বাংলাদেশের তাৎপর্য
দর্শনশাস্ত্রে একটা সূত্র আছে Before there was Cognition, there was Action, অর্থাৎ জগতে এমন এ ঘটনা ঘটে, যার তাৎপর্য পূর্ব থেকে বােঝা বা জানা যায় না, ঘটনার পরেই তার নানাবিধ তাৎপর্য ও অর্থ উপলব্ধি হতে থাকে। বাংলাদেশ” বলে যে একটি ঘটনার বিস্ফোরণ ঘটলাে, এটি এ জাতীয়। মনুষ্যনির্ধারিত পথের বা পূর্ব পরিকল্পিত নেতৃত্বেরও একটা সীমা আছে। সে সীমাগুলাে মানুষের সহজাত রক্ষণশীলতা, ভীরুতা ও অন্ধ স্বার্থবুদ্ধিজাত ক্ষুদ্র চেতনায় নির্দিষ্ট। মানুষ আজও সচেতনে সবকিছু করে না, ইতিহাস করায়, তারপর মানুষ পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে মেনে নিতে শুরু করে। মানুষের মুক্তি ইতিহাসের এই প্রয়ােজন-জনিত অমােঘ নির্দেশগুলাের স্বীকতির উপরই নির্ভরশীল। Freedom from Nes ইতিহাসের নিয়তি বা destiny’র Necessity বা বাধ্যবাধকতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা মানুষের পক্ষে অর্জন করতে আরও আরও সময় লাগবে, যখন পূর্ব থেকেই ঐতিহাসিক প্রয়ােজনের চাহিদা স্বীকার করে নিয়ে মনুষ্য-সমাজ ঠিক ঠিক বা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারবে।
বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র করতে হবে, এই প্রস্তাব মুজিবর রহমান বা আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনাে দলেরও ছিল না। এই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম সশস্ত্র করতে হবে, এই ধারণা ও প্রস্তুতি ছিল না। ভারতের সাহায্য নিতে হবে, এ জাতীয় ধারণাও কারাে ছিল না। ভারতকে এ ব্যাপারে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে পড়তে হবে, ভারতেরও এ জাতীয় ভাবনা বা দুর্ভাবনা কিছুমাত্র ছিল না, বরং পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে তা ভারত দেখেও দেখেনি বা দেখবার বুঝবার চেষ্টা করেনি। শেষপর্যন্ত ভারতকেই এমন ব্ৰিত ও বিপন্ন হয়ে পড়তে হয়, এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে এক জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পড়তে হয়, এ সম্বন্ধে ভারতের পূর্ব চেতনা ও পূর্ব প্রস্তুতি বিন্দুমাত্র ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানেও কোনাে নেতা বা কোনাে দল ভারত সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত করতেন না, পাছে তারা ভারতের দালাল” বলে অভিযুক্ত হন! ভারতও পাকিস্তানের “আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে না বলে নিজেকে যথাসম্ভব নির্লিপ্ত বা উদাসীন রাখবার চেষ্টা করে, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে তার সত্যিকার খবর বা intelligence পর্যন্ত রাখতাে না। শেষ পর্যন্ত কোটি খানেক শরণার্থী যখন একবস্ত্রে এ দেশে স্রেফ প্রাণরক্ষা করতে ছুটে এল, তখন ভারতের চৈতন্য আসতে বাধ্য হলাে, অথচ দফায় দফায় লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যখন পূর্বে এসেছে, তখনও ভারত এ বিষয়ের রাজনৈতিক কারণ ও গুরুত্ব বিচার করতে যায়নি।
