You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.28 | পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশ : অতঃকিম (৩) | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশ : অতঃকিম (৩)
অসিত ভটাচার্য

পাক-চীন সম্পর্ক ও মার্কিন সরকার ১৯৬২-র চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের পর আয়ুবের নেতৃত্বাধীন পাক জঙ্গীশাহীর চীনপ্রীতি অকস্মাৎ পল্লবিত হয়ে ওঠে বলে, ভারতীয় ভাষ্যকাররা এর ভারত-বিরােধী রূপটিই এতদিন দেখেছেন এবং মার্কিন সরকারকে দেখাবার জন্যে তাদের পায়ে মাথা খুঁড়ে মরেছেন। কিন্তু মার্কিন সরকার যে এই ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা দেখেও দেখেননি, এবং প্রজাতন্ত্রী চীন সরকার ও যে, পাকিস্তানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক
চুক্তিবন্ধন ও সম্পূর্ণ আর্থিক নির্ভরতা যেন দেখতেই পাচ্ছে না, এমন ভাব করে পাকিস্তানের প্রত্যেক স্বৈরাচারী সরকারের প্রতি তার সাহায্য ও সমর্থন অটুট রেখে চলেন, এর তাৎপর্য ভারতীয় রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা কিছুতেই বােঝেননি।*
তাছাড়া আমেরিকা তথা মার্কিন সরকারের সম্মতি ব্যতীত পাক সরকার যে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে একপাও অগ্রসর হতে পারেন না সেটা বােঝা কি খুব দুর্বোধ্য ছিল? আয়ুব খান নিজেই কি তাঁর Friends not Masters (1967 ed.) 216 6317613ta Tha; The United States would not be too eager to provide us with Unlimited economic and military assistance if we were to establish bilateral relations with the major communist powers. Without any regard to American interests or strategy in Asia. (ঐ পৃঃ ১১৯) (বাঁকা অক্ষর আমার)।
সুতরাং একথা ধরেই নিতে হয় যে পাক-চীন সম্পর্কের যেটুকু বিকাশ ঘটে তা এশিয়াতে আমেরিকার স্বার্থ ও সমরনীতি’ বাদ দিয়ে হয়নি, বরং তারই প্রয়ােজনে ঘটেছে। অথচ এই সহজ সত্যটা বােঝা কি খুব কঠিন ছিল যে, পাক সরকার মার্কিন সরকারের বিশ্বস্ত চর হিসেবে প্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের সঙ্গে দৃতীয়ালী চালাচ্ছে। ওয়ারশ-তে চীনা ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে নিয়মিত কথােপকথনের বিষয় গােপন থাকেনি। কিন্তু চীনের নীতি ক্রমেই সােভিয়েত বিরােধী হয়ে ওঠায়, এবং মার্কিন সরকারের নীতি যখন বরাবরই তাই,
…………………………………………………………………………………………
* অথচ “International Studies’ July-Oct 1966)-4 Ms. Venkataramani Harish chandra Tau PCSA; “Angry admonition from India calling up on the U.S. not to be bound to Sino-Pak collusion are not likely to any drastic change in American policy towards Pakistan. The U.S. itself, it may be noted, has lately given many indications that its own attitude towards China might not remain rigid and unchanging” (ঐ পৃ. ১২২-২৩) কিন্তু উক্ত লেখকদ্বয়ও তাদের নিজেদের মন্তব্য অনুধাবন করেন নি। তাদের প্রবন্ধের শিরােনামায় তাঁরা Americans military alliance with Pakistan কে Uneasy Partnership বলেন।
………………………………………………………………………………………………
