বাংলাদেশে সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলােতে (৪)
শকুন্তল সেন
ঘুম আসছে না, আসবার কথাও নয়। একটু ঝিমুনি আসে আর মেশিনগানের কর্কশ গুলি, গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে লাফিয়ে উঠি। মিলিটারির চাইতে বেশি জ্বালাচ্ছে আমায় আরশােলা আর নেংটি ইদুরগুলাে। এ গুলাের ইয়াহিয়ার সৈন্য বাহিনীর মতাে কোনােই কাণ্ডজ্ঞান নেই। ২৪ ঘণ্টা পার হয়েছে। একটা কাঁচা গােলআলু ছাড়া আর কিছুই পেটে যায়নি! এই অন্ধকারেও ঢাকার আকাশ লাল! আমাদের এখানে কালীপূজার রাতে যেমন হয়। পার্থক্য উৎসবের আলাে আর চিতার আগুন। সেই একনাগাড়ে মেশিনগানের শব্দ। গত কালের মতাে আজ আর ট্রাক আসছে না। মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়াই। আবার ভয় হয় হঠাৎ যদি একটা গুলি এসে লাগে! যদি একটা গ্রেনেড এই বাড়িটায় এসে পড়ে তাহলে একেবারে বেহেস্তে!
আধাে ঘুম আধাে জাগরণে আর একটি অভিশপ্ত রাত কাটিয়ে দিলাম। ঘুম ভাঙল পােড়া কটু গন্ধ আর গুলির আওয়াজে। আজ ২৭ শে মার্চ। আমার সম্বল মাত্র দুটি কাঁচা আলু! মুখ হাত ধুয়ে উঠে চারদিক দেখলাম। আমাদের সামনের রাস্তায় মিলিটারি পাহারা। চারজন! মৃতদেহগুলাে পচতে শুরু করেছে। দুর্গন্ধ। সদা কর্মচঞ্চল সদর ঘাট, পাটুয়াটুলি, নবাবপুর রােড এই বিস্তৃত অঞ্চল প্রাণহীন। আমি অপলক দৃষ্টিতে ওই চারজনের দিকে তাকিয়ে আছি—ওরা ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। আমি ওদের দেখতে পাচ্ছি। ওরা আমায় দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে পেলে কৈফিয়ৎ দেবার মতাে সুযােগ দেবে কি! একে বিদেশী-পাসপোের্ট নেই, তার উপর হিন্দু। সঙ্গে রেকর্ড দুটি আর কত কাগজ পত্র। হত্যা করার পর পাক রেডিও সগর্বে প্রচার করত, “বহু নথিপত্রসহ হিন্দুস্থানের স্পাই সামরিক বাহিনীর গুলিতে নিহত।” মিথ্যা-উদ্ভট প্রচারে ওরা গােয়েবলসকে হার মানাতে পারে। তবে গােয়েবলস্-এর রাজনৈতিক কিঞ্চিৎ জ্ঞান ছিল এদের তা একেবারেই নেই!
বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ ওই চারজন তাে চলে গেল, আরও কয়েক ট্রাক যারা এদিকে ছিল চলে গেল। এখানে থেকে কিই বা করবে। হত্যা করবার, ধ্বংস করবার মতাে অবশিষ্ট আর কিছু আছে কি! বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওই অন্ধকূপ থেকে বেরােলাম। এখন গুলির শব্দ, মিলিটারির আনাগােনা টের পাচ্ছি না। আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে দোতলায় আসি। রক্তের দাগ সব মুছে যায় নি। আমার ঘরটার অবস্থা অত্যন্ত শােচনীয়। মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে! এদিক ওদিক ঘুরে আবার নিচে নেমে এলাম। কেউ নেই হয় খতম নয় তাে পালিয়েছে। বাইরের বন্ধ দরজা দিয়ে উঁকি দিই! নাঃ দোকানগুলাে শেষ। কেউ বেঁচে নেই! ঘুরে আবার আমার ওই আশ্রয়ের দিকে ফিরে আসছি—ভূত দেখার মতাে চমকে উঠলাম! নােংরা কাদা ময়লা মাখা একটা মূর্তি- টলছে। আমি বিমুঢ় হতবাক! এ আবার কে?
