেন। ১৯৩৭ সালে তিনি প্রথম বিভাগে জুনিয়র এবং ১৯৪২ সালে ত্রয়ােদশ স্থান নিয়ে কৃতিত্বের সাথে হাই মাদ্রাসা পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৪৬ সালে বিএ, এবং ১৯৫০ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ, পাস করেন। এ বছরেই ডিসেম্বরে অধ্যাপক হিসেবে তিনি কারমাইকেল কলেজে যােগদান করেন। ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করেন। অধ্যাপনায় রত অবস্থায় তিনি ১৯৫২ সালে রংপুরে ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসেবে গ্রেফতার হন।
ছাত্রজীবনে তিনি প্রত্যক্ষভাবে তমদুন মজলিশের সাথে জড়িত ছিলেন না কিন্তু ১৯৫২ – এর ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে ছাড়া পাওয়ার পর তমদুন মজলিশে যােগ দেন। ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যােগ দেন এবং যখন এই দলের সদস্যপদ লাভ করেন, তখন তিনি রংপুর জেলে বন্দি। প্রকৃতিগতভাবে জনাব গােলাম আযম একজন সংগ্রামী ব্যক্তি। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পিকেটিং করতে গিয়ে প্রথম তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতা হিসেবে পুনরায় গ্রেফতার হন। ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর রুল জারি হলে আবার গ্রেফতার হন। এবং হেবিয়াস কার্পাসের ফলে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬৪ সালে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় তিনি জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য হিসেবে গ্রেফতার হয়ে দু’মাস লাহাের জেলে আটক থাকেন। ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসে তিনি সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ঢাকা প্রেরিত হন এবং পুনরায় ঢাকা বিমান বন্দরে গ্রেফতার হয়ে প্রায় ৬ মাস কারারুদ্ধ থাকেন। এবারেও তিনি হেবিয়াস কার্পাসের ফলে মুক্তিলাভ করেন। জনাব গােলাম আযম ১৯৫৬ সালে প্রাদেশিক জামায়াতের জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৫৭ সালে জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। এ বছরই তিনি সাবেক পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর প্রধান (আমির) নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের নভেম্বরের শেষভাগে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং এ যােগদানের জন্য তিনি সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানে যান। ৩রা ডিসেম্বর তিনি করাচী থেকে ঢাকা রওয়ানা হন। ঢাকার ওপর তখন ভারতীয় বিমান হামলার দরুণ তাঁদের বিমান ঢাকার অতি নিকটবর্তী হয়েও ফিরে গিয়ে কলম্বােয় অবতরণ করতে বাধ্য হয়। এবং অবশেষে তাঁদেরকে জেদ্দা নিয়ে যায়। এভাবেই তিনি বিদেশে আটকা পড়ে যান। ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকার তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করেন এবং তাঁকে প্রবাস জীবন যাপনে বাধ্য করেন। ১৯৭৮ সালের ৯ই জুলাই ভিসা নিয়ে তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। সুদীর্ঘ ৫ বছর বিদেশে থাকাকালেও জনাব গােলাম আযম অনন্য সাধারণ কর্মতৎপর জীবনের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে রিয়াদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামিক যুব সম্মেলনের প্রথম ডেলিগেট মিটিং’-এ তিনি সভাপতিত্ব করেন। এছাড়া তিনি অতিথি বক্তা হিসেবে :
১. ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে লিবিয়ার ত্রিপােলীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী যুব সম্মেলনে ভাষণ দেন,
২. ১৯৭৩ সালের আগস্টে লন্ডনে অনুষ্ঠিত FOSIS -এর বার্ষিক কনভেনশনে ভাষণ দেন,
৩. ১৯৭৩ সালের আগস্টে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ইসলামিক মিশনের বার্ষিক সম্মেলনে ভাষণ দেন,
৪. ১৯৭৭ সালের জুলাইতে ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত IIFSO-এর বার্ষিক সম্মলনে ভাষণ দেন,
৫. ‘ওভারসিজ গেস্ট স্পিকার হিসেবে তিনি ১০৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকার মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত MSA- এর বার্ষিক কনভেনশনে ভাষণ দেন।
প্রবাস জীবনে গােলাম আযম আমন্ত্রিত প্রতিনিধি হিসেবেও বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এগুলাে হলাে :
১. ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে রাবেতা আল- আলমে ইসলামীর উদ্যোগে মক্কায় অনুষ্ঠিত ইসলামী সংগঠন সমূহের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে
