শামসুন্নাহার আহসান
মিসেস শামসুন্নাহার আহসান বর্তমানে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপিকা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যাঁরা মিছিলের পুরােভাগে ছিলেন, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তিনিই একমাত্র ব্যতিক্রম যিনি বােরখা পরিধান করে সেদিনের মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৩২ সালের ১১ মে তিনি বরিশাল জেলার আলেকান্দায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আলহাজ্ব আবদুল ওহাব খান। পরিবারের ধর্মীয় এবং শিক্ষার অনুকূল পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। ১৯৪৮ সালে বরিশাল সদর গার্লস স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫০ সালে বরিশাল বি. এম. কলেজ থেকে আই.এ. পাস করেন। ১৯৫০ সালেই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অনার্স ক্লাসে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে অনার্স ও মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ড. সুফিয়া আহমদের ছােটবেলার বন্ধু। তাঁরা পরস্পর ক্লাসমেট। ছােটবেলার বন্ধুত্ব এখনও অটুট রয়েছে। মিসেস শামসুন্নাহার আহসানের স্বামী প্রজেক্ট ইনফরমেশন ব্যুরাে’র ডাইরেক্টর। তাঁদের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করলেও এ যাবৎ কেউ তাঁর এ গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে আলােচনা করেনি।
প্রশ্ন : আপনি কোন সময় থেকে ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত হন? উত্তর : ১৯৫০ সালে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরই আমি এর সাথে জড়িত হয়ে পড়ি।
প্রশ্ন : রাষ্ট্রভাষার স্বপক্ষে আমতলায় যেসব সভা অনুষ্ঠিত হতাে, সেগুলােতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন কি?
উত্তর : হ্যা, অধিকাংশ সভাতেই আমরা মেয়েরা সংগঠিত হয়ে অংশগ্রহণ করতাম। তবে আমরা বেলকনিতে অবস্থান করেই সভায় অংশগ্রহণ বা বক্তব্য শ্রবণ করতাম। এখনকার ছাত্র-ছাত্রীদের মতাে তখন এত সহজ মেলামেশা ছিল না। তখন ছাত্রীদের সাথে কথা বলার জন্য প্রােক্টরের অনুমতি প্রয়ােজন হতাে।
প্রশ্ন : বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার মনােভাব আপনার কিভাবে গড়ে ওঠে?
উত্তর : মাতৃভাষার প্রতি কার না অনুরাগ থাকে বলুন? পারিবারিক পরিবেশও আমার এ অনুরাগ সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে। আমার পিতা অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। এসব ব্যাপারে একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন তিনি। পিতার দরুনই আমি একটু সচেতন এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে উঠি।
প্রশ্ন : বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি কি উর্দু ভাষার প্রতি বিরূপ ভাব সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : উর্দু ভাষার বিরােধিতা বা এর প্রতি বিরূপভাবে সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠেনি। উর্দুর প্রতি বিরূপভাব সৃষ্টির জন্য তৎকালীন সরকার এবং বাংলাভাষা বিরােধীরাই দায়ী। প্রথমে তাে উর্দুর প্রতি কোনাে বিরূপ ভাব ছিল না। আমরা তাে ছােটবেলায় কিছু কিছু উর্দু শিখেছি পারিবারিক উৎসাহ পেয়ে কিন্তু জবরদস্তি করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার ফলেই উর্দুর প্রতি বিদ্বেষভাব সৃষ্টি হয়েছে।
প্রশ্ন : একুশে ফেব্রুয়ারিকে সফল করে তােলার জন্য আপনারা ছাত্রীরা এর পূর্বে কোন তৎপরতা চালিয়েছিলেন কি?
উত্তর : একুশে ফেব্রুয়ারিকে সফল করে তােলার জন্য আমরা গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের স্কুলে গিয়ে একদিন আমতলায় মিটিং এ উপস্থিত হওয়ার জন্য ছাত্রীদের সংগঠিত করি। এসব তৎপরতার প্রতি উৎসাহজনক সাড়া পাওয়া যায়।
প্রশ্ন : আমতলার মিটিং-এ কিভাবে মিছিল করার সিদ্ধান্ত হয়?
উত্তর : দু’জন দু’জন করে মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত হয় এবং কৌশল হিসেবে মেয়েদের পুরােভাগে দেয়ার কথা স্থির হয়। প্রশ্ন : প্রথমে কারা মিছিল করে এগিয়ে যায়?
উত্তর : শাফিয়া আপার (ড, শাফিয়া) নেতৃত্বে মেয়েরা প্রথম দু’জন দু’জন করে মিছিল করে এগিয়ে যায়।
প্রশ্ন : ড. শাফিয়ার খণ্ড মিছিলে আপনারা ছিলেন?
উত্তর : না, শাফিয়া আপাদের সাথে আমরা ছিলাম না।
প্রশ্ন : আপনারা কখন বের হন?
