ডক্টর হালিমা খাতুন
ডক্টর হালিমা খাতুন বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এম,এ প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযােগী অধ্যাপিকা হিসেবে কর্মরত।
প্রশ্ন : ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আপনার স্মৃতিচারণ থেকে কিছু জানতে চাই।।
উত্তর : ১৯৪৯ সাল হতে ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হয়ে আসছিল। তবে ১৯৫২ তে এসে সরকারি ঘােষণায় সবার মনে বিক্ষোভের দানা বেঁধে উঠে। যার ফলে, প্রতিদিনই নানা সভা ও প্রতিবাদ মিছিল হচ্ছিল। আর সংখ্যায় কম হলেও আমরা ছাত্রীরা তাতে অংশ গ্রহণ করে আসছিলাম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অপেক্ষা বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যেই উৎসাহ উদ্দীপনার ভাগটা ছিল বেশি। আমি নিজে ১৯৪২ সাল থেকে ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম খানিকটা। নেতাজী সুভাষ বােসের আদর্শিক চিন্তাচেতনার প্রতি সাংঘাতিকভাবে অনুপ্রাণিত ছিলাম। নেতাজীর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযােগীর সাথে ছিল আমাদের পারিবারিক পরিচয়। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন (শ্রীযুক্ত নিশিকান্ত ব্যানাজী, ক্যাপ্টেন রহমান), আমার এক সহপাঠির দাদু। বিভিন্ন সময়ে সহপাঠির কাছে লেখা দাদুর চিঠি পড়ে আমাদেরকে যেন বিপ্লবী পথ ও মত হাতছানি দিয়ে ডাকত। তাছাড়া দাদুর লেখা বিপ্লবী জীবনের গল্প আমরা পড়তাম। আর দেখা হলে তাে দীর্ঘ সময় ধরে শুনতাম নেতাজী ও তাঁর সমস্ত দুঃসাহসিক জীবনের ইতিহাস। বাগেরহাটে ছিল আমার জন্ম। দীর্ঘকাল ধরে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলনের এক শক্ত ঘাঁটি ছিল এই বাগেরহাট। অতএব সেই পরিবেশে মানুষ হয়ে জন্মেই দেখেছি ক্ষুব্ধ স্বদেশের চিত্র। প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজের বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ পুরােহিত অধ্যাপকরাও আমাদের সেই স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন। এক কথায় তৈরি মনমানসিকতা নিয়ে যখন ঢাকায় এলাম তখন দেখলাম তৎকালীন ঔপনিবেশিক ও আমলাতান্ত্রিক শােষণ টিকিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়। আর তখনই নিশ্ৰুপ না করে পথে নেমে ছিলাম ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধে। একুশের প্রস্তুতি চলছিল বেশ কয়দিন ধরে। প্রতিদিনই মেয়েদের স্কুলে বিশেষ করে কামরুন্নেছা, বাংলাবাজার ও মুসলিম গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের সংগঠিত করার কাজে দায়িত্ব পালন করেছিলাম আমি নিজে। স্কুলের ছাত্রীদের বয়স কম। তাই তাদের মিছিলে, সভা-সমিতিতে নিয়ে আসতে তেমন অসুবিধা ছিল না কিন্তু মুশকিল হলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে। আমি ঢাকায় নতুন এসেছি, তাই আমার কথায় বিশেষ করে পুলিশের সামনা-সামনি হতে বিশেষ রাজী হচ্ছিল না কেউই। আমি তাই ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে হাতীরপুলে গিয়ে নাদেরা বেগমের (শহীদ মুনীর চৌধুরীর বােন) কাছ হতে একটা চিঠি নিয়ে এলাম। যে চিঠিতে তিনি পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে জমা হয়ে মিছিলে যাওয়ার জন্য ছাত্রী বােনদেরকে অনুরােধ করেছিলেন। নাদেরা বেগম নিজের নিরাপত্তার কারণে নিজে আসতে পারেননি। সে যা হােক, চিঠির জন্য হােক বা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হােক হােস্টেল থেকে গুটিকয়েক ছাত্রী মিছিলে যাওয়ার জন্য আর কামরুন্নেসা, বাংলাবাজার ও মুসলিম গার্লস স্কুল থেকেও প্রায় ৩০/৪০ জন ছাত্রী আমতলায় এসে জড়াে হলাে। সেদিন আমতলার মিটিংয়ে অবশ্য একটা সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। এ সিদ্ধান্ত আমরা অর্থাৎ ছাত্রীরা মানতে চাচ্ছিলাম না। মানতে চাইনি বলেই আইন অমান্যকারীদের প্রথম মিছিল নিয়ে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম। সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করে আমরা চারজন প্রথম পুরানাে আর্টস বিল্ডিংয়ের দরজায় পুলিশের ব্যারিকেড ঠেলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে পথে বের হয়ে পড়ি। মেয়েদের দেখে কেন জানি পুলিশ পথ ছেড়ে দেয়। তারপর ছােট ঘােট আরাে দু’টি মিছিল (দল) পুলিশের বেড়া ভেঙ্গে বের হয়ে আসে। মেয়েদের ৩য় ও ৪র্থ মিছিল (দল) কে পুলিশ অ্যারেস্ট করে, পুলিশ তাদের ভ্যানে তুলে বহুদূর নিয়ে ছেড়ে দেয়।
আজ অনেক কথা, অনেক নাম, অনেক ঘটনা ভুলে গেছি— তবুও সেদিনের কিছু কিছু স্মৃতি এখন আমাকে বিচলিত করে। সেদিন আমতলা থেকে বের হয়ে আমরা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারিনি। ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়ার গ্যাসের সেল আমাদের দিকে ছুটে আসতে থাকে। চোখের জ্বালায় কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবুও এগিয়ে যাচ্ছি। স্বেচ্ছাসেবকরা বালতি করে পানি এনে সামনে ধরলেন। বালতির পানিতে রুমাল আঁচল ভিজিয়ে চোখে ঝাপটা দিতে লাগলাম। শেলের তীব্রতা ক্রমশ বেড়ে চলল। উপায়ন্তর না দেখে অবশেষে হাতড়ে হাতড়ে মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে গেলাম। ঐদিকে তখন কিন্তু প্রচণ্ডভাবে গুলি বর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। মেডিকেল হােস্টেলের বাঁশের খড়ের উপরে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে পড়ছে। জরুরি বিভাগে আহতদের ধরাধরি করে নিয়ে আসতে গিয়ে যে আর্তনাদ শুনেছিলাম। আজও যেন তা কানে শুনতে পাই। হাসপাতালের বাড়ি তৈরির জন্যে প্রচুর ইট জমা করা ছিল হাসপাতালের চত্বরে। মারমুখী পুলিশের বিরুদ্ধে ছাত্ররা সেই ইট ছুঁডতে থাকে। গুলির শব্দ, স্লোগান, ইটের শব্দ ও আহতদের আর্তনাদে মেডিকেলের মােড় সেদিন এক রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়ে আমরা হােস্টেলের দিকে গেলাম। তখন কোন লাশ ছিল না সেখানে, শুধু তরতাজা রক্ত আর মগজ ছড়ানাে ছিল পিচঢালা পথে।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭
সূত্র: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মােস্তফা কামাল