স্বাধীন বাংলার মুক্তিসংগ্রামে গেরিলা যুদ্ধের স্থান
প্রফুল্ল গুপ্ত
“আমরা কুকুর বেড়ালের মতাে মরবাে না, বাংলা মায়ের সুযােগ্য সন্তানের মতাে লড়াই করেই মরতে চাই” কথাগুলাে বলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আপােষহীন জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবর রহমান। তিনি গত ২৫ শে মার্চ থেকে সারা পূর্ববাংলার কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী সকল অংশকে ঐক্যবদ্ধ করে এক ঐতিহাসিক সগ্রাম আরম্ভ করেছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী এই যুদ্ধকে বলেছে গৃহযুদ্ধ, বলেছে বিচ্ছিন্নতাকামী মানুষের সামরিক বিস্ফোরণ। কিন্তু আসলে তা নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারী জঙ্গীতন্ত্রের শােষণ আর অপশাসনে জর্জরিত বাংলাদেশের মুক্তিকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষ চেয়েছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের একচেটিয়া পুঁজিপতি আমলাতন্ত্র এবং সমর চক্রের মিলিত শােষণের হাত থেকে মুক্তি। চেয়েছেন গণতন্ত্র। শুধুমাত্র এই অপরাধে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ওপরে নেমে এসেছে সমর নায়ক ইয়াহিয়ার ফ্যাসিস্ট বর্বরতা। লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোেদ্ধাদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে স্বাধীন বাংলার শহর এবং মাঠ-ঘাট।
সংগ্রামের প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের যারা নায়ক, তারা ভেবেছিলেন জনস্রোতের প্লাবন দিয়ে ওরা জঙ্গী শাহীকে ভাসিয়ে দেবেন। সুতরাং নিরস্ত্র মানুষ হাজারে হাজারে, লাখে লাখে এগিয়ে গিয়েছেন ট্যাঙ্ক, মেসিনগান, মর্টার প্রভৃতির সামনে। মাত্র একমাসের অসমান এবং অঘােষিত যুদ্ধে সেইজন্য। নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সশস্ত্র প্রতিরােধ বলতে মুক্তি সম্রামের পক্ষে ছিলেন ই, পি, আর, বাহিনীর যােদ্ধারা, কিছু আন্সার বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসৈন্য ও পুলিশ। কিন্তু তারা সম্মুখ যুদ্ধ (Pitched Battle and Frontal attack), স্থিতিযুদ্ধ (Positional war ); Flanks বা পার্শ্বদেশ রক্ষা করার জন্য সাজ সরঞ্জামসহ শত্রুর মুখােমুখী ঘাঁটি গাড়ার প্রবণতা এবং “সূচীভেদনীতি” সামরিক ভাষায় যাকে বলা হয়। tactics of deep infiltration কৌশলগুলাের ওপরে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, ভারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত পাক ফৌজের কাছে তারাও অনেক ক্ষেত্রে পর্যদস্ত হয়েছেন এবং প্রচুর প্রাণহানি হয়েছে। কিন্তু এখন তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যেমন সুসংগঠিত হয়ে দীর্ঘস্থায়ী সগ্রামের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, তেমনি, গেরিলা যুদ্ধের নীতি ও কৌশলগুলাে আয়ত্ত করতে চেষ্টা করছেন। সুতরাং গেরিলাযুদ্ধের নীতি এবং কৌশল নিয়ে আলােচনা করা হয়তাে এ সময়ে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
অখণ্ড ভারতবর্ষে গেরিলাযুদ্ধ তাে দূরের কথা ব্যাপকভাবে সশস্ত্র সগ্রাম একমাত্র সিপাহী বিদ্রোহ ছাড়া সুদীর্ঘ ইংরেজ রাজত্বে হয়নি বললে হয়তাে একেবারে ভুল বলা হবে না। যা হয়েছে, তা হচ্ছে; মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অহিংস-অসহযােগ আন্দোলন এবং তার পাশে সন্ত্রাসবাদ আন্দোলন। সেইদিক থেকে হয়তাে বলা চলে বাংলাদেশের মাটিতে সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস এই প্রথম রচিত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, পূর্ব বাংলার মতাে সমতল জায়গায়, যেখানে পাহাড় পর্বত বা দুর্ভেদ্য অরণ্য সামান্যই আছে, সেখানে কি গেরিলা যুদ্ধ চালাননা সম্ভব? গেরিলা যুদ্ধের নীতি এবং কৌশল বলছে যে, হ্যা সম্ভব। গেরিলা যুদ্ধের জন্য পাহাড় এবং জঙ্গল প্রশস্ত হলে ও সমতল ক্ষেত্রে তা হতে পারে। এ যুদ্ধের রণকৌশল হচ্ছে Hit and run আচমকা আঘাত হাননা, তারপর চুপ করে যাও, আবার আচমকা প্রবল আঘাত হাননা, এই ভাবে শত্রু সৈন্য বিধ্বস্ত করে তার অস্ত্র সম্ভার কেড়ে নাও। এইভাবে কাজ করে, যখন যথেষ্ট মানুষ এবং অস্ত্র আসবে, তখন একটা অঞ্চল অধিকার করে নাও। তারপর লড়াই চালিয়ে যাও
গেরিলা উপায়ে অধিকৃত অঞ্চল রক্ষার জন্য এবং মুক্ত অঞ্চল বাড়াবার জন্য। আঞ্চলিক ক্ষমতা দখল করলে সে অঞ্চলের সমস্ত দায়িত্বও গেরিলাদের