হঠাৎ বাংলাদেশ বলে একটি বিস্ফোরণ ঘটে গেল, তাতাে নয়। ঘনায়মান ঐতিহাসিক কারণগুলাে ধীরে ধীরে এমন একটা critical অবস্থা সৃষ্টি করলাে, যা আজ হঠাৎ এমন একটা অভূতপূর্ব অদ্ভুত বিস্ফোরণে আজ কি ভারত, কি পাকিস্তান, কি পৃথিবী সবাইকে হতচকিত করে দেয়। ইতিহাসের স্থূপীকৃত জঞ্জাল সজ্ঞানে সচেতনে যথাসময়ে যথাযথভাবে দূর করে দেবার নেতৃত্বের অভাব থেকেই এতবড় একটা ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী কাণ্ড ঘটে গেল। এখানে একথা পরিষ্কার যে human leadership failed to recognise ahead what is brewing in the depth of History. ইতিহাসের অতল গর্ভে কী জাতীয় ঘনঘটা সৃষ্টি হচ্ছে তা কারাে হদিসের মধ্যে ছিল না।
অবশেষে সেই অঘটন ঘটল, বিস্ফোরণ ঘটলাে যার নাম বাংলাদেশ। আমরা অনেক আগে থেকেই বলেছিলাম, সূর্য পূর্ব দিক থেকেই উঠবে। সে সূর্য পূর্ব দিক থেকেই উঠেছে। কিন্তু এই নববাদয়ের প্রকৃত তাৎপর্য কী এবং কতদূর প্রসারী তা আজও হয়তাে ভারতীয় চেতনায়, এমন কি নবজাত বাংলাদেশের চেতনায় স্পষ্ট হয়নি।
প্রথম কথা, এই সূর্যোদয় কি কেবল পূর্বদেশ বা বাংলাদেশেরই জন্য? আমাদের বক্তব্য হলাে এই, এ কেবল বাংলাদেশের সূর্য নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের পক্ষেও সূর্যোদয়। আমাদের আশঙ্কা ছিল, ভয় ছিল, হয় তাে ভারত এই সূর্যোদয়কে নিজেরই সূর্যোদয় বলে অভিনন্দন ও গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হবে। ভারতীয় নেতৃত্বের দ্বিধা দ্বন্দ্বের প্রতি তাই আমাদের ক্ষুব্ধ নালিশ কম ছিল না। সুখের বিষয়, ভারত শেষ পর্যন্ত এই সূর্যোদয়কে নিজের সূর্যোদয় বলেও গ্রহণ করতে পেরেছে। সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তি সম্রামে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। আসমুদ্র হিমাচল বিস্তৃত ভারতে প্রতিটি রাজ্যের জনগণ ও তার সংঘবদ্ধ নেতৃত্ব ও সরকার সবাই মরণপণ করে এই সগ্রামে অংশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশের সূর্য, সমগ্র ভারতের পক্ষেও সূর্যোদয় কেন? বাংলাদেশ যে রক্তমূল্যে তার স্বাধীনতা অর্জন করে নিল, সেই রক্তমূল্যেই অন্যান্য কয়েকটি ফল তার প্রাপ্য হবে যথা ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এবং ভারতের সঙ্গে চিরন্তন সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব। অথচ এই পূর্ব বাংলাই একদিন পাকিস্তান সৃষ্টির মূলশক্তি জুগিয়েছিল। ইতিহাসের চাকা সম্পূর্ণ ঘুরে গেল। আজ পূর্ব বাংলাই পাকিস্তান বা দ্বিজাতিতত্ত্ব’র গাের দিতে বসেছে। এ যে কতবড় তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার তা বুঝতে কারাে কষ্ট হওয়া উচিত নয়। ভারত দশ বার যুদ্ধ করলেও এই দ্বিজাতিতত্ত্বের মূল উচ্ছেদ করতে পারত না। কিন্তু পূর্ব বাংলা সে। সগ্রাম করে তার মূল উৎপাটিত করে দিল। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রই এবং মানবিকতাই যদি বাংলাদেশ গ্রহণ করে, তবে ভারতের সঙ্গে তার কোনাে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনাে বিষয়ে কোনাে বিভেদ থাকে না। ভাবাদর্শের দিক থেকে দুই দেশই এক হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরে আজও যেখানে যত পকেট আছে সাম্প্রদায়িকতার, সে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতাই হােক, আর সংখ্যালঘুদের সাম্প্রদায়িকতাই হােক, সে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাই হােক আর ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাই হােক— সবারই মূলদেশে টনক নড়ছে কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে। তারপর যদি পশ্চিম পাকিস্তানেও তাদের জঙ্গীশাহীর পতন ঘটে ও সেখানেও একটা গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে যা হওয়া আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অসম্ভব নয়।
