বাংলাদেশ বাহিনীর জন্য প্রয়ােজনীয় গেরিলাযুদ্ধের মূলসূত্র
আব্দুল কাদের
১. মাত্র আশি হাজার সৈন্য নিয়ে সাড়ে সাতকোটি মানুষকে তাবে রাখা যায় না। ট্যাংক, বিমান, গানবােট নিয়েও পাকিস্তানি বাহিনী সর্বত্র টহল দিতে পারবে না। সুতরাং সুবিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মুক্তিফৌজ গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পশ্চিমী হানাদারদের একে একে সাবাড় করে দিতে পারবে। খানদের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে জনসাধারণের যােগ নেই। তাই এদের ভয় করার কারণ নেই। এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। বাংলাদেশের জনগণের জয় হবেই। কিন্তু আমরা দ্রুত জয় লাভ করবাে এ কথা ভাবলে মারাত্মক ভুল হবে। একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ভিতর দিয়ে নিজেদের শক্তিকে ধীরে ধীরে বাড়িয়ে এবং জনসাধারণের সহযােগিতায় শক্রর শক্তিকে ধীরে ধীরে খর্ব করে আমরা জয়লাভের পথে এগিয়ে যাবাে।
২. সদাসর্বদা দেখতে হবে কীভাবে নিজেদের শক্তিকে অটুট রেখে পশ্চিমী হানাদারদের নিপাত করা যায়। অনেক সময় নিজেকে বলি দিয়েই নিজের বন্ধুদের ও নিজের জাতিকে বাঁচাতে হবে।
৩. পশ্চিমী হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের মানুষরা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং আমরা আমাদের দেশ রক্ষার জন্য লড়ছি। সুতরাং দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে আমরা জিতবােই।
৪.আমাদের প্রত্যেক সৈনিককে ধারণা দিতে হবে, কেন আমরা যুদ্ধ করছি? রাজনীতি সম্পর্কে তাদের অজ্ঞ রাখলে চলবে না। আমাদের সামনে মাতৃভূমি রক্ষার আদর্শ সবসময় তুলে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে, পাকসেনাদের মধ্যে এমন কোনাে মহৎ উদ্দেশ্য নেই। তারা শুধু মাইনের জন্য যুদ্ধ করছে। বালুচ ও পাঠান সৈন্যদের মধ্যে এখনই এমন একটা ধারণা জেগেছে যে এই যুদ্ধ নিরর্থক। অস্ত্র ছাড়া পাকসেনাদের কোনাে শক্তি নেই। আমাদের শক্তি মনােবল। পাক হানাদারদের মনােবল নেই বললেই চলে।
৫. আমাদের অনেক সময়ই গেরিলা যুদ্ধের পথ ধরতে হবে। গেরিলা যুদ্ধে আক্রমণগুলাে আচমকা আঘাতের রূপ নেবে। আর গেরিলা যুদ্ধে আসল লড়াই খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ করেই গেরিলা বাহিনীকে লড়াইয়ের জায়গা থেকে সরে পড়তে হবে। সুতরাং গেরিলা ইউনিটকে অল্প শত্রুর বিরুদ্ধে বেশি যােদ্ধা লাগিয়ে খুব তাড়াতাড়ি শয়তানদের খতম করে জমির সঙ্গে মিলিয়ে যেতে হবে। চুপচাপ বসে থেকে প্রতিরক্ষার চেষ্টা করা, গড়িমসি করা বা লড়াইয়ের আগে নিজেদের শক্তিকে বহু জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়া গেরিলা ইউনিটের পক্ষে অপরাধ বলে গণ্য হবে। বিশেষ বিশেষ জায়গায় পাহাড়ে, জঙ্গলে, নদীপথে শত্রুকে হয়রান করার জন্য গেরিলারা প্রতিরক্ষামূলক কাজে নামতে পারে। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধের মূলসূত্র হবে আকস্মিক আক্রমণ আর আক্রমণ। সর্বদা খেয়াল রাখতে হবে যে শত্রু সৈন্যের একটি ক্ষুদ্র অংশের উপর আঘাত হানার জন্য একটা বড় সেনাবাহিনী সমাবেশ করা চাই। এই মূলনীতি সর্বদা যেন অনুসরণ করা হয়। শত্রুকে ছােট ছােট দলে পরিবেষ্টিত করে তাকে ধ্বংস করে সরে পড়তে হবে এবং নিজেদের ইউনিটগুলাের মধ্যে সর্বদা যােগাযােগ রাখতে হবে। এই যােগাযােগের জন্য ট্রান্সমিটার ছাড়াও ধুম্র নিশান, আয়নার মাঝ দিয়ে বিচ্ছুরিত আলাে নিশান, শিক্ষিত পায়রাও ব্যবহার করা যেতে পারে।
৬. গেরিলা যুদ্ধের একটা মূল কথা হচ্ছে নিজে যুদ্ধ করার স্বাধীনতা রাখা আর শত্রুর কাছ থেকে এই স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া। আমরা যুদ্ধ করব আমাদের সুবিধামতাে আর শত্রু বেকায়দায় পড়ে শুধু যান্ত্রিকভাবে তার উত্তর দিতে চেষ্টা করবে এই অবস্থাটা সর্বদা বজায় রাখতে হবে। অধিকাংশ গেরিলা ইউনিটই কঠিন পরিবেশে যুদ্ধ করে। কিন্তু ইনিশিয়েটিভ অর্থাৎ নিজে কাজ করার ক্ষমতা তাদের অর্জন করতে হবে এবং রাখতে হবে। পুনঃপুনঃ অতর্কিত আক্রমণ করে শত্রুকে ধ্বংস করে বাতাসের সঙ্গে মিলিয়ে গিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখিয়ে অবস্থা বুঝে তড়িৎ গতিতে ব্যবস্থা অবলম্বন করে বলশালী শত্রুকে ক্ষীণ করে ফেলতে হবে। যে কারণে গেরিলা ইউনিটগুলাে ছােট এবং দুর্বল, ঠিক সেই জন্যেই সেগুলাে শত্রু বাহিনীর পিছন দিকে রহস্যজনকভাবে কাজকর্ম চালাতে এবং আচমকা অপ্রত্যাশিত জায়গায় হাজির হতে পারে আবার তেমনই উধাও হয়ে যেতে পারে শত্ৰু কিছু বুঝবার আগেই।
৭. সফল গেরিলাযুদ্ধ চালাতে গেলে ব্যবস্থা-অবস্থার সর্বদা সঠিক মূল্যায়ন দরকার। হতাশাপীড়িত হয়ে বসে থাকলে যেমন পরাজিত হতে হবে তেমনই বৃথা আশা করে হঠকারিতা করলেও ফল পেতে হবে। বাস্তব অবস্থার মূল্যায়নের ক্ষমতা দিয়েই গেরিলা ইউনিটের নেতা নির্বাচন করতে হবে। এক জায়গায় অবস্থা খারাপ দেখলে সেখান থেকে সরে গিয়ে শত্রুকে অন্যত্র আঘাত হানার সুযােগ খুঁজতে হবে।
৮. কুশলী জেলে যেমন জাল ছড়িয়ে ফেলে দৃঢ়ভাবে গুটিয়ে তােলে; ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করে গেরিলা সেনানায়ক তেমনই সৈন্যদের ছড়িয়ে দিয়ে শত্রুকে আক্রমণের ঠিক আগে তাদের শক্ত হাতে কেন্দ্রীভূত করবেন এবং কাজ শেষ হলেই তাদের ছড়িয়ে দিয়ে নতুন জায়গায় তাদের সমাবেশ করে শত্রু ধ্বংসের জন্য তৈরি হবেন।
৯. গেরিলা ইউনিটের সৈন্যদের সমানভাবে ছড়িয়ে দেওয়া চলবে না। কোনও একটা সুবিধাজনক জায়গায় সৈন্যশক্তির একটা বড় অংশ যেন সমাবিষ্ট থাকে—দরকার মতাে এই জায়গাটা বদলাতে হবে। আর বিক্ষিপ্ত ইউনিটগুলাের জন্য স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট কর্তব্যভাগ, সামরিক কাজকর্মের জায়গা, সামরিক কাজকর্মের সময় সীমা আর পরে একত্র মিলবার স্থান এবং যােগাযােগের উপায় উপকরণ সর্বদা ঠিক করে দিতে হবে।
