বাংলাদেশে একমাস
[ বাংলাদেশের সংগ্রাম হলাে পেট্রিয়টিজমউদ্ভূত গণতান্ত্রিক অধিকার ও মাতৃভাষার রক্ষার জন্য এক ব্যাপক মুক্তি সংগ্রাম।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশের মানুষ যে রায় দিয়েছিলেন তা ইসলামাবাদচক্র নস্যাৎ করে দেবার চেষ্টা করায় হলাে সিভিল ক্যু। ইয়াহিয়া + টিক্কা খা + মিটা চক্র চাপিয়ে দিল সশস্ত্র সংগ্রাম। এই চক্রের সহায়ক ছিলেন দুজন চীনা বিশেষজ্ঞ যারা ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আরবারের সঙ্গে ঢাকা শহরে ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত।
আর ঢাকা হতে প্রকাশিত গণশক্তি ২৮শে ফেব্রুয়ারি ইং ১৯৭১ সংখ্যায় ষড়যন্ত্রের রাজনীতি প্রবন্ধে শেখ মুজিবর রহমান নেতৃত্বকে আখ্যা দিল মার্কিন দালাল বলে। এখানের ট্রামের গায়েও এ লেখা দেখা দিয়েছে।]
কুমিল্লা শহরের প্রায় ২ মাইল পূর্বে হলাে শ্ৰীমন্তপুর গা। ২৩শে এপ্রিল শুক্রবার এই গাঁয়ের মসজিদে নামাজ পড়ছেন গায়ের লােক, আর রয়েছেন তাঁরা যারা এসেছেন অন্য গা হতে। এঁরা এসেছেন শ্রীমন্তপুরে কারণ পাকবাহিনী গাঁয়ের মসজিদ দিয়েছে ভেঙে আর গায়ের লােককে দিচ্ছে না একত্র হতে।
যখন শ্ৰীমন্তপুর মসজিদে ধর্মবিশ্বাসীরা পড়ছেন নামাজ তখন গাঁয়ের পশ্চিমদিকে কুমিল্লা শহর উপকণ্ঠের বিবির বাজারে হচ্ছিল ঘণ্টা দুই ধরে লড়াই, পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিফৌজের। এই লড়াই চলাকালে পাক মেশিনগানের দু পাচটা গুলি এসে পড়ছিল শ্রীমন্তপুর গাঁয়ের বাড়ির টিনের ছাদে। ছেলেবুড়াে বাঁশঝাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিল এই সগ্রাম। আর এই সগ্রাম দেখছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক মি. ফ্র্যাঙ্ক মােরেস ও শ্রীমতি মারেলিন সিলভারস্টোন, সগ্রামস্থলে দাঁড়িয়ে।
গায়ের লােকের দঢ়তা ও মনােবল ছিল অভূতপূর্ব। সগ্রাম ক্ষেত্র হতে ফিরে এসে মি, ফ্রাঙ্ক মােরেস জিজ্ঞাসা করলেন উপস্থিত গ্রামবাসীদের এই সগ্রাম সম্বন্ধে। উপস্থিত বৃদ্ধ যুবকরা প্রায় সমস্বরে উত্তর দিল: নিজেদের অধিকার ও মাতৃভাষার জন্য হলাে এই সগ্রাম। তৎক্ষণাৎ মুক্তিবাহিনীর প্রখ্যাত মেজর নিজের সহযােদ্ধাদের ও গ্রামবাসীকে উদ্দেশ্য করে বললেন যে লড়াইয়ের সঙ্গে সঙ্গে চালাতে হবে প্রচার কার্য, করতে হবে সভাসমিতির বন্দোবস্ত…।
আবার এরই দুদিন আগে আখাউড়া শহরের উপকণ্ঠে অর্থাৎ মাইল দুই দূরে ফকিরমুরা গায়ে যখন পৌছলেন শ্রীমতি সিলভারস্টোন তখন তরুণ আফজল বললে : আখাউড়ায় আমাদের বাড়ি দখল করে বসে আছে পাক সৈন্য আর আমরা আছি এই গাঁয়ের লােকেদের সঙ্গে। তখন এখানে উপস্থিত ছিলেন অনেকে যারা এসেছেন নানা জায়গা হতে। এঁদেরই ভাষায় এঁরা হলেন প্রায় হাজার দশেক লােক যাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন ফকিরমুরা ও পার্শ্ববর্তী গাঁবাসী।
যখন এঁদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তখন সঙ্গে ছিলেন মুক্তিফৌজের এক অফিসার। এঁর বাড়ি হলাে মৈমনসিংহ-এ, আর ইনি নিজেই জানেন না কি হয়েছে নিজ পরিবারের লােকজনের। এঁদের সকলের সঙ্গে কথা বার্তার সময়ে বিদেশিনী শ্রীমতি মারেলিন বললেন এঁরা জিতবেনই কারণ এরা পেট্রিয়ট আর লড়ছে মাতৃভাষা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য।
