You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.08 | বাংলাদেশে সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলােতে | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশে সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলােতে (৩)
শকুন্তল সেন

পরিতৃপ্ত হৃদয় নিয়ে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে বেরিয়ে এলাম রাজপথে। আপন মনেই বিভোের ছিলাম। কেন যে অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি নেহাৎ ভাগ্যের জোর। মনে হচ্ছিল এই নেতা, এই ছাত্র-কৃষক সমাজ, এই শ্রমিক, সাধারণ মানুষ আজ যে সগ্রামে নেমে পড়েছে, আমিও তাতে সামিল হই। হই না কেন আজ আমি ভিন্ন। দেশের নাগরিক আমার জন্মভূমি তাে এটাই।
আঃ মানুষ যা চায় তাই যদি করবার সাধ্য থাকত! মনে মনে বললাম “ঈশ্বর, তুমি এদের দেখাে’!
বেলা তিনটেয় পল্টনে মিটিং। আমার কাজ খাওয়া দেখা ঘােরা। আর্থিক অবস্থা খুব ভালাে নয়। কাল সাংবাদিক বন্ধুটির কাছ থেকে কিছু টাকা নিতে হবে, না পেলে…। হেঁটে হেঁটেই চলি। চৈত্রের সূর্য গলানাে বরাদুরে। পয়সা নেই-রিক্সায় উঠতে মানা।
‘পল্টনে এসে পৌছলাম মিটিং শুরু_গরম গরম গান হচ্ছে। এই প্রথম লরি আর বাসে করে মিটিংএ লােক আনতে দেখলাম। এখন মনে নেই, তবে যতদূর স্মরণ হয় শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে মিটিং ডাকা হয়েছিল। প্রধান বক্তা কাজী জাফর। সুন্দর চেহারা! বক্তৃতায় আগুন আছে। অনেক প্রস্তাব। একটি অল্পবয়সী মেয়ে প্রস্তাবগুলাে রাখল। শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী! ভালাে কর্মী। সভা শেষে তারা শশাভাযাত্রা করে শহীদ মিনারের দিকে গেলেন। আমি মাঠ পেরিয়ে বায়তুল মােকাররমে এলাম।
এখানে সরকারি কর্মচারীদের সভা। প্রধান বক্তা প্রখ্যাত ছাত্রনেতা নূরে আলম, এ. সিদ্দিকী। চমৎকার বলেন চিন্তাধারা পরিষ্কার। সর্ট ফিগার শক্ত চেহারা। হিউমার বােধও রয়েছে।
বল্লেন “বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ ও শেখ সাহেবের নেতৃত্বে শােষণ, জুলুম ও গােলামীর বিরুদ্ধে অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ধরনের আন্দোলনের তুলনা নেই। গত ২৩ বৎসর আমাদের ইসলাম বিপন্ন’ বলে থােকা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, পাকিস্তান বিপন্ন। পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের গােলাম ছাড়া, উপনিবেশ ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। তারা মনে করেন বাঙালি গােলামী করবে, আর তারা করবেন উজিরী। আমরা এই অসাম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে এসেছি। আজ অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের ২৪ তম দিন। শেখ সাহেব বলেছেন “অশান্তি অথবা বিশৃঙ্খলার দ্বারা কোনও মহৎ লক্ষ্যে উপনীত হওয়া যায় না। সুতরাং আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সম্মানজনক মীমাংসায় আসতে চাই। কিন্তু তা যদি না হয়, তাহলে গান্ধিজীর মতাে আমরাও বিশ্বাস করি প্রয়ােজনে হিংসা, অহিংসার চাইতেও শ্রেয়। (প্রচণ্ড ক্লাপ-হিয়ার হিয়ার)। যদি দরকার হয়, যদি সময় আসে, তাহলে বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি দেখিয়ে দেবে কিভাবে সগ্রাম করতে হয়, মরতে হয়, মারতে হয়।” ইত্যাদি ইত্যাদি।
