যদি যুদ্ধ বাঁধে তাহলে পাকিস্তান কতদিন লড়তে পারে
প্রফুল্ল গুপ্ত
ভারতবর্ষের পূর্বে ও পশ্চিমে দুই দেশের সীমান্তেই পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সমাবেশ ঘটেছে। কামান, বন্দুক, ট্যাঙ্ক, প্লেন, বিমান বিধ্বংসী কামান প্রভৃতি আধুনিক যুদ্ধের সাজসরঞ্জামগুলােও পাক-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় সুসজ্জিত করা হয়েছে। কাশ্মীর থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে গুপ্তচর, পঞ্চমবাহিনী ও নাশকতামূলক কাজের এজেন্টরাও বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পশ্চিম ভারতের পাঞ্জাব, রাজস্থান সীমানায় এবং পূর্ব ভারতের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায়, ত্রিপুরা ও শ্রীহট্ট সীমানায় এক কথায় পাক-ভারত সীমানার হাজার হাজার মাইল দীর্ঘ পথের সম্ভাব্য সমস্ত জায়গাতেই অস্ত্র ও সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছে। প্রতিদিন এই দীর্ঘ সীমান্তের যত্র-তত্র পাক ফৌজ বিনা কারণে এবং প্ররােচনায় ভারতীয় সীমান্তে গােলাগুলি বর্ষণ করছে। তাতে আজ পর্যন্ত প্রচুর অসামরিক ভারতীয় জনসাধারণ নিহত হয়েছে। দুদিকেই ব্ল্যাক আউটের ও অসামরিক প্রতিরক্ষার মহড়া আরম্ভ হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী সকলেই বলেছেন যে কোনাে মুহূর্তে ভারত আক্রান্ত হতে পারে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও তার তিন সপ্তাহের ইউরােপ এবং আমেরিকা সফর শেষ করে দেশে ফিরে এলেন। ইয়াহিয়ার ওপরে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন বলে শ্রীমতী গান্ধীর যে ধারণা ছিল সম্ভবত সেই ভ্রান্ত ধারণারও হয়তাে অবসান হয়েছে। সুতরাং এখন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধটা হয়তাে আর কল্পনা-প্রসূত নাও হতে পারে। অতএব মােটামুটি একটা বিচার করে দেখা যেতে পারে যে, যুদ্ধ যদি লাগে তাহলে পাকিস্তান কতদিন লড়তে পারে?
কিন্তু এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পেতে হলে দুই দেশের শক্তি সামর্থের একটা তুলনামূলক বাস্তব চিত্রের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। কারণ রণপণ্ডিতেরা বলে থাকেন যে, আধুনিক যুদ্ধে Material Strength যার যত বেশি, শেষ পর্যন্ত সেই দেশই দীর্ঘস্থায়ী সম্রামে টিকে থাকতে পারে। দুর্বল দেশ কখনও আগ বাড়িয়ে যুদ্ধের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে চায় না “No country goes to war because it is poor, no country goes to war because it is weak and unhappy. A country goes to war because it is full of vigour, because it has a great mass of unemployed people, because it has materials in hand.”
