You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৬ই ডিসেম্বর, সোমবার, ৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮১

অম্লান বিজয় দিবস!

আজ সেই মহান বিজয় দিবস। তিন বছর আগে ঠিক এমনি দিনে শ্যামল শোভাময় বাংলাদেশের মাটিতে আমরা উড়িয়েছিলাম রক্ত সূর্য মণ্ডিত সবুজ উজ্জ্বল জাতীয় পতাকা। দুই যুগব্যাপী বিভাষী শাসনতন্ত্রের শোষণ ও অমানবিক নৃশংস অত্যাচারের অবসান হয়েছিল সেদিন। আর এই বিশেষ দিনটি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়েছিল বিজয় দিবসের মর্যাদা নিয়ে। জাতীয় জীবনের প্রবাহমান ঐতিহ্যে ১৬ই ডিসেম্বর সেই থেকে হয়ে রইল সোনালী স্মৃতির অমর প্রতীক।
একথা সত্য যে, অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম, সাধনা ও দেশপ্রেমের বিনিময়েই আমরা পর্যুদস্ত জীবনের অধ্যায়কে করেছিলাম উৎপাটিত। অনেক সংগ্রামী অমূল্য প্রাণ, অনেক রত্নসম দেশপ্রেমিক, বহু প্রজ্ঞাবান সুধী ব্যক্তি এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ভুদ্ধ বহু উন্মত্ত কিশোর দামাল ছেলের জীবনের দামে কিনেছিলাম আমরা এই দিনটিকে। অসংখ্য মায়ের সন্তান হারানোর ব্যথা, অগণিত বধু কন্যার অবর্ণনীয় নির্যাতন, লক্ষ লক্ষ শিশু বৃদ্ধের বিকলাঙ্গ অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েই আমরা সেদিন হেসেছিলাম। গণহত্যার দুঃসহ নিষ্ঠুরতায় হৃদয় পুড়ে গেলেও সৎকারবিহীন মৃতের হাড়ের স্তুপে দাঁড়িয়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশে কুসুমকানন রচনা করার ভবিষ্যৎ বাসনায় গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় শপথও গ্রহণ করেছিলাম। লাভ-ক্ষতি সুখ দুঃখ তথা সার্বিক হাহাকারের মাঝেও বুকে বল সঞ্চার করে বীর বাঙালি বরণ করেছিল ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের আনন্দকে। তাহলে আজ দীর্ঘশ্বাস পরে কেন এই দিনে?
অনেকের ধারণা সুখের দিন বা আনন্দের দিনে সামনের ও পেছনে দু’দিকেই চাইতে হয়। তাই মনে পড়ছে একদা মাতৃভাষাকে ভালোবাসতে গিয়ে আমরা ভালোবেসেছিলাম মাতৃভূমিকে। উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম জাতীয়তাবাদী চেতনায়। সাম্প্রদায়িকতার জঘন্য প্রবণতা ও মানসিকতা বিসর্জন দিয়েছিলাম। বিভাষী সরকারের শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দেশে গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিলাম এই আমরাই। তারপর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও সংগঠন সংগ্রাম ও তারই ফলশ্রুতিতে বর্তমানের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। কত সাধের সোনার বাংলা!
এরই মধ্যে তিনটি বছরের পথপরিক্রমা আমরা শেষ করেছি। ৩৬টি মাসের প্রতিটি দিন নতুন করে সূর্য উঠেছে পূর্ব দিগন্তে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমাদের সংগ্রামী মানসিকতাকে। দেশ গড়ার এই আমাদেরই পায়ে লুটিয়ে পড়ে কেঁদেছে অবিরাম। সাধারণ নিরীহ মানুষ স্বাধীনতা লাভের অমৃত ফল লাভের আশায় পেটে পাথর বেঁধে সর্বংসহার ভূমিকা পালন করেছে। শহীদ বীর শহীদ বুদ্ধিজীবীর সহ সকল শহীদ বীর সেনা পরিবার-পরিজন স্বাধীন বাংলার স্বপন প্রাচুর্যে বিভোর হলো। কিন্তু আমাদের ইপ্সিত স্বাধীনতা কাম্যরুপে কি আজও আমাদের জাতীয় জীবনে আশীর্বাদে ডালি নিয়ে এসেছে? আজকের বিজয় দিবসের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের। অবশ্যই স্বাধীনতা দিবসের সমীক্ষায় সনিষ্ঠ আত্ম সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে দেশের কান্ডারীদের।
