যুদ্ধ পরিস্থিতি
যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধ বাংলাদেশের
২৫শে মার্চ, ১৯৭১। ঐ দিনে রাতে বাংলাদেশের ঢাকা শহরে পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী বাঙালি জাতির সম্পূর্ণ উৎসাদনের জন্য যে মৃত্যুর বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন তারপর থেকে বুড়িগঙ্গা, পদ্মা, মেঘনা, কর্ণফুলী, ভৈরব, মধুমতি, ধরলা, করতােয়া, তিস্তার ওপর দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে অনেক রক্ত বয়ে গেছে আট মাস ধরে। ঐ তারিখেই জন্ম নিয়েছিল এক নতুন জাতি।
ঐ জাতি ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়েছিল দেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর কজা থেকে মুক্ত করার। আর ঐ দেশ থেকে অত্যাচার, নিপীড়ন ও অনাচারের হাত থেকে ভারতের বুকে আশ্রয়ের আশায় আছড়ে পড়া এক কোটি মানুষকে স্বস্থানে ফিরিয়ে মানুষের মর্যাদার আসনে বসবার মহৎ অঙ্গীকার আবদ্ধ হলেন তাঁরা। কঠোর সংকল্প নিয়ে তৈরি হলাে মুজিবনগরে নতুন দেশের নতুন রাজধানী গড়ে উঠলাে মুক্তি বাহিনী দলমত নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে।
পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী এত কাণ্ড এত কারখানার জন্য দায়ী করল ভারতকে ও তার জনসাধারণকে। ভারতের অপরাধ সে কিনা চিরন্তন মানবধর্মকে রূপায়িত করে বাংলাদেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীকে নৈতিক সমর্থন দিয়ে আর বাংলার মানুষের স্বাধীনতার কামনা ও বাসনাতে মদদ দিয়েছে। প্রথমে ছিল ভারতের বিরুদ্ধে অভিযােগ ও প্রতিবাদের পালা। কিন্তু ভারত অবিচল তার ন্যায় নিষ্ঠায়। বিদেশী বড় বড় রাষ্ট্র ভাবল, বাংলাদেশের এক কোটি মানুষের জন্য তেরপল খাটিয়ে , ওষুধ সরবরাহ করে, লঙ্গর থানায় খাওয়াবার ব্যবস্থা করলেই যথেষ্ট। তাই সে সব রাষ্ট্রের বড় বড় কর্তারা আপ্তবাক্য ছড়িয়ে, কেউ বা কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করে গােটা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতি তাদের কর্তব্য সারলেন। বিশ্বমানবের প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রসংঘ বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি, বাঙালির শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাগমন ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ না দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালির হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহকে দোষারােপ না করে গােটা বিষয়টা নিয়ে কেমন যেন উদাসীন মনােভাব দেখালেন। ঐ প্রতিষ্ঠান শুধু ব্যবস্থা করতে চাইল রাষ্ট্রসংঘের নিয়ন্ত্রণাধীন পর্যবেক্ষক রাখার।
এ রকম এক টানাপােড়েনের মধ্যে অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিদেশ যাত্রা করলেন বড় বড় দেশের রাষ্ট্রনেতাদের বােঝাতে যে বাংলাদেশে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তার রাজনৈতিক সমাধান প্রয়ােজন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া আর কোনাে পথ নেই। বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেয়েছে, তাতে ঐ জাতিকে কিছুতেই নিরুদ্ধ করা যাবে না।
যা হােক নভেম্বরের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে ফিরলেন। বলা যায় খালি হাতেই। সকলেই বাঙালি শরণার্থীদের ভিক্ষা দিতে চায়, কিন্তু বাঙালি জাতির স্বাধীনতার অধিকার মেনে নিতে চায় না। তাতে নাকি পাকিস্তানের অখণ্ডতা ভেঙে যায়। এ ব্যাপারে মজার ব্যাপার হলাে বিশ্বের পুঁজিবাদী, সমাজবাদী, রাজতন্ত্রবাদী, গণতন্ত্রবাদী, উগ্র সাম্যতন্ত্রবাদী-প্রায় সব রকম রাষ্ট্রের প্রধানদের মুখে এক রা’। শুধু রাশিয়া জানাল রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া বাংলাদেশের বাঙালি জাতির সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আর রাশিয়া স্পষ্টতই জানিয়ে দিলাে বাংলাদেশে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানই দায়ী—পাকিস্তান সরকারই বাংলাদেশকে রক্তাক্ত করেছে, গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করেছে।
ওদিকে এরকম এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহীর বর্বরতা আরও উদ্দাম আরও বল্গাহীন হয়ে পড়েছে। দিনের পর দিন শরণার্থীর দল যেমন ভিড় জমাতে থাকে ভারতে আশ্রয়ের আশায় তেমনি বাংলাদেশের নতুন মানুষদের মুক্তি অভিযান হয়ে ওঠে দুর্বার। আর ততই ফুসে ওঠে পাক জঙ্গীশাহী। শেষ পর্যন্ত ক্রুদ্ধ আক্রোশে ভারতের সীমান্তস্থ কোনাে কোনাে শহরে গােলাবর্ষণ শুরু করে। এবার পাক জঙ্গীশাহী ক্রোধে ফেটে পড়ে। এই ক্রোধ উছলে পড়ে বয়ড়ায় হিলিতে, বালুরঘাটে…অবশেষে আগরতলায়। এ সবই ঘটতে থাকে নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের দিক থেকে আর তা চরম রূপ নেয় ২রা ডিসেম্বর। ঐ দিন বেলা সাড়ে বারােটায় পাকিস্তানের ৩টি স্যাবার জেট বিনা প্ররােচনায় ভারতের পূর্ব সীমান্তের রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় বােমাবর্ষণ করে বহু অসামরিক ব্যক্তিকে নিহত ও আহত করে।
তবুও ভারত ধৈর্যহারা হলাে না। কিন্তু ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল ৩রা ডিসেম্বর। এদিন সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে অঘঘাষিত যুদ্ধ শুরু করল কাশ্মীর, পাঞ্জাব এবং রাজস্থানের কয়েকটা অগ্রবর্তী বিমান ঘাঁটির ওপর বিমান থেকে বােমাবর্ষণ ও মেশিনগানের গুলি দিয়া আক্রমণ করে।
তারপর, নানা পন্থা! ভারতকেও তৈরি হতে হলাে। ভারতে অগ্রবর্তী এলাকায় বিমান ঘাঁটির ওপর বিনা প্ররােচনায় পাকিস্তানের বিমান হানার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি. ভি. গিরি সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করলেন। (এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য পাকিস্তানের প্রে. ইয়াহিয়া খান্ ইতিপূর্বেই ২৩শে নভেম্বর সারা পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করে রেখেছিলেন ভারতের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযােগ করে যে ভারত নাকি পাকিস্তানের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালিয়েছে।)
৩রা ডিসেম্বর মাঝ রাতের কিছু পরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশবাসীকে বেতার ঘােষণার মাধ্যমে জানালেন পাকিস্তান পুরােমাত্রায় যুদ্ধ আরম্ভ করেছে। যুদ্ধ এখন বাংলাদেশেই আবদ্ধ নয়। যুদ্ধ এখন আমাদের যুদ্ধ বাংলাদেশের। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব সীমান্তে ভারতের সৈন্যদলকে বলা হলাে তারা যেন মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করে। যা হােক, ৩রা ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে ও লড়াই ছড়িয়ে দিল। ভারতের অমৃতসর, শ্রীনগর, পাঠানকোট, আগ্রা, আম্বালা ও যােধপুরে, আগরতলায়, ফিরােজপুরে পাকিস্তানি বিমান হামলা শুরু হলাে।
