You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঢাকা থেকে আর্তনাদ
আমাদের বাঁচাও

আমি জনৈক পূর্ববাংলার অধিবাসী বিশ্ববাসীর প্রতি এই মর্মে আবেদন জানাচ্ছি যে আপনারা আমাদের রক্ষা করুন। আর বিলম্ব করবেন না। পাকিস্তানি শয়তান চক্র আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে এবং সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই তারা ২৪শে মার্চ থেকে কাজ করে যাচ্ছে।

ঢাকার সেই বীভৎসতা
গত ২৫শে মার্চ মধ্য রাত্রিতে তারা ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে ঘুমন্ত নগরীকে কামান বন্দুক ও ট্যাঙ্ক সহকারে আক্রমণ করে চোরের মতাে। আমি নিজে প্রত্যক্ষ করেছি যে তারা প্রথমে ঘুমন্ত পুলিশ ও ই.পি.আর ও ফায়ার ব্রিগেড সংস্থাগুলােকে আক্রমণ করে নিঃশেষ করে। এর পর তারা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাসে ও শিক্ষকদের ঘরে ঘরে আক্রমণ চালিয়ে তাদের নির্বিচারে হত্যা করে। কোনাে কোনাে শিক্ষককে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। এরপর তারা দৈনিক পত্রিকার অফিসগুলােতে আগুন ধরায়। তারপর আগুন দেয় ঢাকার সমস্ত বাজার এবং খাদ্যের গুদামগুলােতে। তারপর পুড়তে দেখা যায় বস্তি এলাকা। এইসব এলাকার লােকগুলাে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পালাবার চেষ্টা করতে থাকলে ছেলেমেয়ে জোয়ান বুড়াে নির্বিশেষে তাদের গুলি করে অথবা বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়। যেসব হাজার হাজার বাস্তুহারা ছিন্নমূল জনতা নিয়মিতভাবে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, সদর ঘাটের IWTA ঘাট, বিভিন্ন ফুটপাতে আস্তানা গেড়ে থাকতাে এবং গােলা বারুদের তাড়া খেয়ে ঐ রাত্রিতে যারা ঐ সকল স্থান নিরাপদ মনে করে ছুটে এসে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের সকলকেই সমূলে ধ্বংস করা হয়েছে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন I.W.T.A ঘাট ও বিভিন্ন ফুটপাতে রক্তের স্রোত তার স্বাক্ষর বহন করছে। অনেক ক্ষেত্রে এইসব ছিন্নমূলদের বিভিন্ন বাস স্ট্যান্ডে রেখে দেওয়া শত শত বাসের ভেতর পুরে আগুন দিয়ে পুড়ানাে হয়েছে। বলাবাহুল্য এসব বাস বাঙালিদের। মীরপুর মহম্মদপুরের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা, নিউ মার্কেটের কাঁচা বাজার, আওলাদ হােসেন বাজার, ঠাটারী বাজার, নয়া বাজার, লাল বাগ, সদর ঘাটের বাজার আরও অসংখ্য ছােট ছােট, বাঙালি মালিকানাধীন বিপনি কেন্দ্র ঐ ২৫ তারিখের রাত্রিতেই ভস্মীভূত করেছে। এই রাত্রিতেই অন্ন লক্ষাধিক লােককে হত্যা করা হয়েছে এবং কয়েক শত কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট করেছে দস্যু ইয়াহিয়ার বর্বর দুবৃত্ত দল।

তারপর দিন
২৬ তারিখে ছিল শুক্রবার। সারাদিন ধরে ছিল কারফিউ। কোনাে জনপ্রাণী বের হতে পারেনি। কিন্তু সামরিক বাহিনীর জীপের উপর দেখা গেছে অনেক চেনা মুখ। এইসব চেনা মুখ সকলেই অবাঙালি। তারা অন্যদেশ থেকে এদেশে এসেছিল। বাঙালিরা তাদের আশ্রয় দিয়ে খাদ্য দিয়ে পালন করেছে গত তেইশ বছর ধরে। বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনের সময় ওরা বিরুদ্ধতা করলেও বাঙালিরা তা ক্ষমার চোখে দেখেছে এবং রক্ষা করেছে তাদের জানমাল। এইসব নিমকহারামের দল ওদের জিপে চড়ে রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রনেতা ও শিক্ষকদের ঘরবাড়ি শনাক্ত করে দিয়ে তাদের সপরিবারে হত্যা করিয়েছে। এবং তাদের ঘরবাড়ি থেকে সােনারূপা টাকা পয়সা এবং মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করেছে। এরপর তারা হানা দিয়েছে দোকানে দোকানে। দোকান ভেঙে লুট করেছে এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকে শুক্রবার সারাদিন এবং সারারাত্রি ধরে।