২. ১৯৭৬ সালের এপ্রিলে ইউরােপীয় ইসলামিক কাউন্সিলের উদ্যোগে লণ্ডনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামিক কনফারেন্স’
৩. ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে ‘ইমাম মােহাম্মদ বিন সৌদ ইউনির্ভাসিটির উদ্যোগে রিয়াদে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স সম্মেলন’
৪. ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে ‘কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি’র উদ্যোগে মক্কায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী শিক্ষা সম্মেলন।
জনাব গােলাম আযম বেশ কিছু গ্রন্থের রচয়িতা : উহাদের মধ্যে Economic Solution to Medern Economic Problems, A Guide to Islamic Movement. antipeta onntata সংঘাত, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা, ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষবাদ, নবী জীবনের আদর্শ, বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলন প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযােগ্য। ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলায় গােলাম আযমকে গ্রেফতার করে। ২০১৩ সালের ১৫ই জুলাই তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগের মধ্যে ৫টি অভিযােগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেয় ট্রাইবুনাল। আর ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যবরণ করেন।
প্রশ্ন : কোন সময় হতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয় বলে আপনি মনে করেন?
সূচনার লগ্ন থেকেই কি আপনি এ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন?
উত্তর : তমদুন মজলিশ এ আন্দোলনের সূচনা করেন। তবে ঠিক কোন সময় তা সঠিক খেয়াল নেই। যতদূর মনে পড়ে কায়েদে আযমের আগমনের পূর্বে ১৯৪৮- এর মার্চের শুরুতে আমি এর সাথে জড়িত হই।
প্রশ্ন : এ আন্দোলনের উদ্যোক্তা কারা ছিলেন?
উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে গঠিত তমদুন মজলিশই এর উদ্যোক্তা। কায়েদে আযমের আগমনের পূর্বে রাষ্ট্রভাষার দাবি প্রথম আন্দোলনের রূপ নেয়। ১১ মার্চের পর সরকারের সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের চুক্তি এবং কায়েদে আযমের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আন্দোলন স্তিমিত হয়। কিন্তু ব্যাপক আন্দোলনে রূপ না নিলেও ক্রমে ক্রমে দানা বাঁধতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের ১৯৫২ সালের পল্টনের ঘােষণার পর পরই এ আন্দোলন সত্যিকার অর্থে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলনের রূপ নেয় এবং গুলিবর্ষণের পর সর্বপ্রথম গণআন্দোলনে পরিণত হয়।
প্রশ্ন : আপনি কোন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন? কোন সালে আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের (ডাকসু) G. S. নির্বাচিত হন? তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের তৎপরতা কিরূপ ছিল?
উত্তর : ১৯৪৪ সালে আইএ পাস করার পরই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ১৯৪৬ সালে বিএ পাস করি এবং ১৯৪৬ – ১৯৪৭ শিক্ষাবর্ষে যখন এম, এ-র ছাত্র তখন ফজলুল হক মুসলিম হলের জিএস, নির্বাচিত হই। ১৯৪৭-৪৮ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকুস) G. S. নির্বাচিত হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই আবাসিক ছিল। হলগুলােতে Extra Academic Activities এত বেশি ছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের তৎপরতার সুযােগ ছিল অত্যন্ত সীমিত। দুটো মুসলিম হল এবং দুটো হিন্দু হলের নিয়মিত সাহিত্যানুষ্ঠান, ড্রামা এবং স্পাের্টস ছাড়াও ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান হলগুলােকে কর্মচঞ্চল রাখত। পাকিস্তান আন্দোলন হিন্দু ও মুসলিম ছাত্রদেরকে সুস্পষ্ট দুটি ক্যাম্পে বিভক্ত করায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর সর্বপ্রথম ১৯৪৬ সালের শেষ দিকে আবার শুরু হয় এবং এর পরবর্তী বছর আমি G. S. নির্বাচিত হই। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের তেমন কোনাে রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল না। রাজনৈতিক তৎপরতা হলগুলােতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
প্রশ্ন : বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রথম ছাত্রদের মনে কিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে?
