ডা. সাঈদ হায়দার
ডা. সাঈদ হায়দার ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। স্বভাবতই ডা. হায়দার আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় ডা. সাঈদ হায়দার বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশনের চিফ মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ সালে তিনি পাবনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী সদরউদ্দিন আহমদ তদানীন্তন বেঙ্গল সিনিয়র এডুকেশন সার্ভিসের সদস্য ছিলেন। তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ও কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশােনা করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হতে এমবি, বি-এস, ডিপ্লোমা লাভ করেন। পরে ১৯৫৮ সালে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাবলিক হেলথে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। অতপর তিনি পি, আই, ডি, সি- তে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যােগদান করেন। প্রমােশন পেয়ে ক্রমে তিনি ই, পি, আই, ডি, সি-র চিপ মেডিকেল অফিসার পদে উন্নীত হন। পরবর্তীসময় ১৯৮৩ সালে বিটিএমসি’র চাকরি থেকে অবসর নেন। তিনি রােগ নিরাময়-সুস্থ জীবন এবং সুন্দরী হতে হলে’ নামে বহুল প্রশংসিত দু’টি গ্রন্থের রচয়িতা। সম্প্রতি বাংলা একাডেমি তাঁর লেখা ‘লােকসমাজ চিকিৎসা বিজ্ঞান বৃহদাকার বইটি তিন খণ্ডে প্রকাশ করেছে। ডেভিডসনের চিকিৎসা বিজ্ঞান পাঠ্য পুস্তকের তিন খণ্ড অনুবাদ গ্রন্থের সম্পাদককের মধ্যে তিনিও অন্যতম। এ ছাড়া ‘পপুলার সাইন্সের ওপর তাঁর অনেক লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। বার্ষিক ‘প্রেসক্রাইবার্স গাইড’নামে একটি চিকিৎসা ম্যাগাজিন তিনি দীর্ঘদিন থেকে সম্পাদনা করে আসছেন। ডা. সাঈদ হায়দারের এ সাক্ষাৎকার ভাষা আন্দোলনের কিছু তথ্য জোগাবে বলে আমরা আশা করি।
প্রশ্ন : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় আপনি কি ঢাকা মেডিকেল কলেজের
ছাত্র ছিলেন?
উত্তর : হ্যা, তখন আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে শেষ বর্ষের ছাত্র।
প্রশ্ন : আপনি কোন সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন? তখন মেডিকেল
কলেজের ছাত্র সংখ্যা কত ছিল? আপনি কি মেডিকেল কলেজ হােস্টেলেই থাকতেন?
উত্তর : ১৯৪৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। আমি ১৯৪৭ সালে
ভারত বিভাগের সময় কোলকাতা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে এসে ভর্তি হই। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে এই কলেজে শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের পড়াশােনা চলছিল। তাই কলকাতা থেকে সকল শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এখানে আসা সম্ভব হয়নি। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের জন পঞ্চাশেক ছাত্র যারা বিপুল আশায় বুক। বেঁধে কোলকাতা থেকে চলে এলাম, তাদেরও বাসস্থানের সমস্যা দেখা দিল। আমরা বাইশজন ছাত্র এবং একজন ছাত্রী এলাম, যাদের প্রথম এমবি,বি-এস, পরীক্ষা অত্যাসন্ন। মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের তখন কোনাে নিজস্ব হােস্টেল ছিল না। সলিমুল্লাহ হল, ফজলুল হক হল, ঢাকা হল প্রভৃতি ছাত্রাবাসে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত। কোলকাতা ও পশ্চিম বাংলা থেকে আগত হাজার হাজার সরকারি কর্মচারীর মত, সরকার সদ্য আগত মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের থাকার জন্য পুরাতন পলাশী ব্যারাকে একটি অংশ নির্দিষ্ট করে দেন। আহসানুল্লাহ কারিগরী স্কুল ও কলেজের সুদৃশ্য পুরাতন হােস্টেলের দক্ষিণের রেলক্রসিং এর ওপারে সেই বাশের ব্যারাকটির অস্তিত্ব আজ আর নেই। কিন্তু ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে সেই উত্তেজনার দিনগুলােতে এই বাঁশের ব্যারাকটি ছাত্রদের রাতদিন পড়াশােনা আর সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহের আলােচনায় মুখর থাকত। আমি অবশ্য হােস্টেলে স্থান নেইনি।
প্রশ্ন : কোথায় থাকতেন? তাহলে কি ছাত্র হােস্টেলের সমসাময়িক ঘটনা সম্পর্কে আপনি পুরােপুরি অবহিত ছিলেন না?
