বাংলাদেশে সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলােতে (৫)
শকুন্তল সেন
মাত্র ক’দিন আগে চাঁদপুর এসেছিলাম। সেদিন ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের ভি-ডে। ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীন বাংলার পতাকা এখনও শহরের সর্বত্র। চাঁদপুরকে শহর না বলে বন্দর বলাই বােধ হয় ঠিক হবে। চাঁদপুরের নতুন বাজার যেমন, বসতি এলাকা তেমনি নদীর ওপারে পুরান বাজার ব্যবসা প্রধান অঞ্চল। কয়েক মাইল নদীপথে গেলেই আমাদের গ্রাম। অস্পষ্ট আবছার মতাে মনে পড়ে ছােটবেলার কথা। বাবা মার সঙ্গে নৌকা করে মেঘনা ডাকাতিয়া পাড়ি দিয়ে গ্রামের বাড়িতে যেতাম! হায়, সে গ্রামে আর কি কোনােদিন যেতে পারব। এই শহরেও আমাদের আত্মীয় স্বজনও রয়েছেন তাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক সামাজিক জীবনে এককালে জেলার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। আজ সেসব কথা মনে করে কোনও লাভ নেই। হােটেলে না উঠে কারাে কারাে বাড়িতে যেতে পারতাম তারা বিব্রত বােধ করতেন আজকের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পটভূমিকায়; ২৬ শে মার্চের আগে হয়ত এটা হতাে না। কারাে মনে এতটুকু ভয় বা আশঙ্কার ছাপ দেখলাম না। ছােট ছােট দলে সকলেই যুদ্ধের অবস্থা নিয়ে আলােচনা করছেন। গতকাল স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে শেখ সাহেবের ভাষণ নাকি অনেকেই শুনেছেন। শেখ সাহেব যে পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হন নি এটা সকলেই বিশ্বাস করে।
স্নান করে এক কাপ চা খেয়ে হােটেলের বিছানায় শুয়ে ১৯শে মার্চ থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত সমগ্র পরিস্থিতিটা তলিয়ে দেখতে শুরু করি। আর একটি বড় চিন্তা, পয়সা কড়ি নেই, যদি দীর্ঘদিন থাকতে হয় তাহলে চলবে কি করে। সীমান্ত পার হওয়াটা একটা বড় সমস্যা। এই অবস্থায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা শুরু হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। মুসলিম লীগ, জামায়েতে ইসলাম, জামায়েতে উলেমা এইসব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলাে যারা নতুন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মাটির নিচে আত্মগােপন করেছিল তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কিছুক্ষণ আগে চাঁদপুরে টার্মিনালে এক ছাত্র নেতারসঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলছিলাম। তিনি বললেন “আপনার কথাটা ঠিক কিন্তু আজকের পরিস্থিতিটা অন্য রকম। সাম্প্রদায়িকতা নিঃসন্দেহে নীচ ব্যাপার। দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য পাগল সেখানে এই সব ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়ে কোথাও কোথাও সামান্য কিছু স্বার্থপর ব্যক্তি কিছু করতে পারে কিন্তু ১৯৫০ বা ১৯৬৪ আর ফিরে আসবে না। দেশের মানুষ অনেক বেশি সজাগ।”
বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে ভালাে লাগল না বিকেল হতে না হতেই আবার বেরুলাম। সেই মানুষের জটলা। ট্রানজিস্টর এর সামনে ভিড়। এই বুঝি কোনও সংবাদ ফস্কে যায়। ইন্ডিয়া কি বলছে স্বীকৃতি কবে দিচ্ছে— দেবে নিশ্চয়ই। ইন্ডিয়া’ দিলে রাশিয়া দেবেই। কিন্তু সকলের একমত, পুলিশ, ই.পি.আর, আনসার, বি, আর খুব ভালাে যুদ্ধ করছে—ওরা যুদ্ধে না নামলে আমাদের সর্বনাশ হতাে! একজন অধ্যাপকের মতে ই, পি, আর কিংবা বি, আর হয়ত এখনই আমাদের দিকে যােগ দিত না অন্তত ২৭ শে মার্চ পর্যন্ত সে রকম স্পষ্ট কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের বােকামীর জন্যই এটা ঘটেছে। তারা ওইভাবে ওদের হত্যা করছে আর সেই সংবাদ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সহস্রগুণ ফলাও হয়ে সর্বত্র প্রচারিত হয়েছে। এদের এতদিনকার চাপা বিক্ষোভ ফেটে পড়ল। বারুদের স্তুপে জ্বলন্ত কাঠি! এখন ওরা আমরা সকলে এক।”
এখানে সেই একই রকম ভাব। কয়েকটি রাইফেল আর বন্দুক! শুনলাম গত কদিন ধরে বােমা তৈরি হচ্ছে। সেই উৎসাহ উচ্ছাস! রাইফেল কিংবা বন্দুক নিয়ে কয়েকজন মুক্তি সেনা যাচ্ছে, তার পিছনে পিছনে অসংখ্য লােকের ভিড় যেন চৈত্র মাসের সং। কিংবা হয়ত তারা কোথাও বসে আছে সেখানেও বহু লােকের ভিড়। আর নানা রকম জল্পনা কল্পনা। একটা রাইফেলে কত গুলি আছে এক সঙ্গে কটা গুলি ছুঁড়তে পারে কত দূর যায়। ইত্যাদি আরও অনেক! দাবাড়ি দিলেই বা কি। কে কার কথা শােনে। অবশ্য এদের দোষ নেই ২৪ বৎসরে এ রকম সংকট বা পরিস্থিতির মুখােমুখি পূর্ব বাংলার মানুষ কখনও পড়েনি। এটাও লক্ষ্য করা গেছে মুক্তিসেনা বা নেতৃত্ব এই অহেতুক কৌতূহল থেকে জনতাকে নিবৃত্ত করতে সম্পূর্ণ। অক্ষম হয়েছেন। আমাদের ঘিরে সব সময় এত লােক” এই ধরনের মিথ্যা অহঙ্কার তাদের মনে এসেছিল বলেই মনে হয়। সেই অধ্যাপকই বলছিলেন “এই জনতাই আমাদের বিপদে ফেলবে। এটা জনতার যুদ্ধ কিন্তু জনতা আর যুদ্ধ সম্পূর্ণ পৃথক বস্তু।” কথাটা সত্যিই অপূর্ব লেগেছিল।
সন্ধ্যা হয়েছে। আমরা কলেজের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মসজিদ ছাড়িয়ে একটা চায়ের দোকানে দুপেয়ালা চা নিয়ে বসেছি। ট্রাঞ্জিস্টারে ইন্ডিয়ার অনুষ্ঠান চলছে। রিক্সায় মাইক দিয়ে ঘােষণা করে গেল “কেউ আলাে জ্বালবেন না। একটু পরেই সমস্ত শহরটা অন্ধকারে ডুবে গেল। মিটমিট করে আলাে জ্বলছে যাতে বাইরে না দেখা যায়। এমন সময় “পালা পালা মিলিটারি আইছে মিলিটারি আইছে।” এক রিক্সাওয়ালা চীকার করতে করতে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ঝপাঝপ দোকান পাট বন্ধ। পড়ি কি মরি করে লােক দৌড়চ্ছে-। রিক্সা, মানুষ, সাইকেল সব দৌড়ের কপিটিশন। দেখা যাচ্ছে আমার কপালটাই খারাপ। তুমি যাও বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে। ভেবেছিলাম একটু বিশ্রাম নেব। তা আর হল না। আমার সঙ্গী নির্বিকার! আমি অধৈর্য হয়ে বললাম চলুন। একটু মৃদু হেসে বললেন “কোথায় আগুন সর্বত্র জ্বলছে, কোথায় পালাবেন।” ভয়ঙ্কর রাগ হলাে। বিপদের মুখে এইসব দার্শনিক তত্ত্ব কার ভালাে লাগে! আমার অবস্থা অনুমান করে বললেন “ভয় নেই। আর আমরাই যদি পালাই বৃদ্ধ, শিশু নারী এদের অবস্থা কি হবে। এদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। চলুন হাঁটি।” দেখি কোমর থেকে কি বার করছেন। ছােট একটা আগ্নেয়াস্ত্র, দেখে শুনে আবার রেখে দিলেন।
