শুধু আবেগের ফেনা নয়
পূর্ববাংলার এই দারুণ বিপদে পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকা বুদ্ধিজীবীমহল, ছাত্র-ছাত্রী, যুবক-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সমেত গােটা এপার বাংলা-আবেগে ফেটে পড়েছে। এতে ওপার বাংলা প্রেরণা পাচ্ছে ও পাবে, কিন্তু এখনই এই আবেগকে সুসংগঠিত করে বাস্তব কাজে লাগাতে হবে এবং ওপারের জীবনমরণ সংগ্রামে ঠিক ঠিক যা প্রয়ােজন, যথাযথ নির্ভুলভাবে জোগাবার দায়িত্ব পশ্চিমবাংলাকে নিতে হবে।
(১) প্রথমত এই আবেগকে সুশৃঙ্খলপথে চালিত করার প্রয়ােজন ছিল এবং হয়ত এখনও আছে। যেমন যে হাজার হাজার ছাত্র ও যুবক হরিদাসপুর সীমান্তে গত কয়েকদিন ধরে বনবাদাড়ের মধ্য দিয়ে আবেগমত্ত হয়ে ওপারে যেতে চেয়েছেন এবং এপারের সীমান্ত প্রহরীরা কী অসীম ধৈৰ্য্য ও কষ্ট সহকারে অশেষ গলদঘর্ম হয়ে এই আবেগােচ্ছল জনতাকে ঠেকিয়ে রেখেছেন,- এ দৃশ্য যারা স্বচক্ষে দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, এতে প্রেরণা দাতা ও প্রাপক উভয় পক্ষের নেতৃবৃন্দকে যথেষ্ট ব্রিত হতে হয়েছে। তার বদলে যদি ২/৩ জনের এক একটি লাইন চেকপােস্টে দাঁড়াতেন এবং (সীমান্তচিহ্নের ওপারে যাওয়ার কোনাে প্রয়ােজন নেই) একটিবার স্বাধীন বাংলার পতাকাকে নীরবে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানিয়েই চলে আসার জন্য সীমান্ত প্রহরীদের বলতেন, আশা করি তাতে আমাদের প্রহরীদেরও কোনাে আপত্তি থাকত না। বস্তুতঃ ভিতরে গুটিয়ে থাকা ফ্যাসিস্ট পাঞ্জাবি- মিলিটারি ছাড়া এতে কারােই আপত্তি থাকার কথা নয়। এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সকল অভিযাত্রীই পতাকা অভিবাদনের সুযােগ পেতেন; তাদের এই সুসংবদ্ধ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন পদ্ধতিকে অভিনন্দন জানাবার মতাে এবং এপারের বাংলা যে তাদের সত্যিকার সাহায্য দেওয়ার জন্য সুসংহতভাবে প্রস্তুত, এটা উপলব্ধি করার মতাে শত চক্ষু ও প্রাণ ওপারে সব সময়েই আছে।
বস্তৃত যতক্ষণ না স্বাধীন বিপ্লবী বাংলার সরকার বা দায়িত্বশীল জনগণ আমাদের ওপারে আহ্বান না করেন, ততক্ষণ সীমান্ত অতিক্রম করার দরকার বা অধিকার বােধ হয় একজনেরও নেই।
(২) সমগ্র সীমান্তরেখা ধরে ওপার বাংলার বিপ্লবী জনতা শুধু আবেগ নয়, বাস্তব সাহায্য পাওয়ার জন্য এপারের সঙ্গে যােগাযােগ করতে উন্মুখ। একাজে এখানে একই সময়ে একই স্থলে শত শত লােকের ভিড় করার কোনাে প্রয়ােজনই নেই বরং এতে কাজের অসুবিধা। একটুখানি বিচক্ষণ নেতৃত্বে ২/৩ জনের ছােট ছােট দল সজাগ চক্ষু রাখলে তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে কখন কী সাহায্যের প্রয়ােজন, জেনে নিতে পারবেন। সাথে সাথে সুগঠিত সাহায্য ব্যবস্থা পিছনে তৈরি রাখতে হবে। বর্তমানে পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা সমগ্র সীমান্তজুড়ে এটাই প্রথম এবং প্রধান কাজ।