এখন তুলনামূলকভাবে পাকিস্তান এবং ভারতরাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেই বােঝা যাবে যে যুদ্ধে পাকিস্তান কতদিন টিকে থাকতে পারে।
সম্প্রতি পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন, ভারতবর্ষ পাকিস্তানের পাঁচ গুণ। কিন্তু শুধু কি ভৌগলিক এবং জনসংখ্যার দিক থেকেই ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বড়? একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে ভারতবর্ষ সব দিক থেকেই পাকিস্তানের চেয়ে বড় এবং শক্তিশালী। পূর্ববঙ্গ সমেত সমগ্র পাকিস্তানের বছরে খাদ্য উৎপাদনের যে হিসাব পাওয়া গিয়াছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, পাকিস্তান বছরে যেখানে ১৭ মিলিয়ন টন খাদ্য উৎপাদন করে, ভারত সে ক্ষেত্রে করে ৮৫ মিলিয়ন টন। রপ্তানি বাণিজ্যের দ্বারা পাকিস্তান যেখানে বছরে ২০৩ কোটি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে, সেখানে ভারত কম করেও পারে ৮৩০ কোটি টাকা। কিন্তু পূর্ববাংলার কৃষি এবং উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় এখন তার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার ক্ষমতা অর্ধেক হয়ে গিয়াছে। বিদেশের বাজার থেকে সামরিক এবং অসামরিক দ্রব্য ক্রয়ের ক্ষমতা পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের অনেক বেশি। আমেরিকা ইংলন্ড প্রভৃতি পাশ্চাত্য দেশগুলাে যদি পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়, সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার কাছ থেকেও ভারতবর্ষ সাহায্য পাবে। ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও ইরান পাকিস্তানকে অস্ত্র-শস্ত্র দিয়ে বিশেষ কিছু সাহায্য দিতে পারে না, একমাত্র তেল দিয়ে হয়তাে কিছু সাহায্য দিতে পারে। কিন্তু অপর্যাপ্ত তেল তারা পাকিস্তানকে খয়রাতি করতে পারে বলে তাে মনে হয় না। পাকিস্তানকে সাহায্য করার ক্ষমতা চীনের আছে, কিন্তু সম্প্রতি মি. ভূট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের আলােচনায় পাকিস্তান বিশেষ সুবিধা করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধলে চীন পাকিস্তানকে সর্বতােভাবে সাহায্য করবে তেমন প্রতিশ্রুতি দিতে চীন রাজী হয়নি।
পাকিস্তানের জনসাধারণ ভারতের চেয়ে দরিদ্র। ভারতের চাষিদের মাথা পিছু চাষ যােগ্য জমি যেখানে ০.৩৪ হেক্টর, পাকিস্তানের সেখানে ০.২৯ হেক্টর। সুতরাং অপেক্ষাকৃত দরিদ্র জনসাধারণের ত্যাগ স্বীকারের ক্ষমতাও কম হতে বাধ্য। সারা ভারত যােগাযােগ ব্যবস্থায় স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা চলে। কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ব্যবধান ১,০০০ মাইল; তাও যদি ভারতের ওপর দিয়ে যেতে দেওয়া হয়। তা না হলে সমুদ্র পথে আড়াই হাজার মাইলেরও বেশি অতিক্রম করে তবে দুই পাকিস্তানের মধ্যে যােগাযােগ রাখতে