উত্তর : মগবাজারে আজ যেখানে ইস্পাহানি কলােনি গড়ে উঠেছে তার আম বাগানের পেছনে ‘সিসেম হাউসে এক কোণের বাসায় থাকতাম আমি। তাই বলে ছাত্র হােস্টেলের সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের কোনটিই অজ্ঞাত ছিল না। কারণ বেশিরভাগ সময় সেখানেই কাটাতে হতাে। প্রত্যহ পড়াশােনার তাগিদে ব্যারাকে যেতে হতাে পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য। রাতেও থাকতে হতাে মাঝে মাঝে। কারণ সে সময় সঙ্গীহীন পায়ে হেঁটে বাসায় ফেরার সম্ভব হতাে না। সন্ধ্যার পর জনমানবশূন্য রমনার পথে হাঁটতে গা ছছ করত। সেদিনের ঢাকায় এ অঞ্চলে বাস চলত না। স্কুটার, বেবি ট্যাক্সি তাে ছিলই না, রিক্সার সংখ্যাও ছিল নগণ্য।
প্রশ্ন : আপনাদের ছাত্রদের মাঝে সমসাময়িক আলােচনায় কি কি বিষয় স্থান পেতাে?
উত্তর : ছাত্রদের শিক্ষা ও আবাসিক সমস্যা ছাড়াও রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি আলােচনার অন্যতম বিষয়ে পরিণত হতাে।
প্রশ্ন : এ সময়ে সংঘটিত রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত কোনাে উল্লেখযােগ্য ঘটনার কথা মনে পড়ে কি?
উত্তর : ১৯৪৭ সালের শেষের দিকের ঘটনা, সম্ভবত ডিসেম্বরের দিকে। দিনক্ষণ সঠিক মনে করতে পারছি না। আমাদের পলাশী ব্যারাকের ছাত্রাবাসের সামনের রাস্তায় ভাষা প্রশ্নে প্রথম প্রতিরােধ দ্বন্দ্ব সংঘটিত হলাে।
ছাত্রাবাসের সামনের সেই রাস্তাটি লেভেল ক্রসিং পেরিয়ে সােজা সলিমুল্লাহ হলের সামনে এসে মিশেছিল। ইদানীং অবশ্য সলিমুল্লাহ হলের সামনে রাস্তার মুখটি উঁচু দেয়াল তুলে বন্ধ করে দিয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় রাস্তাটিকে তাদের ক্যাম্পাসের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। সেদিন এ রাস্তা দিয়ে জন পঞ্চাশেক লােকের এক মিছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে শ্লোগান দিতে দিতে নাজিরাবাজার ও মৌলভীবাজারের দিক থেকে এসে হাজির হয়। এদের অধিকাংশই ছিল পুরােনাে ঢাকার স্থানীয় অধিবাসী এবং নবাবদের সমর্থক। প্রতিরােধে এল, তাদের অগ্রগতিকে বাধা দিতে বেরিয়ে এল মেডিকেল ছাত্রাবাসের ছাত্ররা, বেরিয়ে এল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হােস্টেলের ছাত্ররা। সে এক খণ্ড যুদ্ধ। মিছিলের সাথে যে ভগ্নপ্রায় বাসটি ছিল, তার ভেতর লুকিয়ে রাখা লাঠি ও রড নিয়ে ওরা আক্রমণ করলাে ছাত্রদের ওপর। আমরা রেললাইনের পাশে রক্ষিত প্রস্তর খণ্ড নিক্ষেপ করে পাল্টা আক্রমণ করলাম ওদের। স্বল্প সময়ের এ খণ্ড যুদ্ধ সম্ভবত ভাষা প্রশ্নে ঢাকার রাজপথে প্রথম প্রত্যক্ষ সংগ্রাম।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের গােড়ার দিক থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা সচেতন ছিল?
