আজ আমাদের সাহসের প্রয়ােজন
যতদূর মনে হচ্ছে পৃথিবীর কোন রাষ্ট্রই স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারছে না—অন্তত অদূর ভবিষ্যতে নয়। ভারত সরকার নাকি তলে তলে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন আর কোন রাষ্ট্র আছে কিনা পৃথিবীতে, বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। কেউ নেই জেনে, ভারত সরকার নিজেও স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছেন না!
এই অনীহা বা দ্বিধার পিছনে যুক্তি কী? শােনা যায়, যুক্তি নাকি এ রকম। প্রথমত একাই যদি ভারত স্বীকৃতি দেয়, আর কেউ না দেয়, তবে পাকিস্তানি সরকার প্রচারে সুবিধা পাবে এই বলে “দেখলে, আগাগােড়া ব্যাপারটা ভারতেরই, ভারতই উস্কানি দিয়ে পূর্ব-বাংলার বাঙালিদের বিদ্রোহী করেছে। এতে নাকি ভারতকে জগৎসভায় অপরাধীর মতাে দাঁড়াতে হবে। এবং তাতে নাকি ভারত সরকার পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রকে চাপ দেবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে, অর্থাৎ ভারতের পররাষ্ট্রীয় রাজনীতির সাহায্য করার ক্ষমতা লুপ্ত হবে! তাদের হয়তাে অপর যুক্তি হলাে এই স্বীকৃতিটাই বড় কথা নয়, সাহায্যটাই বড় কথা, ভারত যথাসাধ্য সাহায্য করতে কার্পণ্য করবে না।
স্বীকৃতি না দিলে যে সাহায্য করার প্রথম সােপানটিই অবহেলা করা হয়, এ কথা আমাদের সরকারকে কে বােঝায়? আমরাই যদি স্বীকার না করি, বাংলাদেশের অগণিত জনসাধারণের তাদের বর্তমান শিশু সরকারটির উপর নিজেদেরই আস্থা আসবে কতটুকু? বাংলাদেশের জনসাধারণের আস্থাটাকে দৃঢ় করা, তাদের আত্মপ্রত্যয় সুদৃঢ় করার জন্যও প্রথমেই আমাদের এই সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া দরকার। তাদের আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি হলে বাইরের জগতের সাহায্যটাকে অমন অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হবে না।
প্রথমে প্রথমে স্বীকৃতির বিরুদ্ধে যুক্তি দেখানাে হতাে, ওদের সরকার, কৈ, কাকে স্বীকৃতি দেবাে? আজ তাে সে যুক্তি দেখানাে চলে না? তারা এমন লােক নিয়েই সরকার গঠন করেছেন যারা সকলেই এমন একটি দলের সদস্য যে দল শতকরা নিরানব্বইটি আসন গণতান্ত্রিক নির্বাচনেই দখল করেছিল। তাদের জনপ্রতিনিধিত্ব সম্বন্ধে কেউ এতটুকু সন্দেহ প্রকাশ করতে পারে না। ন্যায়ের দিক থেকে, গণতান্ত্রিক রীতিনীতির দিক থেকে কোন দিক থেকেই তাদের স্বীকৃতি না দেবার অধিকার কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই থাকতে পারে না। এই নীরবতা ও সুবিধাবাদ দিয়ে আমরা বা পৃথিবীর কোন দেশ কোন কালে কোন “আন্তর্জাতিক নীতিবােধ ও জনমত সৃষ্টি করতে পারবাে? যুক্ত জাতিসঙ্রে ভিত এরপরও কি আর সৃষ্টি হতে পারবে?
