সাদেকের বাবা বেঁচে নেই
নিমেষেই চোখের জল মুছে হেসে ফেলেছিল সাদেক। বলেছিল, কিছু মনে করবেন না, কোনােদিন মাকে ছেড়ে থাকিনি, তাই একটু…। আমি তার পিঠে হাত দিয়ে বলেছিলাম না, কিছু না এতে লজ্জার কি আছে! প্রথম প্রথম এরকম হয়ই।
গত ন’ তারিখের সকালে করিমগঞ্জের একটা হােটেলে ওদের সঙ্গে দেখা। পাঁচ ছ’জন তরুণের একটি দল আমাদের রুমের বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। আমার মনে হলাে ওরা ওপার থেকে আসছে, তাই বেরিয়ে এলাম। আমার ধারণা ভুল হয়নি। ওরা সবাই সিলেট থেকে আসছে। একজন শুধু রংপুরের সিলেট মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র। ওদের সঙ্গে আলাপ শুরু হলাে। সিলেটের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ছবি পাওয়া গেল। দলের মধ্যে একটি ছেলেকে খুব সপ্রতিভ মনে হলাে। সিলেটে আমার জানাশােনা প্রায় সবাইকে সে চেনে। দিলওয়ার, কবিভাই, মােস্তফা, মুনিম, বাসিত, মানিক সবার খবর জানলাম। তারপর কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম সেই ভদ্রমহিলার কথা—বেগম হােসনে আরা যিনি আমাদের সভাসমিতিতে নিয়মিত যেতেন। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির চোখে জল এল। আমি কিছু বুঝতে পারিনি, সঙ্গের আরেকটি ছেলে বলে ছিল সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষা বেগম হােসনে আরা সাদেকেরই মা। আমি বিস্ময়ে তাকালাম। সেই ছােট্ট সাদেক এতবড় হয়ে গেছে ভাবতে অবাক লাগে। সে তখন ভাঙা গলায় বলছে আজ সাতদিন মায়ের সঙ্গে আমার কোনাে যােগাযােগ নেই। ওরা কেমন আছেন কোথায় আছেন কিছুই জানি না। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বলি-দুঃখ করে লাভ নেই, তােমার তাে সাতদিন, আমি সাত বছর ধরে আমার মাকে দেখতে পারিনি।’
অল্প সময়ের মধ্যেই সাদেক খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। সে একে একে সিলেট শহরে সামরিক বর্বরতার ছবি তুলে ধরছিল। সে তার নিজের কথা বলছিল- প্রথমবর্ষ এম, বি. বি. এস পড়ে। সাহিত্যের দিকে খুব ঝোঁক, কবিতা পড়তে খুব ভালােবাসে। বাবা সিলেটের প্রাক্তন সিভিল সার্জন, বর্তমানে মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. সামছুদ্দিন। সে আজ মুক্তিফৌজে যােগ দিতে চলেছে। বলল কারাে সঙ্গে যােগাযােগ নেই, সবাই হয়তাে ভাববে আমি কোথায় গেলাম। এই বিলেতের একটা ঠিকানা দিলাম। ওদের জানিয়ে দেবেন আমি মুক্তি বাহিনীতে যােগ দিয়েছি। আমি সে সংবাদ যথাস্থানে পৌছে দিয়েছি।
সম্প্রতি সিলেট থেকে আরেকটি ভয়াবহ সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকদের কোয়ার্টারে হানা দিয়ে পাকিস্তানি জঙ্গীবাহিনী ডা. সামসুদ্দিন সহ আরাে ছ’জনকে ধরে নিয়ে যায়। দুদিন পর ডা, সামছুদ্দিনের বুলেট বিদ্ধ মৃতদেহ চৌহাট্টার রাজপথে ফেলে রাখা হয়। তিনদিন পর্যন্ত এ শব রাস্তায় পড়েছিল। সাংবাদিকের দায়িত্ব হিসেবে এ খবর যখন কাগজে লিখছি তখন বার বার সেই কচি তারুণ্যভরা সাদেকের মুখ ভেসে উঠছে, তাকে কি করে জানাই যে তার বাবা আর বেঁচে নেই।
অতীন দাশ
সূত্র: কম্পাস, ৮ই মে ১৯৭১