সিদ্দিকী সাহেবের জয় বাংলা’ আওয়াজ দেবার কায়দাটা আমার খুব ভালাে লেগেছে। জানি না, এখন কোথায় উনি।
সন্ধ্যা হয় হয়। হঠাৎ গুজব শুনলাম শেখ সাহেবের বড় ছেলে কামাল মােটর দুর্ঘটনায় আহত, আর শেখ সাহেব চারদফা মেনে নিয়েছেন। কি একটা কাগজে টেলিগ্রামও বেরিয়ে গেল। নেহাৎই গুজব। কলকাতা ও ঢাকা সব সমান। কয়েকটি মিলিটারি ট্রাক চলে গেল। ডি, আই, টি বিল্ডিং এ সামরিক পাহারা! চললাম শহীদ মিনারে। ওখানেও হাসপাতালের কাছে সৈন্য বােঝাই ট্রাক এদিক ওদিক যাতায়াত করছে। একটু খারাপ লাগল। শহীদ মিনারে কোনও আলাে নেই। অন্ধকার রাত। ভালাে লাগল না বেরিয়ে এলাম।
রাত প্রায় এগারােটা নাগাদ ফিরে এলাম। আসবার পথে অনেক জায়গায় ই, পি, আর, পুলিশ আর মিলিটারী পােস্টিং দেখলাম। জিপে করে সামরিক পােশাক পরিহিত ব্যাক্তিদের যেতে দেখলাম। আরও খারাপ লাগল। বাড়িতে চাকর ও অন্যান্য লােকেরা আছে। কর্তা নেই। বললাম খেয়ে এসেছি। ও খুব দুঃখ করতে লাগল। কেন জানি না কিছুই ভালাে লাগছিল না। সারাদিন যে আনন্দ উৎসাহে কাটিয়েছি তার লেশমাত্র আর অবশিষ্ট নেই। বড় ক্লান্ত, খুবই নিঃসঙ্গ। কেউ নেই কিছু নেই। কোনাে এক গভীর অজানা আশঙ্কা আর আতঙ্কে মন কেঁপে উঠছে।
অলক্ষণ, মানুষ কি আগেই টের পায়! এখন কলকাতা শহরে বসে নিরাপদ আশ্রয়ে লিখছি। কিন্তু কত দূরে, বন্ধু নেই আত্মীয় স্বজন বলতে কেউই নেই টাকা পয়সা নেই, এই ঢাকা শহরে আমি নিজেকে একান্তভাবে নিরাশ্রয় বােধ করতে লাগলুম। ১৯ শে মার্চের পর এই প্রথম বড় দুর্বল একা বােধ হ’ল। মনে পড়ল পান্না বাবুর কথা। আসবার সময় বলেছিলেন-“নিজেকে কখনও দুর্বল ভেব না, একা ভেব না। আমরা সব সময় তােমার সঙ্গেই আছি।” একটু পরেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠলাম। শুয়ে পড়লাম। যে গম্ভীর ভাষণ সকালে শুনেছি এমপ্লিফায়ারে সেই কণ্ঠস্বরে “ভায়েরা আমার…।” একটু একটু করে চোখের পাতা খুঁজে আসতে লাগল। নির্মল আকাশ, অন্ধকার রাত -অসংখ্য তারা যেন লক্ষ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ রাখছে।
একটু পরে প্রচণ্ড বােমার আওয়াজ! মুহুর্তের মধ্যে আমি দু হাত মাথায় নিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়েছি। কয়েক মুহূর্ত নীরব। হাত বাড়িয়ে রেডিয়াম’ ডায়ালে ঘড়িটা বালিশের নিচ থেকে টেনে নিলাম। রাত ১২ – ১৮ মি:। তারপর—তারপর শুরু হ’ল একনাগাড়ে গুলি বৃষ্টি। মেশিনগান। কটু-টু-ট। একটানা বিশ্রাম নেই— ক্লান্তি নেই, বিরতি নেই! আমি একভাবে নিশ্বাস বন্ধ করে মেঝেতে পড়ে আছি। ভয়ে আতঙ্কে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হায় ঈশ্বর! এ কি হ’ল। মনে হচ্ছিল একদল উন্মাদকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
