স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে এলাম
[ স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তি সগ্রাম অব্যাহত। বড় শহরগুলাের নিকটবর্তী ক্যান্টনমেন্ট এলাকাগুলােতে পাকসৈন্যবাহিনী কোনাে রকমে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত। মাঝে মাঝে শহরগুলােতে হানা দিচ্ছে খাদ্য ও পানীয় জলের আশায়। বাদ বাকী গ্রামাঞ্চলসহ সমগ্র বাংলাদেশ মুক্তি ফৌজের অধীন।
এ সপ্তাহে জয়পরাজয় দুইই ঘটেছে। রংপুর হাত ছাড়া হওয়ার পর পুনরায় অধিকৃত হয়েছে। কুমিল্লা শহরও পুনরায় দখল। শ্রীহট্টে সংগ্রাম চলছে। সেখানকার বিমানঘাঁটি মুক্তিফৌজের দখলে। ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল ও ফরিদপুর সম্পূর্ণ শত্রু মুক্ত। যশােহরে আবার লড়াই শুরু হয়েছে। বর্ষা আসছে, সঙ্গে আনছে হানাদারদের দুর্দিন।
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি স্বাধীন বাংলাদেশ ঘুরে এসেছেন। তাঁদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এ সংখ্যায় দেওয়া হলাে।]
এপার বাংলার ঘােজাডাঙ্গা। আর ওপারের স্বাধীন বাংলার সীমান্ত চৌকী ভােমরা। মাঝখানে ছােট্ট একটি খাল, খালের উপর সেতু তাও আবার কিছু কাঁটাতার ঐ সেতুর উপর ফেলা। সেদিন তারিখটি ছিল ১ লা এপ্রিল। সকাল ১০ টা ১৫ মি: আমি ও কম্পাসের আর এক সাংবাদিক বন্ধু শ্যামল পাল এবং কোলকাতার আরও কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধু সেতুটির নিচ দিয়ে পায়ে হেঁটে খাল পেরিয়ে ওপার বাংলা স্বাধীন বাংলার পুণ্যমাটিতে পা রাখলাম। স্বীকার করতে বাধা নেই আবেগে তুলে নিলাম এক মুঠো এই পুণ্য মাটি, চুম্বন করলাম, মাথায় ছোঁয়ালাম এই মাটি। এবার জয় বাংলার মাটিতে। সামনে ভােমরা সীমান্ত চৌকী। এই চৌকীরই সামনে পত পত করে উড়ছে জয় বাংলার স্বাধীন পতাকা সবুজ জমির মাঝখানে হলুদ রং এর বৃত্তাকার; বৃত্তের মাঝে জয় বাংলার মানচিত্র। আনসার বাহিনীর একজন মুক্তি সেনানী হাতে একটি রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পতাকার স্ট্যান্ডটির নিচে। পাশেই একটি লেখা ফেস্টুন “জয় বাংলার মুক্তি ফৌজকে সাহায্য করুন।” আরও একটি চিত্র চোখে পড়ল—ওপার বাংলায় তবুও সীমান্তের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে সড়কের উপর আড়াআড়ি ভাবে পাতা একখানা বাঁশ আর স্বাধীন বাংলার সীমান্তের কোনাে অস্তিত্বই নেই, একটা কাঠের বেড়ার ভগ্নাবশেষ শুধু পাশে বিদ্যমান। স্বাধীন বাংলার সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ছাউনীগুলাে আজ ফাকা। আমাদের এপার বাংলায়ও দেখা পেলাম বহু স্বাধীন বাংলার মুখ। এর অধিকাংশই আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক। এসেছেন খবর দিতে, খবর নিতে, এসেছেন সাহায্যের সন্ধানে। সাতক্ষীরার জনৈক ছাত্রনেতা বল্লেন তিনি নিজে গতকাল মুক্তিফৌজের সৈনিক হিসাবে ফায়ারিং” করে এসেছেন খুলনায় পাক সৈনিকের উপর। আজ আবার পার্টির নির্দেশে এক গুরু দায়িত্বভার নিয়ে এসেছেন এখানে।