হবে। পাকিস্তানের অস্ত্রশস্ত্র সবই ধার করা। একবার নষ্ট হয়ে গেলে আর কিছু করার থাকে না, এমনকি মেরামত করার ক্ষমতা পর্যন্ত তার নেই। গড়ে বছরে ২১,০০০ জন ছাত্র যেখানে ভারতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়, সেখানে পাকিস্তানে ভর্তি হয় মাত্র ১,৩৩০ জন। সিভিল ও মেকানিকাল ছাড়া অন্যান্য জটিলতর ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পাকিস্তানে শিক্ষাদানের কোনাে ব্যবস্থা নাই। পাকিস্তানে আছে মােট ১৫,০০০ জন ডাক্তার, ৩৩,০০০ হাসপাতাল বেড় ও ৩,২০০ নার্স; সে ক্ষেত্রে ভারতে আছে ৭৭,৮৮০০ ডাক্তার, ২০,২০০ হাসপাতাল বেড় এবং ৩২,২০০ নার্স। ডাক্তার, হাসপাতাল এবং নার্সের সংখ্যা ভারতে ক্রমবর্ধমান। ভারতে ৬০ লক্ষ টন ইস্পাত বছরে উৎপন্ন হয়, পাকিস্তানে হয় ১২ হাজার টন মাত্র। ভারতে সােডা এ্যাস ও সালফিউরিক এ্যাসিড উৎপন্ন হয় বছরে ২,৬৭,০০০ এবং ৫,৬৮,০০০ টন, কিন্তু পাকিস্তানে হয় মাত্র ৩২,০০০ এবং ১৯,০০০ টন। ভারতে ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি, বৈদ্যুতিক এবং মেশিন টুল উৎপাদিত হয় প্রচুর পরিমাণে, পাকিস্তানে সে সবের কোনাে বালাই নেই। ফলে ভারত ট্যাঙ্ক, বন্দুক, সামরিক যানবাহন, বিমান, গােলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র প্রয়ােজন মতাে উৎপাদন করতে পারে কিন্তু পাকিস্তান তার কোনােটাই পারে না। এক কথায় বলা যেতে পারে যে পাকিস্তানের কোনাে শিল্পভিত্তি তাে নেই-ই উপরন্তু কয়লার জন্যও তাকে অপরের ওপরে নির্ভর করে থাকতে হয়। বর্তমানে পাকিস্তানকে চীন থেকে কয়লা আনতে হচ্ছে; কিন্তু নিয়মিতভাবে চীন থেকে কয়লা নিয়ে আসা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
কিন্তু তবু পাকিস্তান যুদ্ধ চায় কিসের জোরে? সংবাদপত্রে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আস্কারা এবং সামরিক কর্তাদের উস্কানিই পাকিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উৎসাহ যােগাচ্ছে। সাত মাস পার হতে চলেছে; কিন্তু পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলাে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে এগিয়ে তাে আসেইনি বরং সমাধানকে আরও জটিল করে তুলছে। অবস্থা এখন অগ্নিগর্ভ। সুতরাং অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে, ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ অনিবার্য। আর এই অনিবার্য সংঘর্ষের মুখে পাকিস্তান সত্যই বিপন্ন।
হবে জয়, হবে জয় রে
সুদিন ভট্টাচার্য্য