তবে এই উপমহাদেশ থেকেই জাতিপাতিজাত দুষ্টুগ্রহ ও দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষ দাঁতই শুধু ভেঙে পড়ে না, একটা নবীন সূর্যোদয় ঘটবে এই ভারতের মানবতীর্থে।
এই উপমহাদেশে পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশের বেশি লােক এই উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদ ইয়ােরােপীয় জাতীয়তাবাদের ছাঁচে হতে পারে না, কাকে জাতি বলে এবং কি দিয়ে একটি জাতি হয় তার ব্যাখ্যা ইয়ােরােপীয় শাস্ত্র দিয়ে হবে না। এ মহাজাতি কোনাে একটি জাতির জাত্যাভিমান বা chauvinism দিয়েও তৈরি হবে না। জনসংজ্ঞা বা হিন্দুসভার অখণ্ড ভারতও এ নয়। যেমন নয় সি-পি-এম বিবৃত Multinationalism with the right to secede বা আলাদা হয়ে যাবার অধিকার-এর ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদ। আলাদা হয়ে গিয়ে মুসলমানেরা পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল এই তথাকথিত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতেই। কিন্তু কী রক্তমূল্যে পাকিস্তানের বৃহত্তম অংশকেই তা বর্জন করতে হলাে।
ভারত তীর্থ বা মানব তীর্থের যে মহান স্বপ্ন ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ একদিন এঁকেছিলেন, তাকে আমরা অবাস্তব স্বপ্ন বলে মনে করে দেশ ভাগ করে ছিলাম। আজ বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রভাব যার, সে হলাে রবীন্দ্রনাথই। ১৯৪৭ সালে এই ভারতবর্ষ মানবতীর্থের পথিক ভারতবর্ষ পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। আজ ১৯১৭ সালে আবার ভারতবর্ষ বা পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ জনসমষ্টি তার ঐতিহাসিক destiny’র পথ খুঁজে পাচ্ছে। তার অর্থ এই নয় যে আবার ভারত একটিই রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনিক সীমানা নানা থাকলেও, আদর্শগত লক্ষ্য একই থাকতে পারে বন্ধুর মতাে ভাইয়ের মতাে হাত ধরাধরি করে বিশ্বমানবতার পথে এগিয়ে যাবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি নিত্যদিনের পূজারী, উপস্থিতের ব্যবসাদার রাজনৈতিক নয়। পলিটিশিয়ানরা ক্ষণকালের ক্ষীণজীবী সন্তান, কিন্তু ইতিহাসের বিচার কখনও ২/৪ বছর বা ২/৪ দশকের মাপকাঠিতে হয় না, তার বিচারের ইউনিটগুলাে শতাব্দী-প্রসারিত, সুদূর প্রসারী, দিগন্তচারী। কিন্তু রাজনীতি তখনই দর্শনের কোঠায় উন্নীত হয় যখন তা ইতিহাসের সুরে সুর মেলাতে পারে। ভারতের ইতিহাস পাকিস্তানের মতাে এক জেনারেশনের ইতি নয়, হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। সে ইতিহাসের নির্দেশকে অমান্য করে পাকিস্তান নামক যে ব্যাভিচারটির সৃষ্টি হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের রথচক্রতলে তা ধূলায় মিশিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে।