অবশ্য পাঞ্জাবে হালওয়ারার আকাশে একটা ও অমৃতসরের আকাশে একটা পাক-বিমান এবং আগ্রার কাছে আর একটা পাকবিমান ধ্বংস হলাে। (মজার ব্যাপার ৩রা ডিসেম্বর ৬-১৫ মিনিট- প্রায় একই সময়ে পাকিস্তানের বেতার কেন্দ্র ও নয়াচীনের সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান এই মর্মে ঘােষণা করেছিল যে ভারতীয় বাহিনী পশ্চিম খণ্ডে আক্রমণ চালিয়েছে।)
৪ঠা ডিসেম্বর
আর ঢাক ঢাক, গুড় গুড় নয়! সত্যি সত্যিই পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করলাে- ৪ঠা ডিসেম্বর। রাওয়ালপিন্ডিতে পাক সরকারের একজন মুখপাত্র জানালেন ১৯৬৫ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। ভারতই যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। প্রে: ইয়াহিয়া বললেন, ভারতের বিরুদ্ধে এই হবে তার চূড়ান্ত যুদ্ধ। ৪ঠা ডিসেম্বর ভারতের পূর্ব সীমান্তে সশস্ত্র সৈন্য বাহিনী মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করে বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। ভারতীয় নৌ, বিমান ও স্থল বাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে দখলাভিযান চালায়। চট্টগ্রাম থেকে করাচী যাওয়ার পথে পাকিস্তানি বাণিজ্য জাহাজ ‘পাসনি’ আরব সাগরে আটক হয়ে পড়ে ও কোচিন বন্দরে ঐ জাহাজকে আনা হয়। চট্টগ্রাম কক্সবাজারে ভারতীয় নৌবহর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় আর বাংলাদেশের পাক কবলিত অঞ্চলের বন্দরগুলােকে অবরুদ্ধ করার ব্যবস্থা করে। ভারতীয় বিমান বাহিনী ঢাকা ও যশােহর এলাকায় ১৭০ বার ঝাঁক বেঁধে আক্রমণ করে ১৪টি পাকিস্তানি বিমান ভূপাতিত করে। পশ্চিম সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী পাকিস্তানি এলাকার ৭ কিলােমিটার ভেতরে ঢুকে ‘খেরি’ ও নুনি’ সহ ৯টি পাকিস্তানি গ্রাম দখল করে। ছাষ-জোরিয়ান’ খত্রে বিপরীতে অবস্থিত মাতােয়ালি’ শহরটিও ভারতীয় সৈন্যদল দখল করে, মেহ্মার খত্রে বিপরীতে পাকিস্তানি ঘাটি দখল করে। তাছাড়া ভারতীয় বিমান বাহিনী করাচী বন্দর, সারগােধা, সেরকোট প্রভৃতি স্থানে বােমা বর্ষণ করে। হুসেনিওয়ালা খণ্ডে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়েছে এখানে ১২টি পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়। হুদিয়ারা নালায় এক কন্টিনজেন্ট পাক সৈন্যকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এদিন ১৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের ৩টি মিরাজ ও ২টি এফ-১০৪ স্টার ফাইটার সহ ৩৩টি পাকিস্তানি বিমান ধ্বংস হয়েছে। অবশ্য ভারতীয় বিমান বাহিনীরও ১১টি বিমান খােয়া গেছে তার মধ্যে ৬টি পশ্চিম পাকিস্তানে আর বাংলাদেশে ৫টি। এদিন ভারতীয় বিমান বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান খণ্ডে প্রধানত চারী, সেরকোট, সারগগাধা, মুরিদ, মিয়ানওয়ালি, মসরুর (করাচীর কাছে), রিসালওয়ালা (রাওয়ালপিণ্ডির কাছে) এবং ছাঙ্গা-মাঙ্গায় (লাহােরের কাছে) বােমা বর্ষণ করে। অপরপক্ষে বাংলাদেশে প্রধানত কুর্মিটোলা, তেজগাঁও, যশােহর, হিলি, লালমনিরহাট, আখাউড়া ও মালাপুর প্রভৃতি স্থানে পাক বিমান ঘাটির ওপর ব্যাপক বােমা বর্ষণ করে।
৫ই ডিসেম্বর
৫ই ডিসেম্বর ভারতীয় নৌবাহিনীর সাফল্যের দিন। এদিন আরব সাগরে ও বঙ্গোপসাগরে উভয় দরিয়া এলাকায় ভারতীয় নৌবহর সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে বিচরমান ভারতীয় নৌবহর ১ খানি পাকিস্তানি ডুবাে জাহাজকে ডুবিয়ে দেয় আর আরব সাগরে ভারতীয় নৌবহর নৌযুদ্ধে ৪টি পাকিস্তানি ডেস্ট্রয়ার ঘায়েল করে। তা ছাড়া ভারতীয় নৌ বাহিনী করাচী পােতাশ্রয় ও বন্দরের উপর তুমুল গােলাবর্ষণ করে।
এদিন বাংলাদেশে ভারতীয় স্থল বাহিনী লাকসাম, আখাউড়া, বক্সিগঞ্জ (ময়মনসিংহ), মিয়াবাজার, পারিকোট, লালবাগ (কুমিল্লা), কোটচাদপুর (যশােহর) দখল করে। পশ্চিম সীমান্তে রাজস্থান-সিন্ধুর মরুভূমি এলাকায় বারমার খণ্ডে ভারতীয় স্থলবাহিনী সিন্ধু প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ রেল ষ্টেশন ‘গাদরা’ শহর ভারতীয় সৈন্য দল দখল করেছে। সিন্ধু প্রদেশ ও রাজস্থান সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী উত্তরে ইসলামগড় থেকে দক্ষিণে ‘গাদরা শহর পর্যন্ত সিন্ধু প্রদেশের ভেতরে ১৬ মাইল ঢুকে পড়ে বিস্তৃত অঞ্চল দখল করেছে। গাদরা শহর থেকে সিন্ধুর হায়দরাবাদ শহর পর্যন্ত রাস্তা চলে গিয়েছে। পক্ষান্তরে, পাকিস্তানি স্থল বাহিনী রাজস্থানের পশ্চিম সীমান্তবর্তী শহর রামগড়ের দিকে বিপুল রণসম্ভার নিয়ে অভিযান চালায় এবং রাজস্থানের ১৫ মাইল ভেতরে মরুভূমি এলাকায় ঢুকে পড়ে। অবশ্য লনৃগেনওয়ালা’-র কাছে পাকিস্তানি স্থল বাহিনী তীব্র বাধা পায়। এখানে পাকিস্তানি স্থলবাহিনী সব চাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। এ এলাকায় পাক সৈন্য দলের ১৪টি ট্যাঙ্ক (চীনাটি ৫৯’ ট্যাঙ্ক) সমেত আরও ২৩টি ট্যাঙ্ক হারাতে হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্য দলের পালানাের পথও যেন রুদ্ধ। কারণ সব গাড়ি মরুভূমির বালু রাশিতে আটক পড়েছে।
জম্মুর ছাম্ব এলাকায় একটি পাহাড় দখলের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি বাহিনী তৎপর হয়েছে। অবশ্য ভারতীয় বাহিনী বারংবার বাধা দিয়ে চলেছে। পাঞ্জাবে হুসেনিওয়ালা খণ্ডে পাক বাহিনী কিছুটা সুবিধা করতে পারলেও, আজ পাঞ্জাবের বিভিন্ন রণাঙ্গনের অবস্থা অপরিবর্তিত। তবে হুসেনিওয়ালায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর বােমা বর্ষণে পাক বাহিনীকে ১৮টি ট্যাঙ্ক খােয়াতে হয়েছে। আজও ভারতীয় বিমান বহর পশ্চিম সীমান্তে মসরুর, মিয়ানওয়ালা, সােরকোট, সারগােধা, চান্দারওয়ালা এবং লাহােরে বােমা বর্ষণ করেছে। আজ পশ্চিম সীমান্তে ভারতের বিমান বাহিনী মােট ১০০ বার হানা দিয়েছে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী মাত্র ২০ বার ভারত ভূখণ্ডে বিমান হানা দিয়েছে। আজ বিমান হানা দিতে গিয়ে পাকিস্তানকে পাঠান কোটে ২ খানি মিরেজ’ বিমান, কাশ্মীরে ১টি স্যাবার’ ও ২টি স্টার ফাইটার’ অমৃতসরে খােয়াতে হয়েছে। পাকিস্তানি বিমান বহর আজ সিরা (হরিয়ানা), পাঠানকোট, আম্বালা, আগ্রা, শ্রীনগর এবং ভূজ (কচ্ছ) বিমান বন্দরে হানা দেয়।
৬ই ডিসেম্বর
৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ মে: জে: জেকব সাংবাদিকদের বলেন যে বাংলাদেশের ভেতর ভারতীয় বাহিনী এখন পঞ্চমুখী অভিযান চালিয়েছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩২৭ জন পাক সৈন্য নিহত, ১৯৯ জন আহত ও ৪২৬ জন বন্দি হয়েছে। তাছাড়া পাক বাহিনীকে ২৩টি ট্যাঙ্ক খােয়াতে হয়েছে।
পশ্চিম সীমান্তে আজ সকালে জম্মুতে ২টি পাক স্যাবার জেট এবং পাঞ্জাবের আদমপুরে ১ টি পাক বিমান ধ্বংস হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ডেরা বাবা নানকের বিপরীত দিকে কয়েকটা পাকিস্তানি গ্রামও দখল করেছে।
