বাংলাদেশে সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলােতে (৯)
শকুন্তল সেন
সবেমাত্র রাত সাড়ে ৯টা দশটা। রাস্তাঘাট নির্জন। এখানে সেখানে মুক্তিফৌজের সেনারা পাহারা দিচ্ছে। বরিশাল বন্দর সুপ্ত। দিনকাল ভালাে থাকলে এ সময় সারা শহর গমগম করত, বিশেষ করে এই গরমের সময়। রাত বারােটা একটা পর্যন্ত লােকেরা নদীর তীরে হাওয়া খেত। শতশত মানুষ বন্দর এলাকায় শুয়ে থাকত। কিন্তু ঢাকার ঘটনায় ও তারপর সে দিনের তথাকথিত মিলিটারি শিপের’ গুজবের পর আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ বন্দর এলাকা দিয়ে চলাফেরা ছেড়েই দিয়েছে। অন্ধকার রাজপথ দিয়ে হােটেলে ফিরে এলাম। এই বিরাট হােটেল নিঝুম রাজপুরী। মনে হলাে কোনাে এক দৈত্য মন্ত্রবলে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে সকলকে। হােটেলের লাগােয়া রেস্টুরেন্টে জমজমাট ভাব নেই। এই রেস্টুরেন্টে অনেকটা আমাদের শহরের কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসের মতাে ভিড় আর তরুণ ও যুবকদের আড্ডাকেন্দ্র-তবে মেয়েদের কখনও চোখে পড়েনি! এসে পর্যন্ত দেখেছি ম্যানেজার থেকে শুরু করে সকলেই রেডিওর নবৃ’ ঘুরিয়ে চলেছে খবরের আশায়, ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে রেডিও অস্ট্রেলিয়া, হয়ত আরও অনেক সেন্টার। ইন্ডিয়ার বাংলা হিন্দি ইংরেজি কি না শুনছে অথচ একই খবর। ওদের ধারণা বাংলায় না বললেও হয়ত ইংরাজিতে অথবা হিন্দিতে কোনও জরুরি খবর বলতে পারে। হায়রে আশা! রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখলাম প্রায় সব টেবিল ভর্তি কিন্তু কোনও সাড়া শব্দ নেই। কেমন যেন অবসাদগ্রস্ত। মৃদু আলাে জ্বলছে। রেডিও শুনবার ইচ্ছা কারু আছে বলে মনে হ’ল না। চাপা, ফিসফাস শব্দ। কিছু খাবার কথা বলে বসলাম। দুজন তরুণ বসে আছে। আমার দিকে এক পলক চেয়ে খাবার দিকে মনযােগ দিল। একজন প্রশ্ন করল “কি বলল ইন্ডিয়ার খবরে। স্বীকৃতির কথা কিছু বলল?”
গভীর বিষাদ ভরা কণ্ঠে অপরজন “না তারা ভাবছে।” “রাশিয়া, মিশর
“ভারতই ভাবছে আর রাশিয়া মিশর ততা, সাত হাত পানির নিচে। থােও ফালাইয়া সকলেরে দেখা আছে। চল যাই—মায় ভাবব।” ওর স্বরগ্রাম উদারা মূদারা ছাড়িয়ে বােধ হয় তারায় গিয়ে পৌছেছিল।
সচকিত হয়ে অনেকেই তাকাল! কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা এক সঙ্গে অনেক আওয়াজ। বরফ যেন হঠাৎই গলল।
কে যেন বলে উঠল “ইন্ডিয়ার নেতা যদি আজ নেহেরু হতাে তাহলে ইয়াহিয়ার বাপের নাম ভুলিয়ে দিত। মেয়েমানুষের কর্ম নয়।”
জবাবে “ইন্ডিয়ার না হয় মেয়ে-মানুষ কিন্তু আপনার রাশিয়া, কিউবা, যুগােশ্লাভিয়া এরা তাে ব্যাটা ছাওয়াল। এরা সব মুখ বুজে আছে কেন?”