উত্তর : হঁ্যা, ভাষা আন্দোলনের প্রথম থেকেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা সচেতন ছিল। মহান ভাষা আন্দোলনে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৮-এর গােড়ার কথা। মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী ছাত্রাবাস উঠে গেছে। তাদের জোর দাবির মুখে সরকার নতুন ছাত্রাবাস গড়ে দিতে বাধ্য হন। আজ যেখানে শহীদ মিনার দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেই ছিল নতুন মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের প্রধান ফটক। আধুনিক ছাত্রাবাসের মতাে সুরম্য অট্টালিকা নয়, গজারি কাঠের ফ্রেমের ওপর তরজার বেড়া দিয়ে তৈরি হয়েছিল দুই সারি ব্যারাক। সৈন্যদের ছাউনির মতােই মনে হতাে অনেকটা। ফুলার রােডের ফটক দিয়ে শুরু বাঁয়ে এগারটি এবং ডানে ছয়টি ব্যারাকের মাঝ দিয়ে আধাপাকা রাস্তাটি তির্যকভাবে এসে মিলেছিল বসিবাজারের রাস্তায়। পরে আরাে তিনটি ব্যারাক তৈরি হয়েছিল পুরােনাে জগন্নাথ হল বা অ্যাসেম্বেলি বিল্ডিং-এর বিপরীত কোণে। এ সকল স্থানের বর্ণনা দিচ্ছি কারণ অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এ ব্যারাক। এগুলির অস্তিত্ব আজ আর নেই, কিন্তু একদিন এইগুলােই মুখর থাকতাে ভাষা আন্দোলনে সংগ্রামের দিনগুলােতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের এ স্থান ছিল বামপন্থী, ডানপন্থী, উদারপন্থীসব মতবাদের ছাত্রদের মিলনকেন্দ্র। বিভাগ-পূর্বকাল থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দল বা উপদলের সমর্থক বা অনুসারীদের নিয়েই ছিল এক একটি ছাত্র সংগঠন বা উপসংগঠন। কিন্তু ১৯৫২ সালের পূর্ব পর্যন্ত মেডিকেল কলেজ এর ব্যতিক্রম ছিল। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা সচেতন ছিল যেন দলগত রাজনৈতিক অন্তর্বিরােধ তাদের শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত না করে। সেজন্য সংগ্রামের চরম মুহূর্তগুলােতে তারা সর্বদা ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং ভাষা আন্দোলনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পেরেছিল।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রভাষার দাবি উত্থাপিত হওয়ার পর প্রথম দিকে আপনাদের মাঝে কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল?
উত্তর : ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়েও বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ জন্মেছিল আমাদের ভেতর। আর তাই রাষ্ট্রভাষার দাবি উত্থাপিত হওয়ার পর আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি।। মনে পড়ে সেদিনের শল্যবিদ্যার অধ্যাপক স্কটল্যান্ডের অ্যালিনসন তার হাঙ্গেরির লােভাক সাহেব যখন বিকৃত উচ্চারণে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতেন তখন তাঁদের বক্তৃতার অংশ বিশেষ বাংলায় টুকে নেবার চেষ্টা করতাম খাতায়। এটা পরে অভ্যাসে দাড়িয়ে গিয়েছিল। হয়তাে বা এ অভ্যাসই পরবর্তীকালে বাংলা ভাষা চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই ‘রােগ নিরাময়- সুস্থ জীবন’ লিখতে প্রেরণা যুগিয়েছিল।
প্রশ্ন : ভাষা আন্দোলনের গােড়ার দিকে ফজলুল হক হল ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে যে সব আলােচনা সভা অনুষ্ঠিত হতাে তাতে আপনারা যেতেন কি?