ঠিক তেমনই দেখতে পেলাম এপার বাংলা থেকে প্রচুর লােক সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকছে ওপারে। কারণ সীমান্ত আজ আর সীমান্ত বলে কিছু নেই সব একাকার হয়ে গেছে।
এবার আমি ও শ্যামল বাবু একটা রিক্সায় চাপলাম। গন্তব্যস্থল আমাদের সাতক্ষীরা, খুলনা জেলার একটি মহকুমা শহর। দূরত্ব এখান থেকে নমাইল। পথে ছােট বড় যাদের সাথেই দেখা হ’ল ওরা বলল “জয়-বাংলা”—আমরাও হাত নেড়ে উত্তর দিলাম “জয় বাংলা” বলে। রাস্তার দু’ধারে মাঠ। মামুদপুর, আলীপুর, বাকাল একটার পর একটা গ্রাম পেরিয়ে চলছি রাস্তা ঘাটের অবস্থা খারাপ। সুতরাং রিক্সাচালক মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিচ্ছে, দেখা হচ্ছে আঞ্চলিক অধিবাসীদের সঙ্গে। দোকানপাট রীতিমতাে চলছে, এরই মধ্যে কোথাও কোথাও জটলাও হচ্ছে বেশ। সবাই জানতে চান খবর কী। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে আজকাল একমাত্র খবরের সূত্র কোলকাতার দৈনিক কাগজ আর “অলইন্ডিয়া রেডিও।” কিন্তু ওখানে রেডিও সেট সব জায়গায় নেই। এপার বাংলা থেকে যাবার পথে সঙ্গে করে কিছু আনন্দবাজার ও যুগান্তর পত্রিকা নিয়ে গিয়েছিলাম। ওরা কাগজ দেখে আমাদের কাছে ছুটে আসছেন। আমরা দিলামও কিন্তু সব জায়গায় সবাইকে আমরা সন্তুষ্ট করতে পারিনি। কারণ শেষ মুহূর্তে তখন আমাদের হাতে একটি করে কাগজ দাঁড়িয়েছে— বললাম এটাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি সাতক্ষীরার জন্য, ওখানকার আওয়ামী লীগ নেতাদের দেব বলে।
রাস্তায় যেতে যেতে যা যা শুনূতে পেলাম তাতে সর্বত্রই সর্বস্তরের বাঙালিরা (হিন্দু মুসলিম উভয় অর্থেই) একটি কথা বিশ্বাস করেন, যে স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমানে সমস্ত স্তরের অবাঙালি মুসলমানরাই পাক সেনা বাহিনীর সঙ্গে একজোট হয়েছে। শহরের মহল্লায় মহল্লায় এঁরাই “খানদের” (ওদের ভাষায় পশ্চিমা পাঞ্জাবী বালুচ পাঠান সমস্ত পাক সেনারাই খান নামে পরিচিত) সমস্ত বাঙালিদের চিনিয়ে দিচ্ছে, রাস্তা ঘাট সমস্ত এরাই চিনিয়ে দিচ্ছে। এবং এ জন্য খানরা এতদূর লড়তে পাচ্ছে। খুলনা শহরে প্রথম দিন অবাঙালিরাও মিলিটারিদের সহযােগিতায় বােমা প্রভৃতি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায়। কোথাও আবার এরাই মুক্তি বাহিনীর প্রতি দরদ দেখিয়ে খাবারের রুটির সাথে বিষ মিশিয়ে বহু মুক্তি ফৌজীদের হত্যা করেছে। দিন দু’য়েক আগে খুলনা থেকে কিছুদূর খালিশপুরে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে বলে শুনতে পেলাম। এ ধরনের অবাঙালি মুসলমানদের বহু কথা ও কাহিনী সাধারণ লােকের মুখে মুখে শােনা যায়। রিক্সা এসে দাঁড়াল সাতক্ষীরা শহরের কাছে। পাশেই একটি সরকারি অফিস “সি এন্ড বি”, আমাদের এখানে যাকে বলি পূর্ত বিভাগ। স্বাধীন বাংলাদেশের এই মুক্ত অঞ্চলটিতে অসহযােগ আন্দোলনের জন্য এখানকার “ওয়াপদা” “সি এন্ড বির মতাে সমস্ত সরকারি অফিসে কাজকর্ম বন্ধ।
আমাদের ঘড়িতে এখন ভারতীয় সময় দুপুর ১২-৩০ মি:। রাস্তার ওপাশে একটি মিষ্টির দোকানে প্রচণ্ড