গুলি চলছে চলছে চলছে। সামনের দেয়ালে এসে লাগছে। বালি ঝরে ঝরে পড়ছে। চীকার আর্তনাদ ক্রন্দন! থেমেও যাচ্ছে। দৌড়াদৌড়ি চীঙ্কার বাঁচাও বাঁচাও। পড়ে যাবার শব্দ। এই সদর ঘাট এলাকায় এই টার্মিনালে কয়েক হাজার লোেক বােধ করি শুয়ে থাকে। অনেক রাতে যারা লঞ্চে অথবা নৌকায় আসে, তারা রাতটুকু এখানে কাটিয়ে সকালে শহরে যায় তেমনি বহু লােক খুব ভােরে লঞ্চ ধরবার জন্য এখানেই রাত কাটায়। তাছাড়া অসংখ্য বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা। সেই হতভাগ্যদের চীকার আর্ত করুণ স্বরে কেউ আল্লাকে, কেউ ঈশ্বরকে ডাকছে। কিন্তু সে কতক্ষণের জন্য। গুলির বিরাম নেই! এক এক মুহূর্ত এক এক ঘন্টা! এই অন্ধকার, চীৎকারে অভিশাপে ক্রন্দন আর গুলির শব্দে বীভৎস, ভয়ঙ্কর। আমি সেই এক ভাবে শুয়ে আছি।
বলতে আজ সঙ্কোচ নেই চোখের জল ফেটে বেরিয়ে আসছে। আমরা কলকাতায় অনেক গুলি, অনেক বােমা বাজী দেখেছি। কিন্তু এ দৃশ্য সুদূরতম কল্পনার অতীত। কি করি কোথায় যাই। ছুটে বেরিয়ে যাবাে! নাঃ যদি বাড়িতে ঢুকে পড়ে তাহলে! মা কোথায় তুমি। মমতা বাপিতাে। আঃ পাগল হয়ে যাবাে! ইস্ মাথাটা ভীষণ ধরেছে! আচ্ছা চোখটা এত জ্বালা করছে কেন? কাঁদানে গ্যাস! কি সর্বনাশ একটু জল পেলে ভালাে হতাে। শেলের শব্দ। এত কাশি পাচ্ছে কেন? আচ্ছা এ কি থামবে না? এই দুর্বল অসহায় নিরস্ত্র নর নারী শিশু বৃদ্ধকে রাতের এই ঘন কালাে অন্ধকারে এভাবে হত্যা করছে কেন! হঠাৎ হুইসেলের শব্দ। সব থেমে গেল। আকুল ক্রন্দন শুনতে পাচ্ছি। পানি’ পানি, আল্লা আল্লা’। ট্রাকের শব্দ।
“উঠাও উঠাও- জদি জলদি!” রাত দেড়টা! আমি নিশ্বাস বন্ধ করে সন্তর্পণে দরজার খিল খুললাম। নিজেকে বলছি-মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। ওই অবস্থায় ব্যাগের মধ্যে জিনিসগুলাে ভরছি তােয়ালে, লুঙ্গি, স্যান্ডেল। চুপ করে শুয়ে রইলাম।
এ দিকে কান্নার বিরাম নেই। হাজার মানুষের কান্না আর্তনাদ কি ভয়ঙ্কর! বাড়ির অন্যান্য অংশ থেকে অর্তনাদ থেমে গেছে। কেন জানি না হঠাৎ মনে পড়ল পান্না বাবুর কথা। রেগে গেলে বলতেন “মাথা গরম করবে না।”।
আমি একা মিলিটারীর প্রেত নৃত্য! কয়েকবার ট্রাক আনাগােনা করল। কোথায় গেল কে জানে।
আমি দরজাটা একটু মাত্র ফাঁক করেছি। আবার আবার সেই মৃত্যু গর্জন। ফটু-ট-ট। শেলের শব্দ। জানলাম আর বাঁচবার সামান্যতম সম্ভাবনা-ক্ষীণ আশাটুকু বিলীন। পড়ে রইলাম এক ভাবে| অজস্র ধারায় চোখ দিয়ে জল পড়ছে। অসম্ভব যন্ত্রণা কাঁদানে গ্যাস। আমি নেই–আমি নেই। এলােমেলাে অনেক কথা—অনেক ভাবনা। টুকরাে টুকরাে কাটা কাটা অনেকগুলাে শব্দ যেন! আবার গুলির শব্দ, সেগুলাে ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছিল। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে মানুষ কি কোনাে চিন্তা করতে পারে? আজ মনে নেই কি ভাবছিলাম বাড়ির, কলকাতার, ছােট্ট মেয়ের কথা।
গুলি সমানে চলছে। আবার হুইসেলের শব্দ। থেমে গেল। কান্না-চীৎকার কিছু নেই। আবার সেই ট্রাকের আনাগােনা। কেতনা উঠায়েগা?’