ফিস ফিস করে সাব আপনি?” আরে এ যে হােসেন অর্থাৎ সেই চাকরটা! এ কোথায় ছিল। আমি স্তম্ভিত!
“তুমি” আমার গলা থেকে বেরিয়ে আসে! তারপর, ওই কাদা নাংরা মাখা ওকেই জড়িয়ে ধরি। সব ভুলে গেলাম। দুজনেই কাঁদতে থাকি! এই বিরাট বাড়িটায় আমরা দুই হতভাগ্য শুধু বেঁচে আছি। শুনলাম ও নােংরা নালার মধ্যে এতক্ষণ কাটিয়ে দিয়েছে। একটু পরে ওকে ছেড়ে দিলাম। কোনও শব্দ না করে খুব তাড়াতাড়ি পানি দিয়ে গােসল করে নেয়। এরপর দুজনে ভাবতে বসি, কি করা! ও বার বার তাগাদা দেয়, ‘চলেন ওপারে চলে যাই।’
“হ্যা ওপারে চলে যেতে গিয়ে একেবারেই ওপারে চলে যাবে। একটু অপেক্ষা করে ওকে বললাম “তুমি থাক, আমি নবাবপুর রােড-এর ওদিকটা ঘুরে আসি।’ ‘কি সর্বনাশ-ওদিকে গেলে আর বাঁচতে পারবেন না। “তুমি বাইরে যাবার রাস্তা দেখিয়ে দাও।” গম্ভীর ভাবে বলি।
ভাঙা পাঁচিল নর্দমা পেরিয়ে সেই ভাঙা মােটর গাড়িগুলাের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসি। দুর্গন্ধে টেকা দায়! পা ফেলা যায় না। ওকে বলে গেলাম, আমি না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। গলি দিয়ে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড পর্যন্ত এসেছি। একটি লােকও চোখে পড়ল না পােড়া ঘর বাড়ি, অসংখ্য মৃতদেহ। সব বয়সের, সব জাতের স্ত্রী-পুরুষ! আবার ফিরে এলাম। সেই অন্ধকূপে এবার দুজন। বেলা প্রায় বারােটা বাজে। ওই কাঁচা আলু দুটি খেলাম দুজনে। মাঝে মাঝে উঠি, দেখি! ওর সঙ্গে পরামর্শ করি। নদী পেরিয়ে ওপারে গেলে আর ভয়ের কিছু নেই—ও আমায় ভরসা দেয়।
বেলা একটা থেকে ছােট ছােট দলে লোেক আসতে দেখলাম, সব ওয়াইজ ঘাট বা তার কাছাকাছি কোথাও যাচ্ছে! নদী পেরুবে। সব বেটা ছেলে। ক্রমশ ভিড় বাড়তে লাগল! নাঃ কোনও গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। আস্তে আস্তে বলতে বলতে যাচ্ছে “নাই, ই. পি. আর, ই. বি. আর শেষ সময়ে খুব লড়াই করল বটে সৈন্যদের সঙ্গে।” “ইস রমনা কালিবাড়িটা শেষ। ইকবাল হল, জগন্নাথ হলের খুব ক্ষতি হয়েছে। একটা, দুটো-। আমি দেখি, শুনি আর ভাবি।
প্রায় তিনটে নাগাদ পাঁচ জনের ছােট একটি দল। তিনটি মহিলা, একটি অল্প বয়সের শিশু আর এক ভদ্রলােক। প্রত্যেকের হাতে ছােট ছােট ব্যাগ। ক্লান্ত অবসন্ন দৃষ্টি। ভয়ে ভয়ে চারিদিক তাকাতে তাকাতে আসছে। এদের সঙ্গেই যেতে হবে কেন ভেবেছিলাম তা জানি না। তবে আজ মনে হচ্ছে ভুল করিনি। আমরা দুজনে গ্যারেজের ওখানে চুপ করে বসে আছি-ওরা আসতেই আমরা উঠে দাঁড়ালাম। আমাদের দেখে আতঙ্কে ভয়ে ওদের মুখ সাদা হয়ে গেল! হয়ত ভাবল আমরা গুণ্ডা বা অন্য কিছু।
কয়েক মুহূর্ত কেউই কথা বলি না! আমি নীরবতা ভঙ্গ করে বলি: “আমি শিক্ষক। এই বাড়িটায় আমরা আটকে পড়েছিলাম। এ আমার চাকর। আপনাদের ভয় নেই। আমরা ওপারে যাবাে। আপনাদের সঙ্গে গেলে আপত্তি আছে?”
