বাংলাদেশে একমাস (২)
অমর রাহা
২৫শে মার্চের পর একমাস পার হয়ে গেল। এই সময়ের মধ্যে প্রথম দিকে যে ধরনের সংবাদ প্রকাশ হচ্ছিল এবং যে ধরনের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা গিয়েছিল এপারের বাংলাতে সে ধরনের সংবাদও যেমন আজকাল দেখা যায় না ঠিক তেমন ধরনের উৎসাহ ও উদ্দীপনাও অনুভব করা যায় না। আজকাল যা অনুভব করা যায় তা হলাে রূঢ় বাস্তব এবং সেখানে উত্তেজনার স্থান নেই, আছে যুক্তিসঙ্গত অনুধাবন।
গণহত্যা হয়েছে ও হচ্ছে। মানুষ চলে আসতে বাধ্য হচ্ছে ভয়ে নয় বাধ্য হয়ে এবং তা শুধু ক্ষণিকের আশ্রয়ের জন্য। অতএব ওপারের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি যদি সহানুভূতি থেকে থাকে তবে এসবটাই সংগ্রামের অংশ বলেই স্বীকার করে নিতে হবে। মুক্তিফৌজের সংগ্রামের অংশই হচ্ছে এসব। কারণ পাকসৈন্য যাওয়ার পথে ও অবস্থানের ক্ষেত্রে প্রায় পাঁচ মাইল স্থান জনমানব শূন্য করে দিচ্ছে যাতে কোনাে অতর্কিত আক্রমণ সম্ভব না হয়। আর গণহত্যার পদ্ধতি নিয়েছে কারণ জেনারেল টিকা খাঁর পণ হলাে সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। শুধু কি তাই। টিকা খা চান না যে কোনাে বুদ্ধিজীবী বেঁচে থাকে আর কোনাে শিশু বা বালক বুদ্ধিজীবী হতে পারে।
প্রাক ২৫শে মার্চ
তাছাড়া প্রাক-২৫শে মার্চের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা না জানার জন্য [আর, এখন এ জানবার সময়ও নয়] অনেকে অনেক ধরনের মন্তব্য বা সমালােচনা করতে পারেন শেখ নেতৃত্বর। মনে হয় না সে সব মন্তব্য বা সমালােচনার কোনাে মূল্য আছে। ধরুন আজ যারা জাতীয় ফ্রন্ট বা ইউনাইটেড ফ্রন্টের কথা বলছেন তাঁরা নির্বাচন প্রাক্কালে কী ভূমিকা নিয়েছিলেন, এবং নির্বাচন উত্তরকালে ২৫শে মার্চ ও বাংলা সরকার গঠন পর্যন্তই বা কি ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তার হিসাবও করা যুক্তিসঙ্গত হবে বলেই মনে হয়। ধরুন, নির্বাচন প্রাক্কালে ভবেশ নন্দীর দল যখন ৩০/৪০ টি আসনের জন্য শেখ সাহেবের সঙ্গে আলােচনা করতে যান তখন মুজিবুর রহমান বলেছিলেন আপনারা সকলে আওয়ামী লীগে যােগ দিন এবং ঐ আসনগুলাে নিন।…
ইউনাইটেড ফ্রন্ট
আজকের ইউনাইটেড ফ্রন্ট বা যুক্তফ্রন্ট হচ্ছে মুক্তি সগ্রামে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করা। কারণ, মুখ্য প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ পাকশাসনমুক্ত করা।
অনেকে এর মধ্যে শ্রেণী চরিত্র বা রং দেখতে চাইবেন। যদি এমন ধরনের প্রশ্ন আসে তবে উত্তর হলাে যে যদি প্রশ্নকর্তারা জেনে থাকেন যে বাংলাদেশের পুঁজি বলতে বিদেশী পুঁজিকে বােঝায় এবং যদি বাংলাদেশ ইসলামাবাদ শাসক গােষ্ঠির উপনিবেশ হয়ে থাকে তবে এই মুক্তি সংগ্রাম তথাকিথত জাতীয় সগ্রাম নয়, এ সগ্রাম হলাে পেট্রিয়টিক ওয়ার। এদিক দিয়ে এই সংগ্রামী নেতৃত্ব [ আওয়ামী লীগ ] হলাে সংগ্রামী যুক্তফ্রন্ট।
