You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.12 | ভারত ডুবতে বসছে | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

ভারত ডুবতে বসছে

কত দ্রুতগতিতে ভারতের অর্থনীতি সমাজ ও রাজনীতি গভীর সঙ্কটের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে, তা আজও কুপমণ্ডুক ভারতীয়দের চেতনাতে আসেনি। ভারত সরকারের সত্যিই কোনাে নীতি আছে কিনা সন্দেহ। অবস্থার চাপে পড়ে ব্যবস্থা করা যাবে, এর চেয়ে পরিষ্কার কোনাে দূরদৃষ্টি তাদের ছিল না। কিন্তু অবস্থা যা ঘনিয়ে উঠছে, তাতে এখন এই নেতৃত্ব হাবুডুবু খাবে মাত্র। নেতৃত্ব হাবুডুবু খাক বা যাক সেটা সবচেয়ে বড় কথা নয়, সবচেয়ে ভাবনার বিষয় হলাে এই যে এবারে বুঝি ভারতই (এঁদেরই হাতে অবশ্য) ডুবতে বসেছে।
বাংলাদেশে অনতিবিলম্বে ইয়াহিয়ারা বর্ষার জলকাদায় ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ডুবে যাবে, এ জাতীয় অতি সরল হিসেব মুখতার সারল্য থেকেই এমন সহজাত স্ট্রাটাজী রূপে এদেশে চালু হয়েছে। দিনে পাকিস্তানের এককোটি করে নাকি টাকা খরচ হচ্ছে, কিন্তু এক শরণার্থীদের ভাত কাপড় দিতেই কি ভারতের দৈনিক দুই কোটি টাকার ব্যবস্থা করতে হবে না? এখন স্বীকার করা হচ্ছে যে ইতিমধ্যেই শরণার্থীর সংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষে দাঁড়িয়েছে। আর শরণার্থীর আগমনী স্রোত সহসা দ্বিগুণ বেগে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাঝখানে কয়েক দিনের জন্য এই স্রোতটা কিছু কম ছিল। অমনি কর্তৃপক্ষ যেন একটু আশ্বস্ত বােধ করছিল। কিন্তু হায়, আজ কয়েকদিন ধরে এই দৈনিক গড়ের হার লক্ষাধিক হয়েছে। কেউ বলছেন এক লক্ষ, কেউ বলছেন, একলক্ষ বিশ হাজার করে দৈনিক এই আমদানি।
আসলে এই জনস্রোতের বৃদ্ধিটা বুঝতে হবে বাংলাদেশের ভিতরকার অবস্থা থেকে। পাকবাহিনীর আক্রমণের মুখে শহর বন্দর ছেড়ে বহু লােক প্রথমেই ভারতের দিকে ছুটে আসেনি, তারা দূর দূর গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদিকে মুক্তিফৌজ পাকসামরিক বাহিনীর আক্রমণের উত্তরােত্তর বৃদ্ধির সাথে সাথে ভারতের সীমান্তের দিকে চলে আসতে বাধ্য হয়, ভিতরকার প্রতিরােধ ভেঙে পড়ে, জনসাধারণের উপর নির্মম অত্যাচার ও হত্যার বিভীষিকা ও তাণ্ডব সৃষ্টি করা হয়। রাস্তার ধারে ধারে গ্রামগুলাে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সীমান্ত বরাবর পাকবাহিনীর অগ্রগতির ফলে প্রথমটায় সীমান্ত বরাবর জেলাগুলাে থেকেই ভারতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী প্রাণ ভয়ে একবস্ত্রে চলে আসতে থাকে রাত্রির অন্ধকারে সীমান্ত পার