দ্রলােক আমার হাত দুটি জড়িয়ে ধরলেন। চোখ দিয়ে তার জল পড়ছে! শুনলাম আইনজীবী। সঙ্গে মা, স্ত্রী, বােন আর বাচ্চা। বােন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। কিভাবে বেঁচে আছেন এখনও বুঝতে পারছেন না! ইখান থেকে ঘাট পর্যন্ত আসতে ৫ মি: থেকে ৭ মি: লাগে, সেখানে আমাদের প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগল। খুব সাবধানে সন্তর্পণে এগুচ্ছি। কানে আসছে -‘গতকাল আজ সকালে সৈন্যরা নদীতে গুলি করে যাত্রীসহ নৌকা খতম করেছে। বাড়িগুলাে খা খা করছে—মৃত দেহের স্তুপ দুর্গন্ধ।
নৌকায় উঠলাম। বুড়াে মাঝি বলল “সকলে মাথা নিচু করে বসেন।” অর্থাৎ গুলির হাত থেকে আত্মরক্ষার ব্যর্থ প্রয়াস! লগি দিয়ে মৃতদেহ সরিয়ে নৌকা চালাচ্ছে।
“হালার কত মানুষ মারছে আর দেশ যখন একবার স্বাধীন হইছে- তােরা হালারা আর নিতে পারবি? হারামির বাচ্চা। থুঃ।”
পয়সা দিতে যাই। “পয়সা লাগবাে না! সব ফিরি।
‘আম-লীগ কইয়া দিছে। আল্লার কাছে দোয়া করেন এই হারামির পুতেরা য্যান খতম হয়।” কথা শুনে আমি নির্বাক।
এপার থেকে ওপারের অভিশপ্ত ঢাকাকে দেখি। মনের অজান্তে চোখে জল আসে। সেই সুন্দরী রূপসী ঢাকা আর নেই। এখন শুধু ভাঙা-পােড়া বাড়ি তার মৃত দেহের অগুন্তি স্থূপ। আনন্দে, উৎসাহে এসেছিলাম গভীর বেদানাসিক্ত অশ্রুভেজা কন্ঠে ফিরে যাচ্ছি। কত মাতা সন্তানহারা, স্বামী, স্ত্রী হারা, ভগ্নী ভ্রাতৃহারা হয়েছে- কাউকে ছেড়ে-কাউকে নিয়ে কেউ পালাতে পেরেছে, কেউ বা পারেনি। কত হতভাগিনী পাক সৈন্য শিবিরে এখনও নির্যাতিতা, ধর্ষিতা, লাঞ্ছিতা। হিন্দু-মুসলমান এতটুকু ফারাক নেই ওদের কাছে। অথচ একই মসজিদে নামাজ পড়ে, ঈদের দিনে একই সঙ্গে আনন্দ করে আর সেই মক্কায় হজ করতে যায়। তবে বাঙালি মুসলমান ওদের চোখে গােলাম মুসলমান নয়। তাই এই অত্যাচার, নারী, শিশু, বৃদ্ধ সকলের উপর।
সাব চলেন।” স্বপ্নের ঘাের কাটিয়ে বাস্তবে ফিরে আসি।
‘চলুন-‘ মৃদুকণ্ঠে ভদ্রলােক বলেন। একাধিকবার উনি, বৃদ্ধা মহিলা আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন- ওদের সঙ্গী হবার জন্য। পথে ঘাটে কত বিপদ। সঙ্গে দুই তরুণী।
আমি যাবাে কোথায় যাবাে। কিন্তু চলতে হবেই। চরৈবেতি চরৈবেতি।
এপারে জিঞ্জিরার পােল। মাইল দশ পনের হাঁটলে কাটপট্টি। তারপর নদীপার হয়ে চাষাড়া ফতুল্লা দিয়ে নারায়ণগঞ্জ। ওখানেই আমরা যাবাে। এই শিশু মেয়ে বৃদ্ধা পারবে কি?
