You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.13 | মুক্তিযুদ্ধের প্রয়ােজনীয় হাতিয়ার কৈ? | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধের প্রয়ােজনীয় হাতিয়ার কৈ?

আমাদের এই সংখ্যা কম্পাস যেদিন বাজারে বের হবে ততদিনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে ফিরে আসবেন। তিনি কী নিয়ে ফিরলেন, এই জল্পনা-কল্পনা এখনও যেমন চলছে, তখনও তেমনি চলবে। চমকপ্রদ কিছু পদক্ষেপ নেবেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে, এটা যারা ভাবছেন তারা বােধহয় হতাশই হবেন। আমাদের মনে হয়, ইন্দিরা গান্ধী আজও তার মনস্থির করতে পারেননি, একমাত্র “কালহরণ করে দেখি কী হয়” এই নীতি ছাড়া। সমগ্রভাবে ব্যাপারটা যদি অশুভ বলে মনে হয়, তবে অশুভস্য কালহরণং নীতি ভালাে মনে হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্ম ও তার স্বাধীনতার জন্য সগ্রামটি কি ভারতের পক্ষেও একটা অশুভ ব্যাপার বা ঘটনা? এটা কি একটা অনভিপ্রেত উৎপাত না অবশ্যম্ভাবী একটি ঐতিহাসিক জন্মবেদনা যার মধ্যে সৃষ্ট হচ্ছে এই উপমহাদেশের জন্য এক নবীন প্রভাত? গয়ংগচ্ছতার, স্থিতাবস্থার, শান্তি-সােয়াস্তির প্রতীক যে ভারতীয় নেতৃত্ব তার পক্ষে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে কোনাে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ দেওয়া সম্ভব নয়। কেবল অপেক্ষা করা অন্যে কি করে তাই দেখা সবাই কী ভাবে তা বােঝা এবং শেষ পর্যন্ত রিঅ্যাক্ট করা ছাড়া তাদের কোনাে স্বকীয়তা থাকা সম্ভব নয়। ভারত নিজে একটা কিছু করে বিশ্বের দরবারে যদি কিছু দিয়ে বসে তবে পৃথিবী তা মেনে নেবে-এ জাতীয় বলিষ্ঠ চিন্তা এদের কাছ থেকে আশাই করতে পারা যায় না।
বিদেশী দরবারে ইন্দিরা গান্ধী যে যুক্তি নিয়ে আত্মপক্ষ-সমর্থনের চেষ্টা করেছেন সে যেন আসামীর মতত। তাছাড়া ভারত বাদী বা বিবাদী কোনােটাই নয়; আসল সমস্যা পাকিস্তান ও তার প্রজাদের মধ্যে অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে। পূর্ববঙ্গের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে, বিশেষ করে মুজিবর রহমানের সঙ্গে ইয়াহিয়া খান কথা বলুন, রাজনৈতিক সমাধানের এটাই হলাে একমাত্র পথ একথা ইন্দিরা গান্ধী সবাইকে বার বার বলেছেন। তবে এবারে একটা কথা ইন্দিরা গান্ধী এ সম্বন্ধে যা বলেছেন তা সত্যিই প্রণিধানযােগ্য।
তিনি লন্ডনে ও ওয়াশিংটনেও ইংগিত করেছেন যে যদি ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে না পারেন বা না চান, তবে ইয়াহিয়া খান কি পাকিস্তানের পক্ষে একান্তই অপরিহার্য? অর্থাৎ ইয়াহিয়া খানকে সরিয়ে দিলেই তাে হয়। একটা দেশের (পাকিস্তানের চেয়ে একটি ব্যক্তি (ইয়াহিয়া খান) বড় হতে পারে না।
ইয়াহিয়া খান অবশ্য একক নয়, একটি গােষ্ঠীর প্রতীক পাকিস্তানের সামরিক গােষ্ঠীর ও অতিরক্ষণশীল স্বার্থের প্রতীক। ইয়াহিয়া খান গেলে এই গােষ্ঠীকেই যেতে হয় এবং খাস পশ্চিম-পাকিস্তানেই একটা বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটে। এই জাতীয় একটা পথ যে ইন্দিরা গান্ধীই আবিষ্কার করেছেন তা নয়, এই পথটা ইতিহাসের গ্রিন-রুমে উহ্যরূপে উপস্থিত আছে, পশ্চিম পাকিস্তানেও এই প্রশ্নটি আছে, কিন্তু এ প্রশ্ন করার সাহস আজও সেখানকার কোনাে বিরােধী নেতৃত্বের পক্ষে আসেনি। ইন্দিরা গান্ধীকেই শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্ন ও তার সমাধানের ইঙ্গিতটি লন্ডন ও ওয়াশিংটনে উত্থাপন করতে হলাে। খবরের কাগজগুলাে এই তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিতটার তেমন গুরুত্ব দেয়নি দেখে কিছু আশ্চর্য হতে হয়। ব্রিটিশ বা আমেরিকান সরকারও এই ইঙ্গিতটা যেন শুনেও শােনেননি এমনিভাবে চুপ করে আছে। অথচ এই ইঙ্গিতটা কোনাে একটি ব্যক্তির ইঙ্গিত নয়, ইতিহাসেরই এই ইঙ্গিত পাকিস্তানের ইতিহাস থেকে ইয়াহিয়া খানকে বিদেয় করে দেবার ইঙ্গিত, তা না হলে পাকিস্তানের কোনাে চিহ্ন থাকাও অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে পাকিস্তান’ হিসেবে, সম্ভাব্য কোনাে যুদ্ধের ফলে।
