You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.08 | বর্বরতা বনাম মানবিকতা | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

বর্বরতা বনাম মানবিকতা

ইয়াহিয়াদের সমরগােষ্ঠী বা ওয়ারলর্ডদের ব্যবহার ফ্যাসিবাদী হিটলারের মতাে, এর প্রমাণ আমরা দিন দিনই পাচ্ছি। যাকেই আমরা অত্যাচারী মনে করি তাকেই হয়তাে ফ্যাসিস্ট বলে গাল দিই, কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে এ তুলনা অত সামান্য নয়। নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, দুরভিসন্ধি, নির্লজ্জ মিথ্যা ইত্যাদির ক্ষেত্রে ইয়াহিয়া হিটলারকে ছাড়িয়ে গেছে, আর উদ্দেশ্য তাে আরও পরিষ্কার। সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদ এই উভয় প্রথার বাছাই করা অপপ্রয়ােগ আজ চলেছে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের উপরে। দুই লক্ষের উপর নরনারী শিশু ইতিমধ্যে হত্যা করা হয়েছে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়, একথা ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকরাও স্বীকার করেছেন। ব্রুস ডগলাস-ম্যান, এমপি বলেছেন “পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব-পাকিস্তানের জমিটাই চায়, মানুষ চায় না”। টিক্কা খান গর্ব করে তার অভিযানের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলেছিল “তােমরা সর্বদাই নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে দাবি রাখাে, আমি তােমাদের সংখ্যালঘিষ্ঠ করে ছাড়বাে।” সংখ্যালঘিষ্ঠ করার একটি উপায় হলাে লক্ষ লক্ষ লােককে নির্বিচারে মারা, হাজার হাজার গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া, অরক্ষিত শহর বন্দরগুলাের উপর বম্বারি করা যাতে প্রাণ ভয়ে ত্রাসে লক্ষ লক্ষ লোেক ভারতে গিয়ে আশ্রয় খোঁজে। পঞ্চাশ/ষাট লক্ষ বা কোটিখানেক লােক বিতাড়িত করতে পারলেই পশ্চিম পাকিস্তানিরা সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারবে! কোটিখানেক তাে হিন্দুই আছে, আজ হিন্দুদের প্রতি ইয়াহিয়া খান সে-জাতীয় বিদ্বেষ ও হিংসা করতে চাইছে, যা একদা হিটলার ইহুদীদের বিরুদ্ধে লাগিয়েছিল। গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, সমাজতান্ত্রিক শক্তিগুলােকে সামগ্রিকভাবে আঘাত করার সাথে সাথে বেছে বেছে ইহুদীদের প্রতি বিশেষ বিদ্বেষের ক্রোধাগ্নি জ্বালিয়ে দেওয়াই ছিল হিটলারের কৌশল। এ জাতীয় কৌশল ইয়াহিয়া খানেরও আছে।
হিটলারের মতােই ইয়াহিয়া খান তার সৈন্যবাহিনীর হাত রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত করে দিচ্ছে একটা পরিকল্পিত উপায়ে। এমন ধরনের নিষ্ঠুর নির্মম কাজ তার সৈনিকদের দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে, যার কোন ক্ষমা নেই। অর্থাৎ যাদের উপর এই বীভৎস নির্যাতন ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের অভিযান চালানাে হয়েছে, তারাও যাতে তেমনিভাবেই পাল্টা নিষ্ঠুরতা দেখায় এবং একটি অদ্ভুত রকমের মারণযজ্ঞ সৃষ্টি হয়, যাতে কেউ কাউকে আর ক্ষমা করতে না পারে, কেউ আত্মসমর্পণ করতে সাহসী না হয়, তেমনি একটি বেপরােয়া পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে ইয়াহিয়া খানেরা। তার সৈন্যবাহিনীর প্রতি অসীম ঘৃণা যদি সৃষ্টি হয় বাঙালিদের মনে, তাতে ইয়াহিয়া খান অখুশি নয়। বেলুচ, পাঠান প্রভৃতি সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে যাতে