এই ঐতিহাসিক চেতনা বা destiny বােধ কি বাংলাদেশ কি ভারত যদি আজ পায় তবেই বাংলাদেশ নামে যে বিস্ফোরণটি ঘটলাে তার প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম হবে এবং নতুন করে এক বিরাট উদ্দীপনা ও মানবিকতাবােধ সমগ্র উপমহাদেশেটিকে অনুপ্রাণিত করবে। এত বড় কাজ আমাদের খণ্ডিত জাতীয়তাবোেধ এমনকি বাঙালি নবজাতীয়তাবােধও দিতে পারে না। এ শক্তি ক্যুনিজমও দিতে পারেনি, যেহেতু মার্কসবাদ ও কমুনিজমকে ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদী স্বার্থে কূপমণ্ডুকতা সৃষ্টি করে ফেলে এবং তাকেও পথভ্রষ্ট করে ফেলে। সচেতন নেতৃত্ব এভাবে ব্যর্থ হয় বলেই, ইতিহাস শেষ পর্যন্ত নিজে এসে দ্বার ভেঙে রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত। একে গ্রহণ করা ও অভিনন্দন করাই আজ প্রকৃত বিপ্লব। এ বিপ্লবকে অস্বীকার করে অথবা পাশ কাটিয়ে কোনাে গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এই উপমহাদেশে হতে পারে না। এই অর্থেই বাংলাদেশের সূর্যোদয় সমগ্র উপমহাদেশেরই সূর্যোদয়। সব রকম দলীয় ও উপদলীয় ক্ষুদ্রতা ও কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্ত হবার এত বড় আহ্বান আর আমাদের আসেনি।
এই অর্থেই বাংলাদেশের মুক্তি একটি বিপ্লব, আমাদের স্তব্ধ ও অসম্পূর্ণ বিপ্লবের মুক্তিপথ। নইলে বাংলাদেশের আবির্ভাবটাকে যদি কেবল মুক্তিযােদ্ধা ও ভারতীয় জোয়ানদের যুদ্ধ জয় বলেই মনে করি, তবে তার মতাে কদর্য আর হয় না। আজ পাকিস্তানকে যদি আমরা অস্ত্র বলেই হারিয়ে থাকি, তবে একদিন পাকিস্তান তার প্রতিশোেধও নিতে পারে অন্যান্য বৃহৎ শক্তির সঙ্গে জোট পাকিয়ে। এ কেবল অস্ত্রের জয় পরাজয় নয়। এ হলাে আদর্শের জয় পরাজয়ের কথা বিশ্বমানবের মুক্তির পথে এক বৃহৎ পদক্ষেপের কথা। বাংলাদেশ বলে আজ যে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণ ঘটলাে তার পরিপূর্ণ তাৎপর্য গ্রহণ করাই আজ আমাদের কাজ।
যুদ্ধবিরতিতে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ভূকম্পন
বাংলাদেশ আজ পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত। আমেরিকায় সপ্তম নৌবাহিনীর ব্ল্যাকমেল নীতি ব্যর্থ। চীনের বিষােদগার পাকিস্তানের অখণ্ডতা’কে রক্ষা করতে পারেনি। চীন নাকি বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে পাকিস্তানের অখণ্ডতাবিরােধী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র বলেই নিন্দা করছে। কিন্তু গােটা পাকিস্তানটাই ভারতবর্ষের ঐক্যকে খণ্ডন করবার হাতিয়ার হিসেবে সৃষ্টি করেছিল সাম্রাজ্যবাদ সে ঐতিহাসিক কথাটা বেমালুম ভুলে গেছে চীন। আবার এই পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য আজ যে জন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী চীন আমেরিকান ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে একই সুরে সুর মিলিয়েছে এই অদ্ভুত ঐক্যতানটাও তারা দেখতে পাচ্ছে না। বঙ্গোপসাগরে ৭ম নৌবহর ও হিমালয়ের পার থেকে চীন যদি একই সঙ্গে নেমে পড়তাে ভারত ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কী অপূর্ব চিত্রটাই না হতাে!