উত্তর : শাফিয়া আপারা বের হয়ে যাওয়ার পর ছাত্ররা এসে মেয়েদের অনুরােধ করে বলেছিল, মেয়েদের এগিয়ে যেতে বাধা দিচ্ছে না, Please আপনারা বের হয়ে এগিয়ে যান। শাফিয়া আপারা বের হয়ে যাওয়ার খানিক পরেই আমরা বের হয়ে যাই। আমরা মেইন গেইট দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পরই দেখি আমাদের ছাত্রদের মধ্যেই কে বা কারা ইউনিভার্সিটি গেইট বন্ধ করে দিয়েছে। সামনে দেখি পুলিশ কর্ডন করে দাড়িয়ে আছে। কর্ডনের এক পাশে সিটি এস.পি. মাসুদ মাহমুদ দাঁড়িয়ে আছে।
প্রশ্ন : সামনে পুলিশের কর্ডনের পেছনে ইউনিভার্সিটি গেইট বন্ধ, তখন আপনারা কি করলেন?
উত্তর : আমরা কর্ডন ভেদ করে এগিয়ে যাওয়াই স্থির করলাম এবং সুযােগের প্রতীক্ষায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। সুফিয়া, মাসুদ মাহমুদসহ কয়েকজন পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তা দেখে কিছুটা সংকোচ বােধ করছিল। যাক আমি আর সুফিয়া এক জায়গায় কৰ্ডনের নিচ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ঠিক করে ফেললাম এবং ওরা (পুলিশেরা) বুঝবার পূর্বেই হঠাৎ করে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের সাথে সাথে বেশ কয়েকজন মেয়ে বেরিয়ে পড়ল। আমরা সংগঠিত হয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম।
প্রশ্ন : আপনারা কারা কারা ছিলেন? অনুগ্রহ করে তাঁদের নাম বলুন।
উত্তর : সুফিয়া, রওশন আরা, সারা তাইফুর ও আমি ছিলাম। সুরাইয়া নামে বােধ হয় আর একজন ছাত্রী ছিল। সবার নাম মনে পড়ছে না।
প্রশ্ন : পুলিশ আপনাদের বাধা দেয়নি? তারপর ঘটনাপ্রবাহ কিভাবে এগােয়?
উত্তর : আমরা তাে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ঐ দিকে ছেলেরা পেছনের দেয়ালের ওপর থেকে চীৎকার করে চলছে, ‘দু’জন দু’জন করে এগিয়ে যান। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গবেন না, এগিয়ে যান। এগিয়ে যান। পরিষদের সামনের দিকে এগিয়ে যান। আমরা আরেকটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। বর্তমান শহীদ মিনারের পাশ দিয়ে দেয়াল টপকে ছেলেরা রাস্তায় নামছে। আর সামনে ইট ছুঁড়ে পুলিশকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। ইহার মধ্যে টিয়ার গ্যাস ও লাঠি চার্জ শুরু হয়ে গেছে। চারিদিকে ছুটোছুটি। টিয়ার গ্যাসের কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য সবাই নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে। আমাদের মধ্যে রওশন আরাসহ কয়েকজন লাঠির আঘাত পেয়েছে। আমরা ছুটে গেলাম ড. গণিত বসার দিকে আশ্রয় নেয়ার জন্য। বর্তমান সাইন্স অ্যানেক্সের এরিয়াতে তখন গণির বাসার দিকে আশ্রয় নেয়ার জন্য। বর্তমান সাইন্স অ্যানেক্সের এরিয়াতে তখন তাঁর বাসা ছিল। বাউন্ডারি এরিয়ার কাঁটাতারের বেড়া। ভেতরে যাওয়া মুশকিল। ঐ দিকে ইট আসছে অবিরামভাবে। সারা তাইফুরের গায়ে ইটের আঘাত লাগলাে মারাত্মকভাবে। এমন সময় ফরমান। উল্লাহ কোথা থেকে যেন আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। তিনি কাঁটাতারের বেড়া ফাঁক করে আমাদের ভেতরে যেতে সাহায্য করলেন। সেদিন তিনি না এলে বােধ হয় আমাদের আর ভেতরে আশ্রয় নেয়া সম্ভব হতাে না। কাঁটাতারের আঁচড়ে কাপড় ছিড়ে আমরা সবাই কম-বেশি ক্ষত বিক্ষত হয়েছি।
প্রশ্ন : আপনি তাে বােরখা পরা ছিলেন, তাই না?
উত্তর : হ্যা, আমি বােরখা পরেই অংশ নিয়েছি।
প্রশ্ন : গুলি বর্ষিত হলাে কখন?