বাংলাদেশের রণাঙ্গনের অবস্থা হলাে : এদিন নােয়াখালি ফেনী শহরটি ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। শ্রীহট্টের কুলাউড়া ও লাতু ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলে এসেছে। ভারতীয় সৈন্যদল প্রচণ্ড গতিতে যশােহরের দিকে এগিয়ে চলেছে যশাের কেন্টনমেন্ট দখলের জন্য। যশােহরের উত্তর দিকে প্রচণ্ড লড়াই চলেছে। তাছাড়া ঢাকা শহর ভারতীয় বিমান বহরের বারংবার হানার ফলে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। ঢাকার ২২৫ কিলােমিটার দক্ষিণ পূর্বে চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজের কার্যকলাপে কয়েক সপ্তাহ যাবৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। এই শহরে ছিল বাংলাদেশের একমাত্র তৈল শােধনাগার-এসাে তৈল শােধনাগারটি এখন জ্বলছে।
এদিন ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের কলকাতাস্থ প্রথম হাই কমিশনার হােসেন আলীর সদর দপ্তর দিল্লীতে স্থানান্তরিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এদিন ভারতীয় স্থল বাহিনী সর্বপ্রথম পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণের তীব্রতাকে ব্যাপক অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছে। আখনুরে (ছাম্ব খণ্ডে) ২৪ ঘন্টা ধরে ট্যাঙ্ক যুদ্ধ চলেছে— করাচী বন্দর ও শহরের ওপর ভারতীয় বিমানের হানা জোরদার করা হয়েছে। জম্মুতে পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত ঘাঁটিগুলাে দখলের জন্য লড়াই চলছে। খেমকরণের দক্ষিণে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ ছিটমহল ডেরা বাবা নানক ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। তাছাড়া রাজস্থানে বারমার খণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানি শহর পিকানী কাপার’-এর পতন হয়েছেদুদিন ধরে তুমুল যুদ্ধের পরে। বিকানীরের কাছে পাকিস্তানের বানহাল ঘাঁটিরও পতন হয়েছে। চার দিন ধরে ভারত পাক যুদ্ধ চলার ফলে উভয়পক্ষে ক্ষয় ও ক্ষতির খতিয়ান হলাে :
৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের ৫টি বিমান, ২৮টি ট্যাঙ্ক ২৩টি টি-৫৯ চীনা ট্যাঙ্ক ছাখণ্ডে এবং ৫টি প্যাটন ট্যাঙ্ক ডেরা বাবা নানক খণ্ডে খােয়া গেছে। পাকিস্তানের ২টি বাণিজ্য জাহাজ, ২টি ট্যাঙ্কার ধরা পড়েছে, আর মেঘনা নদীতে নৌ যুদ্ধে ২টি যুদ্ধ জাহাজ ও ১টি বাণিজ্য জাহাজ ধ্বংস হয়েছে।
এদিন ভারতীয় বাহিনীর ২টি বিমান খােয়া গিয়ে মােট ১৯টি বিমান খােয়া গিয়াছে।
৭ই ডিসেম্বর
এদিন সকালে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী যশােহরের দুর্ভেদ্য ক্যান্টনমেন্ট ও বিমান ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে। যশােহর শহর থেকে বিমানঘাঁটির দূরত্ব প্রায় ৫ কিলােমিটার উত্তরে। যশােহর ক্যান্টনমেন্ট পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের ৯ নম্বর ডিভিসনের সদর দপ্তর। অধিনায়ক হলেন মে. জে. এ. এ আনসারি। এখানে এক স্কোয়াড্রেনের কিছু বেশি ট্যাঙ্ক, ২৫ পাউণ্ডের ৭৫ মিলিমিটার আর্টিলারি আছে। এই ক্যান্টনমেন্টকে রক্ষার জন্য নাভারন ও সারসার (যশােহর রােড বরাবর) মধ্যে একটি শক্তিশালী ব্যুহ তৈরি করা হয়েছিল। পাক-বাহিনী সেখানে প্রায় দেড় মাইল দীর্ঘ, ২৪ ফুট প্রশস্ত ও ৫ ফুট গভীর খাল কেটেছিল। তাছাড়া ২০ থেকে ২৫টি বাঙ্কার তৈরি করেছিল। এবং যশােহর শহরে যাওয়ার পথে কপােতাক্ষ নদের উপরে ব্রিজের পূর্বে ও পশ্চিমে চারটি আর্টিলারি বসিয়েছিল। এখানে উল্লেখযােগ্য যে ২৫শে মার্চ রাতে এই ক্যান্টনমেন্টে ১ নম্বর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ঐ রেজিমেন্টের একজন বাঙালি লে. কর্নেলকে ছুটি নিতে বললে, তিনি ছুটি নিতে অস্বীকার করেছিলেন। ফলে তাঁকে বন্দি হতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা বিদ্রোহ করে এবং অস্ত্রাগার ও গােলাবারুদের ঘরের তালা ভেঙে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়।
ওদিকে বাংলাদেশের উত্তরে লালমনিরহাট এবং কুষ্টিয়া জেলার গুরুত্বপূর্ণ শহর মেহেরপুরেও ভারতীয় সৈন্যরা দখল করেছে। তাছাড়া ঝিনাইদহও পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর হাত ছাড়া হয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বে গুরুত্বপূর্ণ শ্রীহট্ট শহরেরও পতন হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও পাক-বাহিনী পালাচ্ছে। এদিন হিলি রংপুর খণ্ডে ডাঙ্গাপাড়া, বাদুরিয়া এবং কাঁচাদা ফেরিঘাটও মুক্ত হয়। শ্রীহট্ট খণ্ডে মৌলবী বাজারও মুক্ত। এখন ভারতীয় বাহিনী ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ও কুমিল্লা শহরকে ঘিরে মেঘনা নদীর দিকে এগােচ্ছে।
পশ্চিম সীমান্তের যুদ্ধে রাজস্থানে বারমার খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী গাদরা রােডের দক্ষিণ পশ্চিমে পাকিস্তানের ভেতর আরও এগিয়ে গেছে। ভারতীয় বাহিনী গাদরা রােডের দক্ষিণ পশ্চিমে ৪০ মাইল দূরবর্তী চাচারাে শহর দখল করেছে এবং গাদরা রােডের ২৮ মাইল দূরে বাসেকেটাক’ শহরটি দখল করেছে। কচ্ছ খণ্ডে সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী পাকিস্তানের জালালি’ শহর দখলের জন্য পাক-ভূখণ্ডে নাগরপারকারের পূর্বে আরও ৮ মাইল এগিয়ে গেছে। জম্মু ও কাশ্মিরে ভারতীয় বাহিনী কারগিল খণ্ডে যুদ্ধবিরতি সীমান্ত বরাবর দুটি পাকিস্তানি ঘাঁটি দখল করেছে। আজ ‘ছাম্ব’ শহরে বিমান হানা দিতে গিয়ে পাকিস্তানের ‘মিগ-১৯’ তিনটি বিমান খােয়া দিতে হয়েছে। মােটামুটিভাবে বলা যায় যে ভারতীয় বাহিনী অধিকৃত কাশ্মীর খণ্ডে এগিয়ে চলেছে।
তবে ছাম্ব খণ্ডে ভারতীয় বাহিনীকে পিছু হটে আসতে হয়েছে এদিন। জায়গাটি যুদ্ধবিরতি রেখার ৫/৭ মাইল পূর্বে। ছাম্বের যুদ্ধে পাকিস্তানকে ৩৩টি ট্যাঙ্ক হারাতে হয়েছে। ভারতেরও ১৫টি ট্যাঙ্ক খােয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য যে ১৯৬৫ সালেও পাকিস্তান এই ছাষে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল। ভারতীয় বাহিনী ডেরা বাবা নানক সেতুটি দখল করেছে। খেমকরেন খণ্ডে ভারতীয় সৈন্যদল জাটটানওয়ালা ও রােহেওয়ালা নামে ২টি গ্রাম দখল করেছে। ওয়াগাখণ্ডে শাকহনুম গ্রামটিও দখল করা হয়েছে।
এদিন বাংলাদেশে এ সব অঞ্চল ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সংযােগে দখল করেছে শ্রীহট্ট, যশােহর, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, সুনামগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, চরখাই, ছাতক, মৌলবীবাজার, লালমনিরহাট।
পশ্চিম সীমান্তের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে এসব পাকিস্তানি ঘাটি মহেন্দ্র রােপার, ফেদারােপাল বাখল, লানকাউ, ছাচররা। এসব অঞ্চল বারমার খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত।
৮ই ডিসেম্বর