১০. কোনাে বিশেষ স্থানে শক্রর সৈন্যবাহিনী গুরুতর ভয়ের কারণ হয়ে উঠলে গেরিলা ইউনিটগুলাের সেখানে গড়িমসি করা উচিত নয়। বিদ্যুৎগতিতে তাদের অন্যত্র সরে পড়া উচিত। শত্রুকে ভুলপথে চালাবার জন্যে তাকে ফাঁদে ফেলার জন্যে উচিত পূর্বাঞ্চলে আক্রমণের ভান করে পশ্চিমাঞ্চলে সত্যিকারের আক্রমণ চালানাে—এই দক্ষিণে হামলা করা আর পরক্ষণই উত্তরে গিয়ে হাজির হওয়া। এসবের জন্যে একান্ত গােপনতা আবশ্যক। একটি বাঁশের মধ্যে কারবাইন ঢুকিয়ে ফাটানাে হচ্ছে উত্তর দিকে। শত্রুর ধারণা হলাে উত্তর দিক থেকে তাদের আক্রমণ করা হচ্ছে। উত্তর দিকে যখন তারা বেরিয়ে পড়বে, তখন আমাদের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ করতে হবে।
১১. উপযুক্ত পরিকল্পনা ছাড়া গেরিলা যুদ্ধে জয় অসম্ভব। গেরিলা যুদ্ধ এলােমেলােভাবে চালানাে যায় না। বাস্তব পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করা, কর্তব্য ঠিক করা, সৈন্যশক্তির উপযুক্ত বিন্যাস করা, সামরিক ও রাজনৈতিক ট্রেনিং দেওয়া, সাজসরঞ্জামগুলােকে ভালােভাবে রাখা, জনগণের সমর্থন সাহায্যের যথাযােগ্য ব্যবহার করা—এ সবই হচ্ছে গেরিলা সেনাপতির কাজকর্মের অঙ্গ।
১২. শত্রু যখন তার সুবিধা মতাে প্রবল শক্তি নিয়ে আক্রমণ করবে, তখন আমাদের ঘাল্টি মেরে সরে পড়তে হবে। প্রবল শত্রুর আক্রমণের সময় পাল্টা আঘাত হেনে মিছিমিছি শক্তি ক্ষয় করা উচিত নয়।
১৩. শত্রু যখন অসতর্ক, বিশ্রাম করছে, খাচ্ছে বা ঘুমাচ্ছে, তখন সুযােগ বুঝে আক্রমণ করতে হবে। দূর থেকে শত্রুরা কখন কী করছে, তা আগে দেখে নিতে হবে।
১৪. গেরিলা যােদ্ধারা যাতে কোনাে ঘরের মধ্যে আকা না পড়েন, সেদিকে নজর দিতে হবে। চলাফেরার সময় আমাদের সঙ্গে ছােটো ছােটো অস্ত্র রাখতে হবে। ভালাে করাত, ডিনামাইট, শাবল, কোদাল ও রেলের ক্রোবার দিয়ে আমরা শত্রুর পক্ষে ক্ষতিকর অনেক কাজ করতে পারি।
১৫. জনসাধারণের সঙ্গে যােগ স্থাপন না করে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধ সম্ভব নয়। গেরিলা যােদ্ধাদের মধ্যে অফিসার ও সাধারণ সৈনিক খাওয়া দাওয়ায়, পােশাক-পরিচ্ছদে ও মানসম্রমে কোনাে পার্থক্য থাকবে তবে অফিসারের কথা প্রত্যেক যােদ্ধাকে মানতেই হবে। সৈন্যবাহিনী ও জনসাধারণের মধ্যে সব বিষয়ে সহযােগিতা চাই। যেমন, সৈন্যরা যখন যুদ্ধ চালাচ্ছেন, তখন তাঁদের পরিবারের দেখাশােনার ভার নিজ নিজ গ্রামের মানুষকেই নিতে হবে। শক্ররা জনসাধারণ ও যােদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির যত চেষ্টাই করুক না কেন সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে হবে। সৈন্যদেরও অবসর সময়ে ফসল বােনা ও ফসল কাটার কাজ করতে হবে। সৈন্যদের মধ্যে যাঁরা কলকারখানার কাজ করতে জানেন, অবসর সময়ে এ সব কাজও তাদের করতে হবে। এভাবে খেটে-খাওয়া মানুষদের সৈন্যরা আপনজন বলে ভাবতে পারবেন। জনসাধারণও সৈন্যদের আপন হিসেবে নিতে পারবেন। তাছাড়া, তার ফলে দেশের উৎপাদনও বাড়বে।