‘পারতে হবে–উপায় নেই। বৃদ্ধার জবাব।
সব মিলিয়ে আমার কাছে আছে ৬ টাকা ৭০ পয়সা। এর মধ্যে একটি পাকিস্তানের প্রথম রুপাের টাকা। যে গ্রামে প্রথম এসেছিলাম সেই ভদ্র মহিলা আমার মেয়েকে দেবার জন্য দিয়েছেন। এ টাকাটা খরচ করা যাবে না। এই ৫.৭০ টাকা আর একটি দামী ঘড়ি ঐ ভদ্রমহিলাই তাঁর ভাইকে ইন্ডিয়ায় পৌছে দেবার জন্য দিয়েছেন। পাকিস্তানে আসবার সময় আমার হাতে কোনও ঘড়ি ছিল না। এই সামান্যতম সম্বল নিয়ে আমাকে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ইন্ডিয়ায় পৌঁছুতে হবে। সেই মুহুর্তে আমার মনে হয়েছিল এটা অসম্ভব ব্যাপার। এমন কেউ নেই যে যার কাছ থেকে টাকা পেতে পারি তাছাড়া এই অবস্থায় কে কোথায় আছে কে জানে। তবু চলতে হবে। আমরা অপেক্ষা না করে হাঁটতে শুরু করি। এখন গন্তব্যস্থল কাটপট্টি।
কত লােক কত কথা বলছে। আরও অসংখ্য নর-নারী চলছে। আমাদের লক্ষ্য আপাতত কাটপট্টি। পথে কোনও গ্রামে ডাব, কোনও গ্রামে শুকনা চিড়ে গুড় দিচ্ছে। প্রত্যেকেই বলছে একটু বিশ্রাম করে যান। ঢাকার কথা বলে যান। শেখ সাহেবের খবর কিছু জানেন নাকি। কখনও জবাব দিই, কখনও জবাব দিই না। নদীর পার দিয়ে হাঁটতে থাকি। ওপারে ঢাকা শহর দেখা যাচ্ছে। কালাে কালাে চাপ চাপ ধোয়া কুণ্ডলী দিয়ে উঠছে। নদী দিয়ে মরা ভেসে যাচে। আমার যাওয়া যেমন উদ্দেশ্য তেমনি যারা চলছে তাদের কাছ থেকে খবর জানা আরও খবর।
আমাদের সঙ্গেই চলছে আর একদল ছেলে। এদের কথাবার্তা শুনে মনে হল এরা ই,পি, আর-এর লােক। একটু আলাপ পরিচয় ঘনিষ্ঠ হতে অনেক কিছুই জানা গেল। এরা ই, পি, আর-এর হেড কোয়ার্টার্স পিলখানায় ছিল। এদের কথায় “জয়দেবপুরের ব্যাপারটা ঘটে যাবার পরই আমাদের এবং অন্যান্য যেসব ই, পি, আর আছে তাদের হাত থেকে ভারী অস্ত্র সব নিয়ে যাবার চেষ্টা সামরিক বাহিনীর তরফ থেকে চলতে থাকে। কিন্তু আইন মােতাবেক কোনও অর্ডার দেওয়া হয়নি। নানা কারণে অনেকদিন ধরেই আমাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর লােকদের সম্পর্ক ভালাে যাচ্ছিল না। আজ হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে গেছে, তা না হলেও আমাদের সঙ্গে ওদের একটা লড়াই হতাে কেউ ঠেকাতে পারত না। আমাদের ভেতর একটা বিক্ষোভ ক্রমশ দানা বেঁধে উঠছিল। ২৫শে মার্চ যে যার মতাে খাওয়া দাওয়া শেষ করেছি। যাদের ডিউটি তারা ডিউটি দিচ্ছে। রিজার্ভ থেকে রাত্রিতে অর্থাৎ সন্ধ্যার পর আমাদের বেশ কিছু সংখ্যককে শহরে ডিউটির জন্য পাঠানাে ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি। এমনি