‘কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার উপর ছাড়িয়া দিন’ -শেখ মুজিব
বিক্ষুব্ধ বাংলার দশদিগন্তে সর্বাত্মক মুক্তি আন্দোলনের পটভূমিতে নয়া আঙ্গিকে আবির্ভূত তেইশে মার্চের অবিস্মরণীয় দিনে বন্যার স্রোতের মতাে স্বীয় বাসভবনে সমাগত জনতার উদ্দেশে ভাষণদানকালে স্বাধিকার আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পুনরায় বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সগ্রাম, যত দিন সাড়ে সাতকোটি বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হইবে, যতদিন একজন বাঙালি বাঁচিয়া থাকিবে এই সংগ্রাম আমাদের চলিবেই চলিবে। মনে রাখবেন, সর্বাপেক্ষা কম রক্তপাতের মাধ্যমে যিনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করিতে পারেন, তিনিই সেরা সিপাহশালার। তাই বাংলার জনগণের প্রতি আমার নির্দেশ সগ্রাম চালাইয়া যান, শৃংখলা বজায় রাখুন,সগ্রামের কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার উপরই ছাড়িয়া দিন।
শেখ সাহেব তাহার ভাষণে আরও বলেন, বাংলার দাবীর প্রশ্নে কোনাে আপােষ নাই। বহু রক্ত দিয়াছি, প্রয়ােজনবােধে আরও রক্ত দিব, কিন্তু মুক্তির লক্ষ্যে আমরা পৌছিবই। বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করিয়া রাখা যাইবে না। তিনি বলেন, আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয়, সাড়ে সাতকোটি বাঙালির স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বাঁচিয়া থাকার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আমাদের চলিতেই থাকিবে। এই সগ্রামের পন্থা কী হইবে উহা আমিই ঠিক করিয়া দিব, সে ভার আমার উপরই ছাড়িয়া দিন। শােষক কায়েমী স্বার্থবাদীদের কিভাবে পর্যুদস্ত করিতে হয় আমি জানি। তিনি বলেন, অতুলনীয় ঐক্য, নজির বিহীন সংগ্রামী চেতনা আর প্রশংসনীয় শৃংখলাবােধের পরিচয় দিয়া বাংলার মানুষ প্রমাণ করিয়া দিয়াছে যে, শক্তির জোরে তাহাদের আর দাবাইয়া রাখা যাইবে না। কাকডাকা ভাের হইতে রাজপথ-জনপদ প্লাবিত করিয়া শহর ও শহরতলির বিভিন্ন দিক হইতে অজস্র জনতার স্রোত প্রবাহিত হইতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে। মিছিলের পর মিছিল। সকাল হইতে ১০ ঘন্টা সময়ে ৬টি মহিলা মিছিলসহ অন্তত ৫৫টি ছােট বড় মিছিল গতকাল শেখ সাহেবের বাসভবনে আগমন করিয়া মহান জাতির মহান নেতার প্রতি অকুণ্ঠ আস্থার পুনরাবৃত্তি এবং সংগ্রামের দুর্জয় শপথের স্বাক্ষর রাখিয়া যায়। সেই মিছিলের সমুদ্রে হাতে হাতে লাঠি-বল্লম, বন্দুক, চোখেমুখে মুক্তির দীপ্ত তারুণ্য আর কণ্ঠে কণ্ঠে নয়া দিনে নব জাতি নতুন দেশের বিজয় গাঁথা কোটি প্রাণের অমােঘ সংগীত জয় বাংলা’র সঘন মন্ত্রে গর্জিয়া গর্জিয়া উঠিতে থাকে। তেইশ বছর ধরিয়া বাংলার দশ দিগন্তে যে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়াছে, যে পাকিস্তান দিবস পালিত হইয়াছে, যেভাবে সরকারী ব্যবস্থাপনায় সভা সমিতি হইয়াছে, আর সেইসব অনুষ্ঠানে রাজপথে জনপদে অধিকার বঞ্চিত গণমানুষ ক্ষ্যাপা পাগলের মতাে পাকিস্তান আর স্বাধীনতা খুঁজিয়া বেড়াইয়াছে, গত কালকের দিনটি তার অবসান সূচনা করিয়া জনতাকে নবসূর্যের নয়ালােকে নয়া পতাকার দিক-নির্দেশে প্রাণের টানে টানিয়া নিয়াছে জাতির ভাগ্য নিয়ন্তা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। আর বামহাতে বাংলাদেশের পতাকা উর্ধ্বে তুলিয়া ডানহাত জনতার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বাংলার মুকুটহীন সম্রাট সাড়ে সাত কোটি মানুষের আত্মার স্পন্দনকে একত্রে জড়াে করিয়া গজিয়া উঠিয়াছেন, বাংলার মানুষ কাহারও করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতা বলেই তারা মুক্তি ছিনাইয়া আনিবে জয় বাংলার জয় অনিবার্য।
(“দৈনিক ইত্তেফাক” ২৪শে মার্চ, ৭১ এরপর আর ইত্তেফাক বের হয়নি।)