উত্তর : কায়েদে আযমের ১৯৪৮-এর মার্চের আগমনের পূর্বে এ বিষয়ে ছাত্রদের মধ্যে তেমন খবরই ছিল না। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১১ই মার্চের প্রচেষ্টা এ দিকে ছাত্রদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছাত্রমহলে এর বিরােধিতা দেখা যায়নি। হয় সমর্থন না হয় নির্লিপ্ততা ছিল। ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ১৯৫২ সালেই হয়।
প্রশ্ন : আপনি তমদুন মজলিশের সাথে জড়িত ছিলেন কি? উত্তর : ছাত্রজীবনে আমি প্রত্যক্ষভাবে মজলিশের সাথে জড়িত ছিলাম না। রংপুরে আমি যখন কারমাইকেল কলেজে অধ্যাপনা করি, তখন ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার হই। জেল থেকে বের হওয়ার কিছুদিন পর মরহুম সুলায়মান ভাইয়ের মাধ্যমে প্রথম দাওয়াত পাই এবং মজলিশে যােগদান করি। ১৯৫৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত মজলিশের রংপুর জেলা শাখার প্রধান ছিলাম। তখন নিয়মিত মজলিশের সম্মেলন ও শিবিরে অংশগ্রহণ করতাম। প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন কবে থেকে এবং কিভাবে?
উত্তর : ১৯৪৮ সালে মার্চ থেকে ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে শরীক হই। মনে
পড়ে ১১ই মার্চ আমরা হলের একদল ছাত্র সংগঠিত হয়ে T & T অফিসের সামনে (বর্তমানে টেলিফোন একচেঞ্জ ভবন) পিকেটিং করতে যাই। যেখানে আমরা ১০/১২ জন গ্রেফতার হই। আমাদের গ্রেফতার করে তেজগা ও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এমন এক ঘরে আমাদের আটক রাখা, যার চালা ভাঙ্গা ছিল। এক সময় বৃষ্টি হলে আমরা সবাই ভিজে যাই। আরাে মনে পড়ছে, আশেপাশের মানুষ আমাদের জন্য গুড়মুড়ি নিয়ে আসে। তা খেয়েই আমরা সারাদিন কাটিয়ে দেই। সন্ধ্যায় আমাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রভাষার দাবির প্রশ্নে প্রথমে যেসব বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, সে সম্পর্কে একটু আলােকপাত করুন না। পুরােনাে ঢাকায় সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার কিছু জানা আছে? সে সম্পর্কে উল্লেখযােগ্য কিছু ঘটনার কথা বলুন না।
উত্তর : অন্যেরা এ বিষয়ে যা বলেছেন তাই যথেষ্ট। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় থেকেই সিদ্দিক বাজার, বংশাল ও চকবাজার এলাকা মুসলিম প্রধান বিধায় সে কোনাে আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থনের জন্য সেখানে যেতে হতাে। একদল ছাত্র নিয়ে মিছিল সহকারে একদিন চকে গিয়েছিলাম। চুংগা ফুকে রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে স্লোগান দিচ্ছি। জেলের প্রধান ফটক অতিক্রমকালে জেলের ভেতর থেকেও আমাদের গ্রেফতারকৃত সাথীরা স্লোগানে সাড়া দিয়ে আমাদের সমর্থন জানালাে। চক পর্যন্ত যেতে যেতে আমরা তাদের স্লোগান শুনলাম। চকবাজার মসজিদের পাশে যখন ভাষার দাবিতে চুংগার মাধ্যমে বক্তৃতা দিচ্ছিলাম, তখন সরকার সমর্থক এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার কিছু বিরােধী লােক হামলা করে, আমার হাত থেকে চুংগা কেড়ে নিয়ে মাথায় ও গায়ে চুংগা দিয়ে মারতে থাকে। আমরা