হতে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের ভিতরকার জেলাগুলাে থেকে প্রথমে অত শরণার্থীর স্রোত সৃষ্টি হয়নি। তারা অপেক্ষা করছিল দেখতে শেষ পর্যন্ত কী হয়। শেষ পর্যন্ত কিছুই হলাে না, ভারত প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করলােই না, এমন কি বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি পর্যন্ত দিলাে না, যদিও “আর সহ্য করবাে না, আর সহ্য করবাে না” বলে মৌখিক আশ্বাস দিতে ছাড়ে না। এদিকে পাক-নির্যাতন উৎপীড়ন ও নিধন যন্ত্রের নিষ্পেষণ পূর্ববাংলার দূরতম পল্লীতেও গুণ্ডাশ্রেণীর লােকদের সহায়তায় বিস্তৃত হতে লাগলাে। এখন তাে আর থাকা যায় না, এই প্রত্যয় ও ভয় দৃঢ় হবার সাথে সাথে যে যেখান থেকে পারে, যত দূর থেকেই হােক, সীমান্তের দিকে চলতে শুরু করলাে। গােটা বাংলাদেশ” দেশত্যাগ করতে শুরু করেছে এবার।
এবার বরিশাল, ফরিদপুর, ঢাকা প্রভৃতি দূরবর্তী জেলার গ্রাম থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারী শিশু ভারতের দিকে ক্রমবর্ধমান স্রোতধারায় আসছে। দৈনিক গড় তাই লক্ষাধিক হয়েছে।
প্রথমে যারা নিকটবর্তী অঞ্চল থেকে এসেছিল, তারা অন্তত শক্ত সমর্থ দেহগুলাে নিয়ে হেঁটে হােক, ট্রাকে, গাড়িতে, নৌকাতে, রিক্সাতে এসে পৌঁছতে পেরেছিল, এবং যতটা আশ্রয় শিবির তৈরি ছিল তাতে এসে মাথা খুঁজতে পেরেছিল। আজ যারা আসছে, বহু দূর দূর প্রান্ত থেকে ২/৩ সপ্তাহ ধরে পায়ে হেঁটে, অর্ধভুক্ত অভক্ষ্যদ্রব্য খেতে খেতে, ক্লান্ত শ্রান্ত অবসন্ন দেহে এসে পড়ছে, তাদের ক্লিন্ন, অবসন্ন, শূন্যদৃষ্টি চেহারাগুলাে দেখতে পারা যায় না, মন বিষন্ন হয়ে যায়। তাদের পশুবৎ জীবন অবর্ণনীয় দুঃখে শশাকে ভয়ে ক্লান্তিতে একদম ভেঙে পড়েছে। কে তাদের আজ মনে বল দেয়, কে তাদের আজ বােঝাতে পারে যে তাদের ভবিষ্যৎ আছে, দেশ আছে কোথাও? “বাংলাদেশ”-সে আজ কোথায়-কতদূরে? বুঝি মৃত্যুর অপর পারে।
এদিকে কলেরা মহামারী রূপে উপস্থিত। হাজার কয়েক প্রাণ ইতিমধ্যেই তার শিকার হয়েছে। হুহু করে এর সংক্রমণ আগুনের মতাে ছড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত শরণার্থীরা ও পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও জনপদবাসীরা ভয়ানক এক আতঙ্কগ্রস্ত এই শীতল-মৃত্যু গুলিগােলার মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ ত্রাস সৃষ্টি করছে। কলেরা নিয়েই অনেক শরণার্থী ঢুকেছে, কেননা অভুক্ত অবস্থায় যা তা খেয়েছে, বিষাক্ত জল পান করেছে, নদী নালা বিলে মৃতদেহগুলাে পচছে, ভাসছে সেই জলই খেতে হয়েছে। আর এপারেও যে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনা, বিশুদ্ধ পানীয় ও খাদ্য মিলছে, তাও তাে নয়। শিবিরগুলােতে যথেষ্ট পরিমাণ ওষুধ বিষুধ ও রােগ নিরােধক টীকা ও ইনজেকশন ছিল না, ডাক্তারতাে খুবই কম ছিল। এখানেও কলেরা মহামারী, বসন্ত প্রভৃতি রােগের ক্ষেত্র তৈরি ছিল। আজ মৃতদেহ এখানেও সকারের কোনাে ব্যবস্থা নেই, এমন কি মাটিতে কবর দেবার জন্য যথেষ্ট কোদাল পর্যন্ত নেই। জীবিতদের দায়িত্বই কেউ নিতে নেই, মৃতদেহের দায়িত্ব নেবে কে, বিশেষ করে সংক্রামক রােগে মৃত ব্যক্তিদের? ফলে এখানেও নদীতে মৃতদেহ নিক্ষেপ করা ছাড়া উপায় নেই।
সীমান্ত বিশেষ করে ২৪ পরগণা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদে যে সব শিবির করা হয়েছিল সেগুলাের স্থান নির্ণয়ে কোনাে দূরদৃষ্টি ছিল না, মনে করা হয়েছিল দুদিনের তাে ব্যাপার, বাংলাদেশ শীঘ্রই মুক্ত হয়ে যাচ্ছে, ভারত সরকার নিশ্চয়ই শেষ পর্যন্ত হাত লাগাবে (নইলে এত সৈন্য সামন্ত এধার ওধার করছে কেন! আসলে সৈন্যরা নিষ্ক্রিয় নয় এমনি একটা ভয় দেখাতে ভাণ করছিল মাত্র কিন্তু ইয়াহিয়া খান আমাদের এই ভাণটা ধরে ফেলে তার যা করার তা সে করেই যাচ্ছে কোনাে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে)! তাই যেখানে সেখানে শিবির করা হয়, যার প্রায় সবগুলােই খােলা মাঠের নিচু জমিতে। এদিকে বর্ষা এসে গেছে। এই ক্যাম্পগুলাের অধিকাংশই জলে ডুবে যাবে শীঘ্রই। কী বীভৎস নােংরা অমানুষিক অবস্থায় পড়বে এই হতভাগ্য মানুষগুলাে! মহামারী ও মৃত্যুর মহাভােজ উপস্থিত।
এদিকে, নতুন করে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আসতে শুরু করেছে। সীমান্তের শিবিরে মাথা গুঁজবার কোনাে ঠাই নেই। তাদের সংখ্যা গুণবার জন্যও কোনাে লােক নেই। পশ্চিম বঙ্গের পুনর্বাসন ব্যবস্থা শক্তির বাইরে চলে গেছে। সমগ্র প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ডাক্তার নেই, সেবক নেই, নার্স নেই, এত স্বেচ্ছাসেবক নেই কোনাে স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার-এর কোনাে কূল কিনারা করতে পারে। শরণার্থীরা ক্ষুধায়, অনাহারে, মহামারীর ভয়ে হাজারে হাজারে কোলকাতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এ এক অদ্ভুত মার্চ, পৃথিবীতে যা কেউ কোথাও দেখেনি। প্রাণ ভয়ে ভীত লক্ষ লক্ষ পশুবৎ মানুষের মার্চ। কোলকাতা বাসীরা এবারে আতঙ্কিত, তাদের সুখের নীড় (যদি কিছু সেখানে আজও থেকে থাকে) বুঝি এই আর্তমানুষদের বন্যায় ও সামাজিক ঝড়ে ভেঙে চুরে যায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্য কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন বুঝি বা তাদের মন্ত্রীত্ব খতম করার জন্য কোনাে রাজনৈতিক