You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব বাংলার সংগ্রামে ভারতীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য

পূর্ব বাংলায় যেসব ঘটনা ঘটেছে তার তাৎপর্য ও গুরুত্ব সকল দেশের স্বাধীনতাকামী ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষের কাছে খুবই বেশি। অর্থাৎ বিশ্ববাসী পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশ সম্বন্ধে আজ মােটেই উদাসীন থাকতে পারে না। স্বাধীন পূর্ব বাংলা সরকার বলে যদি কিছু আজ সেখানে দানা বেঁধে থাকে তাকে সকল রাষ্ট্রের উচিত স্বীকৃতি দেওয়া ও তাকে সাহায্য করা।
পশ্চিম বাংলা ও ভারতের সরকার ও জনসাধারণের দায়িত্ব এ বিষয়ে আরও বেশি, আরও প্রত্যক্ষ। মানবিক প্রশ্নে ও গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্নে সকল দেশের সকল মানুষ আজ, নির্যাতিত অথচ সগ্রামী বাঙালিদের সক্রিয় সহানুভূতি দেখাবে। কিন্তু ভারত নিজস্ব স্বার্থেও এ সগ্রামের প্রতি অধিকতর আনুগত্য দেখালে কেবল উচিত কর্মই নয়, ভালাে করবেন। ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব যেমন অধিক, রাজনৈতিক প্রয়ােজনও তাদের অত্যধিক। কেন? পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরার সীমান্ত দিয়ে প্রায় ঘেরা পূর্ব বাংলা। পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত ১৩৫০ মাইল, আসাম সীমান্ত ৬৫০ মাইল ও ত্রিপুরার সীমান্ত ৫৫০ মাইল। প্রায় আড়াই হাজার মাইলের উপর এই সীমান্ত। র্বি বাংলায় যদি সত্যিকার মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে সেই মুক্তিযুদ্ধের তাপে উত্তপ্ত পূর্ব বঙ্গের হিন্দু ও মুসলমান বহু শরণার্থী সাময়িক আশ্রয়ের জন্য এই সীমান্ত অতিক্রম করে এদেশে আসতে পারেন। তাদেরকে এদেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না, এমন নীতি কি ভারত নিতে পারে? মুক্তিযুদ্ধজাত আভ্যন্তরীণ সংগ্রাম ও সংঘর্ষ ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষের মতাে অবস্থাও সৃষ্টি হতে পারে, কেননা সামরিক সরকার পূর্ব বাংলাতে কোনাে খাদ্য বস্তু হয়তাে ঢুকতে দেবে না—দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে ওদের শায়েস্তা করবার পথ নিতে পারে। পূর্ব বাংলাতে এমনিতেই খাদ্যাভাব থাকে, এক দেড় কোটি মণ খাদ্য শস্য আমদানি করতে হয়, সবচেয়ে জনবহুল দেশ বাংলাদেশ, তদুপরি গত বছর এক সাংঘাতিক ঝড় ঝঞায় বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। ফলে তার আমদানি হয়তাে আরও এক কোটি মণ বেশি হওয়া উচিত যদি সেখানে কোনাে দায়িত্বশীল জনদরদী সরকার থাকতাে তবে তাকে তাই করতে হতাে। আজতাে সেখানে কোনাে সরকার নেই, আর যা আছে তাকে দস্যু সরকার ছাড়া কিছু বলা যায় না। এই দস্যু সরকার বাংলাদেশে কোনাে খাদ্য বস্ত্র আসতে দেবে না। ফলে পূর্ব বাংলায় এবার ব্যাপক দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হতে পারে। হাজার হাজার মানুষ তাই প্রাণে বাচবার জন্যও ভারতে আসতে পারে। এই অর্থনৈতিক অবরােধ ও রাজনৈতিক কারণে নরমেধ যজ্ঞের হাত থেকে আজ যদি তারা এদেশে সাময়িক সাহায্যের জন্যও আসে, আমরা কি তাদের ফিরিয়ে দিতে পারি, অনিবার্য মৃত্যুর মধ্যে ঠেলে দিতে পারি? এখানে আমাদের কর্তব্য পালন করতে গেলেও ভারত সরকার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ভারতীয় জনসাধারণকে নানা সক্রিয় কর্মপন্থা নিতে হবে এবং তা নিতে গেলে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক দস্যু সরকারের বাধাদানের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে হবে তাতে যত ঝুঁকি নিতে হয় হােক।
আন্তর্জাতিক সাহায্যও যদি সংগঠিত করা হয়, তাতে ভারতই তার জল স্থল ও আকাশ পথে সে সাহায্য পৌছে দেবার পক্ষে একমাত্র যােগ্য দেশ, কেননা পূর্ব বাংলার প্রায় সব দিকেই ভারত। ভারত যদি এখানে দ্বিধা করে অথবা তার সীমান্ত ব্যবহার করতে না দেয়, তবে ইতিহাসের দরবারে ভারত জঘন্য অপরাধে অপরাধী হবে।
হাজার মাইলের উপরে দূরত্ব পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে। এই দূরত্বের প্রতিকূলতা মাঝখানে ভারত আছে বলে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক গােষ্ঠীর পক্ষে আরাে উব্রভাবে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক জলপথ দিয়ে আসতে হলে ২ হাজার মাইল অতিক্রম করতে হবে। এই দূরত্বের সুবিধাটাই বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে বড় সুবিধা-সংগ্রাম চালিয়ে যাবার পক্ষে। কিন্তু ভারত যদি সহৃদয় ব্যবহার না করে, তবে এই দূরত্বের সুবিধা পূর্ব বাংলা নিতে পারে না। উপরন্তু পশ্চিম পাকিস্তান যদি ভারতের এই উদাসীনতা, অসহযােগিতাটা ব্যবহার করতে পারে, তবেই পূর্ব বাংলার পক্ষে খাদ্য শস্য ও অন্যান্য সাহায্য পাওয়া সম্ভব হবে না, দুর্ভিক্ষ লেগে গেলেও পূর্ব বাংলা কোনাে সাহায্য পাবে না, পূর্ব বাংলা একটা অবরুদ্ধ দেশ হিসেবে না খেয়ে মরবে। ভারত সরকার ও ভারতীয় জনসাধারণ কি এভাবে পূর্ব বাংলাকে অবরুদ্ধ হয়ে থাকতে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ সাহায্য করতে পারে?