তার পরের দিন
শনিবারে ছিল ২৭ তারিখ। এই দিন সকাল ৭ টা থেকে দুপুর দুটা পর্যন্ত কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। বলা হয় সরকারি চাকুরিয়াদের অফিসে যেতে। কিন্তু অফিসে না গিয়ে মানুষ প্রাণভয়ে পালাতে থাকে শহর ছেড়ে বিভিন্ন দিকে। কি অদ্ভুত অমানুষিক ব্যাপার। মানুষ যখন আইন মুক্ত পরিবেশে প্রাণ ভয়ে শহর ছেড়ে পালাচ্ছে তখনও দস্যু ইয়াহিয়ার দুবৃত্তরা গুলি করে তাদের হত্যা করেছে। শনিবারে আইন মুক্ত পরিবেশে ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচ হাজারেরও (আনুমানিক) অধিক পলায়নরত নাগরিককে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়। এই আইন মুক্ত পরিবেশেও ঢাকার শাঁখারী বাজারে ধ্বংস, হত্যা এবং বােমা বর্ষণ অব্যাহত ছিল। এই অঞ্চলে আক্রমণ শুরু হয়েছিল তার আগের দিন রাত্রি থেকে।
বুড়িগঙ্গার বুকে যখন হাজার হাজার নৌকায় লক্ষ লক্ষ আতঙ্কগ্রস্ত লােক পার হচ্ছিল তখন এইসব নৌকা লক্ষ্য করে পাশে রক্ষিত গান বােট থেকে গুলি করা হচ্ছিল। এই গুলিতে বহু নৌকা ডুবেছে। আতঙ্কগ্রস্ত বহু নরনারী শিশু বুড়িগঙ্গায় ঝাপও দিয়েছে। এখানে যে কত মরেছে তা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য।
ঘােষণা অনুযায়ী আইন মুক্ত পরিবেশ ছিল শনিবার দুটা অবধি কিন্তু তার আগেই তারা ঢাকা শহরের সমস্ত এলাকায় বেপরােয়াভাবে মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করে একচেটিয়া হত্যা যজ্ঞ শুরু করে। ঐ শনিবারে যে দু’একজন অফিসে গিয়েছিল তারা অনেকেই আর ফিরে আসেনি। অনেককে অফিসের গেটে গুলি করা হয়েছে। আর অনেককে সারাদিন ধরে রাস্তায় অবরােধ সরানাের কাজ করিয়ে সন্ধ্যায় গুলি করা হয়েছে।
শহীদ মিনারগুলাে ধ্বংস করেছে ২৪ তারিখের রাত্রিতেই এবং ঐ রাত্রিতেই তারা মেডিকেল কলেজে বােমা বর্ষণ করে এবং তার একাংশ ধ্বংস করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় ভবন ও ছাত্রাবাসে গুলিতে ধ্বংস ও হত্যা ঐ রাত্রিতেই চলে এবং পরবর্তী দিনগুলােতেও অব্যাহত থাকে।

তার পরেও
রবি, সােম ও মঙ্গলবারে দেখা গেছে সমস্ত শিল্প এলাকায়, শিল্প কারখানা ও শ্রমিক ব্যারাকগুলাে জ্বলতে। এদিন ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ প্রসারিত হয় নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। সেখানেও অনুরূপ ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ হয়েছে। মােট কথা ঢাকা এখন শ্মশান। বাঙালির কোনাে সম্পত্তি ঢাকাতে নেই। এগুলাে দ্য ইয়াহিয়ার দুবৃত্তরা অবাঙালিদের সহায়তায় প্রথমে হত্যা করে লুট এবং তার পর আগুন দিয়ে ধ্বংস করেছে।
পরে জানতে পেরেছি যে পূর্ব বাংলার সিলেট, চিটাগাং, কুমিল্লা, খুলনা, যশাের, রংপুর, রাজশাহী দিনাজপুর ইত্যাদি প্রায় সকল শহরেই সুপরিকল্পিতভাবে ২৫ তারিখেই হত্যা এবং ধ্বংস যজ্ঞ শুরু হয়েছে এবং তার তাণ্ডব এখনও চলছে।
রক্ষার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আকুল আবেদন বাতাসে ছড়ায়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় আশানুরূপ সাড়া আমরা পাইনি।

