You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.19 | পাকফৌজ বিতাড়িত বাংলাদেশের একটি অঞ্চল | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

পাকফৌজ বিতাড়িত বাংলাদেশের একটি অঞ্চল

বেশ কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের দক্ষিণ অংশের একটা বৃহৎস্থান পাক সৈন্যরা দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিফৌজের প্রবল আক্রমণে পাক সৈন্যরা ২৭ শে মে অনেক দূর পিছু হঠে গিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ও ঐ এলাকার মুক্তিফৌজের অধিনায়কের আমন্ত্রণে ঐ এলাকা দেখতে গেলাম। গত ৬ই জুন সকাল ৯টায় ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করলাম। তারপর একটানা সাড়ে চার মাইল বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে পায়ে হেঁটে আমাদের গন্তব্যস্থানে যেটা পাক ফৌজের হাতছাড়া হয়ে মুক্তিফৌজের দখলে এসেছে সেখানে পৌছলাম। যাওয়ার পথে এবং আসার পথে এই বিরাট মুক্ত অঞ্চলে বেশ কিছু জায়গায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে দেখতে পেলাম। কৃষক ক্ষেতে হাল চাষ করছে তাও দেখতে পেলাম, কিন্তু দেখতে পেলাম না কোথাও পাট ক্ষেত। যতটুকু যাচ্ছি জনসাধারণ ততটুকুই আদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাচ্ছে। বলা বাহুল্য এটা আমারই জেলার একটা অংশ।
গন্তব্যস্থানে পৌছলাম প্রায় এগারটায়, একটা নাম করা বাজারে। দুই পক্ষের লড়াইয়ের যে ছাপ রয়েছে তাও চোখে পড়লাে। এতবড় বাজারে লােকজন অবশ্য তেমন আসেনি কারণ যদিও পাক সৈন্য এ জায়গাটা ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু পুনরায় আক্রমণের সম্ভাবনা যায়নি। তবে জনসাধারণ যারা আছেন তাদের মনােবল অটুট রয়েছে, বিশেষ এই এলাকার মুক্তি ফৌজ যােগাযােগ রক্ষায় সংবাদ আদান প্রদানে এবং ফাইটিং পজিশনে সুসংগঠিত। অবশ্য এর পিছনে বহু কারণও রয়েছে। কারণ এই এলাকার মুক্তিফৌজের মেজর পাক সেনানায়কদের কাছে একটা টেরর’। পাক রেডিওতে এই পর্যন্ত এই মেজরকে কয়েক বারই মেরে ফেলা হয়েছে।
আমাদের আপ্যায়নের ভার এই এলাকারই আওয়ামী লীগ নেতার উপর। প্রায় দুই যুগ পরে আমার দেশের উপর দাঁড়িয়ে আপ্যায়নকারীর সঙ্গে কোলাকুলি করে কি যে আনন্দ পেলাম সে কথা ভুলবার মতাে নয়।
চেয়ার টেবিলে বসে চাতে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলাম এখান হতে পাক সেনা কত দূরে। মেজর বল্লেন মাইল আড়াই দূরে। এ অঞ্চল পুনরাক্রমণের আশঙ্কা আছে কি? উত্তরে বল্লেন এটা পুনর্দখলের জন্য গত কয়েকদিন ধরেই আক্রমণ করছে কিন্তু এটা দখল করতে পাক সেনার বহু কাঠ খড় পােড়াতে হবে। কারণ মুক্তিফৌজ এখন বাংলাদেশের প্রায় সব রণাঙ্গনেই ‘অফেনসিভ (আক্রমণ রত’)।
চা খাওয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পান মুখে দিচ্ছি ঠিক এমন সময় রাইফেল কাঁধে এক যুবক মুক্তিফৌজ মেজরের কানে কানে কি যেন বল্লেন। তখন বেলা সাড়ে এগারটা হবে। ঔৎসুক্যের সহিত মেজরকে জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপার কী? মেজর বল্লেন ভয়ের কোনাে কারণ নেই। অপর একজন বল্লেন প্রায় ১৫০ জন পাক সৈন্য এদিকে আসছে।
মেজর আদেশ দিলেন open FIRE অর্থাৎ বিবর মাটি হতে গুলি চালাতে আরম্ভ কর। আর অমনি সব বিবর মাটি হতে প্রচণ্ড গুলি শুরু। পাক সেনারাও প্রচণ্ডভাবে প্রত্যুত্তর দিয়ে চলেছে। মুক্তিফৌজের ব্যাপক আক্রমণে পাক ফৌজের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে গেল। এই যুদ্ধ দুপুর সাড়ে ১১টায় আরম্ভ হয়ে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত অবিশ্রান্ত ভাবে চলল। তারপর পাক সৈন্য তাদের রুটিন মতাে অসামরিক লােকদের বাড়িঘর পােড়াতে পােড়াতে পিছু হঠে পূর্ব স্থানে চলে গেল। যাওয়ার পূর্বে প্রায় ২০ জন পাক সেনা খতম এবং আরও বহু আহত হয়েছে।