হাে হাে করে হাসি অনেকের। এসব শুনতে ভালােই লাগছিল। রাত অনেক হয়েছে। চলে এলাম নিজের ঘরে।
তারপর দিন এমনি করেই গেল। সন্ধ্যার দিকে মেজর সাহেব বললেন একটা লঞ্চ যাচ্ছে হুলারহাট পর্যন্ত। মনে মনে স্থির করে ফেললাম যাব হুলারহাট। বললাম মেজর সাহেবকে। তিনি না, না, করে উঠলেন। কোথায় যাব বিদেশ বিভূঁই। কাউকে চিনি না জানি না। শেষে কোনাে বিপদে পড়ে যাব।
কিছুতেই রাজী হন না। ভদ্রলোেক সত্যিই আমাকে ভালােবেসে ফেলেছেন। যে কদিন খানের পােরা না আসে এখানেই থাকেন এক সঙ্গেই যুদ্ধ করব মরব এক সাথেই। মাথা খারাপ নাকি। তােমাদের যুদ্ধ তােমরা বােঝ, আমি ওসবের মধ্যে নেই বাবা মনে-মনে বলি। চুপ করে থাকি। হা হা করে হেসে উঠলেন “আরে যুদ্ধ আমরা কেউই করব না। এই রাইফেল আর বন্দুক নিয়ে কি যুদ্ধ করা যায়। খানের পুতেরা আসবে আসবে শুনলেই, গ্রামের দিকে লম্বা দেব। কোনাে ভয় নেই। কিন্তু আমার মন টলে গেছে। অবশেষে বললেন, “ঠিক আছে যাবেন যখন যান।”
ভােরবেলা নিজেই এলেন হােটেলে, চা টোস্ট খাইয়ে লঞ্চে তুলে দিলেন। সজল চক্ষে বিদায় দেবার সময় বললেন “আল্লার কাছে দোয়া করি যেখানে থাকেন ভালাে থাকেন। যদি কোনােদিন সময় আসে সুযােগ হয় আল্লায় দিলে আবার দেখা হবে। আমাদের জন্য, শেখ সাহেবের জন্য আল্লার কাছে দোয়া করবেন। আমাদের দিন আসছে। ঠিক ঠিক পৌছতে পারলে নিজের এলাকায় খানদের বিরুদ্ধে লড়বার চেষ্টা করুন।” উনি চলে গেলেন। এদিকে লঞ্চ ছাড়ে না। কিছুক্ষণ পরে হাবিলদারের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা লঞ্চে এল। সেই ভিড় থেকে একজন প্রৌঢ় ও এক অল্পবয়স্কা মহিলা আর দুতিনটি বাচ্চাকে নামিয়ে নিয়ে গেল। বাচ্চাগুলাে অবুঝ। অঝােরে কাঁদছে, মহিলাটাও একে তাকে মিনতি করছে-প্রৌঢ় চুপ। জানা গেল এই লােকটি পুলিশে কাজ করত বিহারী। মহিলাটি বাঙালি। বেশ কিছুদিন থেকেই গােপনে সামরিক কর্তৃপক্ষকে নাকি খবর সরবরাহ করে আসছিল। আরও মারাত্মক সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা লাগাবার চেষ্টা করছিল গত ক’দিন ধরেই। নজরবন্দি অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও কী করে যেন আজ পালিয়ে লঞ্চে উঠেছে উদ্দেশ্য কোনাে রকমে খুলনা পৌছানাে! মুক্তিসেনারা খবর পেয়ে নিয়ে গেল। বাচ্চাগুলাের কান্নায় আমার চোখে জল এল। ওদের ধারণা বাবাকে বুঝি কেটেই ফেলবে। আমার ছােট্ট মেয়েটির কথা মনে পড়ল—অজান্তে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