হৃদয়হীন ব্যবহার
আন্তর্জাতিক রেডক্রস জেনেভা থেকে একটি বিমান পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এই বিমানটি অনুমতির অভাবে বাংলায় আসতে পারেনি। আমরা অবাক হই এই ভেবে যে আন্তর্জাতিক মানবতা-বােধ-সংস্থা রেডক্রস নরপিশাচ দস্যু ইয়াহিয়ার অনুমতিটাই বড় মনে করে দুর্গত মানুষের প্রাণ রক্ষার মহান ব্রত উপেক্ষা করে ফিরে গেছেন। বিশ্ববাসীও সেই নরপিশাচ দস্যুকে বলছেন তার হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে। কিন্তু যে শয়তান সে কি ধর্মের কথা শুনবে? কাজেই আমাদেরও মানবতার আকুল আবেদন এই যে বিশ্ববাসী যেন এই নরপিশাচ দস্যুকে উপেক্ষা করে বাংলাকে অতিবিলম্বে স্বীকৃতি দেন এবং আমাদের প্রাণ রক্ষার জন্যে যেন ছুটে আসেন।

আজকের অবস্থা
দেশে খাদ্য নেই। বিদেশ থেকে আগত খাদ্য তারা অন্যত্র নিয়ে গেছে আগেই। দেশের অভ্যন্তরে প্রধ প্রধান কেন্দ্রে যা ছিল সেগুলাে ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওষুধ পত্র ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। ওরা ব্যাঙ্কগুলাে দখল করে লুট করেছে। দেশের মধ্যে সমাজবিরােধী তৎপরতা জনিত চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি ইত্যাদি বেড়ে গেছে। জীবনের কোনাে স্থায়িত্ব বা নিশ্চয়তা নেই।
কাজেই বিশ্ববাসীর প্রতি আবারও আকুল আবেদন জানাচ্ছি যে আর কালবিলম্ব না করে মানবতার খাতিরে আমাদের প্রাণ রক্ষা করুন।
[প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে]