প্রচণ্ড ধমক। রাত আড়াইটা! অ আগের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম এরা অন্তত কিছুক্ষণ লাশ তুলবে। সেই মুহূর্তে আমি মনস্থির করলাম। প্রচণ্ড ঝুকি নিলাম। ঈশ্বরের কথা মনে পড়েনি অন্য কারু কথা মনে হয়নি। শুধু ভাবলাম নিজের ভাবনা। বাঁচতে হবে বাঁচার শেষ চেষ্টা করতে হবে। দরজার একটা পাল্লা আস্তে আস্তে খুলি। অপেক্ষা করি। ভাবছি আর ভাবছি। ভাবি এখানেই এভাবে থাকি। মন বলছে বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড় এই সুযােগ! ওই অবস্থায় শুয়ে শুয়ে পায়ের আঙ্গুলে ব্যাগটা আটকে ব্যাগের মধ্যে শেখসাহেবের ভাষণ আর জয় বাংলা রেকর্ড দুখানি প্রাণের চাইতে মূল্যবান বেরিয়ে পড়লাম। একটু থামি, একটু এগােই। ট্রাকের শব্দ শুনি। তারপর আর একটু গতি বাড়িয়ে দিই আঃ পেয়েছি পেয়েছি। নিচে যাবার সিঁড়ি। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। বসে বসে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামি! কোথায় যাবাে। চৌবাচ্চায়, বাথরুমে, পায়খানায়! পায়খানায় বসে রইলাম।
নাঃ এরা বাঁচতে দেবে না দেখছি। আবার শুরু হলাে। কেউ কি বেঁচে আছে? কাকে গুলি করছে— কোথায়! এরা কি পাগল হয়ে গেল! জানি না- জানি না। কিছু জানি না। এই রাত—এই সর্বনাশা রাত কি কাটবে না! পায়খানার দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটু পরে সয়ে এল। আবার শুরু হলাে গুলি বর্ষণ। প্রবল বর্ষণের মতাে অবিশ্রান্ত, ক্লান্তি নেই! আবার এক ঘণ্টা পরে ট্রাকের আনাগােনা। পুনরায় গুলি বর্ষণ। দূর থেকেও গুলির শব্দ শেলের আওয়াজ পাচ্ছি। না, আমরাই শুধু আক্রান্ত নই আজ ঢাকা শহর আক্রান্ত। দানবেরা রাতের অন্ধকারে ঢাকা শহরকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চাইছে। সকালে যাতে মৃতদেহগুলাে চোখে না পড়ে তার জন্যই এখন সেগুলাে পাচার করছে পারবে কি এত মৃতদেহ সরাতে ফেলবে বা কোথায়?