হঁ্যা, ফকিরমুরা অঞ্চলে যাওয়া-আসা কালে আখাউড়ার রাস্তায় দেখা হলাে বহু গ্রামবাসীর সঙ্গে যারা দুদিন বা তিনদিন মুক্তিফৌজ পরিচালিত আশ্রয় শিবিরে থেকে ফিরে যাচ্ছে গরু ছাগল মুরগিসহ নিজ নিজ গাঁয়ে।
আবার আগরতলা হাসপাতালে দেখা গেল ১০/১২ বছর বয়স্ক বালক দানেশকে। গঙ্গাসাগর অঞ্চলের দানেশ যখন গরু বাছুর নিয়ে ফিরছিল বাড়িতে তখন সে আহত হয় পাক সৈন্যের গুলিতে। দানেশের বাবামা দানেশকে এনে ভারত সীমান্তে রেখে ফিরে গেছে নিজ গাঁয়ে। এমনি ঘটনা হলাে দেগ্রামের বালক শাহজাহানেরও।
ডাক্তার রায় চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে হাসপাতালের ডাক্তার-নার্সরা সেবাযত্ন করছেন এমনি কত বালকবৃদ্ধবৃদ্ধার। ডা. রায়চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে গেলেন মি. ফ্রাঙ্ক মােরেস ও শ্রীমতি সিলভারস্টোন মগরা হতে আগত প্রায় ৭০ বছর বয়স্কা এক বৃদ্ধার নিকট। বৃদ্ধা ও তার স্বামী পাক-সৈন্যের আগমনকালে গিয়ে আশ্রয় নিলেন পুকুরের কচুরীপানার আড়ালে। পাকসৈন্য স্বামীকে লক্ষ্য করে গুলি করল। স্বামী হারিয়ে আহত বৃদ্ধা যখন পুকুর হতে উপরে উঠলেন তখন গাঁয়ের যুব তরুণ কয়জন আহত বৃদ্ধাকে পৌছে দিয়ে গেল ভারত সীমান্তে।
এমনি সব ঘটনা। একজন মন্তব্য করলেন বর্বর…। সত্যই তাই। কারণ তারপরই দেখলাম দুজনকে যারা হারিয়ে ফেলেছেন জ্ঞান গম্যি। কিন্তু, কেন? এর উত্তর ওঁরা দুজন দিতে পারেননি। তবে দেখা গেল যে উভয়ে যা পাচ্ছে তা কামড়াচ্ছে এমনভাবে যাতে প্রকাশ পায় এক তীব্র ঘৃণা ও ক্রোধের। পাশেই দেখা গেল গুলি ও বেয়নেট দ্বারা আহত সামসুদ্দিন আহমদকে। আখাউড়ার রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার বললেন: আমি নিজে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে ছিলাম বর্মা ফ্রন্টে; কিন্তু “Never saw such acts of barbarism” [এমন বর্বরতা আমি দেখিনি] …তারপর অশ্রুসিক্ত নয়নে যেন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ইনি মি. মােরেসকে বললেন ভারতীয়দের মতাে এমন উদার [generous] মানুষও দেখিনি…।
সামসুদ্দিন সাহেবের কথা শুনে উপস্থিত ডাক্তার রায় চৌধুরী, মি. মােরেস, শ্রীমতি সিলভার স্টোন প্রভৃতির নয়ন হলাে অশ্রুসিক্ত। ডাক্তার-নার্সরা বললেন আমরা আর কিই বা করতে পারলাম? সামসুদ্দিন সাহেব বা দানেশ বা শাহজাহান হলাে ধর্ম বিশ্বাসের দিক হতে ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসী। কসবার তফাজ্জল আলীও ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসী। অথচ আজ কুমিল্লা জেলায় তফাজ্জল আলী বেঈমান। কারণ তফাজ্জল আলী নিজের পাকা বাড়িতে পাঠা ছাগল মুরগি এনে পাক সৈন্যর খাওয়া থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। এইচ টি, আলীর সহায়তায় এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাক সৈন্য গাঁয়ের বাজার-দোকান-থানা দিয়েছে জ্বালিয়ে, আর তৃতীয় সপ্তাহে পুড়িয়ে দিয়েছে দুচারটে বাড়ি যাতে করে মুক্তি ফৌজ এসে আশ্রয় নিয়ে পাক সৈন্যর কোনাে ক্ষতি করতে সক্ষম না হয়। কিন্তু, এতদসত্ত্বেও মুক্তি ফৌজ উড়িয়ে দিয়েছে তফাজ্জল আলীর বাড়ির একাংশ।