পশ্চিমাঙ্গনেও যুদ্ধ বিরতি হয়েছে ভারতের একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘােষণার ফলে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক অপূর্ব রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। একতরফা যুদ্ধবিরতিকে না পারছে পাকিস্তান গিলতে, না পারবে ওগরাতে। এর ফলে ইয়াহিয়া খানের বিদায় আসন্ন। এই ভাঙ্গা হাটে ভূট্টোর ডাক পড়েছে পাকিস্তানের শেষ রক্ষার জন্য। ভূট্টোকে দিয়ে পাকিস্তান রক্ষা করা যাবে না, কেননা ভূট্টোর প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সহযােগিতা ছাড়া ইয়াহিয়া খান পূর্ববাংলার বিরুদ্ধে এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের বিরুদ্ধে এমন যুদ্ধে নামতে পারতাে না। জানি না পাকিস্তানে যে অসন্তোষ ও হতাশা দেখা দিয়েছে তার পরিণামে আরও প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিশােধপাগল অপর কোনাে সামরিক গােষ্ঠী আসবে কিনা, এলেও তাদের জীবন বেশি দিন স্থায়ী হবে না, শেষ পর্যন্ত ওখানেও গণতান্ত্রিক একপ্লব আসবে।
যুদ্ধবিরতি তাে হলাে, কিন্তু শান্তিচুক্তি হবে কোন্ ভিত্তিতে? হয়তাে দীর্ঘকাল ধরে এই যুদ্ধবিরতিজনিত অচলাবস্থা চালু থাকবে। যদি পাকিস্তান বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে ছেড়ে দেয় এবং বাংলাদেশের উপর দখলদারি দাবি ছেড়ে দেয়, তবে এক্ষুণি শান্তি হতে পারে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অন্যান্য দাবি আমরা ছেড়েও দিতে পারি। বাংলাদেশ অবশ্য স্বাধীন, এর আর কোনাে হেরফের হতেই পারে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বদলে আমরা অন্যান্য দাবি ছেড়ে দিতে পারি। বঙ্গবন্ধুকে আজ বাংলাদেশের জন্য বড়ই দরকার। তার বদলে ওদের ৭০ হাজার বন্দি সৈন্যদের আমরা অবিলম্বে ফিরিয়ে দিতে পারি। জঙ্গী শাহীর পতন ঘটানাে অথবা ওখানে গণতান্ত্রিক কোনাে রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করা এসব দায়িত্ব আমাদের নয়, পাকিস্তানের জনগণই একটু অবসর পেলেই সে দায়িত্ব তারাই নিজেরা পালন করে নেবেন। আমরা সেখানে নাক-গলাতে যাবাে না, যাবার দরকার নেই যদি না ওরা আবার আমাদের উপর হামলা করতে আসে। পাকিস্তানের এতটুকু জমি দখল করাও আমাদের লক্ষ্য নয়। পাকিস্তানের জনগণকে সে বিশ্বাস আমাদের পাইয়ে দিতে হবে। অতএব পরাজিত পাকিস্তানের প্রতি আমাদের অযথা কঠোর কোনাে ব্যবহার করার উদ্দেশ্য নেই। পাকিস্তানের জনগণকে বুঝতে সাহায্য করতে হবে যে সাম্রাজ্যবাদীদের গাঁটছড়ায় নিজেদের বেঁধে তাদের সত্যিকার নিরাপত্তা নেই। আজ পূর্ববাংলা যেমন বহু রক্তমূল্যে বুঝতে পেরেছে যে তাদের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু ভারতই, তেমনি একদিন পাকিস্তানের পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বেলুচ, পাঠান সবাই বুঝতে পারবে ভারতই তাদের প্রকৃত সুহৃদ। অবশ্য এই বােধপ্রত্যয় আজই এই পরাজয়ের মুখে আসা সহজ নয়। সময় দিতে হবে, সময় পেতে হবে। অতএব ভারতকে এ সময়ে অধৈর্য হলে ঠিক হবে না, যেমন ঠিক হবে না অসতর্ক হলেও। কেননা প্রতিশােধপন্থী ফেনাটিক দুষ্টচক্রের ক্ষমতা আজও সেখানে শেষ হয়নি।
সূত্র: কম্পাস, ২৫শে ডিসেম্বর ১৯৭১