তখন ওয়ারশ জায়গাটা উভয়ের পক্ষেই অরুচিকর হয়ে ওঠে, মনে হয়। এই কারণেই মার্কিনের প্রয়ােজন হয় একটি বিশ্বস্ত দালালের এবং একাজে পাক সরকারের চেয়ে নির্ভরযােগ্য আর কে হতে পারত? আয়ুব নিজেই কি ১৯৬১-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে বলেননি ….. If ever the U.S. was in real trouble in Asia, Pakistan would be the only country to stand with it shoulder to shoulder ……. দ্রি: Venkataramani & Harishchandra ঐ, পৃ. ১২৩ এবং Vital Speeches of the Day (N. York) Vol 27. পৃ ৬১২-১৬) এছাড়া মার্কিনের most allied ally হবার গর্ব ও আনন্দ তাে জঙ্গীশাহীর কণ্ঠে বারবার ফুটে উঠেছে। আয়ুব নিজেই বলেন এশিয়ার আর কোনাে রাষ্ট্রই তাঁর পাকিস্তানের মতাে সেন্টো ও সিয়াটো এই উভয় সামরিক চুক্তির সদস্য হয়নি। (Friends No. PMasters. 1967 ed পৃ. ১৩০)

চীনের প্রয়ােজন
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন পৃথিবীতে নেই এমনভাবে চলা চীনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ (১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি মহাশক্তি। মার্কিন সরকারের সঙ্গে যােগাযােগের একটি সূত্র বজায় রাখা চীনের নিজ স্বার্থেই আবশ্যক। (২) সােভিয়েতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকায় এই আবশ্যকতা দিনে দিনে বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থায় চীন কি এশিয়াতে আমেরিকার দূত হিসেবে তার most allied ally-র দিকে তাকাবে, না, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি রক্ষার খাতিরে যার দুদিন অন্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঠোকাঠুকি বাধছে সেই ভারতের দিকে তাকাবে? বিশেষত (এখনাে পর্যন্ত) স্বাধীন গণতন্ত্র হিসেবে ভারতকে মার্কিন সরকার কখনােই পুরােপুরি তাঁবেদার ভাবতে পারে না (দ্র. স্টে, ৩/৭/৭১ জয়প্রকাশ নারায়ণের বিবৃতি। এতে ১৯৫৪ সালে ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে নিক্সন রিপাের্টের উল্লেখ আছে। আর এই কারণেই ভারতীয় নেতা ও সংবাদপত্রগুলাে যতই Sino-Pak Collusion নিয়ে চিৎকার করেছে মার্কিন সরকার তত তাদের অবজ্ঞা মিশ্রিত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দরােজা দেখিয়ে দিয়েছে! বস্তুত এরকম Collusion কিছু ঘটে থাকলে তা মার্কিন সরকারের ইচ্ছা ও নির্দেশ অনুসারেই ঘটেছে। (ব্যাপারটা তুচ্ছ হলেও উল্লেখ্য এই যে, এই কারণেই কোলকাতায় Comprador শ্রেণীর কিম্বা তাদের-ই চুকানিদার P.R.০ শ্রেণীর জীব হঠাৎ ধার করা অতিবাম আলখাল্লা অঙ্গে পরে খুব চীন প্রেম দেখাতে শুরু করে। আর এদেরই বৃহৎ বিদেশি পুঁজি ও মার্কিন মুলুকের সঙ্গে যােগ সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ)।

আয়ুব-শাহী আফ্রো-এশীয় সাজল কেন?
যেমন আয়ুব তথা জঙ্গী শাহীর চীন-প্রেম, তেমনি ষাটের দশকের সূচনায় তার আফ্রো-এশীয় সাজার মূলেও মার্কিন স্বার্থের আনুকূল্যে কাজ করার নির্দেশ-ই প্রধান প্রেরণা জুগিয়েছে। আয়ুবের নিজের জবানীতেই এর প্রমাণ মেলে। যথা :
Indeed at the first meeting of (Afro-Asian) foreign ministers which took place at Jakarta in 1964, in connection with the organisation of the Algiers Conference a resolution was sponsored by several members condemning American action in Vietnam. It was as a result of our intervention that the resolution was dropped. (Friends not master পৃ. ১৬৫) (বাকা অক্ষর আমার)।
