ক্ষমাহীন অপরাধ
সমস্ত ভারত আজ “বাংলাদেশ” বা পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি নিয়ে অভূতপূর্ব এক উদ্বেগের মধ্যে প্রকৃত সংবাদের জন্য উদগ্রীব। যে শয়তানী চক্রান্ত করে পূর্ববঙ্গের নেতাদের উপর ও জনসাধারণের উপর এত অতর্কিত পৈশাচিক আক্রমণ করা হয়েছিল, তার পরিণামে কত যে নিরস্ত্র নিরীহ জনসাধারণের প্রাণ গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। রাজধানী ঢাকা যে একটা শ্মশানে পরিণত হয়েছে এ সংবাদ আজ চারিদিক থেকে বেরিয়ে আসছে। এতবড় ঐতিহাসিক হত্যাকাণ্ডকে চাপা দেওয়া সম্ভব হবে না। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশােহর প্রভৃতি শহরগুলােতে এত মড়া এখনও রাস্তায় পড়ে আছে যা এখনও সরানাে সম্ভব হয়নি, সরাবার লােকও নেই। ৫/৬ লক্ষ লােককে হয়তাে হত্যা করা হয়েছে। কোন বড় আকারের যুদ্ধেও এত লােক মরে না মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে এত বড় হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। পূর্ববঙ্গের নবজাগ্রত যুবশক্তির একটা বিরাট অংশকে ওরা হয়তাে শেষ করে দিয়েছে।
এতৎ সত্ত্বেও জল্লাদ ইয়াহিয়া খান ব্যর্থ হয়েছে। এই পাষণ্ড জেনারেলটি মনে করেছিল যে ২/৩ দিনের এক প্রচণ্ড আঘাতেই পূর্ববঙ্গের মেরুদণ্ড একেবারে ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে এবং সেই প্রচণ্ড অতর্কিত আক্রমণের প্ল্যান নিখুঁতভাবে তৈরি করা হয়েছিল, প্রতিটি আইন সভার সদস্যদের পিছনে সামরিক গুপ্তবাহিনীর চরদের ছায়ার মতাে অনুসরণ করার ব্যবস্থা করে। হয়তাে এমনও হতে পারে নবনির্বাচিত সদস্যদের বেশির ভাগকেই ঐ ২৫শের রাত্রিতেই ধরে ফেলে এবং হয়তাে হত্যাও করে ফেলে। রাত্রির অন্ধকারেই ইউনিভার্সিটি আক্রমণ করে প্রতিটি হলের ঘুমন্ত ছেলেদের নির্বিচারে গুলি করে এবং অধ্যাপকেরাও রেহাই পান না—আর গােটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারপরে কত-কি পৈশাচিক কাণ্ড করে সমস্ত শহরের উপর, পরপর কয়েক দিন ও রাত্রি ধরে তার বীভৎস বিবরণ ক্রমশ প্রকাশ হবে।
এতৎ সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান ব্যর্থ হয়েছে। ২/৩ দিন তাে দূরের কথা ২ সপ্তাহ পার হতে চললাে, পূর্ববাংলার নরনারীদের মেরুদণ্ড ভগ্ন করা সম্ভব হয়নি, তাদের প্রাণে আতঙ্ক ও ত্রাস সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। শহরগুলাের উপরও সর্বত্র তাদের জুলুমী-রাজ পুনপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হয়নি, ক্যান্টনমেন্টগুলােই তাদের হাতে শহরগুলাে হয় এখনও জনতার হাতে, নয়তাে পরিত্যক্ত-উভয়পক্ষ থেকেই। দিনাজপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া প্রভৃতি শহরগুলাের উপর বােমারু বিমান থেকে বােমা ফেলাতে শত্রুপক্ষের শক্তির পরিচয় প্রকাশ পায় না, উক্ত শহরগুলাে যে তাদের এখনও হাতছাড়া, এবং ধ্বংস করা ছাড়া তাদের প্রতিরােধশক্তি নষ্ট করা সম্ভব নয়, এতে তারই প্রমাণ হয় মাত্র। জনসাধারণ যদি আর একটুও এই প্রতিরােধ বজায় রাখতে পারে, তবে এই যুদ্ধ শীঘ্রই একটা অচলাবস্থা বা stalemate-এ পরিণত হবে।