তখনও আশা ভাের হলে সব থেমে যাবে। অন্ধকার একটু একটু ফিকে হয়ে আসছে। নিকটের কোনাে মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি মাইকে ভেসে এল। মৌলবী সাহেব তার কর্তব্য ভােলেননি। পরক্ষণেই তীব্র তীক্ষ আর্তনাদ। “আ-আ-ল্লাল্লা”। মৌলবী সাহেবকে আজান শেষ করতে দিল না এরা। হায় রে! বিংশশতাব্দী তাে দূরের কথা অন্য কোনাে শতকে অন্য কোনও দেশে কি এর তুলনা আছে।
এখানে বসে আছি। মনে মনে বেশ বুঝতে পারছি বাঁচবার আশা নিতান্তই বৃথা! শুধু সময় গুণে যাওয়া—কখন মৃত্যু এসে মুক্তি দেবে। আর সহ্য করতে পারছি না। এর চাইতে অসম্ভব যন্ত্রণার হাত থেকে এখন মুক্তি চাই। প্রচণ্ড ভয়, আতঙ্কে আমি সিটিয়ে আছি, আর ভাবছি এই বুঝি দরজা ভেঙে মিলিটারি বাড়ির ভেতর ঢুকলাে।
খুনিরাত কেটে গেল। চারিদিক ফর্সা হয়ে এসেছে। মনে হলাে বিশ বৎসর অত্যাচারীর জেলখানায় কাটিয়ে দিলাম। বাইরে উঁকি দিলাম। জীবনের এতটুকু সাড়া এত বড় বাড়িটায় কোথাও পেলাম না। হয়ত আমার মতাে কেউ লুকিয়েই আছে। একটু ক্ষণ চুপ করে রইলাম। এদিকে গুলি বর্ষণের কামাই নেই। সব চাইতে অবাক ব্যাপার ঠিক এক ঘণ্টা পর পর ট্রাক এসেছে। তার অর্থ আগে থেকে এটা প্ল্যান করা ছিল। যতদূর মনে হয় এবং পরে জেনেছি প্রায় একই সময় সর্বত্র একইভাবে এ্যাকশন শুরু হয়। পদ্ধতি এক এবং অভিন্ন। বাড়ির ভেতরটা নিস্তব্ধ। আমি আস্তে বেরিয়ে এলাম।
এখন একটা আশ্রয় চাই। বেরােবার চেষ্টা করার অর্থই হলাে মৃত্যুকে ডেকে আনা। যতক্ষণ পারা যায় বেঁচে থাকবার চেষ্টা করতে হবে। নিঃশব্দে মুখে চোখে জল দিলাম। প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে পা ফেলি হঠাৎ চোখে পড়ল একটা বন্ধ অন্ধকার ঘর। লাকড়ি, ভাঙা তক্তপোেষ, চেয়ার আরও কত কি, জমা করা আছে। উঁকি মেরে ভেতরটা দেখবার চেষ্টা করি কিছুই দেখা যায় না। কত দিনের এই স্তুপ কে জানে। ওপরে ছােট ছােট কয়েকটি জানালা। আলাে খুব সামান্যই আসছে। আর একটু ঘুরে ফিরে দেখি। এই ঘরটিই উপযুক্ত বলে মনে হল। বহু কষ্টে সেই প্রায় অন্ধকূপের ভিতর আত্মগােপন করি। ৬টা-৭টা-৮টা। এখন মাঝে মাঝে গুলি বন্ধ হচ্ছে। বাইরে কি হচ্ছে কি হয়েছে দেখবার প্রচণ্ড কৌতূহল হলাে। ওই জানালা দিয়ে দেখতে হবে। বেশ উঁচুতে। আসলে এগুলো বোধ হয় ভেনটিলেটর ছিল। ভাঙা চেয়ার কয়েকটা পড়ে আছে। একটা সেট করলাম। হ্যা, এখন দেখা যাচ্ছে। পরিষ্কার সব দেখা যাচ্ছে। বীভৎস, বীভৎস! চাপ চাপ রক্ত মাংস অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। অজস্র মানুষের মৃত দেহ। কেউ বসে, কেউ ঠেলাগাড়ির ওপরে, নীচে, রিক্সার ওপরে, দেয়ালে, দোকান ঘরের সামনে- কোথায় নেই! এমন কি দোকান ঘরের ছাদের ওপরেও! অর্থাৎ যে যেখানে পেরেছে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের চেষ্টা করতে গিয়ে অথবা এই চৈত্রের গরমে বাইরে শুয়ে ছিল তাদের ঘুম ভাঙবার অবকাশ হয়নি। রাস্তার উপর পড়ে আছে, একটার ওপর আর একটা। কোনগুলাে বা জড়াজড়ি করে। স্ত্রী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ কিছুই বাদ নেই। মৃতদেহ মৃতদেহ মৃতদেহ। যতদূর দৃষ্টি যায় যেখানে দৃষ্টি চলে। আমার অবস্থা এদের মতন হতে পারত হবে না একথাই বা কে