আর এখন উচিত হবে আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গঠন করা এই সগ্রামীদের সহায়তার জন্য। এপারের আমরা যদি রক্তদান ছাড়া জীবনদান করবার প্রয়াস করি তবেই সংহতি গড়ে তুলবার ভিত রচনা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের পতাকা
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীবর্গ এবং অন্যান্য, আওয়ামী লীগ নেতা ও যুবছাত্র নেতারা মিললেন সর্বপ্রথম। সকলেই খুশি মিলনের জন্য দুঃখিত, শেখ সাহেব এঁদের মধ্যে সশরীরে না থাকার জন্য।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেব বললেন যে বাংলাদেশের পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্রই বাংলার জনগণের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করবে। ভবিষ্যৎ সরকারও এই নীতির বাইরে কিছুই করবে না। অর্থাৎ, সােনার বাংলার গঠন ও সুপ্রতিবেশী সুলভ বৈদেশিক নীতিই হলাে শেখ মুজিবর নেতৃত্বের ভিত।
তাজউদ্দীন সাহেব সরল বাংলায় যখন উপস্থিত সহযােদ্ধাদেরকে নিজ বক্তব্য বলছিলেন তখন তিনি ও তাঁর সহযােদ্ধাদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন নতুন যুগের লােক। সত্যিই নতুন যুগের লােক এঁরা। তাছাড়া, তাজউদ্দীন সাহেব গর্বের সঙ্গে বললেন : আমরা গর্ব অনুভব করি আমাদের পতাকার জন্য, কারণ আমাদের পতাকাতেই শুধু দেশের মানচিত্র রয়েছে। এই মানচিত্র সম্বলিত পতাকাই আমাদের আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি ঘােষণা করছে।
এই মিলনের চার-পাঁচ দিন পূর্বে সিলেট জেলার একস্থানে মুক্তিবাহিনীর সেকশান কম্যান্ড-এ টাইমস অব ইন্ডিয়ার শ্রীঅর্জিত ভট্টাচার্য এসে পৌছলেন। সেদিন সেকশান কম্যান্ড ব্যস্ত ছিলেন সামরিক ব্যাপার নিয়ে। এমনি সময় এসে পৌছলেন বাংলা সরকারের বর্তমান সি-ইন-সি কর্নেল ওসমানী।
এঁদের আলাপ আলােচনার পর একজন কর্নেল বললেন আজ আমরা লড়ছি স্বাধীনতার জন্য। মুক্ত সােনার বাংলা গড়বার জন্যও আমাদের সগ্রাম করতে হবে। এই পুনর্গঠন কাজে মনে হয়, এমন এক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলাে যৌথভাবে সাধারণ কর্মসূচি ও পরিকল্পনার মাধ্যমে উন্নয়নকর্ম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবরূপ নিতে পারে।
খােদা হাফিজ
চলে আসার সময় সীমান্তে দাঁড়িয়ে সালাউদ্দিন অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে আলিঙ্গন করে বললে খােদা হাফিজ। সালাউদ্দিন মুহুর্তেই যেন নিজেকে শুধরে নিলে এবং বলল যে এ হলাে সংস্কারজাত।
যুবক সালাউদ্দিন বলল জানেন আমাদের রাষ্ট্র ও সংগ্রাম হল ধর্মনিরপেক্ষ। আমরা যেমন ডিমকে আণ্ডা বলতে অস্বীকার করেছি, ঠিক তেমনি। ধর্ম হলাে ব্যক্তিগত ব্যাপার।
তখন একজন তরুণ ছাত্র নেতার কথা মনে হলাে আমরা জানি না অতীতে কী হয়েছে, তবে বাপঠাকুরদার পাপের প্রায়শ্চিত্ত এখন আমরাই করছি।
সূত্র: কম্পাস, ১৫ই মে ১৯৭১