মতলববাজ দল শরণার্থীদের কোলকাতায় আসতে পথ দেখিয়েছে। কী পর্বতপ্রমাণ মুখতা, কী অদ্ভুত আত্মপ্রতারণা। তাদের মন্ত্রীত্ব তারা এমনিতেই রাখতে পারবেন আর কতদিন সে সন্দেহ তাদের নিজেদেরই আছে। কেন আবার একটা মিথ্যা অভিসন্ধি আরােপ করা! অন্যরা এই শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান স্রোতকে নিজেদের রাজনীতির স্বার্থে লাগাচ্ছে, না এরাই লাগাতে চাইছে! কিন্তু হায়, এতে কোনাে দলেরই কোনাে রাজনীতি হবে না, কোনাে লাভ হবে না গােটা দেশের সব রাজনীতিই এই আর্তজনপ্লাবনে ডুবে যাবে, যাচ্ছেও।
পাকিস্তানের সঙ্গে গােপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সন্দেহে কতিপয় নেতৃস্থানীয় লােকদের ধরা হয়েছে। জানি না এই অভিযােগ কতটা সত্য। পাকিস্তানি চর গুপ্তভাবে নানাদিকে কাজ করছে, করবে এতে আর আশ্চর্য কি, তার জন্য যাকে পাও, দোষী বলে জানাে ধরাে, বিচার করাে। কিন্তু আজ তাে পাকিস্তান শুধু গােপন ষড়যন্ত্র করছে না, খােলা ষড়যন্ত্র করে কোটিখানেক লােক ভারতের ঘাড়ে ফেলে দিচ্ছে এই খােলা ষড়যন্ত্র ও অঘঘাষিত যুদ্ধের জন্য ভারত সরকার অথবা রাজ্যসরকারগুলাে কী করছেন? পাকিস্তানের গায়ে হাত দিতে ভয় লাগছে, তাই নয়?
আজ ভারত সরকারকে পৃথিবীর কাছে S.O.s বা “রক্ষা করাে রক্ষা করাে” বলে আর্তনাদ করতে বাকী! বাংলাদেশকে রক্ষা করাে এই আবেদন আজ তার কাছ থেকে শােনার কোনাে তাৎপর্য নেই। বাংলাদেশের জন্য আর উকীল মােক্তার রাষ্ট্রদূত পৃথিবীর দুয়ারে পাঠাতে হবে না, নিজেকে রক্ষা কেমন করে করবে সে কথাই ভাবুক।
আহা পৃথিবীর বিবেক! পৃথিবীর বিবেকের রক্ষা কর্তা যারা তাদের একটি হলাে আমেরিকা-জাপানে হিরােসিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বােমা অকারণে নিক্ষেপ করে লক্ষ লক্ষ প্রাণ যারা মুহূর্তে ধ্বংস করেছিল। ভিয়েতনামে তার কীর্তি তাে ঐতিহাসিক। ব্রিটেন আর এক ঐতিহাসিক বিবেকের মূর্তি-আহা কী তার ইতিহাস ও ঐতিহ্য! এসব বৃহৎ শক্তির ঘরের খবর কী, ইতিহাস কী? আজ উথান্ট বলছেন পৃথিবীর ইতিহাসে পূর্ববঙ্গে যা হয়েছে সে জাতীয় ট্রাজেডী নাকি বিরল! আহা কত দেরীতে এই পরপদলেহী মােটা বেতনভুক কর্মচারিটির ঐতিহাসিক বিবেকজ্ঞান উপস্থিত হলাে! কয়েক কোটি টাকার আশ্বাস পাওয়া গেছে। পৃথিবীর রাজদরবারগুলাে থেকে ভারত তাই আকাশবাণীর মারফৎ এদেশ ও বাংলাদেশের লােককে শশানাচ্ছে। এই কয়েক কোটি টাকার সাহায্য, আসলে ভস্মে ঘি ঢালার মতােও হবে না, উপরন্তু এর বিনিময়ে সাহায্য দাতারা ভারত যাতে কোনাে কারণেই পাকিস্তানের ‘আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে সে মুচলেকা বা বাধ্যবাধকতা আদায় করে নিচ্ছে!