উত্তর : আমাদের মেডিকেল কলেজের প্রতিনিধি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত বিভিন্ন সভায় নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। আমার সহপাঠী গােলাম মাওলা এবং আহমদ রফিক এসব দায়িত্ব নিয়ে সক্রিয় থাকতেন।
প্রশ্ন : ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন কি?
উত্তর : ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে সার্বিক হরতাল ডাকা হয়। ঢাকার ছাত্রসমাজ তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর শুধুমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। সে ভাষার দাবিতে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বহু ছাত্রকর্মী ও নেতা আহত এবং গ্রেফতার হয়।।
প্রশ্ন : কায়েদে আযমের রেসকোর্সের জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত তার বক্তব্য কি ছিল? বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া কি ছিল?
উত্তর : হ্যা, সে জনসভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। ১৯৪৮ সালের ২১ শে মার্চ। মধ্যাহ্ন সূর্য তখনাে মাথার ওপরে ওঠেনি। জনতার সাথে এগিয়ে চলেছি রমনার পথ বেয়ে রেসকোর্সের মাঠে। পাকিস্তান সংগ্রামের অগ্রনায়ক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাষণ শােনার জন্য জনতার মাঝে সে কি উন্মাদনা। ভারত বিভাগের পর পূর্বাঞ্চলের জনগণের সামনে এই তার প্রথম উপস্থিতি। বন্ধু ও সহপাঠীদের সাথে রমনার কালী মন্দিরের উত্তর দিক ঘেঁষে উদগ্রীব হয়ে বসলাম ভাষণ শােনার জন্য। ভাষণের এক অংশে তিনি বললেন, আমি আপনাদের বলতে চাই যে, আপনাদের মধ্যে এমন লােক আছে যারা বিদেশের অর্থে পুষ্ট হচ্ছে এবং আপনাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে চলেছে। আপনারা এদের আকর্ষণীয় স্লোগান ও চটকদার বুলি থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য সজাগ থাকুন। এরা বলে বেড়াচ্ছে যে, পাকিস্তান সরকার এবং পূর্ববাংলার সরকার আপনাদের ভাষাকে ধ্বংস করতে চায়। এর চেয়ে বড় মিথ্যা কথা কেউ কখনাে বলেনি। … আমাকে জানানাে হয়েছে যে, প্রদেশের কোনাে কোনাে অংশে অবাঙালি মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষভাব পােষণ করা হচ্ছে। কিছুসংখ্যক কমুনিস্ট এবং রাজনৈতিক সুবিধাবাদী ভাষার প্রশ্নকে সামনে তুলে প্রাদেশিক প্রশাসনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে চাইছে এবং এ কাজে ছাত্রসমাজকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তিনি আরাে বলেন, আপনারা ভুলে যান যে আপনারা বাঙালি, পাঞ্জাবি বা বেলুচি। আপনারা তেরশ বছর আগে যে শিক্ষা পেয়েছিলেন, সে পাঠ কি ভুলে গেছেন? আমি যদি বলি এখানে আপনারা সবাই বহিরাগত, তবে কি ভুল বলা হবে? এই প্রদেশের আদি অধিবাসী কারা ছিল? যারা আজ এখানে বাস করছে, নিশ্চয়ই তারা নয়। এরপর তিনি আবার ভাষা প্রশ্নে ফিরে এলেন, ‘ভাষা নিয়ে বাকবিতণ্ডা সৃষ্টি হচ্ছে মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। আমার সরকার এই অন্তর্ঘাতকদের হাত থেকে প্রদেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। আমি আপনাদের বলতে চাই যে, ভাষার বিষয়টি আপনাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করবে না। প্রদেশের সরকারি ভাষা কি হবে তা প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই যথাসময়ে স্থির করবেন। তবে আমি আরাে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিতে চাই যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা—অন্য কোনাে ভাষা নয়। শুধু একটি মাত্র ভাষাই জাতিকে সংঘবদ্ধ রাখতে পারে। উর্দুই হবে পাকিস্তানের সে রাষ্ট্রভাষা। শ্রোতাদের মধ্যে একাংশে মৃদু গুঞ্জন শােনা গেল। বক্তৃতা শ্রবণ অসমাপ্ত রেখে আমরা ফিরে এলাম ছাত্রাবাসে।।
প্রশ্ন : বায়ান্নর ২১শে ফেব্রুয়ারির পূর্বে এর প্রস্তুতি পর্বে গুরুত্বপূর্ণ আর কি কি ঘটনা ঘটেছিল?