বুঝিয়ে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করি। যারা সেদিন ভাষা প্রশ্নে এমন ব্যবহার করেছেন আজো তাঁদের অনেকে বেঁচে আছেন। কর্মজীবনে বহুবার তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। টিনের চুংগা ফুঁকে পুরােনাে ঢাকার আরাে অনেক জায়গায় বক্তৃতা করেছি। শ্লোগান দিয়েছি- বাংলা উর্দু ভাই ভাই, উর্দুর সাথে বাংলা চাই’। ঢাকার আদি অধিবাসীদের ভাষা ছিল এক ধরনের অশুদ্ধ উর্দু, তাই ভাষা প্রশ্নে। তাদের সমর্থন পাওয়া যায়নি। তবে বাংলার বিপক্ষে সব জায়গা থেকে হামলা হয়নি। পুরােনাে ঢাকায় মাওলানা দীন মুহাম্মদ (মরহুম), মাওলানা জাফর আহমদ ওসমানী, মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী প্রমুখের প্রভাব থাকায় এখানকার অধিবাসীরা উর্দুর পক্ষে ছিল। তদানীন্তন প্রাদেশিক সরকার রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটিকে ভারতের উস্কানি ও হিন্দুদের আন্দোলন বলে প্রচার করায় জনমনে এ সম্বন্ধে সন্দেহ ছিল। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, এ আন্দোলনে সবাই একই উদ্দেশ্যে শামিল হয়নি। আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। পূর্ব-পাক সাহিত্য সংসদের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে সৈয়দ আলী আহসানের সাথে আমার খানিক পরিচয় ছিল। সে সূত্রে তার সাথে পুরােনাে রেডিও অফিসে (বর্তমান বােরহান উদ্দীন কলেজ) রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে একবার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার বিরােধী ছিলেন। এমনি ধরনের আরাে অনেকে ছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় অনেক বুদ্ধিজীবী এবং সুধীমহলের সমর্থন তখনও বাংলার পক্ষে ছিল না।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের পেছনে কি যুক্তি ছিল? তকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােকপাত করুন না।
উত্তর : পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগণ ছিল বাংলাভাষী। তাই বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে এটাই ছিল যুক্তিসঙ্গত দাবি।। উর্দু যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মাতৃভাষা নয় এটা বাংলাভাষীরা অনেকেই জানতেন না। আর এ জন্যই কায়েদে আযম যখন ঘােষণা করেন যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, তখন এটাকে পূর্ব পাকিস্তানিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা বলে গণ্য করা হয়। অবাঙালি পাকিস্তানিরা যেহেতু উর্দুতেই কথা বলতেন, তাই এটাকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা মনে করা হতাে। স্বভাবতই ছাত্র সমাজের মনে তীব্র বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে দুটো গ্রুপ ছিল। এক গ্রুপের নেতা ছিলেন নাজিমুদ্দিন-নূরুল আমীন এবং অন্য গ্রুপের নেতৃত্ব দেন সােহরাওয়ার্দী- আবুল হাশিম। নাজিমুদ্দিন গ্রুপ উর্দুর পক্ষে ছিল এবং তাই সােহরাওয়ার্দী সাহেব বাংলার পক্ষাবলম্বন করেন। আমরা শামসুল হকের সহকর্মীরা এ গ্রুপেই ছিলাম।।
প্রশ্ন : শামসুল হক সম্পর্কে কিছু বলুন না?