কানাঘুষায় শুনছিলাম আম্লীগ আজ কিছু একটা করতে পারে তারই প্রস্তুতি। হবেও বা! যাদের ডিউটি দেবার তারা চলে গেল আমরা অন্য দিনের মতােই। রাত সাড়ে দশটার সময় হঠাৎ খবর পাওয়া গেল একজন বাঙালি ওয়ারলেশ অপারেটর বহু কষ্টে জানিয়েছে মিলিটারি নাকি ই, পি, আর হেড কোয়াটার দখল করতে আসছে! আমাদের সেই অপারেটর পজিশন নিতে অথবা পালাতে বলল। দশ মিনিটের মধ্যে আমরা সব রেডি হয়ে গেলাম। এখান থেকে বাধা দেওয়া হবে, না আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ব! ঠিক হলাে সামান্য কিছু এখানে থাকবে, বাদ বাকি আশে পাশের বাড়ি, গলি, যে যেমন সুবিধামতাে পজিশন নেবে। প্রথম ফায়ারিং এর সুযােগ ওদের দিতে হবে। আমাদের প্রচুর পরিমাণ টোটাও ছিল না। আর এমন দুর্ভাগ্য যে পিলখানার’ চাবি যার কাছে, তিনিও অনুপস্থিত। তালা ভাঙবার চেষ্টা বৃথা হলাে। এর মধ্যে অপারেটর আবার খবর দিয়েছে “হুশিয়ার।” যার কাছে যা ছিল যতটুকু ছিল, নিয়ে পজিশন নিলাম। গলির মুখে দোতলা বাড়ির ছাদে আমরা পাঁচজন। প্রথমে সার্চ লাইট ফেলল—চারিদিক দেখল তারা মাইকে চীৎকার করে বলল সারেন্ডার’। এদিক থেকে কোনাে জবাব নেই। আবার শুনতে পেলাম সারেন্ডার’-তবুও উত্তর নেই। আমরা রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা করছি। একটু পরেই “ফায়ার।”
প্রথমে পরপর কয়েকটি গ্রেনেড তারপর মেশিনগান। ভেতরে কয়েকটি মেশিনগান ছিল—আমরা এদিক ওদিক থেকে শুরু করলাম।
একটু পরে আর্মি চুপ করে গেল। তারা এর পর চারদিকে গুলিবর্ষণ শুরু করল। পিলখানা তাে আছেই, আশে পাশে বাড়ি, রাস্তা কিছুই বাদ গেল না। একভাবে। আমাদের যতক্ষণ গুলি ছিল আমরা জবাব দিয়েছি, তারপর সমস্ত পােশাক ফেলে কেউ লুঙ্গি, কেউ আন্ডারওয়ার পরেই সরে এলাম। ম্যাগাজিন খুলে রাইফেলগুলাে এদিকে ওদিকে ফেলে দিলাম। আপনারা যেখানে যাচ্ছেন সব জায়গায় এই সংবাদ জানিয়ে দেবেন বলবেন তৈরি হতে।” আমি এই অসম যুদ্ধের কাহিনী শুনছিলাম। এদের কথা ভাবছিলাম।
এভাবে কখনও হাঁটিনি। ইট-খােলা, কাঁচামাটির পথ তবু চলছি। বাচ্চাটাকে কখনও আমি কখনও হােসেন পিঠে নিচ্ছে। বালুর ওপর দিয়ে চলতে পা ডেবে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ মন্তব্য করে “কোনও দিন হাঁটেননি বাবুরা-এবার দেখেন।” শুনে যাই! সন্ধ্যায় ক্লান্ত অবসন্ন দেহে কাঠপট্টির একটু আগে, একটা নৌকা করলাম—ওপারে চাষাড়া পর্যন্ত নিয়ে যাবে। প্রায় দুদিন কিছুই খাওয়া নেই! চাষাড়ায় নেমে আবার হাঁটি এক সময় অবশেষে নারায়ণগঞ্জ এসে পৌছলাম।
এবার আমরা চলি?