২৯শে মার্চ সকালের দিকে এর চেষ্টায় একটা লরিতে জায়গা পেলাম কুমিল্লা পর্যন্ত। বলে দিলেন কুমিল্লায় প্রচণ্ড গােলমাল চলছে, যেতে পারবেন কিনা জানি না। তবে অযথা ঝুকি নেবেন না। আর এই কাগজটা রেখে দিন সময় করে পড়বেন।” শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন। ড্রাইভার এবং অন্যান্য যারা ছিলেন তাঁরা বললেন রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ জানি না কি হবে। বেশ কিছুটা এসে লরি আর যেতে চায় না। রাস্তা কাটা, গাছ ফেলা রয়েছে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এঁকে বেঁকে চলছে। মনে পড়ল ভদ্রলােকের কাগজটার কথা। খুলেই চমকে উঠলাম,
“শােককে ঘৃণায় রাঙিয়ে নাও
রক্তের শােধ রক্তে নাও।”
বলে কি! একটি প্রচারপত্র “পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম. এল) কর্তৃক প্রচারিত।
পূর্ব পাকিস্তানের কমুনিস্ট পার্টি (এম, এল) এর প্রচার পত্রের ধরনধারণ দেখবার পশ্চিম বাংলার জনগণের হয়নি বলেই মনে হয় সেজন্য হুবহু কপি করে দেওয়া গেল।
“শােককে ঘৃণায় রাঙিয়ে নাও রক্তের শােধ রক্তে নাও।”
কমরেডগণ ও বন্ধুগণ
মহান নেতা চেয়ারম্যান মাওসেতুং বলেছেন, “আমাদের সামনে হাজার হাজার শহীদ বীরত্বের সঙ্গে জনগণের স্বার্থে প্রণামী দিয়েছেন, তাদের সে পতাকা উর্ধ্বে তুলে আসুন, আমরা এগিয়ে চলি তাদের রক্তচিহ্ন বেয়ে।”
“বাংলার ইতিহাসও শশাষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে জনগণের বারংবার বিদ্রোহের ইতিহাস। শত সহস্র বিপ্লবী বীর ও অমর শহীদের মহান সগ্রামের রক্তগাথা লেখা হয়েছে এ ইতিহাস। তিতুমীর আর মঙ্গল পাড়ের তপ্ত রক্তে যে যাত্রা একদিন শুরু হয়েছিল, তারই ধারা বেয়ে এলাে ক্ষুদিরাম আর সূর্য সেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েমের পর এলাে তাদেরই উত্তরসাধক, আনােয়ার, হানিফ দেলওয়ার বিজনদের মতাে মহাপ্রাণ মানুষ, ১৯৫০ সালের যে দিন রাজশাহীর কারাগারে যাদের হত্যা করে জোতদার মহাজন ও আমেরিকার পা-চাটা, লিয়াকত, নুরুল আমিন সরকার পূর্ব বাংলার কৃষক সমাজের ৪৮ এর মুক্তি সংগ্রাম চিরতরে ধ্বংস করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা নিয়েছিল। “তারপর উনিশ শ’বাহান্ন। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের জারজ সন্তান জিন্নাহ-লিয়াকত-নুরুল আমীন চক্র পূর্ব বাংলার জনগণকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য আর একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল। পূর্ব বাংলার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে বানচাল করে দেয়ার জন্য উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেয়ার গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল—জোতদার মহাজন ও দেশি-বিদেশি পুঁজির এ দালালরা। কিন্তু নিরন্তর সংগ্রামের ঐতিহ্য বাংলাদেশের ক্রুদ্ধ প্রতিরােধে রুখে দাঁড়াল পূর্ব বাংলার মেহনতি জনগণ। অস্ত্র আর সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল শাসকগােষ্ঠী তখন নির্মম আর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠল। জনতার সােচ্চার প্রতিবাদে ভীত হয়ে সেদিন জোতদার মহাজন ও ব্রিটিশ আমেরিকার সহযােগী পুঁজিপতিদের পা-চাটা কুকুর মুসলিম লীগ সরকার নিরস্ত্র জনগণের উপর লেলিয়ে দিয়েছিল সামরিক বাহিনীকে। ঢাকার রাজপথে সেদিন শহীদ হলাে সালাম, জব্বার, রফিক, বরকত আর কত নাম না জানা বীর।
সামন্ত মৃৎসুদ্দি দালালদের এ জাতিগত নিপীড়ন আর উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষের এ প্রচণ্ড সংগ্রাম সেদিন জয়ী হয়নি। কেননা পূর্ববাংলার মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের নেতৃত্ব দখল করেছিল পূর্ববাংলার ধনিক গােষ্ঠী তথা রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা। এসব আপােষকামী ধনিক শ্রেণীর দালালরা সেদিন পূর্ববাংলার মুক্তিসংগ্রামকে নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। আর পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সংশােধনবাদী নেতারা এ দেশের মেহনতি জনতার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে এই বাঙালি শােষকগােষ্ঠীর দালালদের তাদের উপর ন্যস্ত কৃষি লেজুড়ে বৃত্তিই বিপ্লব তথা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের দায়িত্বকে করেছিল সম্পূর্ণ অবহেলা।
“আসলে ভাষা ও সংস্কৃতি সমাজ ব্যবস্থারই উপরি কাঠামাে। যে সমাজে ধনী গরিবের শ্রেণী বিভেদ রয়েছে সে সমাজের সকল ক্ষমতাই থাকে ধনিকদের হাতে। সুতরাং অন্য সবকিছুর মতাে ভাষা ও সংস্কৃতি ধনিক শ্রেণীর স্বার্থেই ব্যবহৃত হয়। মােগল পাঠানেরা এ দেশে আমদানি করেছিল তাদের নিজস্ব ভাষা ফার্সি। ইংরেজ বেনিয়ারাও তাদের স্বার্থে এদেশে চালু করেছিল ইংরেজি ভাষা, শিক্ষা ও সভ্যতা। ঠিক তেমনি পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বড় বড় মালিক ও সামরিক বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিরাও তাদের প্রতিনিধি জিন্নাহ লিয়াকতরা পূর্ব বাংলার জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল তাদের নিজেদের ভাষা উর্দু। সেদিন তাই বিচ্ছিন্ন ভাষা আন্দোলনের চাইতে প্রয়ােজন ছিল ধনিক শ্রেণীর এই সমাজকে পুরােপুরি পালটিয়ে দেওয়ার জন্য একটা প্রচণ্ড সশস্ত্র বিপ্লবী লড়াই শুরু করার। চেয়ারম্যান মাও-রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়ার মানেই সব কিছু পাওয়া।” পূর্ববাংলার মেহনতি জনগণকে যদি তার ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জন করতে হয় তবে আমাদের দেশের বর্তমান বৃটিশ আমেরিকা ও দেশি সামন্ত শ্রেণীর যে সংস্কৃতি চলছে তাকে উৎখাত করতে হবে এবং এদেশে একটি নূতন সংস্কৃতি জনগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর সেটা সম্ভব কেবলমাত্র জনগণের গণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েম করার বিপ্লবী সগ্রামের মারফত। বাংলাদেশে ও বাংলার অধিকার রক্ষার কথা বলে উগ্র জাতীয়তাবাদীর শ্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগ বিগত নির্বাচনে ভােট নিয়েছে। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনের পর তারা পাকিস্তানের বড় বড় পুঁজিপতি আদমজী, ইস্পাহানি ও বাওয়ানীদের সঙ্গে আপােষ করেছিল এবং পূর্ব বাংলার স্বার্থকে নিজেদের শ্রেণীর স্বার্থেই ওদের কাছে বিক্রি করেছিল। আর এবার তারা একই স্বার্থ রক্ষা করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গেও গােপন ষড়যন্ত্র করেছে ও পূর্ববাংলার চীনবিরােধী ও কৃষকের বিপ্লবী যুদ্ধ বিরােধী মার্কিন ঘাটি তৈরি করার দরজা খুলে দিয়েছে। মার্কিন দালাল শেখ মুজিব আর তার বুর্জোয়া সাগরেদরা কিছুতেই বাঙালির স্বার্থ রক্ষা করতে পারে না। ইতিমধ্যে তাই তারা পুলিশ ও গুণ্ডাদের সহায়তায় শ্রমিক হত্যার নারকীয় কাজে আত্মনিয়ােগ করেছে।
“সঙ্কীর্ণ বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের এ ঘৃণ্য প্রকৃতির ও সংশােধনবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতা আমরা আজ ধরে ফেলেছি। ভারতের নকশাল বাড়ির বীর কৃষক গেরিলাদের বন্দুকের আওয়াজ আমাদের ঘুম ভেঙে দিয়েছে। হাজার বছরের পুরানাে সামন্ত সমাজ দেশি-বিদেশি শােষকদের অতি শক্ত সৃষ্টি। নকশাল বাড়িতে কৃষকরা যখন মহাবিক্রমে সে খুঁটিকে উপড়ে ফেলে দিল তখন সমগ্র ভারতের কৃষকরা জেগে উঠল। আজ তাইতাে দেখি ওই পথে ভারতের গ্রামে গ্রামে বদমাইস জোতদার মহাজনদের গলা কেটে কেটে ওরা গ্রাম ভারতকে শত্রুমুক্ত করে মেহনতি মানুষের রাজত্ব কায়েম করছে। শহরে তেমনি সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে তৈরি ভাষা ও সংস্কৃতিকে উৎখাত করছে, আর ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিচ্ছে তাদের সব জীবিত ও মৃত দালালদের পুরানাে ভিত। তৈরি হচ্ছে নতুন ভিত। আমরাও মাও সেতুং চিন্তাধারাকে বুঝেছি। বুঝেছি শুধু হয়ে নয়, শুধু শহীদ মিনার গড়ে ফুলের মালা দিয়ে নয়—খালি হাতে শক্রর বুলেটের সামনে এগিয়ে গিয়েও কোনাে দাবী আদায় হয় না অস্ত্র আমাদেরও তুলে নিতে হবে। চেয়ারম্যান আমাদের শিখিয়েছেন ‘বন্দুকের নল দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে তাই আমরা আজ হত্যার একচেটিয়া অধিকার শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছি। যেসব কুখ্যাত জোতদার মহাজনরা এতদিন মুসলিম লীগের পতাকাবাহী ছিল তারাই এখন আওয়ামী লীগ। এসব অত্যাচারী জোতদার যেমন কৃষক