বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য মাস্টার প্ল্যান’ চাই
বাংলাদেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের মধ্যে শুধু ত্রাণসামগ্রী পৌছে দিলেই আমাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না, দায়িত্ব লাঘবও হয় না। এঁদের সুসংগঠিত একটি ফলপ্রসু শক্তিতে পরিণত করার জন্য আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রয়ােজন এবং অনতিবিলম্বে সে পরিকল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করাও অত্যন্ত আবশ্যক। বাংলাদেশ থেকে আগত তরুণ ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, আইন ব্যবসায়ী, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার প্রত্যেককেই এই অবশ্য কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং এই বাংলার মানুষদের উদ্যোগী হতে হবে। এই পরিকল্পনা রূপায়নে পশ্চিমবাংলা সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ দায়িত্ব রয়েছে। তাঁদের পক্ষ থেকে কতকগুলাে বাধ্যতামূলক নির্দেশ জারি করতে হবে।
গেরিলা যুদ্ধের জন্য ভারত সরকারের সহযােগিতায় বাংলাদেশের তরুণদের বিশেষ ট্রেনিং দান করা, এবং এই রণকৌশলে তাদের সুদক্ষ ও সুশিক্ষিত করে তােলা বাংলাদেশ সরকারের কর্মসূচির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যাগত এবং গুণগত পরিস্থিতি কিছুমাত্র সন্তোষজনক নয়। গেরিলা যুদ্ধের প্রাথমিক কর্মপন্থার জন্যই এখন পর্যন্ত সম্ভবত সাত থেকে আট হাজারের বেশি তরুণ তালিকাভুক্ত হননি। প্রকৃত ট্রেনিং কতটা দেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে অবশ্য আমরা কিছু জানি না, কারণ স্বাভাবিভাবেই তা গােপন সামরিক দপ্তরের বিষয়।
কত সংখ্যক তরুণকে এ কাজে পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কে বহু পরস্পর বিরােধী রিপাের্ট আসছে। তবে প্রায় ষাটলক্ষ উদ্বাস্তুর মধ্যে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সের অন্তত পাঁচ ছয় লক্ষ তরুণের নাম রেজিস্ট্রারে থাকা উচিত। ভারত সরকার এবং অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শরণার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা এই যুবকদেরও অন্নবস্ত্রদান এবং রক্ষণাবেক্ষণের দিকে লক্ষ্য রাখছেন। কিন্তু কেন এই পাঁচ ছয় লক্ষ তরুণকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক সামরিক শিক্ষার জন্য তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে না? এন.সি.সি. পদ্ধতির ট্রেনিং (পি.টি. প্যারেড, বন্দুক চালনা, ফার্স্ট এইড, সমাজকল্যাণ ও রাজনীতি সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান, ক্যাম্পের শরণার্থী সেবার মধ্য দিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা সবই এই শিক্ষণ সূচির মধ্যে পড়বে) দেওয়াটা তাে বিপজ্জনক কিছু নয়! ভারতীয় ছাত্রদের জন্য এন.সি.সি. বাধ্যতামূলক, কিন্তু তার সঙ্গে ছাত্রদের রাজনৈতিক মত-পথ জড়িয়ে তাে কেউ দুশ্চিন্তা করে না।
কোনাে শত্রু পক্ষীয় লােক যাতে এই বিশেষ ট্রেনিং এর সময় শিক্ষণকারী তরুণদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে আত্মগােপন করে থাকতে না পারে তার জন্য সতর্ক ক্রুটিনী ও ক্রীনিং করার পরে এই সুশিক্ষিত ও সুসংহত বিশাল যুব বাহিনী থেকে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং কম্যান্ডাে ও গেরিলা গ্রুপের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে দীর্ঘদিন সৈন্য জোগানাে সম্ভব। সমস্ত তরুণদের যদি আলাদাভাবে একটি সুশৃঙ্খল সংগঠনের মধ্যে সতর্ক বিধিনিষেধের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তাহলে স্কুটিনী ও স্ক্রীনিং এর কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যাবে।