ভদ্রলােক দুহাত জড়িয়ে বললেন আজ রাতটা অন্তত আমাদের সঙ্গে থেকে যান। হােসেন চলে গেল। তার দুলাভাই-এর বাড়ি নিকটেই। আমাকে নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট পীড়াপীড়ি। আমাকে এমনভাবে ছেড়ে দিয়েছে শুনলে কর্তারা জুতা মারতে মারতে তাড়াইয়া দিবে! ওর এখনও বিশ্বাস কর্তা বেঁচে আছে ভালাে আছে। আমি নানা কথা বলে ওকে বিদায় দিলাম। যাবার সময় একান্তে ডেকে বলল ‘সাব আপনার কাছে। টাকা পয়সা মনে হয় নাই।’
“না না আছে।”
“আমি দেখেছি। তারপর একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা কয়েকটি দশ টাকা, একটাকার নােট! আমার দিকে একটা দশ টাকার নােট এগিয়ে দেয়। এটা আপনাকে রাখতেই হবে।”
ওর শেষ সম্বল। বাধা দিয়েও লাভ হলাে না। হােসেন চলে গেল। আমরা মিনা বাজারে মিনাবাগ’ হােটেলে আশ্রয় নিলাম।
ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ এই প্রশস্ত রাজপথ খণ্ড খণ্ড করা হয়েছে পাক বাহিনীর প্রবেশ বন্ধ করবার জন্য। বড় বড় গাছ কেটে, ইলিকট্রিক পােস্ট ফেলে, বড় ট্রাক ও নেট দিয়ে, রেল লাইন উপড়ে নানাভাবে ব্যারিকেড করা হয়। হাজার হাজার লােক। রাস্তার পাশেই মাঠ। এটা এরা লক্ষ করেননি যে আর্মি মাঠ দিয়েও আসতে পারে। পরে শুনেছি ঐভাবেই এসেছে। রাইফেল, বন্দুক, তরবারি, তীর ধনুক কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় অত্যন্ত সামান্য। এখানকার আওয়ামী লীগ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে শত্রু সৈন্যকে বাধা দেবার জন্য সংগঠিত হবার চেষ্টা করেন। আমরা যে হােটেলে উঠেছিলাম, সেই হােটেলের মালিকের পুত্র প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য (আঃ লী)। এখানে ছাত্র ও যুব নেতা জহুর ভাই এর খুব প্রশংসা শুনলাম। সেনাবাহিনীর মােকাবিলা শুধু নয় আক্রান্ত হলে অন্যান্য ব্যবস্থাও ঠিক করা হয়। যদি উপযুক্ত অস্ত্র শস্ত্র এদের হাতে থাকত। অন্তত কয়েকটি মেশিনগান তাহলে অবস্থা। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। পাক আর্মি স্থলপথে অথবা জলপথে নারায়ণগঞ্জ কিছুতেই প্রবেশ করতে পারত না। শুধু বােমাবর্ষণ ছাড়া।
আমরা হােটেলের দোতলায় জায়গা পেলাম। হােটেলের ঠিক সামনে একটা খাল তারপর বড় রাস্তা বেশ খানিকটা দূরে নদী। আকস্মিকভাবে এখানে আওয়ামী লীগের কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। রাত প্রায় সাড়ে ৯ টা।