ইস্রায়েলী ঢঙেই শেষ পর্যন্ত শুরু করলেন খাঁ সাহেব। কিন্তু না, হলাে না, ফসকে গেল। পাকিস্তানি বিমান গুলাে ঝাঁকে ঝাঁকে ঝাঁপিয়ে পড়লাে পাঠানকোট, অমৃতসর, শ্রীনগর প্রভৃতি ভারতের অগ্রবর্তী বিমান ঘাটিগুলাের উপরে ৩রা ডিসেম্বর সন্ধ্যার ঠিক আগে—তখন শ্রীমতী গান্ধী ব্রিগেড প্যারেড মাঠে জনসমুদ্রের সম্মুখে বক্তৃতা দিচ্ছেন কিন্তু ইয়াহিয়া যা আশা করেছিলেন তা ঘটলাে না। একটিও ভারতীয় বিমান অপেক্ষা করছিল না রানওয়ের ডগাতে। রানওয়ের বাঁধানাে মেঝেতে কতকগুলাে ৩০ মিলিমিটার শেলের গর্ত এবং রকেটের বিস্ফোরণ ছাড়া কোনাে লাভই হল না। সময়টা এমন যে ভারতীয় বিমানগুলাে শক্ৰবিমানের পশ্চাদ্ধাবন করার সময়ও পেল না কারণ আমাদের তেমন ভালাে নাইট ফাইটার নেই। আর এই তড়িগতির যুগে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মতাে “ডগফাইট”ও বড় একটা হয় না। তাই সে যাত্রা বেঁচে গেল PAF। কিন্তু পরের দিনের মারটা তােলা রইল। ভারতীয় মিগ-ন্যাট-সুখয়ের মারের চোটে এবং রুশ গাইডলাইন মিসাইল ও ভারতে তৈরি বিমান মারা কামানের গােলায় ৫/৬ খানা মিশর জয়ী মীরাজ বিমানসহ মােট ৭৫ খানা পাক বিমান ঘায়েল হ’ল এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে। London I.S.S এর পুস্তিকার পাতা থেকে মুছে দেওয়া হলাে পাকিস্তান বিমান বহরের বিমান সংখ্যা একেবারে ২৭৫ থেকে ২০০। মার তাে এই সবে শুরু। ভারতও হারিয়েছে ৩০/৩৫ খানা জঙ্গী বিমান। ১৯৬৫ সালের ইতিহাস যারা পড়েছেন তারা বলবেন একবাক্যে যে ভারতের দাবী শেষ পর্যন্ত ৮০ ভাগের বেশি ঠিক বলে প্রমাণিত হয়। আর পাক রেডিওর দাবীকে ৫ দিয়ে ভাগ করলে তবে ঠিক সংখ্যাটা পাওয়া যায় (ভারতের ক্ষতির পরিমাণটা) কী বিমান, কী ট্যাঙ্ক, কী রণতরী।
এবারের যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দাবী করতে পারেন ভারতীয় নৌবহর। ১৯৬৫ সালে আমাদের নৌবহরের ভূমিকা ছিল নগণ্য। কিন্তু এবারে ৫/৬ খানা রুশ “মিসাইল বােট” সমগ্র চিত্র একেবারে বদলে দিয়েছে। Styx মিসাইলের ভয়ে পাক নৌবহর করাচী বন্দরের এক কোণে জড়সড়। সেখানেও নিস্তার নেই। ভারতীয় বােমারুদের সেখানে নিত্য আনাগােনা। বঙ্গোপসাগর এখন একটি ভারতীয় ডােবাতে রূপান্তরিত হয়েছে। চট্টগ্রামের অদূরে পাক বিমানহীন পূর্ব বাংলার রণক্ষেত্রের নিকটে থেকে ভারতীয় বিমানবাহী জাহাজ “বিক্রান্ত” তার “ হ্যালিজ” এবং “সীহক” বিমানের সাহায্যে পূর্ব বাংলাকে বাকী পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সম্ভবত “বিক্রান্তের প্রতি কোনাে অনুচিত মনােভাব থাকার অপরাধে পাকিস্ত নের তিনখানি ফরাসী দফে জাতীয় ছােট আকারের সাবমেরিনের একটি বঙ্গোপসাগরের তলায় চিরতরে সলিল সমাধি লাভ করেছে ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজের মারের ফলে। রেডার এর পর্দা থেকে মুছে গেছে ছােট্ট একটা “Blip”। বিশাখা পতনমের অদূরে ধ্বংস হয়েছে আর একখানি পাক সাবমেরিনও।*
স্থল যুদ্ধ চলছে, চলবে। কিন্তু পূর্বখণ্ডে বােধহয় আর বেশিদিন নয়। যশােহর, কুমিল্লা, লাকসাম, শ্রীহট্ট জয়ের পর ভারতীয় ও মুক্তি সেনারা এখন ঢাকার চারিদিকে এসে জড়াে হয়েছে। পূর্ব বাংলায় ৭০ হাজার পাক ফৌজের সরবরাহ পথ বন্ধ, পালাবারও পথ নেই। ভূট্টো ছুটেছেন নিউইয়র্কে। এদের মুক্তির জন্য মার্কিন সাহায্য চাইতে কি? মানেশ বলেছেন আত্মসমর্পণ কর, নতুবা মরবে।