সামরিক শাসন নতুন করে বসাবার পূর্ব মুহূর্তে মুজিবুর রহমান ও তার দলীয় নেতারা পৃথিবীর সকল দেশ, বিশেষ করে আফ্রো-এশিয় দেশসমূহের কাছে সব রকম সাহায্যের জন্য দ্বিধাহীন আবেদন জানিয়েছেন। এই আবেদন উপেক্ষা করার মতাে নির্দয়তা ও উদাসীনতা যদি আজ ভারত দেখায়, তবে ভারতের পক্ষে কোন কালে পূর্ব বাংলার লােকদের কাছে মুখ দেখানাে সম্ভব হবে না। অথচ আজ পূর্ব বাংলার বিদ্রোহ যদি সার্থক হয়, তার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানেও নানা ধরনের বিদ্রোহ দেখা দিতে বাধ্য। বালুচ, সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধু প্রদেশের জনসাধারণও মাথা তুলবে এবং তাদের স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে। এর ফলে পাক-ভারত উপমহাদেশ থেকেই পাকিস্তানি স্বপ্নটা চিরকালের জন্য উবে যাবে। পাকিস্তানি বা দুই জাতিতত্ত্ব জাতীয় দুঃস্বপ্ন থেকে এই উপমহাদেশ মুক্ত হলে আবার ভারতীয় ইতিহাস তার প্রকৃত পথ খুঁজে পাবে, সৃষ্টি হবে এক নতুন অভিযান, অপ্রতিহত অগ্রগতি, উভয় দেশের পক্ষেই। এত বড় সুযােগ ভারতের পক্ষে আর কোন দিন আসবে না, যদি ভারত এই মুহূর্তে তার যােগ্য ভূমিকা পালন না করে।
আর ভারত যদি পূর্ব বাংলার স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দেয় ও তাদেরকে সাহায্য করে, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক গােষ্ঠী আবার কাশ্মীর অথবা পাঞ্জাব আক্রমণ করবে, এ আশংকা সম্পূর্ণ অলীক। যদি তা করে তবে পশ্চিম পাকিস্তানেরও কবর ঘটে যাবে, পশ্চিম পাকিস্তানেও বিদ্রোহ অনিবার্য হয়ে উঠবে। অতএব ভারত সরকারের পক্ষে কোনই ভয়ের কারণ নেই। আর এজাতীয় কর্মপন্থা যদি ভারত গ্রহণ করে, তবে ভারতের আভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিসমূহ যথা প্রান্তীয়তা, সাম্প্রদায়িকতা, প্রভৃতি শক্তিগুলাে নিষ্প্রভ হয়ে যাবে। যদি তা না করে তবে ভারতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রেও বড় বড় ফাটল দেখা দিতে বাধ্য।
একথা বেশ জোরের সঙ্গে বলা যায় যে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য, দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম protracted struggle-ই প্রকৃত পথ, আজ পূর্ববাংলার পক্ষে। কোনক্রমে যদি আগামী বর্ষা পর্যন্তও তাদের এই সংগ্রাম টিকিয়ে রাখতে পারে, তবে সামরিক দস্যুদের তারা অসংখ্য নদী-নালা খাল বিলে ডুবিয়ে দিতে পারবে। আধুনিক সমর সম্ভার তখন অচল হয়ে দাঁড়াবে। ছােট বড় বহু মুক্ত অঞ্চল গড়ে উঠবে, গেরিলা যুদ্ধের উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি হবে। সেই সব মুক্ত অঞ্চলের সগ্রামীদের যদি ভারত সাহায্য না করে, তবে তারা হয়তাে এমন সব বৈদেশিক শক্তির কাছ থেকে সাহায্য পাবে, যা ভারতের পক্ষে একটা শাল হয়ে দাঁড়াবে, যার ফলে সমস্ত পূর্ব ভারত ও পার্বত্য অঞ্চল বৈদেশিক প্রতিকূল শক্তিসমূহের আওতার মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
অতএব আজ পরিষ্কারভাবে বুঝে নেওয়া উচিত পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সম্রামের গুরুত্ব আজ ভারতের পক্ষে কত বড় ও কত সুদূরপ্রসারী। এই সামগ্রিক অর্থে এ সংগ্রাম ভারতেরও সংগ্রাম। মানবিকতা, ন্যায়, গণতন্ত্র ইত্যাদির প্রয়ােজনে এ সংগ্রাম সকল দেশের মুক্তি সংগ্রামেরই অংশ, কিন্তু ভারতের পক্ষে তার আত্মরক্ষা ও অগ্রগতির প্রয়ােজনে এ এক অপরিহার্য দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে যদি আজ ভারতকে পূর্ববাংলার মানুষদের খাইয়ে রাখার জন্য কয়েকশত কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়, সে দায়িত্ব তাকে নিতে হবে। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরাবাসী জনসাধারণের দায়িত্ব সমধিক, তাদের পক্ষে এটাকে একটা উৎপাত বলে মনে করা উচিত নয়, বরং এটা একটা সময়ের ডাক হিসেবে তা বিবেচনা করতে হবে।

সূত্র: কম্পাস, ৩রা এপ্রিল ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!