যুক্ত জাতিসঙ্রে নিরাপত্তা পরিষদে কোনাে রাষ্ট্র এবং ভারতও এ প্রশ্নটি উপস্থিত করছেন না। নিরাপত্তা পরিষদে এর চেয়ে কত ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে অতীতে উপস্থিত হওয়া গিয়েছে। অবশ্য নিরাপত্তা পরিষদকে ভারতের পক্ষে এক্ষেত্রে ডেকে আনার ব্যাপারে ভয়েরও কারণ আছে। নিরাপত্তা পরিষদ কাশ্মীরের মতাে একটা স্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করে দিতে পারে ভারত ও বাংলাদেশকে নিয়ে। তারা এটাকে একটা আন্তর্জাতিক ক্ষমতাবিন্যাসের লীলাক্ষেত্রও করে তুলতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদে যদি না-ই যেতে হয় না-ই গেলাম। সত্যিই যাবার দরকার কী? ভারতের উপরে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর বােঝা চাপিয়ে, ভারতের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে বানচাল করার জন্য পাকিস্তান যে সমস্যা উপস্থিত করেছে তার সমাধান ভারত নিজের হাতেই নিতে পারে, অন্যের দ্বারস্থ হবার কোনই দরকার করে না। বাংলাদেশের সর্বনাশ যদি হয়, ভারতও তার থেকে রক্ষা পাবে না।
ভারতীয় পার্লামেন্টের বিশেষ এক অধিবেশন কেন ডাকা হচ্ছে না? এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতি আর কী থাকতে পারে। এই গুরুত্বপূর্ণ, ভারতের জীবন-মরণ সমস্যাজাত পরিস্থিতির সময়েও যদি ভারতের লােকসভার অধিবেশন না থাকে, তবে সে লােকসভার প্রয়ােজন কী এবং কবে?
স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে কার্যত (defacto) কতটুকু আমাদের সরকার স্বীকার করেন? তাও করেন কি? যদি তাই করেন, তবে এই স্বাধীন সরকারকে বিদেশ থেকে অস্ত্রশস্ত্র কেনা, বা এদেশেই কেনা এবং এদেশ দিয়ে তাদের দেশে নেবার অধিকার তাদের নেই কেন? স্বাধীন সরকার হিসেবে সাহায্য নেবার অধিকার তার কতটুকু হয়েছে? এই সরকারের প্রতিনিধিদের এদেশে থাকা, চলাফেরা করা, পাসপাের্ট ভিসার অধিকার পাওয়া ইত্যাদির অধিকার কীভাবে এবং কতটুকু স্বীকৃত হয়েছে? তাদের আজও এদেশে অপরাধীর মতাে থাকতে হবে কেন? বাংলাদেশ ও তার সরকারকে নিয়ে এই লুকোচুরি কেন? বাংলাদেশের প্রশ্ন নিয়ে আমাদের লজ্জার কারণ কী? অতএব কেবল নীতিগত স্বীকৃতিই দেওয়া হয়নি, কিন্তু কার্যত স্বীকার করে নিয়ে তাকে সব রকম সাহায্য করা হচ্ছে এমন কথা বলা যায় কী?
পরিশেষে একটি মৌলিক কথা স্মরণ করা দরকার। কোন দেশই বড় হতে পারে না, যদি সে দেশ বড় হবার জন্য যে দায়িত্ব ও ঝুঁকি নিতে হয় তা পালন করতে ভয় পায়। আজ ভারতে সর্বত্র বাংলাদেশের পক্ষে যে বিপুল জনমত সৃষ্টি হয়েছে তাকে সম্বল করে আমরা পৃথিবীর যে কোনাে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু যদি পিছিয়ে যাই তবে ভারতের মতাে দেশের উপর আমাদের কোন অধিকার থাকবে না। এই বিশাল ভারতের বিপুল জনসাধারণের রাষ্ট্রনীতি কখনই ভীরু নেতৃত্বের দ্বারা গঠিত হতে পারে না। একটি বৃহৎ দেশের জন্য চাই অকুতােভয় বৃহৎ নেতৃত্ব। কখনও কখনও একটা জাতিকে তার সর্বস্ব পণ করে রুখে দাঁড়াতে হয়, যদি তা সে না পারে, তবে সে জাতির বেঁচে থাকার অধিকারও যেমন থাকে না, বেঁচে থাকেও।
সূত্র: কম্পাস, ৮ই মে ১৯৭১