সমাজের উপর নির্মম পীড়ন চালিয়েছে, দেশি বিদেশি পুঁজিপতি শ্রেণীর অত্যাচারীর সাহায্য করেছিল তেমনি। খুলনা, বরিশাল, নােয়াখালি, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলায় এদেরকে খতম করা শুরু করেই পূর্ব বাংলার বীর কৃষক গেরিলারা শাসকগােষ্ঠীর হৃৎপিণ্ডে আঘাত হেনেছে। আর এ পথেই বাহান্নর ভাষা আন্দোলন তথা সমস্ত মুক্তি সংগ্রামের শহীদদের বদলা নেয়া চলছে। তারা অত্যাচারীদের রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেঙে দেওয়ার জন্য গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছেন।
“আজ মহান শহীদ দিবসে পূর্ব বাংলার গরীব মেহনতি মানুষের পার্টি পাকিস্তানের কমিউনিস্ট (মার্কর্সবাদী লেনিনবাদী) দেশের কৃষক শ্রমিক বিপ্লবী যুবছাত্র ও দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে এ আহ্বান জানাচ্ছে যে আসুন ভাই-সব। শােষক শ্রেণীকে উৎখাত করে জনগণের গণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা কায়েমের যে লড়াই ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে ঘৃণ্য জোতদার মহাজন টাউট শ্রেণীকে খতম করার অভিযান তীব্রতর করে আবার সেই যুদ্ধকে বিরাট জনযুদ্ধে রূপান্তরিত করি। চূর্ণ করি পূর্ববাংলাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিপ্লবের ঘাঁটি চীন বিরােধী ও প্রতি বিপ্লবী সমস্ত ঘৃণ্য মার্কিন যুদ্ধ চক্রান্ত।
‘অমর একুশে তাই আমাদের শপথ শােককে ঘৃণায় রাঙিয়ে নেব, হত্যাকারীকে কবর দেব আর পূর্ববাংলার বুক থেকে উৎখাত করব ঔপনিবেশিক সামন্ততান্ত্রিক ভাববাদী ও সাম্প্রদায়িক ভাষা সংস্কৃতিকে। সেই সাথে মুছে দেব ইতিহাসের খাতা থেকে সৈয়দ আহমদ, আমীর আলী জিন্নাহ, লিয়াকত, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, গান্ধীর মতাে শােষকদের দালালদের নাম। তার জায়গায় তুলব পূর্ববাংলার মেহনতি মানুষের জন্যে জনগণতান্ত্রিক ভাষা সংস্কৃতি। সমর সংগ্রামী বীরদের ইতিহাস।
সংগ্রামের এই পথ বেয়ে উদিত হবে পূর্ববাংলার মানুষের মুক্তির নতুন সূর্য।
১. শহীদ হত্যার বদলা নিন—শ্ৰেণী শত্রু খতম করুন।
২. সাম্রাজ্যবাদী সামন্তবাদী সংস্কৃতি চূর্ণ করুন। জনগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলুন।
৩. সংগ্রামের লাল আগুন জ্বলছে জ্বলবে গ্রামে গ্রামে গলা কাটা চলছে চলবে।
৪. চেয়ারম্যান মাও সেতুং দীর্ঘজীবী হােন।
৫. পূর্বপাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) জিন্দাবাদ।”
অনেক চেষ্টার পর বেলা ৪.৩০ টা নাগাদ এসে কুমিল্লার প্রায় মাইল বারাে দূরে এসে পৌছলাম একটি বাজার এলাকায়! এই পথ স্বাভাবিক সময়ে অতিক্রম করতে ৪ ঘণ্টার মতাে সময় লাগে। কুমিল্লা শহর ও আশেপাশে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে বলে জানা গেল।