এদিন বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানের সর্বশেষ স্যাবার জেট বিমান দুটিকে ধ্বংস করেছে। ভারতীয় স্থলবাহিনীর আক্রমণে কুমিল্লা শহর ও বিমান ঘাঁটির পতন হয়েছে। কুমিল্লা জেলার ইলিয়টগঞ্জ শহর ও শ্রীহট্ট জেলার শ্রীমঙ্গল ব্যতীত কুমিল্লার বদ্যাকুট চৌরা, টেম্পল হিল ও জাজিগান রেল স্টেশন মিত্রবাহিনীর দখলে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরটিরও পতন হয়েছে। যশাের-কালিগঞ্জ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগ কেন্দ্র মাগুরা ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম জেলার রামগড় মুক্ত করেছে। খুলনা জেলার মহকুমা শহর সাতক্ষীরা এবং হিলির উত্তরে পীরগঞ্জের পতন হয়েছে। পীরগঞ্জ দখল হওয়ার ফলে রংপুর ও বগুড়ার মধ্যে যােগাযােগ ছিন্ন হয়ে গেছে। এদিন পাক বাহিনীর ৪টি সাফে ট্যাঙ্ক খােয়া গেছে।
পশ্চিম সীমান্তের যুদ্ধে ভারতীয় স্থলবাহিনী বিভিন্নস্থানে ৭টি পাক জেট বিমানকে ভূপাতিত এবং ১২টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে। পুঞ্চখণ্ডে ভারতীয় বাহিনী ৬টি চৌকি দখল করেছে। ডেরা বাবা নানক এলাকা ও ছাম্ব খণ্ডে তুমুল যুদ্ধ হয়েছে। লাদাকের উত্তরে পারতাপুর এলাকায় আরও ২টি চৌকির পতন হয়েছে। কারগিল অঞ্চলে আরও ২টি চৌকি ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। ছাম্ব এলাকায় পাকিস্তানের ৪টি ট্যাঙ্ক এবং ১টি স্যাবার জেট ধ্বংস করেছে। আজ পাকিস্তান ৩টি ফাইটার, ২টি সি-১৩০, ১টি পরিবহন, ৪টি মিগ – ১৯ ১টি এফ ১০৪, ১টি এফ-৮৬ বিমান হারিয়েছে।
৯ই ডিসেম্বর
আজ ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের নদীবন্দর চাঁদপুর দখল করেছে। এখান থেকে পাক সেনাবােঝাই একটি বড় স্টিমার পালাচ্ছিল। স্টিমারটির উপর ট্যাঙ্ক থেকে গােলা ও বিমান থেকে রকেট ফেলা হয়। জ্বলন্ত অবস্থায় স্টিমারটি ডুবে যায়। স্টীমারে শ পাঁচেক সৈন্য ছিল।
চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, চালনা, খুলনার জলপথে পাক জাহাজ, স্টিমার ও গান বােটগুলাের উপর ভারতীয় বিমান বাহিনী ব্যাপক আক্রমণ চালিয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা মাগুরায় গিয়ে মধুমতীর তীরে পৌছেছে। অপর পারে ফরিদপুর জেলা।
চাঁদপুর দখল হওয়ার ফলে ভারতীয় সেনারা এখন ঢাকার ৬৪ কিলােমিটার দক্ষিণে এবং দাউদকান্দিতে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতির ফলে ঢাকার দূরত্ব এখন পূবে দাঁড়িয়েছে ৩৩ কিলােমিটার। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ভারতীয় বাহিনী চারদিকে ঘিরে রেখেছে। মেঘনার পূর্ব পারে আশুগঞ্জও ভারতীয় বাহিনীর দখলে এসেছে। এখানে ৩০০ রাজাকারকে বন্দি করা হয়েছে। যশাের দখলের পর ভারতীয় বাহিনীর একটি দল উত্তরে কুষ্টিয়ার দিকে এবং আর একটি দল দক্ষিণে খুলনার দিকে এগিয়ে চলেছে। উত্তরাংশে ভারতীয় বাহিনী রংপুর ও দিনাজপুরের পথে চলেছে। ভারতীয় বাহিনীর খুলনা যাওয়ার পথে রূপদিয়াতে উভয়পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। এখানে বালুচ রেজিমেন্টের একজন অফিসার সহ ৪০ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে ছখানি পাক বাণিজ্য জাহাজকে আটক করে কলকাতায় নিয়ে এসেছে। ভারতীয় বিমান বাহিনী খুলনা ও নারায়ণগঞ্জে বহু পাক জলযান ডুবিয়ে দিয়েছে— পাকিস্তানের ৩ হাজার টনের ৬টি বড় জাহাজ, ৯টি মাঝারি জাহাজ, ৭টি গানবােট, ১১টি মােটর বােট খােয়া গেছে। পাক বাহিনী যাতে গাইবান্ধার কাছে যমুনা নদী পার হয়ে ঢাকার দিকে পালাতে না পারে, সেজন্য ভারতীয় বিমান বাহিনী ফুলছড়িঘাট ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে স্টিমার ও অন্যান্য জলযানের ওপর বিমান আক্রমণ চালায়। দিনাজপুর জেলার পলাশবাড়িও মুক্ত হয়েছে। এখান থেকে ভারতীয় বাহিনী পশ্চিমে সাদুল্লাপুর হয়ে গাইবান্ধার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে— গাইবান্ধার উত্তরাংশ এখন মুক্ত। গােবিন্দগঞ্জ দখল করার পর গাইবান্ধা হয়ে বগুড়ার পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দিনাজপুর, পার্বতীপুর, রংপুর এবং গাইবান্ধা ও
রেলপথে যাতে পাক বাহিনী পালাতে না পারে, সেজন্য ভারতীয় বিমান বহর অভিযান চালাচ্ছে।
পশ্চিম রণাঙ্গনে
৮ই ডিসেম্বর রাতে করাচী বন্দরের ওপর ভারতীয় বিমানবহরের অভিযানের ফলে ৪টা পাক জাহাজ ডুবে গেছে। করাচীর বহু ঘর-বাড়ি এবং সামরিক ঘাঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি পেট্রোল গুদাম বিধ্বস্ত হয়েছে। আজও ভারতীয় সৈন্যরা স্থলে ও অন্তরীক্ষে ছাম্বখণ্ডে পাক সৈন্যদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। ভারতীয় বাহিনী তাদের শক্তি সুসংহত করে ৫/৬ কিলােমিটার পশ্চিমে এগিয়েছে। পাকিস্তানের হায়দরাবাদের নগর পার কার ভারতীয় সেনারা দখল করেছে। জয়সলমীর খণ্ডের বিপরীতে গব্বরে ভারতীয় সেনারা পলায়নপর পাক সেনাদে ১টি চীনা ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে। পাকহায়দরাবাদে সিন্ধু এলাকার মীরপুর খাস রেল জংশনের ওপর ভারতীয় বিমান বহর আক্রমণ চালিয়েছে। নয়াচোড়ের কাছেও বহু পাক ঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে। এখানে উভয়পক্ষে তুমুল লড়াই চলছে। লঙগেনওয়ালায় এখনও যুদ্ধ চলছে—তবে পাক বাহিনী পলায়নপর। রাজস্থানখণ্ডে বহু পাক সৈন্য বন্দি হয়েছে। জামােমাধােপুর (পাঞ্জাব) দিয়ে অগ্রসরমান ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানের আরও ভেতরে দারমান, ধাহলরা এবং বারি পর্যন্ত ঢুকেছে। লাদাখের সব যােগাযােগ লাইন থেকে পাক সৈন্যদের হটতে হয়েছে। কারগিলে উত্তর দিকে ভারতের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। হয়েছে। পুঞ্চ এলাকায় পাক সৈন্যরা নিওব্ধ হয়েছে। রাজস্থানে বারমার খত্রে বিপরীতে হায়দরাবাদ বিভাগে সিন্ধুর নয়া চোড়ের কাছে ২টি পাক ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়েছে। ৮ই ডিসেম্বর রাতের দিকে পাক বিমান বাহিনী বারমার ও কচ্ছে হানা দেয়। তাছাড়া, বিকানীর যােধপুর ও জয়সলমীরে পাক-বিমান হানা দিয়েছে। জলন্ধরেও তারা বােমাবর্ষণ করেছে। জলন্ধরের ভােগপুর ও আদমপুর তহসিলের আলমগির ও ঘােড়াবাহী গ্রামের ওপর পাক বিমান হানায় ভারতের ২০ জন নিহত ও ২৫ জন আহত হয়েছে। ৮ই ডিসেম্বর পাক বিমান বহর ২বার আগ্রায় হানা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১টি পাক বিমান এখানে ঘায়েল হয়েছে।
১০ই ডিসেম্বর
আজ ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তি বাহিনী কুমিল্লা শ্রীহট্টখণ্ডে আশুগঞ্জ থেকে দুরন্ত মেঘনা নদী পার হয়ে ভৈরব বাজারের কাছে পৌঁছেছে। এর ফলে ঢাকা যাওয়ার পথে আর কোনাে বড় বাধা রইল না। আজ বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী নােয়াখালি মুক্ত করেছে। কুমিল্লা জেলার লাকসামে আজ বেলা সাড়ে তিনটায় ভারতীয় সৈন্যদের কাছে ১ জন লেফেটন্যান্ট সহ ৪৯৫ জন পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। ভারতীয় সেনারা এখন কুষ্টিয়া শহর প্রবেশের মুখে। কুষ্টিয়া, ভেড়ামারা ও নবাবপাড়ায় তুমুল যুদ্ধ চলছে।