উত্তর : তিনি ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের একজন অত্যন্ত যােগ্যতাসম্পন্ন কর্মী। পরবর্তীকালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে তার বিশেষ অবদান ছিল।
প্রশ্ন : বাংলাভাষার বিরােধিতা করেছেন কারা? কোন মানসিকতা তাঁদেরকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করে?
উত্তর : এঁদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লােক ছিলেন। কেউ কেউ কায়েদে আযমের অন্ধ অনুরাগী। কায়েদে আযম যা বলেছেন এর বিরােধিতা করার কথা এঁরা চিন্তা করতে পারতেন না। এদেশের ওলামা সমাজ উর্দুর পক্ষে ছিলেন। এর কারণ হয়ত তাদের পরিচিতি বাংলার চেয়ে উর্দুর সাথে ছিল ঘনিষ্ঠতর। এ প্রসঙ্গে পল্টনে মাওলানা দীন মােহাম্মদ সাহেবের এক জনসভার কথা মনে পড়াে, তিনি সভায় উর্দুতে বক্তৃতা শুরু করলে আমরা ছাত্ররা ‘বাংলায় বলুন বলে ধ্বনি তুলি। তখন তিনি বলে উঠেন, ‘সিনেমা হলে উর্দু ছবি না হলে মন ভরে না, এখন চান বাংলায় বক্তৃতা। আমরা চুপ করে যাই। আমাদের তেমন সমর্থকও ছিল না। তখন তিনি উর্দুতেই বক্তৃতা করেন। নাজিমুদ্দিন সাহেবের সমর্থকরা উর্দুর পক্ষে ছিলেন। কারণ পাকিস্তানের সংহতির জন্য তারা একটা রাষ্ট্রভাষার প্রয়ােজনীয়তাবােধ করতেন এবং এজন্য ভাষা আন্দোলনকারীদের তাঁরা হিন্দু কমিউনিস্টদের এজেন্ট মনে। করতেন। আর একটা শ্রেণীও বাংলা ভাষার বিরােধিতা করেছেন। এঁরা সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে উর্দুকে হিন্দির বিরুদ্ধে মুসলিম জাতির সাধারণ ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতেন।
প্রশ্ন : ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ঘটনা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে কতটুকু তাৎপর্যবহ? ১১ মার্চের পূর্বে রাষ্ট্রভাষা বাংলার স্বপক্ষে কোনাে গণবিক্ষোভ বা ধর্মঘট পালিত হয়েছিল কি?
উত্তর : ১১ মার্চের পূর্বে ভাষা প্রশ্নে কোনাে গণবিক্ষোভ বা ধর্মঘটের কথা মনে পড়ছে না। কায়েদে আযমের আগমনের পূর্বে এই দাবির যথার্থতা তুলে ধরার জন্যই প্রথম গণদাবি হিসেবে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন শুরু হয়। ১১ মার্চ সে বিচারে ঐতিহাসিক মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে। ১৯৪৮ সালে এটা ছাত্রপ্রধান বিক্ষোভই ছিল।
প্রশ্ন : নাজিমুদ্দিনের সাথে ছাত্রদের ৭ দফা চুক্তি কিভাবে কোন পরিস্থিতিতে সম্পাদিত হয়? এই চুক্তি কি ১১ই মার্চের ফলশ্রুতি?
উত্তর : পরিস্থিতিকে শান্ত করার জন্য নাজিমুদ্দিন সরকার ছাত্রদের সাথে সাত দফা চুক্তি সম্পাদন করেন। কায়েদে আযমের সফর উপলক্ষে পরিস্থিতিকে শান্ত করাই ছিল এর প্রধান উদ্দেশ্য। ১৫ মার্চ এ চুক্তি সম্পাদিত হয়। হ্যা, এই চুক্তি ১১ মার্চের আন্দোলনের ফল।
প্রশ্ন : ১১ মার্চে যাঁরা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন না।
উত্তর : আপনাদের পূর্বের সাক্ষাৎকারগুলােতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে। নতুন করে আর তেমন কিছু বলার নেই।
প্রশ্ন : কায়েদে আযম কখন ঢাকা সফরে আসেন? কায়েদে আযমের আগমন উপলক্ষে ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেছিল কি?