কিন্তু পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তান খুবই শক্তিমান। ভারতের সঙ্গে অন্তত ২/৩ সপ্তাহ সমানে সমানে তারা লড়তে পারবে বলে মনে হয়। জয় পরাজয় স্থান বিশেষে – ১৯৬৫ সালের মতােই প্রথমটা উভয় পক্ষেরই হবে। এই অঞ্চলে পাকিস্তানের সমরযন্ত্র ভেঙে পড়বে বেশ কিছুদিন পরে। প্রথমে ওদের ফুরিয়ে যাবে কামানগুলাের গােলা। তার পরে বিমান ও ট্যাঙ্কের যন্ত্রাংশ এবং শেষ পর্যন্ত তেলের সরবরাহ। সাধারণত কোনাে ট্যাঙ্ক যুদ্ধের পরে “বিধ্বস্ত” ট্যাঙ্কগুলাের অন্তত অর্ধেক ২/৪ দিনের মধ্যে আবার চালু করা যায় যদি যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় এবং ভাঙা ট্যাঙ্কগুলাে যদি নিজেদের জমিতেই থাকে। এবারে ভারতের এদিক থেকে একটা সুবিধা এই যে বেশির ভাগ পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক এবারে T-59 ও T-54 এবং ভারতের ওই একই ট্যাঙ্ক প্রায় অর্ধেক। কাজেই ভাঙা পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক ভারত সারিয়ে নিজেদের কাজে লাগাতে পারবে যদি পাক ফৌজকে ভারত ২/৪ মাইল হটিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু পশ্চিম রণাঙ্গনে প্রথম সপ্তাহের যুদ্ধে ভারত তার ট্যাঙ্কগুলােকে ব্যাপক ভাবে আক্রমণের জন্য ব্যবহার করেনি। কিন্তু পাকিস্তান করেছে এবং মারও খেয়েছে ছাষে এবং বারমেরে। দুপক্ষই অপেক্ষা করছে কে আগে আক্রমণ করে দেখবার জন্য। যেই আক্রমণ করুক না কেন ট্যাঙ্ক মারা মিসাইল উভয় পক্ষেরই আছে পাকিস্তানের জার্মান কোবরা মিসাইল এবং ভারতের ফরাসি এবং দেশী মিসাইল। সুতরাং ১৯৬৫ সালে খেমকরণের ঢঙে এক সঙ্গে বহু ট্যাঙ্ক নিয়ােগ করবার ইচ্ছা এবারে কারুর আছে বলে মনে হয় না।
________________
* ৯ই ডিসেম্বর শ্রীজগজীবনরাম পার্লামেন্টে বলেন যে গত সপ্তাহের শেষে বিশাখাপতনমের অদূরে আর একখানি পাক সাবমেরিন ভারতীয় ফ্রিগেটের ডেপথ চার্জের আঘাতে ডুবে যায়। তিনজন মৃত পাক নাবিকের পােশাকাদি থেকে জানা যায় যে ঐ সাবমেরিন হ’ল আমাদের পূর্ব পরিচিত “গাজী”। এটি খুব বড় দূর পাল্লার প্রাক্তন মার্কিন ডুবােজাহাজ এবং এতে ১৮ জন নাবিক ছিল। সুতরাং আগের রিপাের্ট যে বঙ্গোপসাগরে একখানি ফরাসিদের তৈরি দর্ষে জাতীয় সাবমেরিন ডুবেছে তা আর এখন বহাল রইল কি না বলা যায় না। কারণ দর্ষে জাতীয় ডুবােজাহাজ ছােট আকারের এবং করাচি থেকে তা বঙ্গোপসাগরে হানা দেওয়ার সামর্থ রাখে কি না সন্দেহ। অবশ্য চট্টগ্রামের কাছে হয়ত তেল নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পাকিস্তানের এখন বাকী রইল ২ খানা দ েজাতের সাবমেরিন।