যশােহর খুলনা খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী চেঙ্গুটিয়া, হরিশঙ্কর, ডাঙ্গামারা দখল করেছে। যশােহর থেকে পলায়মান পাক সেনাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাদের ফুলতলায় যুদ্ধ হয়েছে। এই যুদ্ধ চলাকালে ভারতীয় সেনাদের আর একটি অংশ নদী পার হয়ে পিছন থেকে পাক সেনাদের পালানাের পথ আটক করছে। এখানে তিন কোম্পানি পাক সেনা আছে। পাক বাহিনীর পথ অবরােধকারী ভারতীয় সেনারা এখন খুলনা থেকে ২৭ কিলােমিটার দূরে রয়েছে। এখানে যে যুদ্ধ হয়েছে তাতে পাকিস্তানি সেনাদের ৩০টি যান, ৬টি আর, সি,এ কামান, ৪টি ভারী মর্টার হারাতে হয়েছে।
রংপুর খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী দুরা ও বড়চাই গ্রাম দখল করেছে এবং বীরগঞ্জকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ময়মনসিংহ খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী জামালপুর ঘিরে পাক সেনাদের পালাবার পথ অবরুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের উত্তরে হিলিখণ্ডে ভারতীয় সেনারা পশ্চিমে গাইবান্ধায় পৌছে গেছে। এর ফলে রংপুরদিনাজপুর খণ্ডে পাক সেনাদের পালিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এখানে ভারতীয় বিমান বাহিনী রংপুর, সৈয়দপুর এবং গাইবান্ধায় বােমাবর্ষণ করে রেল সড়ক সংযােগ ধ্বংস করেছে। ফুলছাড়িঘাট ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় পাক সৈন্য পদ্মানদী পেরিয়ে পালাবার সময় ভারতীয় বিমান বাহিনী বােমা বর্ষণ করে ১৫টি গাদাবােট, ৮টি স্টিমার, ও ২টি মােটর বােটকে নষ্ট করে দিয়েছে। পীরগঞ্জে হাতাহাতি লড়াইয়ে পাকিস্তানের ৩২ নং বালুচ রেজিমেন্টের অফিসার কম্যান্ডিং লে. কর্নেল সুলতান মহম্মদ নিহত হয়েছেন। আজ ভারতীয় বিমান বাহিনী চালনা, বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জে হানা দিয়ে ৬ থেকে ৮টি মাঝারি জাহাজ, ১০টি ছােট জাহাজ, ৭টি গানবােট এবং ১১টি মােটর বােটকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আজ ভারতীয় নৌবাহিনী বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর চালনা ও মংলা বন্দর দখল করেছে। নােয়াখালি মুক্তি বাহিনীর দখলে আসার ফলে ভারতীয় সেনাদের চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশের পথে আর কোননা বাধা রইল না। উত্তরে দিনাজপুর শহরের ওপর ভারতীয় সেনারা তিন দিক দিয়ে আক্রমণ চালাচ্ছে। দিনাজপুর থেকে ২৬ মাইল দূরে সৈয়দপুরে পাক-দুর্গের ওপর ভারতীয় বাহিনী গােলাবর্ষণ করে চলছে। হিলি ও গাইবান্ধার মধ্যেকার সড়কটি ভারতীয় বাহিনী কেটে দেওয়ার ফলে পাকসেনারা এখন হিলিতে অবরুদ্ধ।
আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের উত্তরখণ্ডে ভারতীয় বাহিনী ৩৫০০ বর্গকিলােমিটার পাক হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করেছে। ১৫০০ পাকিস্তানি নিয়মিত ও অনিয়মিত সেনা ধরা পড়েছে, ৪১৩ জন মারা গেছে, ৭টি ট্যাঙ্ক ঘায়েল হয়েছে।
চাঁদপুর থেকে পালাবার সময় ৯০ জন পাকসেনাকে বন্দি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের পূর্বাংশে লাকসামে তুমুল যুদ্ধের পরে পাকবাহিনী পর্যদস্ত হয়েছে। এর ফলে ২৩ নং পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের ২ জন অফিসার সহ ৪১০ জন পাক-সেনাকে বন্দি করা হয়েছে। ভারতের বিমানবাহী জাহাজ বিক্রান্ত, থেকে সন্দীপ, কক্সবাজারে আক্রমণ চালানাে হয়েছে। চট্টগ্রামের অদূরে ৪টি গানবােট ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত এ অঞ্চলে ভারতীয় নৌবহর ১৩টি গানবােট ডুবিয়ে দিয়েছে।
আজ শ্রীহট্ট সুরমা উপত্যকা খণ্ডে ভারতীয় ও মুক্তিফৌজের বিমানবাহিনীর যুক্ত অভিযানের ফলে ৫০ জন পাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। শ্রীহট্ট শহরের ৯৬ কিলােমিটার দক্ষিণে ৩০টি পাক যানবাহন বােমা মেরে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। খাদিমনগর ক্যান্টনমেন্টে রকেট আক্রমণের ফলে কিছু সংখ্যক পাকসেনা নিহত হয়েছে ও তাদের ব্যারাক ধ্বংস হয়েছে।
ঢাকার কুর্মিটোলা ও তেজগাঁও বিমানক্ষেত্র এবং ঢাকার ফ্লাইংক্লাবের আর একটি বিমান ক্ষেত্রের ওপর ভারতীয় বিমান বাহিনী হানা দিয়েছে।
রাষ্ট্রসংঘের অনুরােধ
রাষ্টসংঘের লােকজনদের ঢাকা থেকে সরিয়ে আনার জন্য সিঙ্গাপুর থেকে ৩টি ব্রিটিশ বিমানকে ঢাকায় আসা-যাওয়ার সুযােগ দেওয়ার জন্য আজ সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২৪ ঘণ্টা বিমান হানা বন্ধ রাখার জন্য ভারতকে অনুরােধ করা হয়েছে এবং ভারত সরকার এই অনুরােধ রাখতে সম্মত হয়েছেন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রসংঘ ছাড়া ৭টি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া, কানাডা, জাপান, পশ্চিম জার্মানি ও ফ্রান্স ভারতকে অনুরােধ করেছিল। অবশ্য এর ফলে পাক-পদাতিক বাহিনী ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণের হাত থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য রেহাই পাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে তারা ঢাকার চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য স্টিমার ও জাহাজে আরও সৈন্য আনার সুযােগ পেয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে অসামরিক প্রশাসন
এদিকে পাকহানাদারদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা হচ্ছে। কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অসামরিক প্রশাসন ১৭ই ডিসেম্বর থেকে চালু হচ্ছে। যশােহর শহরে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, খাদ্য, কৃষি ইত্যাদি জরুরি বিভাগগুলাে অস্থায়ীভাবে খােলা হচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে বিভাগগুলাে চালু হবে।
৮টি পাক-জাহাজের কাহিনী
বাংলাদেশের সমুদ্রোপকূলে আটক ৮টি পাকিস্তানি কর্তৃত্বাধীন বিদেশী জাহাজ এখন খিদিরপুরের কেজি, ডকে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ২টি গ্রীক জাহাজই ১ হাজার টনের মিনি লেডি, মিনি লােফ’। আর ৪টি জাহাজ ৪’শ টনের। ৫টি জাহাজের নাম বদল করা হয়েছিল-গলিফ ট্রেডার (ক্রিস্টেন হােম), গলিফ জাইন (এলি লাইন) গলিফ ক্রিসেন্ট (এলি ফর্ম), গলিফ নিউগেটার (গ্রেডেক্রটিন) গলিফ প্রিন্সে (ক্যাথেরিনা)। আর একটা জাহাজ ডিনাক্রি টেসশান-এর নাম পরিবর্তিত হয়নি। জাহাজগুলাে সম্পূর্ণ ফাঁকা ছিল কোনাে মালপত্র ছিল না। অথচ জাহাজের গায়ে ইংরাজি ও বাংলায় বড় বড় হরফে লেখা ছিল রাষ্ট্রসংঘের পৃষ্ঠপােষকতায় রিলিফ দ্রব্য পরিবহনকারী বিদেশী জাহাজ। গত রাতে ৭ হাজার টনের পাক জাহাজ “আনােয়ার বক্স” জাপানী জাহাজ বলে পালাবার চেষ্টা করছিল। জাহাজে পাক-সামরিক বাহিনীর লােকেরা ছিল। জাহাজটিকে কলকাতায় আনা হয়েছে। ১০ই ডিসেম্বর উড়িষ্যায় পারাদিপের কাছে ভারতীয় নৌবাহিনী দুটি জাহাজ আটক করে কলকাতায় এনেছে—১টি জাহাজ লিবিয়ার, অপরটি পাকিস্তানের।