খড়িবাড়ি শরণার্থী
শিবিরে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীর সংখ্যা সরকারি হিসাবে এখানে ২৫০০ জন। কিন্তু বেসরকারি মতে এই সংখ্যা তিন হাজারের উপর। সবগুলাে বিদ্যালয় এবং হাটের, শেড ঘর ও গাছের নিচে শরণার্থীদের আশ্রয় স্থল। প্রতিদিন শরণার্থীরা বিভিন্নস্থান থেকে এখানে আসছেন। থানার বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে একটি নাগরিক কমিটি গঠিত হয়েছে। গিয়েছিলাম শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের কথা জানতে। বাংলাদেশের রংপুর ও পূর্ব দিনাজপুর জেলার শরণার্থীই বেশি। তাছাড়া আছে সিলেট ও রাজশাহী জেলার। এদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সামান্য অংশ পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি।
সিলেট জেলার জনৈক সরকারি কর্মচারী (যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) উক্ত জেলার মুক্তিফৌজের এক বীরত্বপূর্ণ কাহিনী শােনালেন। পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ ২৪শে মার্চ রাত্রিতে মৌলবীবাজারে কারফিউ জারি করে। ২৫শে মার্চ থেকে এদের অত্যাচার শুরু হয়। তারা পাকিস্তান পার্লামেন্টের সদস্য ম. আজিজুর রহমানকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে বেদম প্রহার করে। পরে তাকে সিলেট হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। এরপর পাক পাষণ্ডরা স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতাদের সহায়তায় চড়াও হয় নেতৃবৃন্দের বাড়িতে। এরা ধরে নিয়ে যায়। শ্রীব্যোমকেশ ঘােষ, কানাই দেব, বলাই বট, কানাই বট, ছাত্রনেতা আবদুল মােতিনকে, এবং প্রখ্যাত ব্যবসায়ী শ্রীপ্রসন্ন কুমার রায়কে। দুবৃত্তরা শ্রীরায়ের বাড়ি থেকে নগদ ৮৪ হাজার টাকা এবং স্বর্ণালঙ্কার লুট করে। এদের সকলকে ক্যাম্পে নিয়ে যেয়ে পাক সৈন্যরা অত্যাচার চালায়। অমানুষিক অত্যাচার করার পর শ্রীবলাই বট ও কানাই দেবকে মনু নদীর ব্রিজ থেকে নীচে ফেলে দেয়। এমন অত্যাচার এদের উপর করা হয় যে, শরীরের হাড়গুলাে ভেঙে গিয়েছিল। অত্যাচারে এই দুজন যুবক প্রাণ হারায়।
শ্রীপ্রসন্ন কুমার রায়কে মৃত মনে করে পাক-চমুরা ফেলে রেখে যায়। তিনি বর্তমানে জীবিত। আগরতলার ধর্মনগরে আছেন। পাকসৈন্যদের অত্যাচারের কথা গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকশত মুক্তিযােদ্ধা শমসের নগর (বিমান ঘাঁটি) আক্রমণ করে। পাক-সৈন্যদের তারা খতম করে মৌলভিবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসৈন্য এই সংবাদ পেয়ে মৌলভিবাজার ছেড়ে শেরপুরে ঘাঁটি স্থাপন করে। মুক্তিফৌজ মৌলভিবাজার দখল করে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে মুক্তিফৌজ ৩রা এপ্রিল শেরপুর আক্রমণ করে। সপ্তাহকাল ধরে যুদ্ধ চলার পর পাকফৌজ পিছু হটে সিলেট শহরে আশ্রয় নেয়। সিলেট রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজ প্রাণপণ যুদ্ধ করে পাকফৌজকে হটিয়ে দেয়। উপায়ান্তর না দেখে পাক সৈন্যরা সালুটিকর বিমান ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। এরপর আরম্ভ হয় পাক সৈন্যদের অত্যাচার। মুক্তিফৌজ সালুটিকর বিমান ঘাঁটি চারদিক দিয়ে ঘিরে রাখে। পাকসৈন্যরা বিমান বাহিনীর সাহায্যে সিলেট, শেরপুর, মৌলভিবাজার, শােভানগর, শ্রীমঙ্গল প্রভৃতি স্থানে নির্বিচারে বােমা বর্ষণ করে। কয়েকদিন সালুটিকর বিমান ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ থাকার পর বাইরে থেকে আরও সৈন্য, ট্যাঙ্ক, কামান প্রভৃতি অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অবরুদ্ধ সৈন্যদের উদ্ধারের জন্য আসে।
একদিকে আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত সু-শিক্ষিত সৈন্য বাহিনী, অপর দিকে দেশপ্রেমিক মুক্তিফৌজ। উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই আরম্ভ হয়। মুক্তি ফৌজের সঙ্গে সম্মুখ সমরে না পেরে উঠে পাক-বাহিনী পুনরায় বিমান বাহিনীর সহায়তায় মুক্তি ফৌজের উপর বােমা বর্ষণ শুরু করে। কয়েকদিন বীরত্বপূর্ণ সগ্রামের পর মুক্তিফৌজ সালুটিকর বিমান ঘাটির যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি করে পিছু হটে। পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা একে একে মুক্তিফৌজের হাত থেকে সমগ্র সিলেট শহর দখল করে নেয়, পাষণ্ডরা রাস্তার দু’ধারে বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, নির্বিচারে নিরীহ নাগরিকদের হত্যা করে এবং নারী ধর্ষণ শুরু করে। শহরের অধিবাসীগণ গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নেয়।