উত্তর : ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ তিনি ঢাকা আগমন করেন। ২১ মার্চ তিনি রেসকোর্সে বক্তৃতা করেন। কায়েদে আযম ইংরেজিতে ভাষণ দিয়েছিলেন। আমি মঞ্চের পেছনের দিকে একপাশে বসেছিলাম। পেছনে থেকে বক্তৃতারত কায়েদে আযমকে লক্ষ্য করছিলাম। তিনি কখনাে কখনাে হাত নেড়ে খানিক পা উঁচিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। একমাত্র উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে। শুনার পর আমি ক্ষুব্ধ হয়ে হলে ফিরে আসি এবং সেখানেই রেডিওতে বাকি বক্তৃতাটুকু শুনি। কার্জন হলে ‘নাে, নাে’ প্রতিবাদ ছাড়া অপ্রীতিকর আর কিছু ঘটেনি।
প্রশ্ন : রেসকোর্সের জনসভায় প্রতিবাদ উঠেছিল কি?
উত্তর : আমি কোনাে প্রতিবাদ উঠতে দেখিনি। অবশ্য আমার বসার স্থান থেকে বিশাল জনসভার সামান্য অংশই দৃষ্টিগােচর হচ্ছিল। তেমন কিছু দেখতে পাওয়া যায়নি। আমি ক্ষুব্ধ মনে চলে আসার সময়ও কোথাও থেকে কোনাে আওয়াজ শুনিনি। পরেও কেউ এ প্রসঙ্গে বলেনি।
প্রশ্ন : কায়েদে আযমের সঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধি দলের যে সব সাক্ষাৎকার হয়েছিল, তাতে আপনি উপস্থিত ছিলেন কি? সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সম্পর্কে কিছু আলােচিত হয়েছিল কি?
উত্তর : শুধু হল ইউনিয়নের V. P. ও G. S.-রাই উক্ত সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন। আমি উপস্থিত ছিলাম না। আমাদের হলের V. P. ছিলেন তােয়াহা সাহেব। আমরা একই দলের ছিলাম।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রভাষার দাবি সম্বলিত কোননা স্মারকলিপি দেয়া হয়েছিল কি?
উত্তর : হ্যা, স্মরকলিপি দেয়া হয়েছিল। শুনেছি, একাধিক রাষ্ট্রভাষার নজির দেখালে তিনি তা অবগত আছেন বলে জানান। কিছুটা বিরক্ত হয়ে তিনি বলেন, ‘Now leave it to me’.
প্রশ্ন : কার্জন হলের কনভােকেশনে আপনি উপস্থিত ছিলেন কি?
উত্তর : ওটা ছিল বিশেষ কনভােকেশন। আমি তখন এমএ, পড়ি। তাই সে কনভােকেশনে উপস্থিত ছিলাম না। সেখানকার ঘটনা পরে বন্ধুদের কাছে জেনেছি
প্রশ্ন : তােয়াহা সাহেব আপনার হলের V. P. ছিলেন বলেছেন। তার সাথে। আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?
উত্তর : পূর্বেই বলেছি, তখন আমরা একই দলে ছিলাম। আমাদের মাঝে খুবই ভালাে সম্পর্ক ছিল। একই সাথে ওঠা-বসা, চলাফেরা ছিল। হল কেন্টিনে। একসাথে নাস্তা খেতে যেতাম। তােয়াহা সাহেব খুব ভালাে কোরআন। তেলাওয়াত করতেন। নামাজও পড়তেন।
প্রশ্ন : লিয়াকত আলী খান কখন ঢাকা সফরে আসেন? তিনি ঢাকায় কোনাে ছাত্র সমাবেশে ভাষণ দিয়েছিলেন কি?