একটু পরেই সন্ধ্যা হবে কুমিল্লা এখনও অনেক দূর অন্তত বারাে মাইল তাে হবেই। ট্রাক ভর্তি নানাপ্রকার জিনিসওখানকার স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য যাচ্ছে। কিন্তু যা অবস্থা তাতে এ ট্রাক শহর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হবে না, তার উপর শহরের পরিস্থিতিটাও অনুকূল নয়। এইসব জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে শক্রর হাতে দেওয়ার চাইতে না নিয়ে যাওয়া অনেক ভালাে এই দেখলাম আমার সঙ্গীদের মত! সঙ্গীদের মধ্যে আছেন আমলীগ, ভাসানি পন্থী ন্যাপ এবং অন্যরা। ট্রাকের মাথায় স্বাধীন বাংলার পতাকা। অনেক গ্রামবাসী এবং রাজনৈতিক কর্মীরা এগিয়ে এলেন। অল্পক্ষণ পরেই দেখা গেল ট্রাকের জিনিসপত্র কি করে পৌছানাে যায় তার চাইতে যুদ্ধগত পরিস্থিতিই আলােচনার মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠল। অবশেষে ঠিক হলাে ট্রাকটাকে গ্রামের দিকে নিয়ে রাখা হবে আর দুজন কর্মী কুমিল্লা শহরের দিকে যাবার চেষ্টা করবে। আমাকে সীমান্ত অতিক্রম করতে হলে কুমিল্লা চকবাজার পর্যন্ত পৌছতেই হবে। সেখানে কেউ কেউ আছে যারা আমাকে সীমান্ত অতিক্রম করতে সাহায্য করবেন আর একটি কথা, ভাবছিলাম হঠাৎ এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্য আমার খোঁজে কেউ না কেউ কুমিল্লা পর্যন্ত আসবে।
এদিকে পূর্ববাংলার কোথায় কি হচ্ছে সেটা জানবার কোনও সূত্র নেই একমাত্র ইন্ডিয়ার সংবাদ ছাড়া। যেখানে সেখানে সকলেই প্রায় সব সময়েই ট্রানজিস্টার খুলে বসে আছে হঠাৎ যদি কোনও সংবাদ পাওয়া যায়। আকুল আগ্রহে ইন্ডিয়ার খবরের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু সে খবর কখন হবে ঠিক নেই। আবার যখন হবার কথা হলােই না।
মূল আলােচনার বিষয় তিনটি :
১. ঢাকা ও শেখ সাহেব,
২. ইন্ডিয়া রাশিয়া কবে পর্যন্ত স্বীকৃতি দিতে পারে
৩. যুদ্ধের পরিণতি।
দেখলাম সকলেই ঢাকা শহরে যে অসংখ্য নরনারীকে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়ে একমত। নির্বিচারে নারীদের ধর্ষণও করা হয়েছে। শেখ সাহেব ধরা পড়েননি এবং নিরাপদে আছেন এ বিষয়ে সকলেই একমত।
কেউ বলেছেন, তিনি গােপালগঞ্জের দিকে চলে গেছেন, কেউ বলছেন চাঁদপুরের কাছ ঘেসে মেঘনা পদ্মা পার হয়ে আড়িয়াল খাঁর ভেতর দিয়ে বরিশালের খাল বিল অধ্যুষিত অঞ্চলে আত্মগােপন করেছেন কিন্তু তিনি যে ধরা পড়েননি সে বিষয়ে দেখা গেল সকলেই এক। কেউ আবার বলছেন শেখ সাহেব যদি ধরাই পড়বেন তাহলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তার কণ্ঠস্বর কী করে শােনা যাবে! আমরা কয়েকজন আললাচনা করছিলাম। কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ ইন্ডিয়ার খবরে যে বার বার করে মুজিববাহিনী’ বলা হচ্ছে সে বিষয়ে কথা উঠল। একজন আমলীগ কর্মী বললেন “আমাদের প্রতিবাদ করার সুযােগ নেই—না হলে করতাম। মুজিববাহিনী মানে কী? শেখ সাহেব কি নামের কাঙাল! তাছাড়া আমরা সকলেই যুদ্ধ করছি, হয়ত আমলীগ নেতৃত্ব দিচ্ছে কিন্তু অনেক জায়গায় অন্যরাও দিচ্ছে। মুজিববাহিনী’ না বলে মুক্তিবাহিনী’ বলাই অনেক ভালাে। মুজিববাহিনী’ বলার ফলে আমাদের