এদিকে ভারতের প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভণিতার অন্ত নেই। পার্লামেন্টে ভি, সি, শুষ্কা জানাচ্ছেন, ভারত শীঘ্রই চার দফা-ক্রিয় ক্ষেপণাস্ত্র (Four Stage Rocket) তৈরি করতে যাচ্ছে, কেননা চীন শীঘ্রই নাকি আন্তমহাদেশিক পারমাণবিক বােমার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করতে যাচ্ছে ভারতের আকাশের উপর দিয়ে ভারত মহাসাগরে। এই সময়ে এই তথ্যটি পরিবেশন করার একটা মতলব আছে। পাছে ভারতবাসীরা বাংলাদেশের জন্য পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে বলে, দরকার মতাে যুদ্ধের দায়িত্ব নেবার দাবি করে যে দাবি উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পেতে বাধ্য, সেই জন্যই আমাদের ভােলাবার চেষ্টা করা হচ্ছে এই বলে যে আসল শক্ৰতাে চীন, তার সঙ্গে যুদ্ধের কথাটা না ভেবে কী পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবাে? পাকিস্তান থেকে দেশের দৃষ্টি অন্যত্র ঘুরিয়ে দেবার জন্যই পার্লামেন্টে এই বীরত্বব্যঞ্জক ঘােষণা রকেট বানাবার (পারমাণবিক বােমার রকেট নয় সাধারণ বােমাই) ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়! ভারত সরকার আমাদের সত্যিই আহাম্মক মনে করেন।
এদিকে প্রতিরক্ষা বাজেটের বরাদ্দ ১১৫০ কোটি থেকে ১২৫০ কোটিতে টেনে আনা হলাে! এত টাকা খরচ করা হচ্ছে কেন, যদি আজ পাকিস্তানের এমন বর্বর আক্রমণের জবাব দিতেও না যাই? আমাদের নাকি বহু অস্ত্রশস্ত্র ও বহু সৈন্যসামন্ত হয়েছে, এমন কি এক সঙ্গে ২/৩টি দেশের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে পারি বলে মাঝে মাঝে বলা হতাে। এখন আর ওসব উচ্চারণও হয় না। ভারত আজ সত্যিই নার্ভাস। যদি এমন দিনেও আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কোনাে কাজে না আসে, তবে এত খরচ করা কেন? সৈন্যবাহিনীকে দিয়ে যখন যুদ্ধ করানাে হচ্ছে না, তখন শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণের ভারটাই তাদের দেওয়া হােক না কেন? তারপর ভারতকে একটি “খােলাদেশ” বা Open Country বলেই ঘােষণা করা হােক না কেন? ভারতের চতুর্দিকে যেসব বৃহৎ শক্তি আছে রুশ, চীন, আমেরিকা, ব্রিটেন প্রভৃতি তারাই আমাদের ডিফেন্সের ভার নিন, তারা ভাগাভাগি করে নিজেদের শক্তিসাম্যের খাতিরেই হয়তাে ভারতকে রক্ষা করে যাবে—যদিও ভারতের তাতে কোনাে স্বাধীনতাও থাকবে না, ইজ্জতও থাকবে না, বৃহৎ শক্তিগুলাের সকলের দাস হয়ে বেশ “সুখের সংসার” নিরাপদে চালাতে থাকবে!! হায় জয়হিন্দ, হায় জয় ভারত!
কিন্তু আমরা এভাবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার বদলে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের পথও বােধহয় গ্রহণ করতে পারব। ছােট বড় নানা অহঙ্কারও তাে আছে! আপাতত আমরা অর্থনৈতিক সামাজিক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সব রকমের এক নারকীয় দুর্গতির মধ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এতবড় দেশের মালিক হতে চাই, অথচ একফোটা সাহস আমাদের নেই। এই নির্লজ্জ ভীরুতাকে ঐতিহাসিক বিজ্ঞতা বলে দার্শনিক আত্মপ্রতারণায় নিমগ্ন আছি। ভারতের ইতিহাসে এতবড় লজ্জা ও এতবড় ট্রাজেডী পূর্বে কখনাে ঘটেনি। আমরা ডুবে যাচ্ছি।

সূত্র: কম্পাস, ১২ জুন ১৯৭১