বরাবরের মতো এবারও স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গৃহীত হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচি। তোপধ্বনি, কুচকাওয়াজ, আলোচনা সভা, বিচিত্রানুষ্ঠান, কাঙালী ভোজন, আনন্দমেলা, প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়ানুষ্ঠান সবই নিয়মমাফিক হবে। কিন্তু বিগত তিন বছরের স্বাধীনতা-উত্তর সংগ্রামে ভুঁইফোড় এর মত যেসব চোরাচালানী, মজুতদার, মুনাফাখোর, ভেজালকারী ও সমাজ বিরোধী দুষ্কৃতিকারীর জন্ম হলো-দেশের নেতারা প্রতিদিন যাদের মুণ্ডুপাত ঘটাচ্ছেন বক্তৃতায় আর বাণী বিতরণে-তাদের জন্য বিজয় দিবসে কোন কার্যকরী কর্মসূচি গৃহীত হতে পারে নাকি? যাদের ষড়যন্ত্রে লবণে স্বয়ম্ভর দেশে আজ চূড়ান্ত কৃত্রিম সঙ্কট বিরাজ করছে, পাটের কারবার লাটে উঠেছে, চামড়া শিল্পের ক্ষেত্রে লোকসানের বোঝা ভারি হয়ে উঠেছে, শিশুখাদ্য হয়েছে ডুমুরের ফুল, দেশের অর্ধেক লোক অপুষ্টি ও রক্তহীনতায় ধুকে ধুকে মৃত্যুর দুয়ারে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এমন শত শত কুকর্ম ঘটছে-তাদেরকে চিহ্নিত করা ও শাস্তি দেয়ার কোনো বাস্তব ও কার্যকরী পরিকল্পনাও বিজয় দিবসের কর্মসূচি অঙ্গীভূত হবার যোগ্যতা রাখে না কি? অবনত মস্তকে স্বীকার করে বিগত তিনটি বছরে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি হয়েছে প্রায় অতুলনীয়। জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ও জোট নিরপেক্ষ নীতি সহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতা ভিত্তিক সহ-অবস্থানের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ও বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। আভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাধা বিপত্তি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাস্তবমুখী কষ্টকর অথচ অবশ্যই সহনীয় সমস্যা থাকা সত্ত্বেও উন্নতির হিসেব একেবারে শূন্যের কোঠায় নয়। তবু সেইটাই সব কথা নয়। কারণ এই উন্নয়ন কর্ম যতটা এগিয়ে যেতে পারতো -স্বাধীনতা-উত্তরকালে সৃষ্ট কতিপয় ঘৃণ্য জীবদের জন্য তা হতে পারছে না বলে আমরা খুব দুঃখিত এবং চূড়ান্ত রকমে হতাশাক্রান্ত হয়ে পড়েছি। তাই আজকের বিজয় দিবসের শপথ হোক -শত্রুমুক্ত করে স্বদেশকে সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করা। বহু দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ স্বীকৃত পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির যথার্থ উন্নয়নে সম্ভাব্য সকল শত্রুকে সুপরিকল্পিত উপায়ে নির্মূল করা। আমাদের ধারণায় রক্ত সূর্যের প্রতীক ধর্মী জাতীয় পতাকার নির্দেশ সেটি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিজয় দিবস’ অম্লান হোক-কলুষমুক্ত হোক। হাসি ফুটুক সাধারণ মানুষের মুখে। নবান্নের উৎসবে মুখর হোক বাংলার মাঠ ঘাট ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের দুর্গম সীমা পর্যন্ত। শাশ্বত স্বাগতম ১৬ই ডিসেম্বর!

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!