ইতিমধ্যে ওপারের অন্তত কয়েকটি স্থলে সংবাদ ও যােগাযােগ ব্যবস্থার জন্য পেট্রোল ও ডিজেলের জরুরি চাহিদা এবং ফার্স্ট এড ও চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া তারা আর কিছু জরুরি জিনিস চেয়েছেন, যা সাধারণের পক্ষে সগ্রহ বা বহন করা সম্ভব নয় এ সব প্রার্থিত বস্তুর কথা সম্ভাব্য প্রাপ্তিস্থলে জানিয়ে দেওয়াই সংবাদ প্রাপকের কাজ। এ সবের জন্য প্রচুর অর্থ এবং কঠোর পরিশ্রমী নীরব কর্মী চাই।
বিপ্লবী যােদ্ধাদের পােড়ামাটি নীতিতে খাদ্য সমেত বহু জিনিস নিজেদেরই নষ্ট করে দিতে হচ্ছে এবং আক্রমণকারীরাও এ সব প্রচুর পরিমাণে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে অনতিবিলম্বেই ওখানে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় বস্তুর হাহাকার উঠবে। এসব আমাদেরই দিতে হবে এবং এর জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি চাই।
ইতিমধ্যে আরও কি কি জিনিসের দরকার, খবর আসতেই থাকবে এবং সেগুলাে কী হতে পারে অনুমান করে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।
উপরােক্ত কাজের জন্য সুসংহত প্রচুর প্রতিষ্ঠান এক্ষুণি গড়ে তােলা চাই।
(৩) এই মুহূর্তেই সকল রাজনৈতিক দলের অন্তত এই ইসুতে এক হওয়া অত্যাবশ্যক। সি পি এম নব সহ সকল কংগ্রেস, সি পি আই, এস ইউ সি, ফ, ব্লক, গুখালীগ, নক্সাল ও অন্যান্য ছােট বড় সকল দলকে এখন ভেদাভেদ ভুলে একত্রে দাঁড়াতে হবে। যত বেশি সম্ভব সভাসমিতি মিছিল, বিবৃতি ইত্যাদি একত্র ব্যবস্থা করা হােক। জাপানি আক্রমণকালে চীনে চিরশত্রু মাও সে তুং এর কমিউনিস্ট পার্টি ও চিয়াং কাইসেকের কুওমিন্টং দল কিভাবে একত্র হয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়েছিল, কমিউনিস্ট সহ সকল দেশপ্রেমীদল একটিবার ভালাে করে স্মরণ করুন। পূর্ববাংলার লক্ষ লক্ষ এবং এখানকার শত শত নক্সাল, সি পি এম ও অন্যান্য দলের শহীদের মিলিত রক্তস্রোতে খুনাখুনি, গালাগালি ও বিদ্বেষের বিষাক্ত নীল খালবিলগুলাে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক। জয় বাংলার পতাকাতলে আজ সকল পার্টি পতাকা একত্রে সমবেত হােক। প্রবীণেরা যদি সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে এ মিলন যজ্ঞের হােতা হতে অক্ষম হন, তবে নবীনেরা নিশ্চয়ই তাদের ঠেলে ফেলে এ কাজে এগিয়ে আসবেন।
ওপারের বিপ্লবী বাংলা নিঃসন্দেহে এ পারের পশ্চিম বাংলার উপর অনেকখানি নির্ভর করছে। হামলার দিন তিনেক পরে ওপারের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এ পারের একজনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলেছেন‘দাদা, আমাদের দেখবেন। তাদের এ নির্ভরতা বিফল হতে পারে যদি এই সন্ধিক্ষণে ওপারের সঙ্গে এ পারের সকল দল, সকল মন সকল হাত এক না হতে পারে বিশেষভাবে তরুণ সম্প্রদায়কে এ কথা মনে প্রাণে উপলব্ধি করতে হবে।
বি. চক্রবর্তী
সূত্র: কম্পাস, ৩রা এপ্রিল ১৯৭১