এই অজস্র শরণার্থীদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা একটি বিরাট দায়িত্ব এবং প্রচণ্ড সমস্যা। পশ্চিমবাংলার আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থাটাই এতে দিশাহারা হয়ে পড়তে পারে। উপরন্তু এই হতদরিদ্র, শৃঙ্খলাহীন ভারতে এই দেশত্যাগী হৃত সর্বস্ব মানুষের স্রোত যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট সৃষ্টি করবে সেই পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের ষড়যন্ত্রকারীরা ধূমায়িত সাম্প্রদায়িকতার সুযােগ নিতে চেষ্টা করবে। কিন্তু বাংলাদেশের সমস্ত শরণার্থী যুবকদেরই যদি নিয়মশৃঙ্খলার আওতায় আনা যায় তবে তার প্রভাবে সমগ্র শরণার্থী স্রোতই নিয়ন্ত্রিত হবে। এই তরুণেরা শরণার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রাখবেন। অতএব, সর্বাগ্রে বাংলাদেশ থেকে আগত যুবশক্তিকে পূর্ণত শৃঙ্খলাবদ্ধ করার মধ্যেই রয়েছে এই বিপর্যস্ত পরিস্থিতিকে সুনিয়ন্ত্রিত করার চাবিকাঠি।
প্রত্যেক কর্মী ও সংগঠককে ট্রেনিং দিয়ে এই শরণার্থী যুবশক্তিকে সুসংগঠিত করা ও সুনিপুণভাবে যুবশিবিরগুলাে পরিচালনা করা নিঃসন্দেহে একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। তবে অজস্র কর্মী পাওয়া সম্ভব। বহু শিক্ষিত ব্যক্তি, নানাবিধ কাজে যুক্ত মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ, যথা— অধ্যাপক, শিক্ষক, আইন ব্যবসায়ী, সাহিত্যিক, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়াররা আজ বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবাংলায় আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাদের সকলকে এই উদ্দেশ্যে সঙ্বদ্ধ করা প্রয়ােজন। চাকুরির সন্ধানে, আশ্রয়ের সন্ধানে, উদ্দেশ্যহীনভাবে বৃথা ঘুরে তাদের লাভ নেই। স্বদেশীয় মানুষ ও যুবকদের প্রতি তাদের বাধ্যতামূলকভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে আদেশ জারি করা উচিত। আমরা আশা রাখি যে যদি জাতীয় স্বার্থে একটি বিরাট ফলশ্রুতিপূর্ণ পরিকল্পনার আয়ত্তে এঁদের নিয়ে আসা যায় তাহলে এঁদের অধিকাংশই জীবনের বিভ্রান্ত লক্ষ্যকে পুনরায় ফিরে পাবেন। ইতিহাস, জনস্বাস্থ্য, ভূগােল, অক্ষর পরিচয়, ব্যবস্থাপনা, রাজনীতিজ্ঞান, সহায়হীন শরণার্থী সেবায় আত্মনিয়ােগ সমস্তই এই পরিকল্পনার বিষয়ীভূত হবে। যদি টেকনিক্যাল ট্রেনিংয়ের জন্য যথেষ্ট লােক না পাওয়া যায় তাহলে ভারতীয়দের মধ্য থেকে কর্মী সগ্রহ করে শূন্যস্থান পূর্ণ করা যাবে।
এটা স্বাভাবিক যে মুসলমান শরণার্থীদের চেয়ে হিন্দু শরণার্থীরা সংখ্যায় বেশি হবেন। এই হিন্দু শরণার্থীদের মনােবলই সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত দেখা যাবে এবং বেশির ভাগ হিন্দু যুবকেরা বাংলাদেশে আর ফিরে যাবার ইচ্ছা পােষণ করবেন না। কিন্তু যদি বাংলাদেশ এবং ভারতের সর্বস্তরের নেতারা একযােগে এদের মধ্যে ব্যাপক, গভীর এবং সুশৃঙ্খলভাবে রাজনৈতিক কাজ করে যান তাহলে বাংলাদেশের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস আবার ফিরে আসবে। শরণার্থীদের মধ্যে বহু হিন্দু তরুণ সব কিছু সত্ত্বেও এখনাে মুক্তি সগ্রামে যােগ দিতে ইচ্ছুক, ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র, পরিকল্পনা ইত্যাদি সহযােগে এদের সুশিক্ষিত করে তুললে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক চক্রকে সার্বিকভাবে প্রত্যাঘাত করার মুহূর্তে এঁরা এগিয়ে যাবেন।