উত্তর : ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি উর্দুর স্বপক্ষে খাজা নাজিমুদ্দিন ঘােষণার পর আবার শুরু প্রতিরােধ আন্দোলন। ৩০ জানুয়ারি বিকেলে বার লাইব্রেরি হলে সর্বদলীয় সম্মেলনে আন্দোলন পরিচালনার জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ নামে এক বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিই ২১শে ফেব্রুয়ারিকে প্রদেশব্যাপী ‘বাংলাভাষা দিবস’ রূপে পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করে আন্দোলনের ডাক দেন। ৪ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বে ঢাকার সব স্কুল-কলেজে প্রতীক ধর্মঘট পালিত হয়। মওলানা ভাসানী এক জনসভায় বক্তৃতা দেন। যথাযথ মর্যাদার সাথে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছিল। জনসভা, শােভাযাত্রা, সার্বিক হরতালের মাধ্যমে এ দিবসকে সফল করার জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল। ভাষা দিবস পালনের প্রস্তুতি-পর্বের শেষ পর্যায়ে ২০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি হলাে। মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে এসে দেখলাম একটা থমথমে ভাব। হাসপাতালে গিয়ে দেখি রােগীদের ডিসচার্জ করে দেয়া হচ্ছে। রাতে খবর এল সর্বদলীয় কর্মপরিষদের মিটিং-এ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলে ও অন্যান্য ছাত্রাবাসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বলিষ্ঠ মনােভাব পরিলক্ষিত হয়। গভীর রাতে এক মিটিং-এ ছাত্র নেতারা ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা অমান্য করার সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রশ্ন : ২১শে ফেব্রুয়ারির পরিস্থিতি সম্পর্কে বলুন না।
উত্তর : ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার সকল স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সভায় সমবেত হয়। ছাত্রনেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভা আরম্ভ হয়। সর্বদলীয় কর্মপরিষদের প্রতিনিধি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার বিপক্ষে বক্তব্য রাখলেন। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করলেন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে সে সুযােগে সরকার দেশব্যাপী আসন্ন নির্বাচন বন্ধ করে দেবে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ এ যুক্তি মেনে নিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে সজ্জিত পুলিশ বাহিনীর ভীতিকে উপেক্ষা করে সভা শেষ হতে-না-হতেই তারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য রাজপথে বেরিয়ে পড়ল। পুলিশ গ্রেফতার করতে লাগলাে। তারপর চালালাে কাঁদানে গ্যাস আর লাঠিচার্জের উপর্যুপরি আক্রমণ। সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এমনকি মেডিকেল কলেজের প্রাঙ্গণও কাঁদানে গ্যাসে ছেয়ে গেল। প্রতিরােধ সংগ্রামে ছাত্ররাও হাতের কাছে পাওয়া ইটপাটকেল ছুঁড়ে পুলিশের সাথে খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হলাে। পুলিশ ও ছাত্রদের এ খণ্ড যুদ্ধ শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েই সীমাবদ্ধ রইলাে না। ছড়িয়ে পড়লাে ফুলার রােড, মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রাবাসসহ সন্নিহিত সব এলাকায়। পুলিশের বেপরােয়া লাঠি চালনায় আহত হলাে অনেক ছাত্র মেডিকেল কলেজের শূন্য বেডগুলাে আবার ভরে উঠলাে রক্তাপ্লুত আহত ছাত্রদের দ্বারা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলাে, সংঘর্ষের তীব্রতা কমল না। প্রতিবাদমুখর ছাত্র-জনতাকে পুলিশ লাঠি চালিয়ে শান্ত করতে পারল না। তারা গুলি চালালাে মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের সামনের রাস্তায়। জব্বার আর রফিক প্রাণ হারালাে। আমাদের ছাত্রাবাসের ভেতর