কমলা সাগরের পাশেই বাংলাদেশের সীমান্ত। কসবা রেলস্টেশন উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। দূরে হলাে সাদা রং এর তফজ্জালের বাড়ি। আর গায়ে যারা আছে তারা হলাে মুসলিম লীগের লােক। এদেরই সহায়তায় পাক সৈন্যরা দু’দশটা ছােট ছােট মুসলিম পতাকা উড়িয়ে ঘােষণা করছে নিজেদের বেঈমানীরমাতৃভাষা ও পেট্রিয়টিজমের বিরুদ্ধে। এতাে গেল সাধারণ গ্রামবাসীর কথা—যারা ঠিক সগ্রামী ক্ষেত্রের বাইরে কাজ করছে মাঠে-ঘাটে। আর এই সাধারণ মানুষের সহায়তায় যাঁরা সগ্রাম করছেন পাক সৈন্যর বিরুদ্ধে সেই মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর মৈন, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর জিয়া প্রভৃতিকে দেখলে মনে হবে যে এঁরা ভিন্ন ধাতুতে গড়া। শুধু তাই নয়। মুক্তি ফৌজে যােগদানকারীদের ট্রেনিংও সত্যই প্রশংসনীয়। আবার এঁদেরই সঙ্গে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রকিব ও হবিগঞ্জের আকবর [ উভয়েই ছিলেন ওখানকার এস, ডি, ও]। ওদিকে চাঁদপুরের লে, দেদার আলম, ফ্লাইট লে. সিদ্দিকিকে দেখলে মনে হবে যেন তারুণ্যের প্রতীক। এবং এঁরা সকলে ও ছাত্র যুব-অন্যান্য নেতাদের দেখে এই বিশ্বাসই দৃঢ়তর হবে যে মুক্তি সগ্রাম দীর্ঘতর হওয়া সত্ত্বেও জয়ী এঁরা হবেনই।
পরিশেষে
আজ যদি আমাদের সমর্থন থেকে থাকে এই গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে, তবে আমাদের দায়িত্ববােধজাত চলাফেরা ও কর্মকাণ্ডও হওয়া উচিত যুক্তিপূর্ণ। এদিক দিয়ে আমাদের মনে রাখা প্রয়ােজন যে আমরা এমন কিছু করব না যাতে ভারতীয় রাষ্ট্রের অবস্থা হয় জটিলতর আর ঐ সগ্রামীদের সগ্রামী শক্তি হয়ে পড়ে দুর্বল।
দ্বিতীয়ত যদি আমাদের সমর্থন থেকে থাকে এই সগ্রামের পক্ষে তবে আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে এই সাময়িক আশ্রয়প্রার্থীদের সর্বদিক দিয়ে সাহায্য করাও আমাদেরই দায়িত্ব।
তৃতীয়ত এই সগ্রাম যদি প্রগতিশীল হয়ে থাকে তবে সব প্রগতিশীল শক্তির কর্তব্য হচ্ছে সব রকম মননামালিন্য ও পার্থক্য পরিত্যাগ করে যুক্তভাবে ঐ সগ্রামের পক্ষে এসে দাঁড়ান। মনে রাখা প্রয়ােজন যে দলীয় স্বার্থের উর্দ্ধে হলাে ঐতিহাসিক ধারা।
চতুর্থত আজ প্রয়ােজন পিকিংনীতির বিরুদ্ধে সুস্থ ও যুক্তিপূর্ণ গণমন গড়ে তােলা। তাছাড়া একথা মনে রাখা দরকার যে ঢাকা শহরে ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার আরবারের সঙ্গে যে দু’জন চীনা বিশেষজ্ঞ ছিলেন [ মুক্তি ফৌজের দায়িত্বশীল লােকের মতে] তারাই বুদ্ধি জুগিয়েছেন পাক সৈন্যর কাজকর্মের। তাছাড়া, ঢাকা হতে প্রকাশিত গণশক্তিতে [ ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১) “ষড়যন্ত্রের রাজনীতি” শিরােনামায় যে প্রবন্ধ বেরিয়ে ছিল তাতে শেখ মুজিবর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে মার্কিন দালাল বলে। অতএব পিকিং-আলবেনিয়ার পাকিস্তানি দরদ এবং নর্থ কোরিয়ার দর্শকের ভূমিকা- এই ত্রিভুজের ভারতীয় সহযাত্রী পৃথিবীর প্রগতিশীল সংগ্রামের পরিপূরক কিনা তাও হবে বিচার্য বিষয়।
অমর রাহা
সূত্র: কম্পাস, ৮ই মে ১৯৭১