জমেছে। আকাশ বাণী থেকে খবর পড়া হচ্ছে বাংলা খবর। আর ঐ দোকানের একটি মাত্র রেডিও সেটে সেই খবর শােনার জন্য আশ পাশের সবাই জমায়েত। মুক্তি ফৌজের কোথাও কোথাও অগ্রগমনের খবরে অনেকের চোখে মুখে গৌরবের হাসি।
এখানেই দেখা হ’ল “সি এন্ড বি’র একজন সরকারি তরুণ অফিসারের সঙ্গে। রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের ডিগ্রীধারী এই বাঙালি মুসলিম তরুণটিকে আমাদের পরিচয় জানালাম, আরও জানালাম আমরা কেন এখানে এসেছি। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে তিনিও আর একটি রিক্সায় চাপলেন আমাদের সঙ্গে যাবার জন্য। এইখানে আমি শ্যামল বাবুকে বলে ঐ তরুণ বন্ধুটির রিক্সায় চেপে বসলাম। এইবার আমার বন্ধুটির সঙ্গে কিছু কথােপকথন হয়। বন্ধুটি এখানকার ইউনিয়নের একজন প্রথম সারির নেতাও। তিনি জানিয়েছেন এখানকার বাঙালিরা কিছুটা ভীতু। এ ছাড়া এখানে একটি পঞ্চম বাহিনীও রয়েছে। বিশদভাবে বলতে যেয়ে তিনি একটি প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের নাম করলেন। বললেন যদিও এদের সংখ্যা এখানে অনেক কম এবং দিন দুয়েক হয় এরা সবাই এই সংগ্রামে তাদের পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে, তবুও এদের এরা বিশ্বাস করেন না। শুনলাম এখান থেকে প্রায় দু হাজার যুবক মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিয়েছেন। কিছু ধনুক ধারী গ্রামের চাষিও যশােহরে পাক সেনাদের সঙ্গে লড়তে চলে গেছে বলে বন্ধুটি জানালে করলাম আপনারা কি এর জন্য আগে থেকে কোনাে প্রস্তুতি চালিয়ে ছিলেন, নইলে আপনারা এমন প্রতিরােধ গড়ে তুললেন কী করে।
আরও জিজ্ঞেস করলাম—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে দীর্ঘ এগারদিন আলােচনা চালিয়ে অযথা কালক্ষয় ও সেই সুযােগে পাক সরকারকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও রসদ আনার সময় দিয়ে তাদের নেতা কোনাে ভুল করেছেন কিনা?
উত্তরে বন্ধুটি প্রথমেই বললেন আমরা একথা বিশ্বাস করি না যে আমাদের প্রিয় নেতা কোনাে প্রকার ভুল করতে পারেন। মুজিবর রহমান শুধু একজন ব্যক্তি নন তিনি আমাদের সাড়ে সাতকোটি বাঙালির আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। তিনি আরও বললেন যে, আলােচনার দ্বিতীয় দিবসেই বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত এ আলােচনা ফলপ্রসু হবার সম্ভাবনা কম। তাই তিনি দলের প্রতিটি অঞ্চলের প্রতিটি ইউনিটকে যথাযথ প্রস্তত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনারা এপার বাংলার নাম “স্বাধীন বাংলাদেশ” নামকরণ করলেন কেন ওপার বাংলা অর্থাৎ প. বাংলার অস্তিত্বকে কি তবে কোনাে মূল্য দিতে রাজী নন। তিনি বললেন কথাটা ওভাবে নিচ্ছেন কেন। এপার বাংলাই বলুন আর ওপার বাংলাই বলুন- আজ কিন্তু সঠিকভাবে বাঙালির অস্তিত্বকে বজায় রাখার প্রশ্নটা বড়ভাবে দেখা দিয়েছে। এখানে আমি আপনি কেহই পৃথক নই।
জিজ্ঞেস করেছিলাম এই যে লক্ষ লক্ষ প্রাণ বিনষ্ট হচ্ছে এর জন্য আপনারা শঙ্কিত নন!