উত্তর : ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা সফরে আসেন। কোন মাসে ঠিক মনে নেই। তবে শীতকাল ছিল বলে মনে পড়ে। হ্যা, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমন্যাসিয়াম মাঠে এক বিরাট ছাত্র সমাবেশে ভাষণ দেন। সভাপতি ছিলেন কার্যরত ভাইস চ্যান্সেলর সুলতান উদ্দীন আহমদ।
প্রশ্ন : ছাত্রদের পক্ষ হতে লিয়াকত আলী খানকে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত কোনাে মেমােরেন্ডাম প্রদান করা হয়েছিল কি?
উত্তর : হ্যা, ছাত্রদের পক্ষ হতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সম্বলিত একটি মেমােরেন্ডাম প্রদান করা হয়। ডাকসুর জিএস, হিসেবে আমি ঐ মেমােরেন্ডাম পাঠ করি। ভাষার কথাটা ছিল প্রায় শেষের দিকে। এর পূর্বে আঞ্চলিকতা ও প্রাদেশিকতার নিন্দা ছিল। মনে পড়ে, ভাষার দাবির প্যারাটা দু’বার পড়েছিলাম। একবার পড়ার পর ছাত্র সমাবেশে তুমুল করতালি পড়ে। করতালি শেষ হলে আমার কানে এল বেগম রানা লিয়াকত আলী রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্যারাটি শুনে লিয়াকত আলী খানকে বলছেন, ‘ল্যাঙ্গুয়েজকে বারে মে সাফ সাফ বাতা দেনা। যেখানে দাঁড়িয়ে স্মারকলিপি পাঠ করছিলাম, তার পাশে রানা লিয়াকত বসেছিলেন। তাঁর কথা শুনে, আমি Let me repeat this’ বলে আবার ভাষার দাবির প্যারাটা পড়লাম। আবারও এ দাবির সমর্থনে সমাবেশে তুমুল করতালি পড়ে।
প্রশ্ন : সমাবেশে রাষ্ট্রভাষার স্মারকলিপিটি পাঠ করার দায়িত্ব আপনার ওপর অর্পিত হলাে কিভাবে?
উত্তর : চারটি হল ইউনিয়নের ছাত্র নেতৃবৃন্দ সঙ্গত কারণেই ডাকসুর কাউকে দিয়ে স্মারকলিপি পেশ করতে ঐকমত্যে পৌঁছেন। V. P. অরবিন্দু বােস ছিলেন হিন্দু। তাঁকে দিয়ে পাঠ করালে সরকার তা ভিন্নভাবে চিত্রিত করতে পারেন। তাই ডাকসুর জিএস হিসেবে দায়িত্ব আমার ওপর অর্পিত হয়।
প্রশ্ন : ভাষা প্রশ্নে লিয়াকত আলী খান কি মন্তব্য করেছিলেন?
উত্তর : বক্তৃতার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘If it is not provincialism, then what is provincialism?’ তার কথাগুলাে শুনে আমরা ভেবেছিলাম, তিনি হয়ত ভাষা প্রশ্নে সুস্পষ্ট কোনাে মন্তব্য রাখবেন। কিন্তু না, তিনি আর কিছু বলেননি। গােটা প্রসঙ্গটাই এড়িয়ে গেলেন।
প্রশ্ন : ১৯৪৮-এর ১১ মার্চের কর্মসূচির উদ্যোক্তা কারা ছিলেন?
উত্তর : হল ইউনিয়নসমূহের নেতৃবৃন্দ এবং প্রথম রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের নেতৃবৃন্দের যৌথ উদ্যোগেই ১১ই মার্চের হরতাল ও গণবিক্ষোভের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
প্রশ্ন : পরবর্তী পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের উল্লেখযােগ্য ঘটনা কি ছিল? উত্তর : ১৯৪৮ সালের পরবর্তী উল্লেখযােগ্য ঘটনা হলাে পাকিস্তানের উজীরে আযম খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টনের ঘােষণা। ১৯৫২ সালে পল্টন ময়দানে তিনি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত কায়েদে আযমের উক্তির পুনরাবৃত্তি করার পরই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন প্রথম গণদাবিতে পরিণত হয়। প্রশ্ন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি কখন গঠিত হয়?