জনসাধারণের পক্ষেও কিছু ভুল ধারণা হয়তাে ছিল, তারাও হয়তাে মনে করেছিলেন যে একমাত্র জনসমুদ্রের সাহায্যেই ইয়াহিয়াবাহিনীর ঘাঁটিগুলােকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে—২/১ সপ্তাহের মধ্যেই। তাঁরা লক্ষে লক্ষে প্রাণ দিতেও তাই কসুর করেননি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রবলভাবে সজ্জিত আধুনিক এক বেপরােয়া নির্মম শত্রুপক্ষকে একমাত্র human-wave বা জনসমুদ্রের ঢেউ দিয়েই ভাসিয়ে দেওয়া যায় না, প্রত্যক্ষভাবে শক্রর উপর ঝাপিয়ে পড়ে এ সংগ্রামে জয় অর্জন করা সহজ নয়। জনসাধারণ তাই গ্রামদেশে ও নদী-নালা জঙ্গল পর্বতের উপরই ক্রমশ নির্ভরশীল হতে বাধ্য হচ্ছে। ২/১ সপ্তাহের সগ্রাম এ নয়, ২/১ বৎসরের সগ্রামের জন্যই তাদের প্রস্তুত হতে হবে, এই জ্ঞান অভিজ্ঞতা থেকেই সঞ্চিত হচ্ছে। যদি এই সগ্রামকে দীর্ঘায়িত করা যায়, হাজার হাজার গ্রামে মাঠে প্রান্তরে বনে জঙ্গলে নদীতে ছড়িয়ে টেনে বিস্তৃত করা যায়, তবেই শত্রুপক্ষের সাপ্লাই-লাইনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, তাকে জলে কাদাতে পাকে জঙ্গলে কবর দেওয়া সম্ভব হবে।
শত্রুপক্ষই চেয়েছিল একপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শেষ করতে। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে ও যাবে শত্রুপক্ষের বিপদ তত বাড়তে থাকবে। বর্ষা এসে গেলে শত্রুপক্ষের ক্যান্টনমেন্ট ঘাঁটি থেকে বের হওয়াও বিপদজনক হবে। ততদিনে জনসাধারণের শক্তির পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের কাজ অনেকটা গুছিয়ে আনা সম্ভব হবে, কেন্দ্রিয় কম্যান্ড পুনর্গঠিত হবে, ভারত ও পৃথিবীর সাহায্য পাওয়া সম্ভব হবে। তখন, এমনকি ক্যান্টনমেন্ট বা ঘাঁটিতে আবদ্ধ ও আশ্রিত শত্রুসৈন্যদের উপর গ্রামদেশ থেকে চারিদিক থেকে প্রতিআক্রমণ সংগঠিত করাও সম্ভব হতে পারে। মর্টার জাতীয় আগ্নেয়াস্ত্রের সাহায্যে এই ঘাঁটিগুলােকে চূর্ণ করে দেওয়াও অসম্ভব হবে না। আমেরিকার মতাে একটা সুপার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকেই যদি ভিয়েতনামে এমন আবদ্ধ ও নাজেহাল হতে হয়, তবে এই ক্ষুদে সাম্রাজ্যবাদীরা ইয়াহিয়া ভূট্টোখানেরা কতদিন সে শক্তির মােকাবিলা করতে পারবে?
ততদিনে পৃথিবীর জনমতও সােচ্চার হতে বাধ্য। এত বড় হত্যাকাণ্ড যে পৃথিবীতে কোনকালে কোথাও ঘটেনি তার বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়া না হয়েই পারে না। গণতান্ত্রিক পশ্চিমারা, স্বাধনিতাকামী আফ্রো-এশিয় দেশবাসীরা, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের রাষ্ট্রসমূহ আজও তেমন সােচ্চার নয় দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। এইসব দেশের রাষ্ট্রের নায়কেরাই তাদের নিজ নিজ ক্ষুদ্রস্বার্থবুদ্ধির খাতিরে তাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে না, প্রকৃত সংবাদও তাদের নিজ নিজ দেশের লােকদের পরিবেশন করছে না। এইসব রাষ্ট্রের ভীরুতা ও সুবিধাবাদী নীরবতা তদেশীয় জনসাধারণ খুব বেশি দিন সহ্য করবেন, এমন মনে করার কারণ নেই।
সুখের বিষয় বা আশার কথা এই যে ভারতের সব রাজ্যের সকল জনতা এতবড হত্যাকাণ্ড ও বিশ্বাসঘাতকতাকে আজ বরদাস্ত করতে প্রস্তুত নয়। ভারতের প্রতি কোণে কোণে তীব্র প্রতিবাদ সােচ্চার হয়ে উঠছে। পূর্ববঙ্গের লােকদের সাহায্য করার জন্য প্রাণ কেঁদে উঠছে। এদেশের সরকারের পক্ষেও তা অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। প্রায় তিনহাজার মাইল যে সীমান্ত আছে তার এপারে সর্বত্র এদেশের জনসাধারণ পূর্ববঙ্গের লােকদের প্রাণে মারবার চক্রান্ত ব্যর্থ করবেই। যদি আমাদের কোন রাষ্ট্র বলে শক্তি থেকে থাকে, সে রাষ্ট্রের যদি সামরিক কিছু শক্তি থেকে থাকে তা যদি