উত্তর : আমরা ড. গণির বাসভবনের বাউন্ডারিতে যাওয়ার পূর্বেই গুলি বর্ষণের আওয়াজ শুনতে পেলাম। ড. গণির বাসভবনের দিকে গেলেও আমরা ভেতরে যাইনি। ভেতর থেকে ডাকলেও আমরা বিক্ষুব্ধ মনে বাইরেই অপেক্ষা করছিলাম।
প্রশ্ন : সেখানে অবস্থানকালে আপনারা উল্লেখযােগ্য কিছু লক্ষ্য করেছেন?
উত্তর : বেশ কিছু সময় পর দেখতে পেলাম ছেলেরা কোথা থেকে আইন পরিষদের সদস্যদের ধরে এনে আনন্দে নৃত্য করছে। কেউ কেউ সদস্যদের কাঁধে নিয়ে চুমু খাচ্ছে। ছেলেদের এই আনন্দের কারণ হলাে সদস্যদের পরিষদে যােগদান থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হওয়া এর ফলে সেদিন রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলা ভাষার বিপক্ষে কোনাে আইন পাস করানাে যায়নি।
প্রশ্ন : সেখানে আপনারা কতক্ষণ অবস্থান করেছিলেন? তারপর কি করলেন?
উত্তর : সম্ভবত সাড়ে তিনটের দিকে আমরা সেখান থেকে বের হয়ে মেডিকেলে যাই। মেডিকেলে সারা তাইফুরসহ আমরা ‘ফাস্ট-এইড’ গ্রহণ করি। তারপর কয়েকজন ছাত্রের সহায়তায় মেডিকেলের পেছনে দিকে এস.এম. হলের পাশ দিয়ে আমাদের হলে ফিরে আসি। পুলিশ এবং সশস্ত্র বাহিনীকে এড়ানাের জন্যই আমাদের অতদূর ঘুরে আসতে হয়েছে।
প্রশ্ন : এরপর আপনাদের কি তৎপরতা ছিল?
উত্তর : এরপর আহত ছাত্র-ছাত্রীদের ঔষধপথ্য প্রভৃতির জন্য চাঁদা তােলাসহ অন্যান্য প্রয়ােজনীয় কাজে তৎপর হই। গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে গিয়ে আমরা হাটখােলা টিকাটুলী প্রভৃতি বিভিন্ন এলাকায় চাঁদা তুলি। জনগণের কাছ থেকে এ ব্যাপারে অভাবিত সাড়া পাওয়া যায়।
প্রশ্ন : আপনাদের এসব তৎপরতায় পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোন বাধা সৃষ্টি করতাে কি?
উত্তর : গ্রেফতার ও ধরপাকড় তাে শুরু হয়েছিলই। কিন্তু আমাদের কাজে কোনাে বাধা আসেনি। চাঁদা তােলায় কাজী আমিনাও তৎপর ছিল। সে একদিন বলল এ. বি-তে তার এক আত্মীয় আছে। তার কাছ থেকে সে নাকি শুনতে পেয়েছে যে, আন্দোলনের ব্যাপারে যারা তৎপর রয়েছে তাদের নাম তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এজন্য কাজী আমিনা আমাদেরকে বেশি ঘােরাঘুরি করতে নিষেধ করেছিল। আমরা এসব কিছুকে তেমন আমল দিতাম না।
প্রশ্ন : পরবর্তী দিনগুলােতে আরাে উল্লেখযােগ্য কিছু ঘটেছে বলে এখন মনে পড়ছে কি?
উত্তর : সম্ভবত একুশে ফেব্রুয়ারি রাত্রিবেলায় আমাদের হল থেকেই মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের ছাত্রদের মর্মস্পর্শী আহ্বান শুনতে পেলাম। মাইকে বলা হচ্ছিল, ভাইয়েরা, আপনারা আগামীকাল সকাল ন’টার আসবেন। আমরা শহীদের লাশ মর্যাদার সাথে রক্ষা করছি। আমরা আপনাদের নিয়ে। যথাযােগ্য মর্যাদার সাথে শহীদদের দাফন করব।’ বেশ কিছু সময় পর আবার করুণ চীৎকার ধ্বনি ভেসে আসে, ‘ভাইয়েরা পারলাম না, পারলাম রাখতে, পুলিশ আমাদের শহীদের লাশ ছিনিয়ে নিয়ে গেল। পারলাম না আমাদের শহীদের লাশ মর্যাদার সাথে দাফন করতে।’- এসব মর্মস্পর্শী ঘােষণা এবং আর্তি মনভারাক্রান্ত করত।
প্রশ্ন : ইউনিভার্সিটি কবে বন্ধ ঘােষণা করা হয়?
উত্তর : পুলিশ এবং সামরিক বাহিনী কর্তৃক এস.এম. হল রেইড হওয়ার পরদিন ২৪ তারিখ ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘােষণা করা হয়। আমি ২৪ তারিখেই হল থেকে জিন্দাবাহার ফার্স্ট লেনে খালার বাসায় চলে যাই।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: এপ্রিল, ১৯৭৮
সূত্র: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মােস্তফা কামাল