কিছুমাত্র মানবিকতাবােধ না জাগে, এদের অবস্থা যদি এমন করে দেওয়া হয় যাতে আর তারা ফিরতে না পারে, এটাই হলাে তার উদ্দেশ্য। শিশু নারী আবালবৃদ্ধবনিতার রক্তে যদি তাদের হাত রাঙা করে দেওয়া যায়, তবে এদের সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকদের কোন সৌহার্দ্যের সম্ভাবনা কোন কালে থাকবে না। এই ভাড়াটিয়া সৈনিকেরা তখন বুঝতে পারবে যে তাদের অপরাধের কোন ক্ষমা নেই, তারা একথা ভাবতেই পারে না যে যদি ইয়াহিয়া খানেরা শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়, তবে তাদের দশা কী হবে! হাজার হাজার হয়তাে লক্ষাধিক এইসব সৈনিক তখন প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পারবে তাে? অর্থাৎ এই পাঠান বালুচ পাঞ্জাবী সৈন্যদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিয়েই তাদের ব্যবহার আরও নিষ্ঠুর, আরও জঘন্য করে তােলা হয়েছে point of no retum বলতে যা বােঝায় সেই বেপরােয়া অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। হিটলারও এমনিই করেছিল।
কিন্তু এই হিটলারকেও একদিন যেতে হয়েছিল। অথচ তার তুলনায় ইয়াহিয়া খান কতটুকু? শক্তির ক্ষেত্রে তার হাস্যকর অনুকরণ মাত্র। যে আধুনিক অস্ত্রপাতির বহর দিয়ে আজ নিরস্ত্র জনতাকে ইয়াহিয়া তার বিক্রম দেখাচ্ছে তার প্রতিটি জিনিস ধার করা, তার একটা যন্ত্রাংশ তৈরি করার মতাে কারখানাও পূর্বপাকিস্তানে করেনি, পশ্চিমেও নয়। ধার করে সে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ চালাচ্ছে। না করেও পারে না, কেননা এই সামরিক গােষ্ঠি জানে, পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে গেলে, পশ্চিম পাকিস্তানও থাকবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের শােষণসূত্রটি শুকিয়ে যাবে, তার ভিতরকার অন্তর্দ্বন্দগুলােও ফেটে বেরিয়ে পড়বে। পূর্ববাংলায় হেরে যাওয়া মানে পাকিস্তানেরও শেষ, অর্থাৎ পাকিস্তানি আইডিয়ার শেষ। পশ্চিম পাকিস্তানেও তখন পাঞ্জাব, সিন্ধু, বালুচিস্তান ও পাকতুনিস্তান জাতিসমূহ আত্মনিয়ন্ত্রণাধীন স্বরাজ্য স্থাপন করবে। গত তেইশ বছর ধরে যে পাকিস্তানি সাম্রাজ্যবাদের কায়েমী স্বার্থ একটা গড়ে উঠেছিল তার অবসান ঘটবে। কাজেই ইয়াহিয়া খানেরা জীবন থাকতে এ জিনিস হতে দিতে পারে না, নিজেদের মৃত্যু নিজেরা বরণ করে নিতে পারে না। তারই জন্য এই বেপরােয়া নরমেধযজ্ঞ, এই নিষ্ঠুরতা এই বর্বরতা। নিজেদের এই স্বার্থ রক্ষা করতে হলে তার ভাড়াটিয়া সৈন্যদের বর্বর করে না ফেলতে পারলে চলে না।
বাংলাদেশের যারা মুক্তিযােদ্ধা তারা এই বর্বরতার উত্তর বর্বরতা দিয়ে দেবেন না। বাংলাদেশের যে বাণী, তার উদারতা, গণতান্ত্রিকতা, মানবিকতা, ও ধর্মনিরপেক্ষতা আজ সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশ কেবল তার নিজেরই স্বাধীনতা চায় তাই নয়, এই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার যাতে পাঠান, বেলুচ, সিন্ধু, পাঞ্জাবী সবাই পায় সেই অধিকারও তারা দিতে চায়। যারা নিজেদের জন্য সত্যিকার স্বাধীনতা চায়, তারা অপরের স্বাধীনতাও চায়। বাংলাদেশের মুক্তিফৌজের বিজয় অভিযান যেদিন শুরু হবে (এবং অদূর ভবিষ্যতেই হবে), তখন পরাজিত এই পাকিস্তানি ফৌজদের তারা নিশ্চয়ই নির্বিচারে খুন করবে না। আত্মসমর্পণের পথ তারা খুলে রাখবে, যুদ্ধে আহত পাকিস্তানি সৈন্যদের তারা সেবাও করবে, আত্মসমর্পণ করলে তাদের নিরাপদে ঘরে ফিরে যাবার ব্যবস্থাও করে দেবে।

সূত্র: কম্পাস, ৮ই মে ১৯৭১