এ কাজে যে প্রচুর টাকা দরকার এতে কোনাে সন্দেহ নেই। কিন্তু শরণার্থীদের ভরণ-পােষণের জন্য টাকা আমাদের জোগাড় করতেই হবে। বিক্ষিপ্ত বা আধাখেচড়া ভাবে নয়, এতবড় একটা যুবশক্তিকে প্রকৃত ট্রেনিং দিতে হলে যে আরাে কিছু বেশি টাকা দরকার তা সত্য। কিন্তু এই অর্থব্যয় পরিণামে উভয়ত লাভজনক হবে। শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের জন্য এক বিরাট শক্তিকে গড়ে তােলা দুটি কাজই এতে সার্থক হবে। তবে পরিচ্ছন্ন শৌচাগার, পানীয়জল, পােশাক পরিচ্ছদ, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, গ্রন্থাগার, চিকিৎসা ব্যবস্থা এই সমস্ত প্রয়ােজনীয় জিনিস ছাড়া যুব-শিবিরগুলাের কাজ আরম্ভ করা ঠিক নয়। যাতে অতি প্রয়ােজনীয় সাধারণ জিনিসগুলাের অভাবে তাদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিরক্তি দেখা না দেয় সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
যদি ভারত আজ এ দায়িত্ব যােগ্যভাবে গ্রহণ ও পালন করতে পারে তবে একদিন স্বাধীন বাংলাদেশ এজন্য ভারতকে আন্তরিক প্রীতি ও সৌহার্দ জ্ঞাপন করবে—আর অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যে সম্পূর্ণ স্বাধীন হবেই এতে কোনাে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশকে পুনর্গঠিত করার কাজে স্বাধীন বাঙালিরা এই লক্ষ লক্ষ সুশিক্ষিত সুনিয়ন্ত্রিত যুবকদের নিয়ােগ করতে পারবেন। আজ যা অসহনীয় বােঝা মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে তা-ই এক বিশাল সজীব সােনার খনি বলে পরিগণিত হবে। চূড়ান্ত দুঃখজনক পরিস্থিতিকেও পরম মঙ্গলের প্রতি পরিচালিত করার এটাই একমাত্র পথ।
কিন্তু কে এই বিরাট পরিকল্পনার দায়িত্ব নেবেন এবং তা কার্যকরী করবেন? আজ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং দ্ব্যর্থহীন পদ্ধতিতে প্রত্যেকের দায়িত্ব প্রত্যেকের সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি, ভারত সরকারের প্রতিনিধি, এবং ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের সামরিক কর্মচারীদের নিয়ে একটি উচ্চক্ষমতাশালী সংস্থা গঠন করতে হবে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, সমাজতত্ত্ববিদ, মনস্তত্ত্ববিদ ও সমাজকর্মীদের উপদেষ্টা হিসেবে নিতে হবে। দুটি দেশের যৌথ ভবিষ্যতের পরিপ্রেক্ষিতে সকলকে আমরা প্রস্তাবটি ভেবে দেখতে অনুরােধ করছি। ক্ষিপ্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। মনে রাখা দরকার “শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে বিশ্বের দরবারে এটা কাতরকণ্ঠে বলে বেড়ালেও দায়িত্বটা “বিশ্ববিবেক” বা “বিশ্বমানবতার” নয়, তাদের দোষারােপ করার চেয়ে নিজেদের কতকগুলাে commitment এ আসা বেশি প্রয়ােজন। এক্ষুণি শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না। সম্মুখে দীর্ঘদিন এবং দীর্ঘপথ। উভয় দেশকেই এই মহান দুঃখ বহন করার শক্তি অন্তর থেকে অর্জন করতে হবে। বলহীনের কাছে কিছুই লভ্য নয়।
সূত্র: কম্পাস, ১৯শে জুন ১৯৭১