পশ্চিম রণাঙ্গনে
পশ্চিম রণাঙ্গনে আজ ভারতীয় বাহিনী পৃথকভাবে শিয়ালকোট এলাকায় ৩ মাইল ভেতরে নয়নাকোট দখল করেছে। এই এলাকায় খাসরালাও- ভারতীয় বাহিনীর দখলে এসেছে। ভারতীয় সেনারা এখন শিয়ালকোট শহর থেকে ৩৫ কিলােমিটার দূরে রয়েছে। কারগিল খণ্ডে ভারতীয় সেনারা ৪০৮৬ মিটার উঁচু এক পাক সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে। এ ঘাঁটিটা ভারত ১৯৬৫ সালেও জয় করেছিল। পরে তাসখন্দ চুক্তি অনুযায়ী ভারতকে তা পাকিস্তানকে ফিরিয়ে দিতে হয়। এখানে পাক সেনারা ২টি তিন ইঞ্চি মর্টার, ১টি মেশিনগান, ১টি ৩-৭ ক্যালিবার গান খুইয়েছে। ছাষের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ১টি স্যাবার জেট বিমান ভূপাতিত করেছে এবং ৯টি ট্যাংক ধ্বংস করেছে। মুন্নাওয়ার তাওই নদী বরাবর ৯ কিলােমিটার এলাকায় উভয় পক্ষে যুদ্ধ চলছে। ছাম্ব খণ্ডে এ পর্যন্ত পাকিস্তানের ২০টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়েছে। এখন আখনুর সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন। আজ পাঠানকোটে বিমান ঘাঁটির ওপর হানাদারী ১টি পাক মিরাজ বিমান ধ্বংস করা হয়েছে। ডেরা বাবা নানক খণ্ডে পাকিস্তানি বাহিনী বুর্জ ও বেরা-য় ভারতীয় ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায় এবং বেরা ঘাঁটিটি দখল করে। পরে ভারতীয় সেনারা পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ঐ ঘাঁটিটি আবার দখল করে। সুলেমানকি এলাকায় ভারতীয় বিমান বাহিনী ৩টি পাক ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে।
পশ্চিম কমান্ডের একজন মুখপাত্র বলেন, ছাম্ব খণ্ডে পাক বাহিনী ২ হাজার বর্গগজ ভারতীয় এলাকা দখল করে যে নতুন চাপ সৃষ্টি করেছিল, তা প্রতিহত করে ভারতীয় বাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে। এখন পাক সেনারা পশ্চাদপসরণ করছে। এখানে ভারতীয় ফৌজের যথেষ্ট ক্ষয় ও ক্ষতি হয়েছে।
দক্ষিণ কমান্ডের একজন মুখপাত্রের কাছে থেকে এ মর্মে জানা গেছে যে ২১০ কিলােমিটার পরিমিত বারমার সীমান্ত বরাবর সিন্ধুর সব কটি পাক ঘাটি ভারতীয় বাহিনী দখল করে নিয়েছে। এ জন্য বারমারের বিপরীতে অবস্থিত নাকাউ থেকে নগর পার্কার পর্যন্ত সমগ্র সীমান্ত এলাকা ভারতীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন হয়েছে। তাছাড়া, পাকিস্তানের বিরাট এলাকা হায়দরাবাদ সিন্ধুর নগর পার্কার তহসিল ভারতীয় বাহিনীর দখলে এসেছে। এখানে ভারতীয় সেনারা নয়াচোড়-এ পাক প্রতিরক্ষা ঘাঁটি দখলের জন্য এগিয়ে চলেছে। রাজস্থানের বারমার খণ্ডের বিপরীত দিকের সিন্ধুর ২২৫০ বর্গ কিলােমিটার এবং কচ্ছের ৬৪০ বর্গ কিলােমিটার অঞ্চল ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। কচ্ছ-সিন্ধু খণ্ডে বাইদলের পূর্বে সীমান্তের ওপারে ভিক্ষুর এলাকা আজ বেলা ২টায় ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। এখানে একটি পাক রাডার কেন্দ্র আছে যা গুরুত্বপূর্ণ। লগে ওয়ালায় ৫ দিন ধরে উভয় পক্ষে যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে পাক বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এখানে পাক সৈন্য ৩০টি চীনা ট্যাঙ্ক অকেজো অবস্থায় রেখে গেছে। কচ্ছখণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ শহর বীরওয়ার পতন হয়েছে। জয়সলমীর খণ্ডে শক্তিশালী পাক ঘাঁটি ভৈখানাওয়ালা খু-ও ভারতীয় সেনারা দখল করেছে। বব্বর এলাকায় ভারতীয় বিমান বাহিনী ১টি তৈলবাহী জাহাজ ধ্বংস করেছে। এখানে ১০টি ও বারমার খণ্ডের নয়াচোড়ে ৩টি পাক ট্যাঙ্ক খােয়া গেছে। জম্মু থেকে ১৬০ কিলােমিটার দূরে নৌসেরা খণ্ডের ঝানগড়ে বহু পাক সৈন্য হতাহত হয়েছে।
ভারতীয় নৌবহরের সিদ্ধান্ত
নিরপেক্ষ বিদেশী জাহাজগুলাে যাতে ১২ই ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে করাচী বন্দর ছেড়ে যাত্রা করতে পারে সেজন্য ভারতীয় নৌবহর পশ্চিম পাকিস্তানের বন্দরগুলােতে আক্রমণ সীমাবদ্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
১১ই ডিসেম্বর
এদিন রাতে তুমুল যুদ্ধের পর দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর কুষ্টিয়া মুক্ত হয়েছে। তাছাড়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নােয়াখালি, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছরি, বাহাদুরিয়া পিসাপাড়া, দুর্গাদিকি বিগ্রাম ও চণ্ডীপুরকে মুক্ত করা হয়েছে।
পাক বাহিনী কুষ্টিয়া ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পাবনা জেলায় ঈশ্বরদির কাছে ডিনামাইট দিয়ে পদ্মার ওপর সারা ব্রিজের ১টি স্প্যান উড়িয়ে দিয়েছে। খুলনা অঞ্চলে ভারতীয় বিমান বাহিনী ৬টি জাহাজ এবং পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জে ১০টি স্টিমার ও বজরা ধ্বংস করেছে। ভারতীয় বাহিনী খুলনা থেকে ১০ মাইলের মধ্যে পৌছেছে।
১১ই ডিসেম্বর বেলা সাড়ে বারােটার দিকে ময়মনসিংহ ও জামালপুর শহরকে পাক-বাহিনী মুক্ত করা হয়। জামালপুরে এক ব্যাটালিয়ান পাকসৈন্য ছিল। এখানে ৩ দিন ধরে লড়াইয়ের পর শনিবার (১১ই ডিসেম্বর) সকালে ৫৮১ জন পাক-সৈন্য ভারতীয় সেনাদলের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ১৫০ পাক সৈন্য যুদ্ধে মারা যায়। এখানে ৩১ নং বালুচ রেজিমেন্টের অফিসার কমান্ডিং লে. কর্নেল সুলতান আত্মসমর্পণ করেন। ভারতীয় বাহিনীর হাতে আসে ১২০ মিলি মিটার মর্টার, ৮টি ১০৫ মি. মি. গান, ৮টি ১০৬ আর, সি, এল, গান, ৭২টি এল, এম্, জি, এম, এস, জি এবং ৬ পাউন্ডের গান সমেত প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। লাকসামে ২৩ নং পঞ্জাব ও ১টি বালুচ রেজিমেন্টের ৪০০ পাক সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে লে. কর্নেল আসরফ-আলি সৈয়দ (২৩ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের প্রধান সহ। এখানে ভারতীয় বাহিনীর হস্তগত হয়েছে নানা ধরনের ২০০টি গাড়ি।
কুমিল্লা খণ্ডে মেঘনার পূর্বদিকে পাক বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাজিত। এখানে ২৩ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ছাড়াও ৩০ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ২৫ নং ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং ২১ নং আজাদ কাশ্মীর ব্যাটালিয়নের ১জন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার সহ ১১ জন অফিসার, ১৬ জন জে, সি, ও আত্মসমর্পণ করেছে। কুমিল্লা খণ্ডে এ পর্যন্ত মােট ১২০০ পাক সৈন্যকে বন্দি করা হয়েছে।