আড়িয়ল খাঁ নদী দিয়ে নাম না জানা কত জায়গায় থেমে বেলা ১১টা নাগাদ এসে পৌছলাম হুলারহাট। এখান থেকে টানা পিচঢালা রাজপথ চলে গেছে পিরােজপুর। রিক্সা ফ্রি আওয়ামী লীগ-এর নির্দেশ। জয় বাংলার পতাকা লাগিয়ে অসংখ্য রিক্সা শরণার্থীদের আনছে ও নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দুধার সারিবদ্ধ নারকেল ও ঝাউগাছ। অগুন্তি ডাব। একটু যেতে না যেতেই জোর করে রিক্সা থামিয়ে ছেলেরা ডাব খাওয়াচ্ছে। যত বলি পেটে জায়গা নেই হাসে ওরা। তাও কি হয়। একটা ডাবে কিই বা হবে। একটা একটা করে যে কটা ডাব খেলাম কে তার হিসাব রাখে।
রিক্সাওয়ালা আর একটু উপরে যায়। বলে “খান, খান, কতদূর থেকে কত কষ্ট করে এসেছেন। এত ভালােবাসাও এদের বুকে জমাট ছিল! ইয়াহিয়া অমৃত ছেড়ে গরল পান করেছে। এলাম পিরােজপুর। ছােট্ট টাউন। ছিমছাম পরিষ্কার। খেয়া পার হয়ে এসে বাসে উঠলাম। কলকাতায় একটা বাংলা ছবিতে এ রকম বাস দেখেছিলাম। ফোর্ড কোম্পানির প্রথম আমলের গাড়ি। নড়বড়ে— তার আবার ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড ক্লাস—কানা ছেলের নাম পদ্মলােচন। বাস একেবারে ভর্তি। অনেকক্ষণ পর বারকয়েক হ্যান্ডেল মারবার পর বাস মেদিনী প্রকম্পিত করে যখন ছাড়ল তখন আমরা নবাগতরা বুঝলাম হঁ্যা, পুরােনাে আমলের খাঁটি জিনিস। ভয় পেয়ে আশে পাশের গাছ থেকে কাকগুলাে কা-কা চীকার করে উড়ে পালাল। একরাশ পােড়া পেট্রোল আর প্রচুর ধূম ও ধুলাে উড়িয়ে ছড়িয়ে মহারথ চলল বাগেরহাটের দিকে।
বাস থেকে নেমে খেয়া পার হয়ে বাগেরহাট টাউনে এলাম। জানা গেল বেলা ৩টায় একটি ট্রেন যাবে রূপসাঘাট। ওখান থেকে শরণার্থীদের নিয়ে আসবার জন্য। এই দীর্ঘ পদযাত্রায় এই প্রথম শুনলাম ট্রেন চলবার কথা! বাগেরহাট স্টেশন খুব ছােট অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। স্টাফদের অধিকাংশই নাকি পালিয়েছে। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে স্টেশনের উপর। দীর্ঘকাল ট্রেনের কামরা ধােয়া মােছা হয়নি, এক নজরেই সেটা মালুম হলাে। ট্রেন একদম ফাঁকা—আমরা সামান্য কয়েকজন মাত্র যাত্রী। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, এরপর রূপসাঘাট, তারপর ভৈরব নদী পেরুলেই ওপারে খুলনা, পাক বাহিনীর নৃশংসতার অন্য আর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। নদী পেরিয়ে সােজাসুজি শহরে যাব কি যাব না। বা দু একদিন রূপসাঘাটে থাকব। এ সময়ে খুলনা শহরে ওঠা কি ঠিক হবে? সেসব পরে ভাবা যাবে এখন তাে যাওয়া যাক, রূপসা ঘাট। ট্রেন হাঁটতে লাগল-শুনলাম এদিকের ট্রেন চলে না, হাঁটে।
সূত্র: কম্পাস, ১৯শে জুন ১৯৭১