পরস্পরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে। এই আন্দোলন বাঙালির আন্দোলন, আজ ভাসানি আর মুজিবের কোনাে তফাৎ নেই। গত ২১শে মার্চ তিনি চট্টগ্রামের পােলাে গ্রাউন্ডের জনসভায় বলেছেন বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষ আজ তাদের মুক্তি আন্দোলনে শেখ মুজিবের পিছনে কাতার বন্দী অতএব শেখ মুজিবরের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সরে পড়াই হবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বুদ্ধিমানের কাজ। তিনি আওয়ামী লীগ সাহায্য তহবিলে মুক্তহস্তে দান করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। সুতরাং আজকের এই সংকটে আমরা সকলে এক সঙ্গে বাচব নয়ত মরব একসাথেই।”
আমরা দুজন চললাম। অসম্ভব ব্যাপার। রাতের অন্ধকারে চলা ভালাে। গ্রামের পথ দিয়ে চলি। কুমিল্লার কাছাকাছি পৌছেও শহরে প্রবেশ দুঃসাধ্য। আমার সঙ্গী জায়গামতাে যােগাযােগ করলেন। তাদের মধ্যে কী কথাবার্তা হলাে জানি না।
আবার সকাল হলাে। ৩০শে মার্চ। কুমিল্লা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করা অসম্ভব। যুদ্ধ চলছে আমার মনে হলাে যুদ্ধ নয়, একতরফা মার দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে পাকবাহিনী। আমাদের তৃতীয় সঙ্গী গভীর দুঃখে বললেন “আরে রাইফেল আর ভাঙা মেশিনগান নিয়ে কি যুদ্ধ হয়। তারপর কে যে নেতা কার কথা শুনব কিছু বুঝি না পাবলিকের জন্য আমরা বেশি মার খাচ্ছি। আমি পাক ভারত যুদ্ধে লাহাের ফ্রন্টে ছিলাম যুদ্ধ কাকে বলে কিছু কিছু জানি নেতাদের বললাম, বার বার বললাম, চট্টগ্রাম কুমিল্লা সড়ক উড়িয়ে দিয়ে ব্রিজগুলাে উড়িয়ে দিন ময়নামতি থেকে টাউনে আসবার পথ একেবারে শেষ করে দিন শুধু সীমান্ত অতিক্রম করার একটা দুটি পথ খােলা রাখুন। না তারা মিলিটারির সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলবেন।” গভীর দুঃখের সঙ্গেই বলছিলেন। তাদের দোষ দিয়ে লাভ কি; রসদ নেই, গুলি বারুদ নেই নেতারা কে কোথায় তার ঠিক ঠিকানা নেই সব চাইতে বড় অসুবিধা যােগাযােগ হচ্ছে না। পাক বাহিনীর প্রচণ্ডতম আক্রমণের সামনে মুক্তিবাহিনী দাঁড়াতেই পারছে না। এটা মুক্তিবাহিনীর পক্ষে লজ্জার নয়—গৌরবের। তারা যা পেয়েছেন তা নিয়ে লড়ছেন। ই, পি, আর, পুলিশ, বি আর লড়ছে আর মরছে হাসিমুখে মরছে। তবে আজ হােক আর কাল হােক যুদ্ধে আমরাই জিতব।” বললেন তিনি। এটা শুধু যে তার বিশ্বাস তা নয়, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে চাঁদপুর, সেখান থেকে কুমিল্লা এই বিস্তৃত অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের কণ্ঠে সেই এক সুর দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ভরা।
এবার আমরা তিনজন। ফিরে এলাম। ট্রাকের জিনিসপত্র নেবার ব্যবস্থা তারাই করলেন। আমরা চাঁদপুর ফিরে এলাম গভীর রাত। ব্ল্যাক আউট। হাজার হাজার নরনারী খােলা রাস্তায়। মুক্তি বাহিনীর পাহারায়।
সূত্র: কম্পাস, ২২শে মে ১৯৭১