দৃপ্তকণ্ঠে, বন্ধুটি বললেন, না। আমরা আজ যে পথে নেমেছি, জানি সে পথ সহজ ও সরল নয়। আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। ওরা কত হত্যা করবে, কত লক্ষ? এ পথে যে কোটি প্রাণ দিতে হবে বলিদান তা আমরা জানি।”
প্রয়ােজনে এত মূল্য দিয়েও আমাদের স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রাখব। ইতিমধ্যে রিক্সাটি এসে দাঁড়িয়েছে সাতক্ষীরা বাজারের কাছে একটি কাঠের পুলের এপারে।
ভাড়া দিতে গেলে বন্ধুটিই রিক্সাওয়ালাকে বললেন এঁদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেবে না কারণ এঁরা এসেছেন আমাদের প্রয়ােজনে আমাদের পাশে দাঁড়াতে। বস্তুত “স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে লক্ষ্য করেছি একই জিনিস পঃ বাংলা তথা সারাভারতের জনগণের কাছে এদের অনেক প্রত্যাশা, সীমান্তের ওপারের লােকেরাই আজ এদের সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু।
এবার আমরা গেলাম আওয়ামী লীগ অফিসে। অফিসঘর বন্ধ। গেলাম স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি। কিন্তু এরই মধ্যে সাতক্ষীরায় একটি খবর এসে গেছে যে খুলনার ওদিক থেকে একটি ট্রাক ভর্তি কিছু লােককে গ্রামবাসী আসতে দেখেছে। যদিও তাদের পরনে খাকি পােশাক কিন্তু হাতে অস্ত্র ছিল না। রাস্তার পাশ থেকে জনসাধারণ তাদের “জয় বাংলা” জানালে ওরাও “জয়বাংলা প্রত্যুত্তর করে। তবুও এঁরা আশংকা করছেন “পাকসেনারা হয়তাে ছদ্মবেশে সাতক্ষীরার দিকে আসছে। সাথে সাথেই শহরময় ব্যস্ততা। এবং এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে বন্দুক সগ্রহ করা হ’ল। ছুটল সবাই থানায়। আমরাও থানায় গেলাম। থানায় কিছু ই, পি, আর, কিছু পুলিশ যার যার রাইফেল বন্দুক তুলে নিচ্ছে। বাড়ি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে চারখানা বন্দুক এল। দারােগা সাহেব নিজে সবাইকে যার যার পজিশন নিতে নির্দেশ দিচ্ছেন। শ্যামল বাবু ছবি তুলতে লেগে গেলেন। এই ফাঁকে আমি একবার থানার ভিতরে ঢুকেছি। ওদিকে থানার “ওয়ারলেসে” অন্য সব জায়গার খবর আসছে। খবর পেলাম যশােহর জেল ভেঙে ১৭০০ কয়েদী মুক্ত হয়ে মুক্তিফৌজে যােগ দিয়েছেন।
ইতােমধ্যে একজন স্বেচ্ছাসেবক আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তাদের আওয়ামী লীগ নেতার কাছে। সে দিনের খবরের কাগজখানা দিলাম তাকে। খুশি হলেন, বললেন আরও কাগজ চাই। আমরা আপনাদের উপর অনেক ভরসা করি। আপনাদের নেতাদের বলে আমাদের অস্ত্র দিন। আমরাও বােমা, কটেল, মলােটভ করতে পারি কিন্তু এখন আমাদের দরকার ‘৩,৩ গুলি। দরকার পেট্রোল। যার দাম ওখানে ইতিমধ্যেই ১০০ টাকা লিটারে দাঁড়িয়েছে। দরকার ব্যান্ডেজ ওষুধ পত্তর। বেসরকারি পর্যায়ে যে সব সাহায্য ওখানে যাচ্ছে তার সবগুলাে ওখানে যথাস্থানে পৌছচ্ছে না। আমাদের সামনেই এমন একটি ঘটনার নজীর পেলাম।