কিন্তু শেখ মুজিবর রহমানকে বিনাশর্তে মুক্তি দিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ইয়াহিয়া খানকে বাধ্য করাতে আমেরিকা বা ব্রিটেন কেউ চাপ দিতে রাজি হলাে না। আর চাপ সৃষ্টি করতে পারে কে? পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া বিরােধী কোনাে রাজনৈতিক শক্তি যদি থাকে তবে তারা পারে। কিন্তু এই ভরসাও কিছু আশু নেই। যে ভূট্টো কথায় অগ্নিবর্ষণ করে থাকেন, তাঁর হাতে ক্ষমতা না দিলে তিনি ইয়াহিয়া খানদের যা তা করে দেবেন বলে সেদিনও হুমকি দিয়েছেন, তাকেও নাকি বন্দি করার ভয় দেখিয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান, সেই ভূট্টোর ভুমিকাটা কী? তিনি ইয়াহিয়া খানের প্রধান প্রতিনিধি হয়ে সমর বিভাগের প্রধানদের নিয়ে গিয়েছেন পিকিং—তাদের সমর্থন ও অস্ত্রপাতির সাহায্যের জন্য! পূর্ব বাংলাকে কোতল করার গােপন উপদেশ ও সমর্থন একদা দিয়েছিল এই ভূট্টোই ইয়াহিয়া খানদের। পূর্ববঙ্গের এই হাল করার দায়িত্ব ভূট্টোর কিছু কম নয়। অতএব আজ যদি ইয়াহিয়া খান ভূট্টোকে বলেন যে “তােমার বুদ্ধিতেই তাে আমার এই অবস্থা, আজ যদি তুমি পাকিস্তানের ক্ষমতা চাও, তবে পাকিস্তানকে রক্ষা করাে, আর তুমিই তাে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের নতুন সম্পর্কের জন্মদাতা বলে প্রচার করে থাকো, এখন তুমিই যাও পিকিংএ। এবং তুমি যদি চীনের সক্রিয় ও প্রকাশ্য সমর্থন আদায় করে আনতে পারাে, তবে হয়তাে পাকিস্তান রক্ষা পাবে এবং তােমাকেই প্রধানমন্ত্রী করা যাবে।” ইয়াহিয়া খানের নিজের সব তাস খেলা হয়ে গেছে, তাই তার তথাকথিত বিরােধীদের নানা লােভ ও টোপ দিয়ে নিজের টলমল অবস্থার সামাল দিতে চেষ্টা করবেন। আর পশ্চিম পাকিস্তানের তথাকথিত বিরােধীদলগুলাের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা এই থেকেই বােঝা যাবে। আপাতত পশ্চিম পাকিস্তানের ভিতর থেকে ইয়াহিয়া খানকে সরাবার মতাে কোনাে শক্তিই লক্ষ করা যাচ্ছে না। একদা আয়ুব খান মৌলানা ভাসানীকে পাঠিয়েছিলেন পিকিং, মৌলানা সাহেব আজ তাঁর সেই কর্মের জন্য অনুতপ্ত, কিন্তু ভূট্টোর কোনাে লাজলজ্জাও নেই, সততাও নেই। ভূট্টো জানেন, ইয়াহিয়া খান গেলে তাকেও যেতে হবে।
মােট কথা পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক ওলট পালট এক্ষুণি আশা করা যায় না। একমাত্র বাংলাদেশের মুক্তিযযাদ্ধারাই ভরসা। তাদের কোমর বেঁধে বেশ কিছু কালের জন্য মরিয়া হয়ে লড়াই করে যেতে হবে। এবং তারা যাতে লড়াই করবার মতাে সাজসরঞ্জাম যথেষ্ট পরিমাণে পান, তাদের শিক্ষাদীক্ষা আরও উপযােগী হয় পাক বাহিনীর সঙ্গে ভালােভাবে মােকাবিলা করার মতাে অস্ত্রশস্ত্র যাতে তাদের মিলে সেটাই একমাত্র কথা। তারা যাতে লড়তে না পারেন তার জন্যই ভারতীয় সৈন্য বাহিনীকে সীমান্ত থেকে সরিয়ে আনবার জন্য চাপ দিচ্ছে আমেরিকা, ব্রিটেন প্রভৃতি কুচক্রীরা। অন্তত এ বিষয়ে যাতে ইন্দিরা গান্ধী অটল থাকেন এটুকু আজ দেশবাসীকে দৃঢ়ভাবে দেখতে হবে।