জোর দিয়ে বলতে পারে! এ দিকের জানালা দিয়ে দেখলাম এক দৃশ্য, একই ইতিহাস। আশেপাশের বাড়িগুলাের অবস্থা শােচনীয়। বারান্দায় রেলিং এ মৃতদেহ! একটা ঠেলাগাড়ির শব্দ, বুটের আওয়াজ। এক গাদা মরা মানুষ নিয়ে চলেছে। বেলা প্রায় ৯টা। হঠাৎ দরজায় আওয়াজ। আমি চেয়ার থেকে নেমে, চেয়ার সরিয়ে আবার ওই আবর্জনায় আত্মগােপন করি। এখন ভাবি সেদিন মাথা এত ঠাণ্ডা রেখে কি ভাবে এ কাজগুলাে করেছিলাম। আজ সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে।
দরজা ভেঙে ফেলল। অনেকগুলাে বুটের আওয়াজ। প্রায় আমার ঘরের পাশ দিয়ে ঘুরে গিয়ে দোতলায় এখানে ওখানে ঘুরে আমার ঘরের সামনে দাড়িয়ে পড়ল।
‘কোনাে নেহি—সব খতম হাে গ্যয়া। আবার চলতে শুরু করল। অনেকক্ষণ কেটে গেল। কয়েকটি বুটের শব্দ হােস পাইপ দিয়ে জল দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে বাইরের দরজা বন্ধ করে মনে হলাে তালা দিয়ে চলে গেল। আমি ওই ভাবেই থাকি।
হঠাৎ একটা ট্রাক থামার শব্দ। অনেকগুলাে নারীর কণ্ঠস্বর ক্রন্দন-চীৎকার!
“আমাদের ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও। আল্লার দোহাই।” নাঃ উঠে দেখতে হ’ল ব্যাপারটা। সেই ভাঙা চেয়ার সেট করি। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াই।
মুহূর্তের মধ্যে আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা ঠাণ্ডা রক্তের স্রোত বয়ে গেল। হতবাক হয়ে চেয়ে থাকি! ট্রাকটিতে ভর্তি মেয়ে ছেলে। তের চৌদ্দ থেকে পঞ্চাশ এর উপর। প্রায় উলঙ্গ, উলঙ্গ। ভয়ে আতঙ্কে, আশঙ্কায় সিটিয়ে আছে। আমার বাড়ির মুখটাতে ঠিক বড় রাস্তার উপর। কারাে চোখ দিয়ে জল পড়ছে, কেউ কাঁদছে, কেউ চীৎকার করছে। দেশে মনে হলাে, এই মেয়েরা খুব কম সময়ই রাস্তায় বেরিয়েছেন! এদের আর্ত চীৎকার শুনে একপাল মিলিটারি অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ছে। ওরা গাড়ি থেকে নামবে না এরা টনে নামাচ্ছে। তারপর বােধ হয় এই শতকের সব চাইতে ঘৃণ্যতম দৃশ্য দেখলাম। ইয়াহিয়ার মিলিটারি রাজধানী ঢাকার সব চাইতে জনবহুল এলাকায় প্রকাশ্য দিবালােকে প্রশস্ত রাজপথের উপর যে বীভৎসতম কাণ্ড শুরু করল- হায় ঈশ্বর তার আগে আমি অন্ধ হয়ে গেলাম না কেন! কেন মৃত্যু হ’ল না! ফুলের মতাে সুন্দর এই ছােট্ট মেয়েদের উপর, মায়ের বয়সী বৃদ্ধার, তরুণীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বেলা দশটা ১৫মি:। বিশেষ কুৎসিৎ দৃশ্য অভিনীত হলাে। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে এই নারকীয় অত্যাচার চলল। এক একবার মনে হচ্ছিল ছুটে যাই-বাধা দিই ওই নরপশুগুলাের মুখে থুথু দিই। প্রচণ্ড ঘৃণায় ক্রোধে আমি জ্বলে পুড়ে মরতে লাগলাম। আর ওই হতভাগিনীরা তাদের স্বজাতীয় স্বদেশবাসীদের হাতে লাঞ্ছিতা হতে লাগল।
এক সময় থেমে গেল। ক্লান্ত হয়েই ছেড়ে দিল। মেয়েদের প্রায় সকলেই অর্ধমৃত। হয়ত কেউ কেউ মারা গিয়ে থাকবে। তারপর-তারপর হঠাৎ চুপ! ভয়ঙ্কর নীরবতা। ফট-ট-ট-ট। একটানা গুলি। আল্লার নাম ডাকবার অবসরও এরা পেল না! দু-হাতে মাথা টিপে বসে পড়লাম। চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই জল পড়তে লাগল! হায় খােদা!