১৬. গেরিলাযােদ্ধারা প্রয়ােজন ও সুবিধা থাকলে বিদেশের সাহায্য নেবেন, তবে শুধু তার উপরই নির্ভর করবেন না। গেরিলা যােদ্ধারা প্রধানত শত্রুদের কাছ থেকেই ছিনিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করবেন। শত্রুরা যখন বিক্ষিপ্ত বা দলবদ্ধভাবে যাচ্ছে, তখন আড়াল থেকে তাদের উপর আচমকা আক্রমণ চালিয়ে এদের হত্যা বা আহত করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে হবে।
১৭. জামায়েত-ই ইসলাম ও মুসলিম লীগের লােকদের সঙ্গে জনসাধারণের যােগ নেই। এদের মধ্যে প্রচার চালিয়ে নিজেদের পক্ষে টানতে হবে। এসব মীরজাফররা যাতে হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলতে না পারে, এ বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। পাক হানাদারদের এসব চরদের কাউকে হত্যা করার আগে যদি সম্ভব হয় এদের বােঝানাে দরকার যে এদের পশ্চিমীরা কাজে লাগাচ্ছে। যদি দেখি, তাতে কোনাে কাজ হচ্ছে না; তখনই এদের হত্যা করতে হবে। এদের এটাও বােঝাতে হবে, এদের নিয়ে কাজ হাসিল করিয়ে পাকসৈন্যরা এদেরও রেহাই দিচ্ছে না, এদেরও গুলি করে পাকহানাদাররা মারছে। এসব বুঝিয়ে এদের দলে টানার চেষ্টা করতে হবে। সম্ভব হলে অবাঙালিদেরও বােঝাতে হবে, এ সগ্রাম, অবাঙালিদেরও বিরুদ্ধে নয়। এ জাতীয় সংগ্রাম তাদেরও নিজ নিজ প্রদেশে সিন্ধুতে, বেলুচিস্থানে বা অন্যত্র করতে হবে। এ রকম সংগ্রাম পাঞ্জাবে, সিন্ধুতে এর মধ্যেই আরম্ভ হয়ে গেছে। এই যুদ্ধের মােটা খরচ চালাতে গিয়ে ওখানকার জনসাধারণের দুঃখ কষ্ট চরমে গিয়ে পৌঁছেছে। অনেক সৈন্য মারা যাওয়াতে তাদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এই যুদ্ধে ঐ সব অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কানাকড়ি লাভও হচ্ছে না, লাভ হচ্ছে ওখানকার পুঁজিপতিদের। সম্ভব হলে এসব কথা উর্দু, পাঞ্জাবী, সিন্ধী বা পােশতু ভাষায় লিখে প্রচারপত্র ছাপতে হবে ও ছড়িয়ে দিতে হবে। বাঙালি চরদের দলে টানা সম্ভব হলেও অনেকদিন এদের আচার-আচরণ, চলাফেরার উপর কড়া নজর রাখতে হবে। নতুন দলে টানা লােকগুলােকে প্রথমেই বেশি বিশ্বাস করলে ঠকতে হবে।
১৮. বর্ষার সময় পাট খেতে বা ধান খেতে গেরিলা যােদ্ধারা লুকিয়ে থেকে সুবিধামতাে শত্রুর উপর আঘাত হানতে পারেন। শীতকালে ধান কাটার সময় গেরিলা যােদ্ধাদের অনুরােধে চাষিরা যদি ধান গাছের লম্বা লম্বা গােড়া রেখে দেন, তাহলে ধানক্ষেতগুলােতে গেরিলা যােদ্ধারা লুকিয়ে থেকে আচমকা আক্রমণ করতে পারেন। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়, মৈমনসিংহের উত্তরে গারাে পাহাড়, কুমিল্লার ময়নামতি পাহাড়, ভাওয়াল বা মধুপুরের গড়, শ্রীহট্ট-মৈমনসিংহের হাওর, বরিশালের খালবিল নদীনালা, খুলনার দক্ষিণে সুন্দরবন প্রভৃতি ভৌগােলিক সুবিধাগুলাে গেরিলা যােদ্ধাদের সব সময়ই অনুকূল থাকবে। বর্ষাকালে বাংলাদেশের একেকটি অঞ্চল জলঘেরা দ্বীপের মতাে হয়ে উঠে। তখন এগুলাে সত্যি সত্যি মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠবে! এই সময় গেরিলা যােদ্ধাদের কাজ হবে (ক) শত্রুকে নদীনালা খালবিল পেরিয়ে আসতে না