হােটেলের সামনের দিকে বেশ কিছুটা দূরে উঁচুতে হঠাৎ দেখলাম, কয়েকটা আলাে জ্বলে উঠল, একটু পরে নিভে গেল। কিছুক্ষণ পরে আবার। আমরা বারান্দায় বসে। হােটেলের চাকর বলল, ওটা একজন খানের বাড়ি। বেশ বড় লােক_চার তলা। এই আলাে কিছুক্ষণ আগে থেকে এরকম জ্বলছে আর নিভছে। এর আগে কোনােদিন এটা দেখা যায়নি। আমি আর সঙ্গী দ্রলােক নিজেরা আলােচনা করলাম। উনি বললেন এ ব্যাপারটা হয়ত এখানকার আমলীগ জানে তবুও আমাদের জানান কর্তব্য। আমি ইতস্তত করি। কারণ এদের ব্যাপারে এরাই ভালাে বুঝবেন আমার নাক গলানাে উচিত হবে না। আপত্তি করা সত্ত্বেও শুনলেন না। ভদ্রলােক, তার বােন (জেসমিন) এর পীড়াপীড়িতে চাকরটাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পে গেলাম। শুনলাম নেতারা সব ঘুরছেন। চাকরটা কি যেন বলে চলে এল। একটি ছেলে তখনি বেরিয়ে গেল। আমরা হােটেলে চলে এলাম। খানিকক্ষণ বাদে দু-তিন জন ভদ্রলােক এলেন। তখনও একইভাবে সেই বাড়ির আলাে জ্বলছে-নিভছে।
‘আশ্চর্য—আমরা ঠিক এটা বুঝতে পারিনি। এটা আর্মি’ অথবা অন্য কাউকে সিগন্যাল দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে যা ব্যবস্থা নেবার নিলেন। সেই আলাে আর জ্বলতে দেখিনি। এরপর বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলােচনা হলাে।
একজন বললেন “এই হত্যা ও ধ্বংস ‘পাক আর্মি’ একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে করছে। ঢাকার যে খবর আমরা পেয়েছি তাতে দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ বিশেষ এলাকার উপর তাদের প্রথম ও প্রধান আক্রমণ। বুদ্ধিজীবী, ছাত্র ও বাঙালি ব্যবসায়ী আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য!” গভীর দুঃখের সঙ্গে বললেন, “আমরা তৈরি হচ্ছি কিন্তু কি দিয়ে লড়ব বলতে পারেন আগে শুনেছি প্রয়ােজন হলেই অস্ত্র পাওয়া যাবে। এখন! এই যে হাজার হাজার যুবক তাদের কয়জনকে আমরা অস্ত্র দিতে পেরেছি। আর যারা দেয়ালে দেয়ালে লিখেছে—
‘মিটিং ছাড় মিছিল ছাড়
অস্ত্র ধর যুদ্ধ কর।’
ভেবেছিলাম এদের কাছে হয়ত অস্ত্রশস্ত্র থাকলেও থাকতে পারে। অন্তত কিছু বােমা! এরা সকাল বেলা থেকে আমাদের পেছনে পেছনে ঘুরছে যুদ্ধ করবে হাতিয়ার চায়। এদের কিছুই নেই—আছে কালি আর তুলি।” এই দুঃখেও প্রচণ্ড হাসিতে সকলে ফেটে পড়ল।
রাত গভীর হয়। এখন নতুন চিন্তা। টাকা নেই, পয়সা নেই, শুধু সেই ভদ্র মহিলার দামী ঘড়িটা। যে কোনও মুহূর্তে এটাও খােয়া যেতে পারে। আমাকে এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। যােগাযােগ ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। বর্ডারের পরিস্থিতিই বা কি কে জানে। একমাত্র আশা চাঁদপুর থেকে কোনও অবস্থায় কুমিল্লা যেতে পারি। চাঁদপুর যেতেই হবে।
সকাল ৯টা নাগাদ ‘টার্মিনালে এসে দেখি জনসমুদ্র! লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা ভিড় নিয়ন্ত্রণ করছেন। সেই এ্যাডভােকেট পরিবার থেকে অনেত্রে বিদায় নিলাম। তারা আপাতত গােপালগঞ্জ যাবেন। অনেক কষ্টে আমি চাঁদপুরের লঞ্চে জায়গা পেলাম। লঞ্চ ডুবু ডুবু! সাড়ে দশটায় লঞ্চ ছাড়ল। অসম্ভব ভিড়! য প্রায় সকলেই ঢাকার। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলেছেন!