একটি ক্যামেরা যদি থাকত!
এখন গুলি বর্ষণ একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে। বেলা প্রায় এগারােটা বাজে। হকার্স মার্কেটে আগুন দিয়েছে মিলিটারিরা। দেখতে দেখতে অনেক দূরের আকাশ কালাে ধোঁয়ার আচ্ছন্ন দেখতে পেলাম! হকার্স মার্কেট কাছে, যে কোনও মুহূর্তে এ বাড়িতেও আগুন লাগতে পারে—তফাৎ শুধু একটা রাস্তা! ক্ষুধা, তৃষ্ণা কিছুই বােধ করছি না। এই দুঃসময়েও মনে হ’ল যদি এককাপ চা’ পেতাম। স্বপ্ন-বিলাস আর কি! মাঝে মাঝে বসি আবার উঠি, দেখি শয়তানদের নতুন শয়তানী আর কিছু হয় কি না! এখন মৃতদেহগুলাে পর্যন্ত নিচ্ছে না। কত নেবে! ধোঁয়া, দুর্গন্ধ আর মরা পােড়ার গন্ধে গা বমি বমি করছে। চৈত্রের জ্বলন্ত সূর্যের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু কালাে চাপ চাপ ধোয়া—আর আর অনেক মানুষের চীঙ্কার দূর থেকে মেসিনগানের গর্জন! এদিকে চীকার করবার মতাে বােধ করি কেউ বেঁচে নেই।
কিছুক্ষণ আগেও ভেবেছিলাম আর গুলি চলবে না—আর কিছু হবে না। এখন ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্য রকম মনে হচ্ছে। চক্রান্ত অনেক গভীরে। বেলা গড়িয়ে চলে। খাঁ খাঁ করছে রাজপথ। মাঝে মাঝে মিলিটারির পদক্ষেপ। একটি মানুষও নেই—রাস্তার গরুগুলাে গুলি খেয়ে মরেছে! মাঝে মাঝে কুকুরের করুণ বিলাপ সর্বনাশের ইঙ্গিত ওরাও পেয়েছে। দুপুর গড়িয়ে চলে বেলা প্রায় তিনটা। কয়েকজন মানুষের ফিস্ ফিস্ কথার শব্দ। আবার উঠি। দেখে অবাক হয়ে যাই। কয়েকজন অত্যন্ত সন্তর্পণে গলি দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছে আর কি যেন বলছে। ক্লান্ত ভীত চাহনি। তারপর ওয়াইজ ঘাটের দিকে এগিয়ে গেল। একটু পরেই গুলির শব্দ। বুঝলাম ওরা আর ফিরবে না কোনও দিন!
আবার কিছু লােক। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি। ওয়াইজ ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। গুলির শব্দ। এবার কয়েকজন দৌড়ে পালাতে পারে। এরা নিজেরা মরবে, আমাকেও মারবে। ঠিক এই বাড়িটার কাছে এসে হাঁপাতে থাকে। “ইস নৌকা ভর্তি মানুষগুলােকে কিভাবে গুলি করে মারছে। বুড়িগঙ্গায় আর পানি নাই।” আস্তে আস্তে বলছে। এরা এখানে জটলা করছে। এক্ষুণি মিলিটারি আসবে, একবার মনে হলাে চেঁচিয়ে বলি-পালাও। কি ভেবে চুপ করে রইলাম! অন্য দিক থেকেও লােক নদী পার হবার চেষ্টা করছে। আর সব পথ বন্ধ। নদীপথ ছাড়া আর ঢাকা ছেড়ে যাবার পথ নেই। আবার একদল এল। যে কোনাে মুহূর্তে মিলিটারি আসতে পারে। ওরা বলাবলি করছে “ঢাকায় কিছু নাই। সব শেষ। আমরা যতক্ষণ পেরেছি লড়েছি।” বলে কি! লক্ষ করে দেখলাম হয় ই.পি. আর. নয়তাে বি.আর। এখন পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জী! একজন বলছে “আমি সুরাবর্দী ছাত্রাবাসে থাকতাম। আমি আল্লার দোয়ায় বেঁচে গিয়েছি। কি গুলি, কি বােমা গ্যাস।”