বাংলাদেশকে সংখ্যালঘু প্রদেশ করার পাক চক্রান্ত
দেরীতে হলেও আসল কথা ফাঁস হয়ে গেছে। এখন বেশ পরিষ্কার যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশ থেকে আরও বেশি মানুষ তাড়ানাের জন্য সচেষ্ট হয়েছেন শুধু ইন্দো-পাক সাম্প্রদায়িক সমস্যা সৃষ্টির জন্যই নয়, খােদ পশ্চিম পাকিস্তানের নানা রকমের রাজনৈতিক সমস্যার কথা ভেবেও।
ইয়াহিয়া খানের সাথে নিকট সম্পর্ক যুক্ত কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নরমপন্থীরা পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে জনগণের নবােদ্ভুত বাস্তবতার ভিত্তিতে পাকিস্তানে নতুন করে নির্বাচনের জন্য দাবী জানিয়েছেন। বিপুল সংখ্যক বাঙালিকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়নের নীতির পেছনে যে মুখ্য উদ্দেশ্য কাজ করছে, তা এই সূত্র থেকেই বুঝা যাচ্ছে।
বর্তমানে পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলাে জমিয়তে উল উলেমার সভাপতি মৌলানা গাউস হাজারভির মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছেন, বর্তমানে এই রাজনৈতিক সঙ্কট থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে পূর্ব বাংলা থেকে বাস্তুত্যাগীদের সম্পর্কে প্রধান তথ্যের ভিত্তিতে নূতন করে নির্বাচন গ্রহণ করা।
জমিয়ত-ই-উলেমার নেতা বলেছেন যদি আমরা বাস্তব দিক থেকে বিচার করি তাহলে দেখবাে যে, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পর্কে যে একটা ধারণা আছে তা নেহাতই কাল্পনিক। পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা প্রভৃতি ঘটে গেছে, তাছাড়াও আছে অনেক বিশৃঙ্খল অবস্থা। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে তার সন্দেহজনক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখা সম্ভব হবে না। তাই সব চেয়ে ভালাে হয় যদি সম্পূর্ণ নতুন করে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হয় এবং প্রামাণিক আদম সুমারীর তথ্যের ভিত্তিতে প্রদেশে আসন বণ্টন করা হয়।
জামাত এ ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক তােফায়েল আহম্মদও পাকিস্তানের দুই অংশের জনসংখ্যা সম্পর্কে সঠিক এবং বিশ্বাস্য হিসাব” এর ভিত্তিতে জাতীয় ও প্রাদেশিক আইন সভার জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব রেখেছেন।
তিনি একটি কারণ দেখিয়েছেন যে, “নানা রকমের পরিবর্তন যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক সমস্যা প্রভৃতির ফলে পাকিস্তান এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ নেই। তাই জাতীয় আইন সভায় পূর্ব পাকিস্তানকে বেশির ভাগ আসন দেওয়ার কোনাে যুক্তি ছিল না। জামাতে ইসলামী পৃথক পৃথক নির্বাচন এলাকার ভিত্তিতে নির্বাচন করতে বলেছেন, সে রীতি অনুযায়ী সাধারণ আসনগুলাের জন্য কেবল মুসলমানদেরই ভােট দিতে দেওয়া হবে এবং অমুসলিমদের জন্য কিছু সংরক্ষিত আসন থাকবে।
ঠিক একই কথার প্রতিধ্বনি করেছেন কনভেনশন পন্থী মুসলিম লীগের আবদুল কায়ুম খান।
অবশ্য কায়ুম খান একটু ঘুরিয়ে বলেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাগুলাের সঠিক সমাধান হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই সব চেয়ে ভালাে। যেহেতু কায়ুম খান বর্তমানে ভূট্টোর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ঘনিষ্ট সহযােগী বলে পরিচিত, তাই মনে করা হচ্ছে যে, তিনি (কায়ুম) চান পূর্ববাংলা থেকে আরও অধিবাসী চলে গেলেই নির্বাচন; যাতে করে পূর্বাংশের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তান প্রকৃতই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে পরিণত হয়।