প্রবেশ করে অনেকেই আশ্রয় নেয় হাসপাতালের অঙ্গনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বরকত দাঁড়িয়েছিল বারাে নম্বর ব্যারাকের বারান্দায়। নির্বিচারে আবার গুলি চালায় পুলিশ। একটা গুলি এসে লাগে বরকতের উরুতে। আহত বরকতকে দ্রুত অপসারণ করা হয় হাসপাতালে। কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা। শল্যবিদদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানাে গেল না। ইতিমধ্যে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষের ফলে পট পরিবর্তন হয়ে পড়ে। পুলিশী ধরপাকড় আর নির্যাতনের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পরিষদের সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন থেকে আন্দোলনের কেন্দ্র তখন মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসে এসে পড়ল। এ পর্যায়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবার ভার স্বভাবতই আমাদের হাতে এসে পড়ে। মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের কর্মকর্তারা সক্রিয় হয়ে উঠল, গােলাম মাওলা তখন সংসদের ভিপি। বিশ নম্বর ব্যারাকে সংসদের নিজস্ব মাইক লাগানাে হলাে। কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হলাে সেখানে। পূর্বেই বলেছি বিশ নম্বর ব্যারাক ছিল ছাত্রাবাসের উত্তর পূর্ব কোণে, পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের বিপরীতে। পরিষদকে লক্ষ করে লাউড স্পিকার লাগানাে হয়েছিল। আবুল হাশিম (বর্তমানে সৌদি আরবে কর্মরত একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক), শরফুল (বর্তমানে ভয়েস অব আমেরিকায় কর্মরত) আরাে অনেকে উচ্চকণ্ঠে পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে পরিষদ সদস্যদের পরিষদ কক্ষ ত্যাগের আকুল আহ্বান জানাচ্ছিল। বক্তব্যের স্ক্রিপ্ট তৈরি করছিল জিয়া, আহমদ রফিক, কাদের আরাে অনেক। (ডা. জিয়া হাসান বর্তমানে নিউ মার্কেটের সন্নিকটে এক্সরে ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করছেন, ডা. আহমদ রফিক ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনে প্ল্যানিং একজিকিউটিভ থেকে অবসর নিয়েছেন। ডা. কাদের এখন খুলনায় প্র্যাকটিস করছেন)। ওদিকে পরিষদ ভবনে গমনেচ্ছু সদস্যদের দেখা পেলেই ধরে নিয়ে আসা হচ্ছিল ব্যারাকে, বুঝানাে হচ্ছিল পরিস্থিতির গুরুত্ব। জাহেদ, মাওলা, আহমদ রফিক সবাইকে দেখছি সক্রিয় ব্যস্ততায় ছুটাছুটি করতে। মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা যেমন একদিকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, অপর দিকে আহত ছাত্র ও জনতার চিকিৎসা ও সেবাকার্যের তত্ত্বাবধান করছিল। পরিষদের অভ্যন্তরে ভীষণ উত্তেজনা। আজ একথা জোর দিয়ে বলতে পারি যে, মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মাইকে বলিষ্ঠ প্রচার ও সংযােগের প্রভাবেই পরিষদ কক্ষের উত্তেজনা চরমে পৌঁছে। এই পরিস্থিতি নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর পুলিশী জুলুমের বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপনের সহায়ক হয়। এ সম্পর্কিত মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। বাংলা ভাষা আন্দোলনে সম্প্রতি পরলােকগত এই নেতার অবদান অবিস্মরণীয়। একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কার্যত ভাষা আন্দোলনের প্রত্যেক্ষ কেন্দ্রস্থল ছিল মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস। আমাদের কন্ট্রোল রুম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলগুলাের কর্মীদের সাথে যতদূর সম্ভব সংযােগ রক্ষা করে আন্দোলনকে সুসংবদ্ধ করার প্রয়াস পায়। গাজীউল হক, শহীদুল্লাহ কায়সার, অলি আহাদ, কাজী গােলাম মাহবুব এরা আসতেন গুরুত্বপূর্ণ আলােচনায় অংশ নেয়ার জন্য।
প্রশ্ন : ২২ ফেব্রুয়ারি কোথাও গুলি হয়েছিল কি?