এতবড় হত্যাকাণ্ডের প্রতিরােধে কোন কাজে না লাগে তবে সে রাষ্ট্রের ও সে সামরিক শক্তির কী প্রয়ােজন? মানবতার উপরে এমন বিশ্বাসঘাতকতা, গণতন্ত্রের উপরে এমন নির্মম আঘাত, আর এতবড় হত্যাকাণ্ড আমাদের হাতের সামনেই ঘটবে, আমাদের হাতখানাও তার প্রতিবাদে বাড়ানাে হবে না এই কি সভ্যতার দায়িত্ব? কোন একটি দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ, বড় বড় শক্তিগুলাের অনুমতির জন্য প্রতীক্ষা, রাষ্ট্রস নামক একটা অপদার্থ নপুংসক প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছা অনিচ্ছা ইত্যাদি কোন কিছুর দোহাই দিয়েই আমরা আমাদের মানবিক কর্তব্যকে এড়িয়ে যেতে পারি না। এ দায়িত্ব এড়ালে, রাষ্ট্রস যাই বলুক, বড় বড় শক্তিমান রাষ্ট্রগুলাের ভয়ে যদি আমরা আমাদের কর্তব্য পালন না করি, তবে আমাদের নিজেদের স্বাধীনতারও কোন ঐতিহাসিক অধিকার থাকে না , থাকা উচিত নয়। আমাদের রাষ্ট্র যদি কিছু নাও করে, ভারতের জনসাধারণ নিজেদের হাতে সে দায়িত্ব গ্রহণ করবে এবং করছে। সেদিন (গত রবিবার) পেট্রাপােলের সীমান্ত অতিক্রম করে লক্ষ লক্ষ (সত্যি লক্ষাধিক) নরনারী যশােহরের সংগ্রামী বাঙালি ভাইদের দেখতে যেভাবে অগ্রসর হয়েছিল, এপারের সীমান্ত রক্ষীরা সে জনস্রোতকে বন্ধ করতে সাহস পায়নি। সেই লক্ষাধিক নরনারীর হাতে কিছু না কিছু সাহায্য-খাদ্য বস্ত্র তেল ইত্যাদি ছিল। প্রত্যেকে নিজের হাতে সে সামান্য সামগ্রী ওপারের যােদ্ধাদের হাতে হাতে পৌছে দেবার সে অপূর্ব দৃশ্য যারাই দেখেছেন তাঁরা অভিভূত হয়েছেন। এতে হয়তাে সীমান্তের আইন লঙ্ঘন করা হয়েছিল, কিন্তু মানবিকতার চিরন্তন আইন তাতেই রক্ষিত হয়েছিল। আর কিসের আইন? আজকে পূর্ববঙ্গে কোন রাষ্ট্র আছে, না তার কোন আইন আছে। একদল নরঘাতক দস্যু অকাতরে নিরস্ত্র জনতার প্রাণ হননে ব্যস্ত সেখানে। এ সভ্যতার উপরে আক্রমণ, এ কোন দেশের কথা নয়। পৃথিবীর সকল মানুষের এখানে দায়িত্ব ও অধিকার আসে।
কিন্তু এখানেও আমরা সবাইকে সতর্ক করে দিতে চাই যে এই প্রাণঢালা উদ্বেল সহানুভূতি দিয়েও ঐ নরঘাতক দস্যুদের ভাসিয়ে নেওয়া যাবে না। ভারতীয় জনসমুদ্রের উদ্বেল এই সহানুভূতি ও ভ্রাতৃত্ববোেধকেও সুসংগঠিতভাবে নিয়ােজিত করতে হবে। বহুরকমের কাজ ও সংগঠনের মধ্য দিয়ে তাকে প্রবাহিত করতে হবে। এই তিন হাজার মাইল ব্যাপী বৃহৎ সীমান্তকে একটি সক্রিয় সুসংগঠিত শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। বৃহত্তর দায়িত্ব অদূর ভবিষ্যতে দেখা দেবে। পূর্ববঙ্গে দুর্ভিক্ষের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে সে সময়ে নিজেরা না খেয়ে, আধপেটা খেয়েও ওঁদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে, ওঁদের সংগ্রামী শক্তিকে উত্তরােত্তর সক্রিয় করে তুলতে হবে, ওঁদের মনােবলকে আরও দৃঢ় করতে হবে, একটা দীর্ঘায়ত সংগ্রামের প্রয়ােজনে যাবতীয় জিনিস জুটিয়ে দিতে হবে। প্রকৃত তথ্য পৃথিবীর জনসাধারণের কাছে উপস্থিত করে দিতে হবে। একাজ যদি আমরা করতে পারি, তবে ভারতও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে, ভারত একটা শক্তি হিসেবে আবার পৃথিবীতে গ্রাহ্য হবে। যে জাত যতবড় দায়িত্ব নিতে সাহস রাখে, সে জাতই তত বড় হয়। ভারতের আপামর জনসাধারণের প্রাণে আজ সে প্রেরণা উপস্থিত। একে গ্রাহ্য করা, একে সংগঠিত রূপ দেওয়াই আজ ভারতীয় নেতৃত্বের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত।
সূত্র: কম্পাস, ১০ই এপ্রিল ১৯৭১