থানার তৎপরতা ওদিকে অব্যাহত শুনলাম মুক্তিফৌজ বাহিনীতে ওখানকার দারােগার অবদান। পাক সামরিক সরকার যখন রেডিওযােগে বলেছে জনসাধারণকে যার যার বন্দুক নিকটবর্তী থানায় জমা দেবার জন্য অমনি সবাই থানায় ছােটে, যার যার বন্দুক নিয়ে। কিন্তু এই দারােগা সাহেব সবাইকে ধমকে ফেরৎ পাঠান। শুনলাম সাতক্ষীরার মহকুমা শাসক (পাঞ্জাবী মুসলমান) এখন স্বগৃহে মুক্তি ফৌজীর হাতে নজরবন্দি। তার ভাগ্যে কি আছে বলা মুশকিল। স্থানীয় কর্মচারীরা গত দুমাস ধরে মাইনে পায়নি। যদিও হাশাসক হুকুম দিয়েছেন কিন্তু স্থানীয় ন্যাশনাল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা মানছেন না। কর্মচারীরা ব্যাংকটি ঘেরাও করবেন বললেন।
এবার এলাম বাজার এলাকায়। বলাবাহুল্য এই ধরনের একটি পরিস্থিতি আমাদের স্বাভাবিক আলােচনা কিছুটা ব্যাহত হলাে। ওদিকে বাজারের দোকানপাট সব বন্ধ-হয়ে গেছে ঝটপট। বাড়ি ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। রাস্তার লােকজন (এরমধ্যে প. বাংলার কিছু উৎসাহী লােকও আছে যারা ওখানে অবস্থা দেখতে গেছে) আমাদের কাছে জানতে চাইল পাক সৈন্যরা এসে গেছে কিনা। ওদিকে ওয়ারলেসে খবর এসেছে কোনাে পাক সৈন্য এদিকে আসেনি। পরে ঘটনাটা আরও পরিষ্কার হলাে যে ই. পি. আর এর লােকেরা ঐ ট্রাকে আসছিল। আমরা আবার গেলাম আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি। অনেক কথাবার্তা হলাে। ঢাকার কিছু পত্রপত্রিকাও আমাদিগকে দিলেন।
বেলা গড়িয়ে এল। এবার আমরা ফিরতে চাইলাম। একজন স্বেচ্ছাসেবক আমাদের থেকে যেতে বল্লেন- বারবার অনুরােধ জানালেন স্নান আহারের। হাতে সময় সংক্ষিপ্ত তাই তাঁর অনুরােধ রক্ষা করতে পারলাম না। এবার রিক্সায় উঠার মুখে তিনি বললেন-একটা কথা বলছি—যদি পারেন ওপার বাংলা থেকে এই যে হাজার হাজার লােক এপারে স্বাধীন বাংলায় আসছে তা বন্ধ করুন। আপনারা কাজের লােক, কাজের জন্য এসেছেন, আপনারা আমাদের মেহমান, আপনাদের আমরা না খাইয়ে পারি না। কিন্তু ওরা যারা আসছে তারা যদি এখানকার একটুকরাে রুটিও খায় সেটাও পরিণামে আমাদের অসুবিধায় ফেলতে পারে। কারণ আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধ কতদিন চলবে জানি না সমস্ত রকম পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত।
এখন আমাদের সব চাইতে বেশি করে মনোেযােগ দিতে হচ্ছে খাদ্য সংরক্ষণ করার।
ফেরার পথে আবার নজরে এল পঃ বাংলা থেকে বহুলােক এদিকে আসছে একেবারে শূন্যহাতে। ভাবছিলাম এরা কৌতূহলী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু তবুও যদি এরা যার যার হাতে একখানা করে কোলকাতার খবরের কাগজ নিয়ে যেত তাতে হয়তাে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষরা সুখী হতে পারতেন।
মণি মৈত্র
সূত্র: কম্পাস, ১০ই এপ্রিল ১৯৭১