“শেখ সাহেব, শেখ সাহেব। কয়েক দিনের ক্লান্তি আর উৎকণ্ঠা নদীর ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। অসংখ্য মানুষের চীৎকার মুহূর্তে তন্দ্রা ছুটে গেল। শুনলাম চাঁদপুর মাইল ছয়েক। আমরা ডাকাতিয়া নদীতে। বেলা প্রায় একটা। লঞ্চের নিচ তলায় কোনায় গুটি মেরে বসে আছি। চীৎকার, কোলাহল। অবাক হয়ে ভাবছি এখানে শেখ সাহেব! লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক জন যাত্রী নৌকা করে পার হচ্ছেন। তীরে বহু লােক। একটা স্পিড বােট আমাদের লঞ্চের পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় সাইক্লোস্টাইল করা কতগুলাে প্রচারপত্র ছুঁড়ে দিল। যুদ্ধ শুরু হয়েছে স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়েছে জনসাধারণের আশু কর্তব্য সম্পর্কে নির্দেশ নামা। আওয়ামী লীগের প্রচারপত্র।
ঠিক পরেই আর একটা একটু বড় স্পিড বােট। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম! হঁ্যা, সেই চেহারা সেই মূর্তির! শেখ মুজিবর রহমান! দাঁড়িয়ে আছেন। কাঁধে একটা চাদর ফেলা। একটু ক্লান্ত এক সেই সদাহাস্যময় চেহারা নয়। আমার লঞ্চের প্রায় কুড়ি হাত দূর দিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেলেন। জনগণের উচ্ছসিত অভিবাদনের উত্তর দিচ্ছেন হাত উঁচু করে সেই চির পরিচিত ভঙ্গিতে! ২৩শে মার্চ বেলা ১ টায়। তাহলে পাক বেতার নিয়মিতভাবে যে খবর পরিবেশন করছেন তা অলিক অবাস্তব! ২৫ শে মার্চ তাকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি—আজও দেখলাম। নদীর তীরের দিকে বহু মানুষ তখনও ছুটে আসছেন বহু মানুষ তীর ধরে ছুটছেন, শেখ সাহেব বেরিয়ে গেলেন। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন “ফুল আর্মড” সামরিক পােশাক পরিহিত। একি সত্য একি মায়া? এই দুপুর রৌদ্রে এই অসংখ্য মানুষ? আমরা সকলেই কি স্বপ্ন দেখছিলাম? লঞ্চ চলতে শুরু করে যাত্রীদের কলগুঞ্জন সমানে চলছে।
প্রায় দুটোয় চাঁদপুর। আত্মীয়ের বাড়ি গেলাম। তালা বন্ধ। কোথায় যাই! অনেক চিন্তা করে হােটেল আকবরিতে বলতে গেলে চাঁদপুরের প্রধানতম হােটেল একটু জায়গা পেলাম। এখন চাই বিশ্রাম আর নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম। তারপর দেখা যাক্। কোনাে কুলে তরী ভিড়ে।
সূত্র: কম্পাস, ১৫ মে, ১৯৭১