ইয়াহিয়ার আগামী ঢাকা সফর
চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ঢাকা সফরের সম্ভাবনা আছে। পাকিস্তানের সংবাদ সংস্থা এ্যাসােসিয়েটেড প্রেস অফ পাকিস্তান নুরুল আমিনের এক বিবৃতি তুলেছে, যাতে তিনি বলেছেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খান কথা দিয়েছেন যে, তিনি শীগগিরই ঢাকা পরিদর্শনে যাবেন। তারিখ যদিও এখনও নির্দিষ্ট হয়নি, তবে সম্ভবত তিনি ১৫ই জুনের মধ্যে পূর্ববঙ্গ পরিদর্শনে আসবেন।
রাজনৈতিক মহল মনে করেছেন যে, সামরিক শাসক জেনারেল টিক্কা খানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে ক্রমবর্ধমান অভিযােগ আসছে সে সম্পর্কে নিজে পর্যালােচনা করে দেখার জন্যই ইয়াহিয়া খানের এই সফর। তিনি ইতিমধ্যেই লে. জেনারেল নিয়াজীকে উপমুখ্য সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করেছেন। এই দুই জেনারেল সামরিক বাহিনীতে পরস্পরের প্রাক্তন প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই পরিচিত।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পরিকল্পিত এই সফরের আর একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ক্রীড়নক শাসন কায়েম করার সম্ভাবনা সম্পর্কে অনুসন্ধান করা। তবে মনে হচ্ছে তিনি তার এই প্রচেষ্টায় সফল হবেন না। তার ক্ষমা মূলক আহ্বানে আওয়ামী লীগের টিকেটে আইন সভায় নির্বাচিত বিশেষ কোনাে সদস্যই সাড়া দেননি। জাতীয় আইন সভার মাত্র দুজন আওয়ামী লীগ সদস্য শেখ মুজিবরের নেতৃত্ব এবং আওয়ামী লীগের দাবীকে অস্বীকার করেছেন। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে অবশ্য এ ব্যাপারে সন্দেহ পােষণ করে বলা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগের দুজন সদস্যের মুখে যে বিবৃতি বসানাে হয়েছে তা ভূয়া। তাই জেনারেল ইয়াহিয়া সেই সব প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিবিদদেরই ক্ষমতায় বসাতে পারবেন যারা নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। এ ব্যবস্থা এমন কি নুরুল আমিনও মেনে নিতে পারেননি। তিনি এই ক্ষমতা হস্তান্তর স্থগিত রাখতে বলেছেন। জুন মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তান সাহায্য সংস্থার একটি পরীক্ষামূলক বৈঠক বসবে এবং এই বৈঠকের আগে বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি দল অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পূর্ববঙ্গ সফর করতে পারেন। মনে হয় ঐ দলটি যখন আসবে তখন ইয়াহিয়া খান ঢাকায় উপস্থিত থাকতে চান।
এ ব্যাপারটা ক্রমেই বেশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনমতের একটি বৃহৎ অংশ বাংলাদেশের আন্দোলনকে সমর্থন করেন। বিখ্যাত পাকিস্তানি সাংবাদিক এবং দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল্লা মালিকের বিরুদ্ধে বিস্তৃত অভিযােগে এরকমই ইঙ্গিত করা হয়েছে। একটি সামরিক আদালত মালিককে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছে ও ৯০,০০০ টাকা জরিমানা করেছে। যদিও মামলার শুনানী হয়েছিল রুদ্ধদ্বার কক্ষে এবং পাকিস্তানি সংবাদপত্রগুলােকে নিষেধ করা হয়েছিল যে তারা যেন মালিকের স্বপক্ষে কি বলা হয়েছে তা যেন না ছাপেন,-তবুও পাকিস্তানি সংবাদপত্রে প্রকাশিত চার্টশিটের একটি অংশ থেকেই কৌতূহলােদ্দীপক বিস্তৃত তথ্য জানতে পারা যায়।
বাংলাদেশ’ আন্দোলনের জন্য সমর্থন সংগ্রহের দ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানে গােলযােগ সৃষ্টির জন্য মালিক অভিযুক্ত হয়েছেন। মামলায় অভিযােগ করা হয়েছে যে, অধুনা নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে যুক্ত আব্দুল্লা মালিক গত ২৯ শে এপ্রিল লাহােরের বাঘবান শিল্পাঞ্চলে একটি জনসভায় ভাষণ দেন। “পূর্ব পাকিস্তান”- এর কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি এই জনসভায় বেশ কয়েকবার বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আরও অভিযােগ, তিনি জঙ্গীশাসনকে কঠোর সমালােচনা করেছেন এবং মন্তব্য করেছেন যে, গণ-আন্দোলন কখনও চূর্ণ করা যায় না।
মালিকের বিরুদ্ধে যে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক মহল তাকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছেন। এখন বিশিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সামরিক শাসক কর্তৃক প্রতিশােধ নেওয়া এই প্রথম নয়। তবে এই ব্যাপারটার দ্বারা এই প্রথম স্বীকার করা হলাে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনমতের এক বৃহৎ অংশ বাংলাদেশের যুদ্ধে উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন।
কেশবচন্দ্র শূর।

সূত্র: কম্পাস, ১৯ জুন ১৯৭১