________________
পশ্চিম খণ্ডে এবারেও ১৯৬৫ সালের মতাে ভারতীয় বাহিনী রাজস্থানের গাদরা রােড থেকে এগিয়ে পাকিস্তানের গাদরা শহর দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এই মরুভূমির পথে অল্পদূরে অবস্থিত করাচিতে পৌঁছানাে সম্ভব কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। করাচি অথবা পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদে ভারতীয় জওয়ানরা যদি পৌছাতে পারে তবে বহির্জগতের সঙ্গে সমগ্র পাঞ্জাব কাশ্মীরের যােগাযােগ প্রায় ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। এর ফলে পাকিস্তানের সমরযন্ত্র অচল হয়ে পড়বে।
মাত্র এক সপ্তাহের যে যুদ্ধের বিবরণ উপরে দেওয়া হলাে তার মধ্যে কতকগুলাে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এই প্রশ্নগুলাের উত্তর যুদ্ধ শেষ হলে ভারত সরকারকে পার্লামেন্টে অবশ্যই দিতে হবে। প্রথমত বিগত ৬ বছরে ছাম্ব অঞ্চলের মুনােয়ার তরাই নদীর উপরে ভারী ট্যাঙ্ক চলাচলের মতাে একটা সেতু তৈরি করা সম্ভব হ’ল না কেন? জগজীবনরাম বারংবার বলা সত্ত্বেও ভারতের একটুখানি জমিতেও তাে লড়াই হচ্ছে। দ্বিতীয়ত। পাকিস্তান ভারত আক্রমণের পরে পুরাে এক সপ্তাহ ভারত কেবল আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করল কেন পাঞ্জাব সীমান্তে? এবারে তাে ইছােগিল খালে গিয়ে আটকে যাওয়ার কথা নয় কারণ যথেষ্ট সংখ্যক উভচর ট্যাঙ্ক এখন আমাদের রয়েছে। তৃতীয়ত ভারতীয় বাহিনীর শহরগুলােকে এড়িয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা কি জয়লাভের পথকে সুগম করবে? চতুর্থত আমাদের আকাশে রাত্রিকালে শত্রুবিমানকে প্রতিরােধ করার জন্য ভালাে মানের “নাইট ফাইটারের ব্যবস্থা নেই কেন? প্রতিদিনই সন্ধ্যায় বা শেষরাত্রে পাকিস্তানি মীরাজ বা মীগ ১৯ ভারতের মধ্যে দিল্লী-আগ্রা পর্যন্ত প্রবেশ করে নিরাপদে ফিরে গেছে। এমন কি রাত্রে অতি মন্থরগতি (৬০০ মাঃ ঘঃ) B 57 বােমারুও আমাদের বিমান ঘাঁটিগুলাের উপরে মাঝে মাঝে বােমা ফেলেছে। ১৯৬২ সালের পরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে বটে কিন্তু তবুও বহু ফাক আজও রয়ে গেছে। এই ফাঁকগুলাে খুব শীঘ্র বন্ধ করে দেওয়া দরকার।
সংবাদপত্রে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখলাম যে সৌদি আরব থেকে পাকিস্তান ২ স্কোয়াড্রেন যুদ্ধ বিমান পাচ্ছে। খবরটা সত্য হলে ভারতের উচিত হবে সৌদি আরবের বড় বড় তৈল শােধনাগারগুলােতে রাত্রি বেলা ক্যানবেরা বম্বার পাঠিয়ে হানা দেওয়া। এর ফলে আমেরিকার শত্রুতারও জবাব দেওয়া হবে। কারণ ঐ শশাধনাগারগুলাে মার্কিন ধনবাদের টাকাতেই গড়ে উঠেছে। ঐ কারবারের লাভের টাকাই ধার হিসেবে পাকিস্তানকে দিয়েছিল সৌদি আরব যে টাকায় ফ্রান্স থেকে শতাধিক কোটি টাকায় মীরাজ বিমান বহর ক্রয় করে পাকিস্তান আগ্রার আকাশে পর্যন্ত হানা দিচ্ছে। কিন্তু খবরটা সত্য নাও হতে পারে। কারণ সৌদি আরবের খান ২০ ব্রিটিশ “লাইটনিং” বিমান আছে বলে জানা যায়। ২ স্কোয়াড্রন স্যাবার কোথা থেকে এল তা আন্দাজ করা কষ্টকর নয়। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে পাকিস্তানের বন্ধু অনেক; তবে সামরিক দিক থেকে প্রায় সবগুলােই টোড়া এই যা ভরসা।
সূত্র: কম্পাস, ১৮ই ডিসেম্বর ১৯৭১