আফ্রো-এশীয় গােষ্ঠিতে নবাগত এই সদস্যটির মতলব সম্পর্কে তাই আরব জগতের অদ্বিতীয় নেতা নাসের সদাসতর্ক ছিলেন। যেভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে পিছন থেকে ছুরি মারার জন্যে দ্বিজাতিত্ত্বের সাহায্যে এই অদ্ভুত রাষ্ট্রটিকে খাড়া করা হয়, ঠিক সেইভাবে পশ্চিম এশিয়াতে, বিশেষত আরব জগতে জাতীয়তা, গণতন্ত্র ও প্রগতির শক্তিকে আফ্রো-এশীয় সাজার প্ররােচনা দেওয়া হয়েছে, আরব জাতীয়তার অদ্বিতীয় নেতা নাসের তা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। সখেদে পাক জঙ্গীচক্রের তৎকালীন প্রধান আয়ুব মন্তব্য করেনঃ
President Nasser and other Arab Countries under his influence thought that we were involved in some deep conspiracy to divide the Arab worlds……. (ঐ পৃ. ১১৬)।
বস্তৃত উপরােক্ত আলােচনা থেকেই মার্কিন সরকারের global strategy তে পাক জঙ্গীশাহীর নিম্নলিখিত ভূমিকা স্পষ্ট হয়:
১. আশু ও অব্যবহিত ভূমিকা হলাে চীনের সঙ্গে যােগাযােগের সেতুমুখ (bridge head) হিসেবে কাজ করা। কিন্তু তাও কোনাে অবস্থাতেই মূল মার্কিন নীতি ও স্বার্থের মৌখিক সমালােচনা করেও নয়। এর সবচেয়ে বড়াে উদাহরণ সমস্ত, পাক-চীন যৌথ বিবৃতির কোনােখানেই কখনাে কোনােদিন ভিয়েত্রামে মার্কিন-আক্রমণের কোনাে নিন্দা পর্যন্ত করা হয়নি; মার্কিন সামরিক চুক্তিগুলাের কোনাে নিন্দাবাদ উচ্চারিত হয় নি বা সেগুলাে থেকে পাকিস্তানের বার হয়ে আসার কোনাে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। (এতদসত্ত্বেও কোলকাতার অধুনালুপ্ত একটি ইংরেজি সাপ্তাহিকে চুকানিদার শ্রেণীর কিছু লােক হঠাৎ অতি-বিপ্লবী যাত্রার সাজ পরে আয়ুবের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ভূট্টোকে (i) Gaullism in Asia’র প্রজ্ঞা বলে পিঠ চাপড়াতে থাকে। জঙ্গীশাহীর রাজনৈতিক চুকানিদার ভূট্টোর সঙ্গে এদের সহমর্মিতা তাে থাকবেই!)
২. দ্বিতীয় নির্দিষ্ট ভূমিকা পশ্চিম এশিয়াতে, বিশেষত তার প্রাণকেন্দ্র আরব দেশগুলােতে জাতীয়তা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের যে সব ধারা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে ধর্মের ধাপ্পা দিয়ে সেগুলাে যে কোনাে উপায়ে বানচাল করা। আরব জগতে প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে জোরদার করা। জর্দানে আরব জাতীয়তাবাদী কম্যান্ডােদের বিরুদ্ধে সরকারি বাহনীকে মদদ দিচ্ছে পাক জঙ্গীচক্র সে কথা গােপন নেই। সৌদি আরবকেও শলা-পরামর্শ দিচ্ছে এই জঙ্গীশাহী। আরব উপদ্বীপে বিভিন্ন দেশের রাজ্য Sheikhdom-এ আগে ব্রিটিশ অফিসাররা যে সব কাজ করতেন এখন পাক জঙ্গীচক্রের প্রেরিত অফিসারদের হাতে তা উত্তরােত্তর তুলে দেওয়া হচ্ছে। কারণ, ঐসব দেশে বা অঞ্চলে, শ্বেতাঙ্গদের উপস্থিতি একই সঙ্গে দৃষ্টি ও ক্রোধ আকর্ষণ করে। বাদামী চামড়ার স্বধর্মী মানুষ তা করে না।
৩. ভারতের ওপর সর্বদা একটা চাপ সৃষ্টি করে রাখা, যাতে ভারত তার বিপুল জনসংখ্যা ও নিহিত সম্পদ সত্ত্বেও বেশি বাড়তে না পারে। ভারতের ঐতিহাসিক destiny হলাে মার্কিন; সােভিয়েত ও চীনের মধ্যে একটি মহাশক্তি হয়ে ওঠা। সুষ্ঠু সামাজিক ও আর্থিক বিকাশের মাধ্যমে সেটা যাতে কিছুতেই সম্ভব না হয় সেটা দেশ বিভাগের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। একা মার্কিন নয়, অনেকেই সে প্রয়ােজন বােধ করেন। তাদের আজও সে উদ্দেশ্য বজায় আছে।
মার্কিন সরকারের global strategy সম্বন্ধে সুষ্ঠু চিন্তা করে রাখলে ভারত সরকার রজার্সের কটা কথাকে পুঁজি করে এতবড়াে স্বপ্ন সৌধ গড়তেন না। তবে স্বপ্ন সৌধ না গড়ে হয়তাে তাদের উপায়ও ছিল -কারণ সক্রিয় পথ নেবার ক্ষমতা তারা খুঁজে পাননি। এই প্রসঙ্গে সােভিয়েত নীতির আলােচনাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সে বিষয়ে আসার আগে কয়েকটি কথা বলার প্রয়ােজন আছে মনে করি।