হিলি, গাইবাঁধা ও পবিত্ৰনগর দখলের পর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের পাক সদর দপ্তর বগুড়া থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এখন ২০ মাইল দূরে আছে। উত্তরখণ্ডে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এবং দিনাজপুরে আটক পাক বাহিনীর সামনে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোনাে পথ নেই। বাংলাদেশে পাক বাহিনীর সদর দপ্তর ঢাকা দখলের জন্য ভৈরব বাজার, আশুগঞ্জ এবং দাউদকান্দি থেকে ভারতীয় বাহিনী আগুয়ান হয়েছে। ভারতীয় স্থলবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশ আজ বেতারে পাক বাহিনীর সেনাপতিদের উদ্দেশে এই মর্মে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে স্থলে, জলে অন্তরীক্ষে পাক সৈন্যদের পালাবার পথ রুদ্ধ। এমতাবস্থায় পাক সেনাপতিদের আত্মসমর্পণ করাই যুক্তিযুক্ত হবে।
ওদিকে ঢাকাস্থ পাক বাহিনীর কয়েকজন অফিসার- বিশেষত পূর্ববঙ্গের গভর্ণর ড. মালিকের (বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানে সামরিক পরামর্শদাতা মে. জে. ফারমান আলি রাষ্ট্রসংঘের সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। এই সাহায্য প্রার্থনার মূল বক্তব্য হলাে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী ও অসামরিক ব্যক্তিদের পূর্ববঙ্গ থেকে নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার জন্য যেন ত্বরায় ব্যবস্থা করা হয়। এই সাহায্য প্রার্থনার তার বাতা অগ্রাহ্য করার জন্য রাষ্ট্রসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি মি. আগাশাহী রাষ্ট্রসংঘকে অনুরােধ করেন। মি. আগা শাহী বলেন যে প্রে. ইয়াহিয়া খাঁ স্বয়ং এক বার্তা পাঠাবেন।
আজ মুক্ত যশােহরে প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ঐ জনসভায় এক ঘােষণায় বলেন যে বাংলাদেশে মুসলিম লীগ, নুরুল আমিনের পাকিস্তান গণতান্ত্রিক দল, জামাতে ইসলাম ও নিজামী ইসলাম এই ৪টি রাজনৈতিক দলকে সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হবে।
ভারত-পাক পশ্চিম সীমান্তের রণাঙ্গনে ছাম্ব এলাকায় আজ শনিবার ১১ই ডিসেম্বর পাক বাহিনীকে পিছু হঠতে হয়েছে। পাক বাহিনীকে ছােট নদী মুনাওয়ার তাওয়াই’ -এর পশ্চিম পারে ভারতীয় স্থল বাহিনী হটিয়ে দিয়েছে। এখানে ৫টি পাক-ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়েছে ভারতীয় ন্যাট বিমান পাকিস্তানের ১টি মিরাজ বিমানকে ঘায়েল করেছে। শিয়ালকোট খণ্ডে পাক বাহিনীর ৫টি ট্যাঙ্ক নষ্ট হয়েছে। মামেপার ও ফাসরার মধ্যে ভারতীয় বাহিনী ১টি প্যাটন ট্যাঙ্ক দখল করে নিয়েছে। কাশ্মীরের কারগিল খণ্ডে এ যাবৎ ভারতীয় স্থল বাহিনী ১৯টি পাক ঘাঁটি দখল করেছে। এ অঞ্চলে পাকিস্তানের মােট ২৩টি সামরিক ঘাঁটি আছে। উরি খণ্ডে সাদিগাইনে ভারতীয় সৈন্যদের হাতে ১৫ জন পাক সৈন্য নিহত হয়েছে। পুঞ্চ এলাকায় ভারতীয় সৈন্যরা ২টি পাক-ঘাঁটি দখল করেছে। গাদরা-পাঠানকোট খণ্ডে পাক বাহিনীর ৭টি ট্যাঙ্ক এবং ভারতীয় বাহিনীর ১টি ট্যাঙ্ক খােয়া গিয়েছে। ফাজিলকা ও হুসেনিওয়ালায় যুদ্ধের অবস্থার তেমন কোনাে পরিবর্তন হয়নি।
শিয়ালকোট খণ্ডে ডেরা বাবা নানকে ইরাবতী নদীর ওপর যে সেতু রয়েছে, তার পশ্চিমাংশ পাক বাহিনী উড়িয়ে দিয়েছে। পাক বিমান বাহিনী আজ শ্রীনগর ও জম্মু বিমান ঘাঁটির ওপর হানা দেয়। বারমার খণ্ডে নয়াটোর এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। এ অঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর কিছুটা সুবিধা হয়েছে। জয়সলমীর খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের ভেতর ৬ কিলােমিটার ঢুকে গিয়েছে। এখানে পাকিস্তানের ৫টি ট্যাঙ্ক ও বহু যানবাহন নষ্ট হয়েছে। ভারতীয় স্থলবাহিনী গুজরাট সিন্ধু সীমান্তের তিনটি জায়গায় এগিয়ে চলেছে। ছাদবেটের উত্তরে গুরুত্বপূর্ণ পাক সামরিক ঘাঁটি লে বিঙ্গি ভারতীয় সেনারা দখল করে নিয়েছে।
আজ জয়পুরে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবরকতুল্লা খা বলেন যে রাজস্থান সীমান্ত বরাবর পশ্চিম পাকিস্তানের যে সব অঞ্চল ভারতীয় সেনারা দখল করে নিয়েছে, সে সব অঞ্চলে সৈন্য বাহিনীর নির্দেশাধীন অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য যে পাকিস্তানের সঙ্গে ৮ দিন ধরে যুদ্ধ চলছে তাতে এই সর্ব প্রথম আজ (১১ই ডিসেম্বর) ভারতীয় নৌ বাহিনীর একটি বিমান পাক ঘাঁটিতে বােমা বর্ষণ করতে গিয়ে ধ্বংস হয়েছে। বিমানটি আরব সাগরে ভেঙে পড়েছে। এ ছাড়া আজ পশ্চিম রণাঙ্গনের যুদ্ধে আরও ২টি জঙ্গী বিমান ভারতকে হারাতে হয়েছে।
বাংলাদেশে যেমন ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী ১২ টি শহর মুক্ত করেছে, তেমনি পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনী জোতুর, বিজনেট এবং কারগিলে আরও ১০টি ঘাঁটি দখল করেছে।
১২ই ডিসেম্বর
বাংলাদেশে শেষ পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ সমাগত। আজ (রবিবার ১২ই ডিসেম্বর) ঢাকা দখলের লড়াই শুরু হয়েছে। আগের দিনই (শনিবার) অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনী ও মিত্রসেনা নরসিংদিতে পৌছেছে। ঢাকা থেকে নরসিংদি গ্রামের দূরত্ব ২২ মাইল। ময়মনসিংহ থেকেও আর একটি ভারতীয় বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে ঢাকার দিকে।
খুলনার উপকণ্ঠেও যুদ্ধ চলছে। দৌলতপুরে উভয়পক্ষে যুদ্ধ চলছে। পাক-সেনা খুলনা শহরের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।
উত্তরে হিলি খণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ পাক সামরিক ঘাঁটি বগুড়া শহরের পতন আসন্ন ভারতীয় সেনারা শহর থেকে আট-দশ মাইল দূরে আছে। দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার সদর শহরগুলাে ছাড়া মফঃস্বল। অঞ্চল পাক-সেনাদের কবল মুক্ত। বগুড়ার ৮ মাইল দূরে গােবিন্দগঞ্জ পতনের সময় পাক সেনাদের ৪০ জন বন্দি, ৬০ জন নিহত, ৬টি স্যাফি ট্যাঙ্ক বিধ্বস্ত হয়েছে। পাক সেনারা পাবনা ও রাজশাহীর দিকে পালাচ্ছে। ভারতীয় সেনারা দিনাজপুর শহরের ২ মাইল উত্তরে উপস্থিত হয়েছে। কুষ্টিয়া খণ্ডে ভারতীয় বাহিনী | ভেড়ামারায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কাছে পৌছেছে। সমগ্র কুষ্টিয়া জেলা আজ পাক-সেনা মুক্ত।
শ্রীহট্ট-ময়মনসিংহ খণ্ডে পূর্বে মৌলবী বাজার (শ্রীহট্ট) থেকে পশ্চিমে জামালপুর পর্যন্ত সব এলাকা ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কুমিল্লা খণ্ডে ১ হাজার পাক সেনা আত্মসমর্পণ করেছে। পূর্ব খণ্ডে এ পর্যন্ত ৪ হাজার পাক-সেনা আত্মসমর্পণ করেছে। চট্টগ্রাম খণ্ডে পাক বাহিনী বিপর্যস্ত। চট্টগ্রামে বিমান বন্দরে সামরিক ঘাঁটিগুলােতে ভারতীয় বিমান হানা দিয়ে চলেছে। কক্সবাজারে ভারতীয় নৌ বিমান বাহিনী ১টি গানবােট ও ২টি জাহাজ ধ্বংস করেছে। রাঙামাটির পতন হয়েছে। ভারতীয় সেনারা চট্টগ্রাম শহরের কাছাকাছি পৌছে গেছে। পূর্বাঞ্চলের দরিয়ায় সৈন্য সমেত ৬টি পাক জাহাজ নিমজ্জিত হয়েছে।
ঢাকা থেকে বিদেশী শরণার্থী