উত্তর : ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকেই ১৪৪ ধারার তােয়াক্কা না করে ঢাকার শােকাহত। ছাত্র-জনতা বেরিয়ে পড়ে। বাইশে ফেব্রুয়ারি শহীদের জন্য গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে শােভাযাত্রা বেরুলাে। পুলিশ তাতে বাধা দিল। আবার গুলি চলল। হাইকোর্টের সামনে মৃত্যুবরণ করলাে শফিকুর রহমান। ঐদিনেই ছাত্রাবাসে আমাদের আলােচনায় স্থির করা হলাে, শহীদদের স্মৃতিতে মিনার নির্মাণের। সিদ্ধান্ত নেয়ার সাথে সাথে কাজ রু হলাে। ভাষা আন্দোলনের সেই প্রথম শহীদ মিনারের নকশা তৈরি করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সারারাত ধরে মিনার নির্মাণের কাজ চলল। হাসপাতালের সম্প্রসারণ কাজের জন্য ইট-সিমেন্টের স্টক ছিল প্রচুর। যতদূর মনে পড়ে ছাত্রাবাসের তিন শতাধিক ছাত্রের এমন কেউ ছিল না, যে নির্মাণ কাজে অংশ নেয়নি। শরফুদ্দীন, ইঞ্জিনিয়ার নামেই যাকে আমরা চিনতাম, বিশেষ যত্ন নিয়েছিলেন শহীদ মিনার নির্মাণে। সারারাত পরিশ্রমের ফলে গড়ে উঠলাে বারাে ফুট উঁচু শহীদ মিনার। ২৩ ফেব্রুয়ারি শহীদ শফিকুর রহমানের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন। প্রথম শহীদ মিনার ছিল দলমত নির্বিশেষে মেডিকেল কলেজের সকল ছাত্রের সমবেত প্রচেষ্টার ফল। ২৪ ফেব্রুয়ারি জনাব আতাউর রহমান খানকে আহ্বায়ক নির্বাচিত করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। মেডিকেল কলেজের পক্ষ হতে গােলাম মাওলা এবং আহমদ রফিক এই পরিষদের সাথে যুক্ত ছিল। ২৬-র সকালে স্থির হলাে শহীদ মিনারে সিমেন্টের আস্তর ভেজা থাকতেই মােজাইক করতে হবে। মােজাইক করার খরচ কত লাগে জানার জন্য বেরিয়ে পড়লাম, যতদূর মনে পড়ে, রশিদকে নিয়ে। মােজাইক চিপসের সন্ধানে অনেক ঘােরাঘুরি করার পর লক্ষ্মীবাজারে এক বাঙালি হিন্দু ব্যবসায়ীর কাছে চিপস পেলাম, হিসেব করে ছাত্রাবাসে ফিরে এলাম। মনে। পড়ছে মাপজোকের কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় মনিরুজ্জামানের বিছানায় বসে হিসেব করছিলাম, এমন সময় খবর এল পুলিশ এসেছে। ইতিমধ্যে ছাত্রাবাসগুলিতে নতুন করে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম পুলিশ বন্দুক উঁচিয়ে রয়েছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও রয়েছেন তাদের সাথে। প্রতিবাদের কোন সুযােগ নেই। গাঁইতি চলল শহীদ মিনারের উপর, চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল এত সাধের গড়া শহীদ মিনার।
সাক্ষাৎকার : ডিসেম্বর ১৯৭৮, জানুয়ারি, ১৯৮৭,
সূত্র: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মােস্তফা কামাল