আর ভারত সরকার যদি সত্যিই সক্রিয় হস্তক্ষেপ না করেন, বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিয়ে যুদ্ধের ঝুঁকি না-ই নিতে চান, তবে তাদের পক্ষ থেকে মুক্তিবাহিনীকে অবিলম্বে আক্রমণাত্মক যুদ্ধনীতি গ্রহণ করে মুক্ত অঞ্চল সৃষ্টি করতে চাপ দেওয়া বা কোনাে উস্কানি দেওয়া উচিত নয়, আমাদের দেশের খবরের কাগজগুলােকেও এ জাতীয় উস্কানি দিতে বাধা দেওয়া দরকার। মুক্ত অঞ্চল তখনই করা উচিত হবে যখন মুক্ত অঞ্চলকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ দূরপাল্লার কামান, বিমান বিধ্বংসী কামান ইত্যাদি দেওয়া সম্ভব হবে এবং তা চালাবার মতাে ক্ষমতা তাদের হবে। নইলে ঐ সব মুক্ত অঞ্চলগুলাের উপর যখন পাক সামরিক বাহিনীর প্রচণ্ড প্রতিশােধ আসবে দূর পাল্লার কামান থেকে আর আকাশ থেকে বম্বারির ফলে, তখন মুক্ত অঞ্চল থেকে আবার হটে আসতে হবে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের হতাহতের সংখ্যা অসম্ভব বেড়ে যাবে। যদি এসব অস্ত্রশস্ত্র ও প্রতিরােধ শক্তির জোগান না-ই দেওয়া হয়, তবে তাদের সম্মুখ যুদ্ধে পাক-বাহিনীকে সাগর জলে ভাসিয়ে দেবার লম্বা-হুকুম (tall order) দেওয়া উচিত হবে কী? এ জাতীয় হুকুম ও বাহবা জাতীয় প্রচারণা থেকে ‘স্মল-আর্মস’ নিয়ে পাকবাহিনীকে মােকাবিলা করার উত্তেজনায় মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত ছেলেদের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই বেশ বেড়ে গেছে। এ ভাবে এদের মরতে দেওয়া ঠিক নয়। বরং তাদের শিক্ষাদীক্ষা আরও ভালাে করে দিয়ে, একটু সময় নিয়েই করা হােক। মাত্র তিন সপ্তাহের ট্রেনিং-এ সম্মুখযুদ্ধ হয় না, মুক্ত অঞ্চলের লড়াই হয় না। তারা গেরিলা যুদ্ধই এখন করুক, ব্যক্তিগত সন্ত্রাসের কর্মকাণ্ডই চালিয়ে যাক, রেল জাহাজ মােটর এর যােগাযােগ ব্যবস্থা অচল করতে থাকুক, জনতাকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে থাকুক। মােট কথা ভারতের পক্ষ থেকে active intervention যদি নাই হয়, বাংলাদেশ সরকার ও তার মুক্তিবাহিনীকে স্বীকৃতি দেওয়া না-ই হয়, তবে মুক্তিবাহিনীকেই তার শক্তি মতাে সময় নিয়ে লড়তে দেওয়া হােক। আর তাঁদের যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হােক যার সাহায্যে পাকবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও যাতে তারা কেড়ে নিতে পারেন।
যদি মােটামুটিভাবে ইন্দিরা গান্ধীর বর্তমান পলিসি সােভিয়েত রাশিয়া ও যুগােশ্লাভিয়া প্রভৃতি বন্ধুরাষ্ট্রগুলােও সমর্থন করে, অর্থাৎ পাকিস্তানের সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম ভিন্ন অন্যসব উপায়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে চায় যা তাদের ভক্তরা বােঝাতে চেষ্টা করেন, তবে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে যাতে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র পৌছায় সে দায়িত্বও তাদের নিতে হয়। আজেবাজে অনেক কথার এখন কোনােই দাম নেই, কথা কখনাে কাজের স্থান নিতে পারে না। নিষ্ঠার কষ্টিপাথর এই ক্ষেত্রে হলাে, দেখা যে মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র দিচ্ছাে কি দিচ্ছে না। কাউকেই কিছু চাপ দিয়ে রাজনৈতিক মীমাংসা করাতে পারলে না, ইয়াহিয়া খানকে টলাতে পারলে না, তবে ওসব বাজে কথা বলে লাভ? একথা ভাবতে লজ্জা লাগে যে আজ মুক্তিযুদ্ধে আহত ছেলেদের দেহ থেকে বুলেট বের করে দেবার মতাে যথেষ্ট সার্জিকেল ইনস্ট্রমেন্ট পর্যন্ত নেই, টর্চের আলােতে ব্লেড দিয়ে বুলেট বের করার খবরও আছে! আসন্ন শীতে একটা করে সােয়েটার পর্যন্ত কেউ পায়নি! এসব কথা শুনতে ভালাে লাগে না, ভালাে লাগে আজ কোন কোন অঞ্চল। গেল নয়? আত্মপ্রতারণা থেকে মুক্ত না হলে বাংলাদেশ মুক্ত হবে না।

সূত্র: কম্পাস, ১৩ই নভেম্বর ১৯৭১