দল আজ ঢাকা থেকে দমদম বিমান বন্দরে বিদেশী ৪১৫ জন শরণার্থীদের নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৬০ জন সিঙ্গাপুর গেছেন। ঢাকা থেকে প্রত্যাগত এক ফরাসি মহিলা বলেন, ঢাকায় যখন বােমা পড়ছিল, তখন সকলের কি উল্লাস—বাঙালিদের আবালবৃদ্ধবণিতা ভারতীয় বিমান বাহিনীর বােমাবর্ষণকে অভিনন্দিত করছিল। অপর এক যাত্রী গ্রিস দেশের নাগরিক শ্রী রােপলাম্ ইলিয়াস বলেন যে ঢাকার বাঙালিরা ভারতীয় বাহিনীকে স্বাগত জানাতে অস্থির হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ নাগরিক মি. হেনরি একদিলও একই অভিমত প্রকাশ করেন। সব বিদেশী যাত্রীই বলেছেন- গত ২ দিন ধরে ঢাকা মৃত নগরী। ঢাকায় এখন চাপা উত্তেজনা। ফরাসি ভদ্র মহিলাটি আরও জানান যে ভারত নয়, পাকিস্তানই একটি অনাথ আশ্রমের ৩০০ শিশুকে হত্যা করেছে।
পশ্চিম রণাঙ্গনে
আজ শিয়ালকোট রণাঙ্গনে এক যুদ্ধে অবিভক্ত পাঞ্জাবের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী সিকান্দার হায়াৎ খানের পৌত্র নবাব ইফতিকার হায়াৎ খান বন্দি হয়েছেন।
পশ্চিম রণাঙ্গনে আজ সর্বত্র লড়াই চলেছে। ছাষ ও নিকটবর্তী সামবাপাঠানকোট ও জম্মুখণ্ডে পাক সেনারা বেশি চাপ দিচ্ছে। এ দুটি এলাকায় ট্যাঙ্ক যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধে ভারতের ২টি এবং পাকিস্তানের ৭টি ট্যাঙ্ক খােয়া গেছে।
রাজস্থান সীমান্ত থেকে ১৫ মাইল দূরে নয়া চোর এলাকায় গত ৪ দিন ধরে যুদ্ধ চলছে। নয়া চোর থেকে মীরপুর খাস হয়ে সিন্ধুর হায়দরাবাদ দখলই ভারতীয় বাহিনীর লক্ষ্য। বরমার থেকে ৪০ মাইল দূরবর্তী মীরপুর খাস গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগ কেন্দ্র।
কারগিলে ভারতীয় বাহিনী ২২ টি ঘাটির মধ্যে ২০ টি ঘাঁটি দখল করেছে। পাঞ্জাবে গুরুদাসপুরে ২টি ঘাঁটি ভারতীয় সেনাদের দখলে এসেছে। একটি ঘাঁটি খেমকারান থেকে ৪ মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত। ফাজিলকায় ভারতীয় সৈন্য এই প্রথম আক্রমণ চালিয়ে ৩টি পাক ঘাঁটি রংগেওয়ালা, পেরােক ও ময়াজ্জাম দখল করেছে।
কচ্ছের রাণে ভারতীয় সৈন্যরা আজ ১৫০ বর্গ মাইল আয়তনের ছাদবেট দখল করে নিয়েছে। (৫ বছর আগে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী ভারতকে এই এলাকা পাকিস্তানকে দিতে হয়)। উরি খণ্ডে, অমৃতসর, উত্তরলাই, শ্রীনগর, পাঠানকোট, জামনগর ও ভুজে পাক বাহিনী হানা দিয়েছে, জামনগরে থিক্কা বন্দরে ১টি পাক বিমান ধ্বংস করা হয়েছে। আজ আরব সাগরে ভারত একটি ছােট ফ্রিগেট হারিয়েছে।
১৩ই ডিসেম্বর
আজ মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী ঢাকা শহরকে নাগপাশে বাধার জন্য আরও এগিয়ে গেছে। ঢাকা শহর এখন ভারতীয় গােলার আওতায় এসেছে। ভৈরব বাজার থেকে একদল সৈন্য নরসিংদি পেরিয়ে, আর একদল টাঙ্গাইল দখলের পর মীর্জাপুর হয়ে ঢাকার উত্তর পশ্চিমে জয়দেবপুরের পথে ঢাকার দিকে এগুচ্ছে। চাঁদপুর জয় করে ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনী এখন মেঘনা পার হয়ে দাউদকান্দিতে উপস্থিত হয়েছে। নরসিংদি, জয়দেবপুর ও দাউদকান্দি তিন দিক থেকে ভারতীয় বাহিনী ঢাকার দিকে ছুটে চলেছে সাথে আছে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা।
পাক জঙ্গী নেতারা ঢাকায় ভারতীয় বাহিনীকে বাধা দিতে বদ্ধপরিকর। শহরে কারফিউ চলছে। ভারতীয় সৈন্য ঢাকার কেন্দ্র থেকে ১১/১২ মাইল দূরে আছে। লড়াই এর ক্ষেত্র এখন প্রায় শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের উত্তর খণ্ডে হিলির দিকে ভারতীয় সেনারা পাঁচবিবি দখল করেছে। লক্ষ্মীপুর দখলের পর ভারতীয় সেনারা বগুড়ার শহরতলিতে পৌছে গেছে। ভারতীয় সেনারা ঈশ্বরদির কাছে পদ্মানদীর ওপর সারা সেতু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে। রংপুরের মহকুমা শহর নীলফামারী এখন ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনী ঘিরে ধরেছে। নীলফামারীর উত্তরে ডােমার মুক্ত হয়েছে। দিনাজপুর শহরের কাছে বিরলও মুক্ত হয়েছে।
ভারতীয় সেনারা চট্টগ্রামের পথে সীতাকুণ্ডের দক্ষিণে উপস্থিত হয়েছে। সীতাকুণ্ড চট্টগ্রামের উত্তর পশ্চিমে—২২ মাইল দূরে অবস্থিত।
পশ্চিম রণাঙ্গনে
ছাম্ব খণ্ড ব্যতীত পশ্চিম খণ্ডের যুদ্ধ পাক ভূখণ্ডেই হচ্ছে। ৬০০ মাইল দীর্ঘ আন্তর্জাতিক সীমা ও যুদ্ধ বিরতি রেখা বরাবর সমগ্র অঞ্চল ভারতীয় সেনাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। উরি-রাজৌরি-নৌসেরা খণ্ডে ভারতীয় সেনারা আরও কয়েকটা ছােট ছােট ঘাঁটি দখল করেছে। ছাম্ব এলাকা আজ অন্যদিনের তুলনায় শান্ত থমথমে শান্তভাব।
ভারতীয় সেনারা এখন মুনাওয়ার তাওয়াই নদীর পুব পারে আর পশ্চিম পারে আছে পাক সেনারা। পাঠান কোট খণ্ডে- পাঠানকোট সাম্বা এলাকায় ভারতীয় বাহিনী তৎপর হয়ে আছে। সাম্বা এলাকায় ৭টি ট্যাঙ্ক বিধ্বস্ত করা হয়েছে এবং ১টি ট্যাঙ্ক ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। জম্মু পাঠানকোট রাস্তা রক্ষা করার জন্য এবং ছাম্ব এলাকায় পাক বাহিনীর চাপ নিবারণের জন্য সাম্বা এলাকায় ভারতীয় বাহিনী হানা দিচ্ছে। অমৃতসর-ফিরােজপুর এলাকায় পাক বাহিনী শাহজরার ৩ মাইল দক্ষিণে ব্যর্থ আক্রমণ চালায়।
বারমার এলাকায় নয়াছছাড়ের ৬ মাইল দক্ষিণে পরভাত আলি আজ ভারতীয় বাহিনী দখলে এনেছে। নয়াছােড় দখলের জন্য তুমুল লড়াই চলছে। পাক বিমান জম্মুর অসামরিক এলাকায় আজ ২টি নাপাম বােমা ফেলেছে।
করাচির কাছে বাদিনে পাক রাডার ঘাটি আজ ভারতীয় বােমারু বিমান নষ্ট করে দিয়েছে এখানে ২টি পাক বিমান ধ্বংস হয়েছে। সিন্ধু এলাকায় কালহারে ২টি পাক স্যাবার জেট খােয়া গেছে।
কারগিল খণ্ডে আজ পর্যন্ত ভারতীয় সেনারা ২৩টি সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে। উরি খণ্ডে মিনি গলি ভারতের দখলে এসেছে। এর ফলে কাশ্মীরে অনুপ্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে গেল। পুঞ্চ এলাকায় হাজারা কোলি সড়ককে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে।
পাক বিমান হানায় আজ কিছুটা ভাটা পড়েছে। পাক বিমান ভারতীয় বিমান বহরের সঙ্গে যেন আকাশ যুদ্ধ পরিহার করতে চাইছে।
চট্টগ্রামকে পাক-ভারত উপমহাদেশের হংকং করা কি মার্কিন লক্ষ্য?
আণবিক শক্তি চালিত মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরের দিকে সম্ভাব্য অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী? জনৈক আমেরিকা প্রত্যাগত ভারতীয়ের অভিজ্ঞতালব্ধ অনুমান, চট্টগ্রামে কোনাে গােপন মার্কিন ঘাঁটি (আণবিক সাবমেরিন বেস?) থাকতে পারে যা রক্ষা করার জন্য তাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। ভারতপাক-বাংলাদেশ ঘটিত এই ডামাডােলের বাজারে ছলে বলে কৌশলে এই বন্দরটি হস্তগত করার মার্কিন প্রচেষ্টা নিতান্ত অসম্ভব নয়, যেহেতু এটা এশিয়াখণ্ডে রুশ-মার্কিন-চীনা রাজনৈতিক ভারসাম্যের উপর দারুণ প্রভাব বিস্তার করবে। এরূপ চেষ্টা অবশ্যই প্রচুর বাধা পাবে। প্রকৃত বিষয়টি ভবিষ্যতের গর্ভে নিহিত হলেও যখন সকলের নজর ঢাকার দিকে, তখন চট্টগ্রামের প্রতিও সতর্ক লক্ষ্য রাখা দরকার।