উত্তর : এ সম্পর্কে আমি অবগত নই। আমি তখন অধ্যাপনা করি। প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা কিরূপ ছিল? উত্তর : বামপন্থীরা পাকিস্তান আন্দোলনের বিরােধী থাকায় তাতে মুসলমানদের সংখ্যা নগণ্য ছিল। বামপন্থীদের কোনাে প্রকাশ্য তৎপরতা ছিল না। ১৯৫২ সালের পর তাঁরা সক্রিয় হন। কিন্তু তখনও উল্লেখযােগ্য কোনাে সংগঠন গড়ে উঠেনি। অধিকাংশই আওয়ামী মুসলিম লীগের মাধ্যমে কাজ করতেন। সুতরাং আন্দোলনে তাদের ভূমিকা পৃথক করে দেখার কোনাে উপায় নেই।।
প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মতৎপরতায় শেখ মুজিবের সাথে আপনার কোনাে আলাপ-পরিচয় গড়ে উঠেছিল কি?
উত্তর : শেখ মুজিব তখন কোনাে উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারের প্রাক্কালে। ১৯৫৪ সালে রংপুর নির্বাচনী সফরে সােহরাওয়ার্দী সাহেব এক গণতান্ত্রিক কর্মীশিবিরে ভাষণ দিতে যান। শেখ মুজিবও তার সাথে ছিলেন। আমি তখন অধ্যাপনা করি। সে সময় শেখ মুজিব আমাকে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলেন ‘ইনি হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের প্রাক্তন জিএস। ১৯৪৮ সালে লিয়াকত আলী খানের নিকট রাষ্ট্রভাষা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি ইনিই পেশ করেছিলেন। শেখ মুজিব আমার তখনকার পরিচিতিও তুলে ধরেন।
প্রশ্ন : আপনি ঢাকা ডাইজেস্টে প্রকাশিত ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত বিশেষ সাক্ষাৎকারগুলাে পড়েছেন কি
উত্তর : হ্যা, পড়েছি খুব মনােযােগ দিয়ে, আগ্রহের সাথে। প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার ব্যাপারে ঢাকা ডাইজেস্ট যে উদ্যোগ নিয়েছে সে সম্পর্কে আপনার অভিমত কি? ভাষা আন্দোলনেরস ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে বলে মনে করেননি? উত্তর : এ প্রচেষ্টা প্রশংসার যােগ্য। ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত হচ্ছে কিনা জানি না। | ঢাকা ডাইজেস্টে প্রকাশিত বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে কিছু পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কারণ ইতিহাসের একই ঘটনাকে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন।
প্রশ্ন : ১৯৫২ সালে আপনি কোথায় ছিলেন? সেখানে আন্দোলনের পরিস্থিতি কেমন ছিল?
উত্তর : রংপুর কারমাইকেল কলেজে। সেখানে কলেজের কয়েকজন অধ্যাপক এবং ছাত্রনেতা ও রাজনীতিক এ আন্দোলন চালান। আমি ও বাংলার অধ্যাপক জমির উদ্দীন (বর্তমানে কুমিল্লায় আছেন) এবং বেশ কয়েকজন ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী গ্রেফতার হই।
প্রশ্ন : আন্দোলন সম্পর্কে আপনার আর কোনাে বক্তব্য আছে কি?
উত্তর : বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করা সত্ত্বেও একে এতদিন সরকারি পর্যায়ে মর্যাদা দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হওয়ায় সে সুযােগ এসেছে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জানুয়ারি ১৯৭৯,
সূত্র : সূত্র: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মােস্তফা কামাল