প্রত্যক্ষদর্শী আরও বলেন যে, সিলেট, শেরপুর, মৌলভিবাজার জনশূন্য। কেবল আছে পশ্চিম পাকিস্তানিদের তাঁবেদার বাহিনী। পাক ফৌজ শ্রীমঙ্গল এলাকার প্রায় সবগুলাে চা বাগান নষ্ট করে দিয়েছে। তিনি কোনাে ভাবে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। রংপুর জেলার নিলফামারী থেকে আগত শরণার্থী বললেন যে এই শহর মুক্তিফৌজ দখল করার পর খুবই শান্তিতে ছিলাম। হঠাৎ পাকসৈন্য ট্যাঙ্কবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল এই শহরের উপর। আগে থেকে মুক্তিফৌজের যােদ্ধারা অসামরিক জনসাধারণকে গ্রামে আশ্রয় নেবার জন্য অনুরােধ করেছিলেন। বহু নাগরিক শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিল। পাক-ফৌজ নির্বিচারে হত্যা করল নিরীহ নাগরিকদের। শহরের উপর বােমাবর্ষণ করে ধ্বংস করে দিল বহু বাড়ি ঘর। লুটতরাজ শুরু করল বড় বড় ব্যবসায়ীর গুদাম। যাকে সামনে পেল মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করল। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শ্রীসুরেশ রায়কে প্রকাশ্য রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করেছে। কয়েকশ শরণার্থী যখন ভারতের দিকে প্রাণের ভয়ে চলে আসছিল, তখন কালিগঞ্জের ব্রিজ পাক সৈন্যের কবলে পড়ে। পাক-ফৌজ পুরুষদের গুলি করে হত্যা করে এবং মহিলাদের নিয়ে যায়। শ্রীমতী মেচবর্মনী, রুহিনী কান্ত সরকার ও দুর্গেশ বর্মণ, এসেছেন রংপুর এবং পূর্ব দিনাজপুর জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে। এরা বললেন, আমরা শুনতে পেলাম পাকফৌজ আমাদের গ্রামের দিকে আসছে। এক সঙ্গে ২৫/৩০ টি গ্রামের লােক ভারতে চলে আসার উদ্যোগ করতেই হাজির হলাে মুসলিম লীগের গুণ্ডাদল। এরা বাড়ি ও ঘরের টিন খুলতে আরম্ভ করল। গরু-বাছুর নিয়ে গেল। সারা জীবনের যা কিছু সঞ্চয় ছিল কেড়ে নিয়ে বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিল। আমরা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে এলাম। এই পাষণ্ডদের শায়েস্তা করার জন্য মুক্তিফৌজ যথেষ্ট সক্রিয়। যারা আমাদের অত্যাচার করেছিল তাদের উপর মুক্তিফৌজ পাল্টা প্রতিশােধ নিচ্ছে।
প্রশ্ন করলুম যদি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে তবে দেশে যাবেন কী? উত্তরে বললেন, বাবু যদি ইজ্জত দিতে হয় এবং শান্তিতে থাকতে পারি তবে নিশ্চয়ই যাব। আমাদের বাপ-দাদার ভিটেতাে বিক্রি করিনি। জমি-জমা ফেলেই এসেছি। আমরা শেখ মুজিবকে ভােট দিয়ে ছিলাম অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু অদৃষ্টের কি পরিহাস! ভগবান মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখলে এবং তাঁর হাতে ক্ষমতা আসলে আমরা শান্তিতে বসবাস করতে পারব। মুসলিম লীগের পাণ্ডারা আমাদের গ্রামে সাম্প্রদায়িক বিরােধ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। মুসলিম লীগের পাণ্ডারা ছাড়া আর কেউ এখন সাম্প্রদায়িকতা চিন্তা করে না। সকলের এক কথা, পশ্চিম পাকিস্তানিদের বাংলাদেশ থেকে হটাও। এরা সকলে বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা জানতে চাইলেন। শুনে খুব খুশি। কত কষ্ট তবুও মুক্তিফৌজের জেতার কাহিনী শুনে মনে হয় সব কষ্ট দূর হয়ে গিয়েছিল।
শরণার্থীদের শিবিরে দিবারাত্র কাজ করছেন এখানকার স্থানীয় যুবকগণ। সকালে শরণার্থীদের বরাদ্দ দুধ বিতরণ এবং রেশন দেওয়া সবই এই যুবকগণ করছেন। এরা বিভিন্ন দলের (রাজনৈতিক) সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ভুলে গেছেন রাজনীতির দুর্গন্ধ। দেখলে অবাক হতে হয়। শরণার্থীদের এখানে কোনাে স্থায়ী শিবির খােলা হয়নি। পায়খানা, প্রস্রাবাগার কিছুই নেই, চারিদিকে দুর্গন্ধ। এর ভিতর রান্না-খাওয়া হচ্ছে। সরকারি কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। মনে হয়, এদের জন্য কারুর যেন কোনাে দায়িত্ব নেই। ভারপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে এদের সেবা করছেন। কিন্তু উৰ্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি যে, এই সব শরণার্থীদের কোথায় স্থায়ীভাবে রাখা হবে। এটা একটা আশ্চর্যের বিষয়। প্রবন্ধ লেখার সময় জানতে পারলুম শরণার্থীরা ২ দিন ধরে রেশন পাচ্ছেন না। এদের এভাবে রেখে বি, ডি, ও এবং এস, ডি, ও সাহেব কিভাবে নিশ্চিন্তে বসে আছেন তা ভাবতেও অবাক লাগে। স্থানীয় জনসাধারণ এদের সাধ্যমতাে সাহায্য করে যাচ্ছেন।

সূত্র: কম্পাস, ৫ই জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!