বেলা প্রায় পাঁচটা! এরা কি যেন আলাপ করে এগিয়ে যায়। এবার গুলির কোনও শব্দ শুনতে পেলাম না। আবার পায়ের শব্দ! কয়েকজন। চেহারা দেখে বুঝলাম এরাও হয় ই. পি. আর নয় পুলিশ, বি.আর। “আমাদের ওপর মিলিটারীর রাগ বেশি। সদর কোতােয়ালীর অবস্থা দেখেছ! খুন-আর-খুন। একজনও বেঁচে নাই।”
“আল্লা দিলে একবার বাঁচি। দিন আমাদেরও আসবে। দেখব সেদিন।” অন্য কণ্ঠস্বর।
সকলে এ জায়গাটায় জমা হচ্ছে, কয়েকটা ভাঙা লরি, বাস অনেক খানি জায়গা নিয়ে। পাশ দিয়ে সংকীর্ণ গলি পথ। নিঃসন্দেহে সুবিধাজনক। তবে মিলিটারি যদি টের পায় আর উল্টো দিকের ‘পয়েন্টে পজিসন নিয়ে থাকে তাহলে…ভাবতেও ভয় লাগে!
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হয়ে আসে। ধোঁয়া, আগুন আর পােড়া গন্ধে চৈত্র সন্ধ্যা করুণ হয়ে উঠল। আর একটি দুঃস্বপ্নময় ভয়ের রাত এগিয়ে আসছে! কে জানে আগামীকাল সূর্যের আলাে আর দেখতে পাবাে কি
—অনেকেই, যারা আজ বেঁচে আছে তারা আমার মতােই ভাবছে। সারাটা দিন কেটে গেল সেই সকালে এক আঁজলা জল খেয়েছি। এখন অনেকটা নিরাপদ অন্তত বাড়ির ভিতর। বেশি ঘােরাঘুরি করা ঠিক হবে না। রান্নাঘর কোথায়! আস্তে উঠি। নিঃশব্দে মুখ হাত ধুই পেট ভরে জল খেলাম। একটু খুঁজতে রান্নাঘর পেয়ে গেলাম। সেখানে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে। আধাে আলাে আধাে অন্ধকারে গােটা তিনেক আলু পেলাম। আবার সেই একই ভাবে সময় কাটানাে। অনেক দূরের আকাশ আলাের ফুল-ঝুরিতে ভরে উঠছে মাঝে মাঝে। একটানা গুলির শব্দ, থেমেও যাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ আমার এদিকে ঠাণ্ডা। মৃতদেহগুলাে, সেই মেয়েদের, অত্যাচারিতা, লাঞ্ছিতা দেহগুলাে তেমনি পড়ে আছে। আকাশের দিকে, মুখ করে কোনাে কোনােটি। হয়ত বলতে চাইছে “খােদা তুমি দেখ, এই পশুদের তুমি কখনও ক্ষমা করাে না।” এইবার একটু বিশ্রাম। শশাবার উপায় নেই। আরশােলা আর নেংটি ইদুরের ভয়াবহ উপদ্রব! গত রাত থেকে আজ এখন পর্যন্ত সমগ্র ব্যাপারটা খতিয়ে দেখি। ব্যাগ থেকে নােট বই আর কলমটা বের করে, মােটামুটি একটা নােট নিয়ে রাখি ওই অন্ধকারেই। কাঁচা আলু খেতে কেমন? সেদিন মনে হয়েছিল অমৃত। আঃ কি ভালােই লেগেছিল, একটা খেলাম কদিন থাকতে হবে কে জানে!
আমি একা নিঃসহায় হয়ে এই বিরাট বাড়িটা ভূতের মতাে পাহারা দিচ্ছি। প্রেতের মতাে মৃতদেহগুলাে আগলাচ্ছি, হকার্স মার্কেট পুড়ে শেষ চুইয়ে চুইয়ে ধোয়া তখনও বেরুচ্ছে!

সূত্র: কম্পাস, ৮ই মে ১৯৭১