দেওয়া। ধরা যাক, এক মাঝি বাধ্য হলাে শত্রু সৈন্যদের খেয়া পার করে দিতে। এরা সাঁতার জানে কিনা জেনে নিয়ে ঐ মাঝি নৌকো ডুবিয়ে দিয়ে এদের অস্ত্র ছিনিয়ে গেরিলা যােদ্ধাদের হাতে পৌছিয়ে দিতে পারেন। এভাবে শত্রুসৈন্যরা জলেই ডুবে গেল। এরকম উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় পূর্ব রণাঙ্গনে এক মাঝি দিয়েছেন। মুক্তিযােদ্ধাদের দেশী নৌকো আর ভেলা ছাড়া কিছু থাকবে না। আর অন্য দিকে পাক সৈন্যদের স্টিমার-লঞ্চ ইত্যাদি থাকবে। প্রতি পদে পদে স্টিমার-লঞ্চ এগিয়ে আসার পথে বাধা দিতে হবে। যদি শত্রুরা একবার জলঘেরা একটি বিশেষ অঞ্চলে এসে পৌছােতেই পারে, তাহলে তখনই সঙ্গে সঙ্গে আমরা মুক্তিযোেদ্ধারা নদীনালা পেরিয়ে ঐ রকম আরেকটি দ্বীপে সরে পড়বাে। (খ) অন্য দ্বীপগুলাের মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে সবসময় যােগাযােগ রাখতে হবে। (গ) দ্বীপের মতাে জলঘেরা এক একটি অঞ্চলের জনসাধারণ ও যােদ্ধাদের খাওয়া-পরা অস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের যাতে অভাব না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। অর্থাৎ এরকম প্রতিটি অঞ্চলকে সব দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। (ঘ) শত্রু বিমান থেকে বােমা ফেলার আগেই মাটির তলায় আশ্রয় নেওয়া যায়, তার জন্য মাটি খুঁড়ে বড়াে বড়াে সুড়ঙ্গ করে রাখতে হবে। বর্ষায় যাতে সুড়ঙ্গগুলােতে জল না জমে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। বিমান আক্রমণ ঠেকানাের জন্য বিমান ঘাঁটিতে নামার পথে বাধা সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য মাঠ থাকলেই অনেকটা জায়গা জুড়ে লম্বা লম্বা বাঁশ পুততে হবে। শত্রু সৈন্য যখন এসেই গেছে, তখন তাদের সামনা সামনি গিয়ে বড়াে বড়াে গাছের গুঁড়ি অনেকগুলাে একটার উপর আরেকটা রেখে অনেকটা উঁচু করে তার ফাক দিয়ে আড়াল থেকে গেরিলা যােদ্ধারা শত্রুদের তাক করে গুলি করতে পারেন। এসব পদ্ধতি বলাই বাহুল্য, শুধু বর্ষায় নয়, সব সময়ই অবলম্বন করা উচিত। ১৯. শত্রুদের খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বানচাল করা চাই। ধরা যাক, শত্রুরা ক্ষুধার্ত। আমাদের একজন ফেরিওয়ালা সেজে আম কাঠালের মতাে ঠিক দেখতে কতগুলাে বােমা পটকা বানিয়ে এদের সামনে গিয়ে হাজির হলেন। সুবিধা বুঝে এসব বােমা-পটকা ছুঁড়ে তিনি শত্রুদের ঘায়েল করতে পারেন। একটি পাঠা, ছাগল, খাসি বা গরুর গলায় মাইন বেঁধে শত্রুদের ঘাটির দিকে আমরা ছেড়ে দিলাম। শত্রুসৈন্যরা এর মাংস খাওয়ার লােভে দূর থেকে একে যদি গুলি করে, তাহলে মাইন ফেটে মুহূর্তের মধ্যে সব শত্রু পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। তখন বীরাঙ্গনা রােশেনারার (যিনি বাংলাদেশের রণাঙ্গনে নিজেকে বলি দিয়ে মাইন ফাটিয়ে শত্রুর ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছেন) কাজ বিনা আত্মবিসর্জনেই সম্ভব হবে।
সূত্র: কম্পাস, ১৯.৬.১৯৭১