You dont have javascript enabled! Please enable it!

শেখ মুজিবর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ
(গ্রামােফোন রেকর্ড থেকে লিপিবদ্ধ)

আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বােঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ কলঙ্কিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম- নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভােট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবাে এবং এদেশের ইতিহাসকে আমরা গড়ে তুলবাে। এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবেন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস এই রক্তের ইতিহাস মুমূর্ষ মানুষের করুণ আর্তনাদ- এদেশের করুণ ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস!
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খা মার্শাল-ল জারি করে ১০ বছর আমাদের গােলাম করে রেখেছে। ১৯৬৪ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আয়ুব খার পতনের পরে ইয়াহিয়া এলেন। ইয়াহিয়া খান সাহেব বললেন দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের Majority Party-র নেতা হিসাবে তাকে অনুরােধ করেছিলাম ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আমাদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন ভূট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসে প্রথম সপ্তাহে সভা হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেমব্লিতে বসবাে। আমি বললাম, এসেমব্লির মধ্যে আলােচনা করবাে- এমনকি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনের মতও যদি তা ন্যায্য কথা হয়, আমরা মেনে নেব।
ভূট্টোসাহেব এখানে ঢাকায় এসেছিলেন,আলােচনা করলেন। বলে গেলেন, আলােচনার দরজা বন্ধ নয়, আরাে আলােচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলােচনা করলাম- আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবাে—সবাই আসুন বসুন। আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবাে। তিনি বললেন পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বার যদি আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেমরি। তিনি বললেন, যে যে যাবে তাদের মেরে ফেলে দেওয়া হবে, যদি কেউ এসেমব্লিতে আসে পেশােয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম এসেমব্লি চলবে। আর হঠাৎ ১২ তারিখ এসেমব্লি বন্ধ করে দেওয়া হলাে।
ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসমব্লি ডেকেছিলেন। আমি বললাম, আমি যাবাে। ভূট্টো বললেন, যাবেন না! ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে এলেন তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হল, দোষ দেওয়া হল বাংলার মানুষের, দোষ দেওয়া হল আমাকে। দেশের মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাে, সগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। আমি বললাম, আমরা জামা কেনার পয়সা দিয়ে অস্ত্র পেয়েছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করবার জন্য, আজ সেই অস্ত্রে আমার দেশের গরীব দুঃখী মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে।
আমি বলেছিলাম জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের উপর আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে। কিভাবে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, আপনি দেখুন। তিনি বললেন, আমি ১০ তারিখে Round table conference ডাকবাে?
আমি বলেছি; কিসের এসেমব্লি বসবে; কার সঙ্গে কথা বলবাে? আপনারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলবাে? পাঁচ ঘণ্টার গােপন বৈঠকে সমস্ত দোষ তারা আমাদের উপর, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন। দায়ী আমরা :
২৫ তারিখ এসেমব্লি ডেকেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। ১০ তারিখে বলেছি রক্তে পাড়া দিয়ে, শহীদের উপর পাড়া দিয়ে এসেমব্লি ভােলা চলবে না। সামরিক আইন মার্সাল-ল withdraw করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লােকেদের ব্যারাকের ভিতর ঢুকাতে হবে। যে ভাইদের হত্যা করা হয়েছে তাদের তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবাে আমরা এসেমব্লিতে বসতে পারবাে কি পারবাে না। এরপূর্বে এসেমব্লিতে আমরা বসতে পারি না।
আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমাদের দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট কাছারী আদালত ফৌজদারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলাে আছে, সেগুলাের হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিক্সা, গরুর গাড়ি, রেল চলবে, শুধু সেক্রেটারিয়েট সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট জজকোর্ট সেমি গভর্ণমেন্ট দপ্তর, ওয়াপদা কোনকিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, এরপর যদি ১টি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লােককে হত্যা করা হয় তােমাদের কাছে অনুরােধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলন। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট, যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তােমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবাে, আমরা পানিতে মারবাে। তােমরা আমার ভাই, তােমরা ব্যারাকে থাকো, তােমাদের কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু আর তােমরা গুলি করবার চেষ্টা করাে না। সাত কোটি মানুষকে দাবাইয়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।
আর যে সমস্ত লােক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদুর পারি সাহায্য করতে চেষ্টা করবাে। যারা পারেন লীগ অফিসে সামান্য টাকা পয়সা পৌছে দেবেন। আর ৭দিন হরতালে শ্রমিক ভাইয়েরা যােগদান করেছে, প্রত্যেক শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততদিন, ওয়াপদা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হল—কেউ দেবে না। শুনুন, মনে রাখুন, শত্ৰু পিছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুঠতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান যারা আছে আমাদের ভাই, বাঙালি অ-বাঙালি- তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, কর্মচারীরা, রেডিও যদি আমাদের কথা না শােনে তাহলে কোনাে বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, তাহলে টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাঙ্ক খােলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনে পত্র নিতে পারবে। পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে এবং বাংলাদেশের নিউজ বাইরে পাঠানাে চলবে।
এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবে। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলাে। এবং আমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরাে রক্ত দেবাে। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে। ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।[ শকুন্তল সেন ২৫ মার্চের পর ঢাকা ছেড়ে আসেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন এই রেকর্ডটি]

সূত্র: কম্পাস, ৮.৫.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!