আজকে চীনের সঙ্গে যােগাযােগের সূত্র হিসেবে পাক জঙ্গীশাহী যতােই আদর পাক* একবার সেই যােগ সুপ্রতিষ্ঠিত হলে জঙ্গীশাহীর গুরুত্ব মার্কিন সরকারের কাছে অনেক হ্রাস পাবে। উপরােক্ত দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভূমিকার বিষয়ে যা উল্লেখ করেছি সেই উপাদানগুলাে না থাকলে আর এক বছর পরে পাক জঙ্গীশাহীকে পুরনাে ও ছেড়া জুতাের মতােই পরিত্যাগ করতে মার্কিন সরকারের বাধত না। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত না হলেও, চীনের সঙ্গে সংযােগ সুপ্রতিষ্ঠিত হলে মার্কিন সরকার পাক জঙ্গীশাহীকে আর এখনকার মতাে সম্পূর্ণ মদদ দেবে না। তার অর্থ এই যে, পূর্ব বাংলার বিষয়ে তখন মার্কিন-সরকার ইসলামাবাদের জঙ্গীনেতাদের কিঞ্চিত চাপ দিতে পারে। কিন্তু ততােদিনে কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়, সেইটাই প্রশ্ন। কারণ ইতিহাসের গতি তথাকথিত মহাশক্তিগুলাের খেয়ালখুশি মতাে নিয়ন্ত্রিত হয় না নিয়ন্ত্রিত হয় দেশে দেশে সচেতন ও সংগঠিত জনশক্তির দ্বারা। মার্কিন সরকার ভিয়েনামে আজ সেই শিক্ষাই পাচ্ছে। মনে হয় আরাে কিছু শিক্ষা তাদের নেবার দরকার হয়ে পড়েছে।
………………………………………………
• এই রচনা শেষ হবার পর ৩০ জুলাই-এর স্টেটসম্যানে দেখতে পাই যে গত ২৮ জুলাইতে মার্কিনের ডেমােক্রাট দলীয় সিনেটর জর্জ Mcgovern বলেছেন যে, “arms were still being shipped to Pakistan in return of Pakistan’s cooperation in arranging Dr. Henry Kessinger’s recent trip to Peking. og cooperation-47 per fer তিনি আগে জানতেন না? ধন্য সিনেটর।
……………………………………………….

সােভিয়েত নীতির ভূমিকা : ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশ
৯ই আগস্ট ১৯৭১-এ ভারত সােভিয়েত মৈত্রীচুক্তি সম্পাদিত হবার পূর্বে পর্যন্ত দেখা যায় যে, সােভিয়েত ইউনিয়নের নীতি ও রাজনীতির মধ্যে সামঞ্জস্য স্পষ্ট হয়নি। সােভিয়েত নীতি অবশ্য প্রথম থেকেই ঋজু ছিল।
ইতিপূর্বেই আমরা দুটি জিনিস উল্লেখ করেছি (১) পূর্ববঙ্গে সামরিক অভিযান শুরু হবার অব্যবহিত পরে গত মার্চ-এপ্রিল, ভারত সরকার এ ব্যাপারে যে ঋজুতা দেখাতে পেরেছিলেন, -৩১/৩/৭১-এর সংহতি এসব’ এর (bolidarity resolution) মাধ্যমে যার প্রকাশ ঘটেছিল, পরে তারা তা থেকে সরে যান। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে তাদের কুণ্ঠার কারণ কি, সেটা জনসাধারণকে জানাতে পর্যন্ত পুনঃপুনঃ অস্বীকার করে এবং এ ব্যাপারে সরকার একাই যা ঠিক তা বােঝেন, ও যথাসময়ে তা করবেন, বারবার সদম্ভে সে কথা ঘােষণা করে, ভারত সরকার নিজেদের সম্বন্ধে এমন একটা দাবি উত্থাপন করেছেন, যা হেগেলের দ্বারা আদর্শায়িত Absolute Prussian State ছাড়া আর কেউ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে করতে পারে। অথচ মজা এই যে, শক্তির এই মৌখিক আড়ম্বরের পিছনে যা কাজ করছে তা হলাে শক্তিহীনতা।
(২) নিজেদের ঘােষিত ঋজু নীতি থেকে সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যা আগেই উল্লেখ করেছি—ভারত সরকার আশা করতে থাকেন যে মহাশক্তিগুলাে কার্যত মার্কিন সরকার ও সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের উদ্বাস্তু সমস্যার বিরাট ভয়াবহতা দেখে এগিয়ে এসে ভারতকে ত্রাণ করবে। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গত জুন মাসে বিশ্বপরিক্রমার সময়ে তিনি সর্বত্র মৌখিক সমর্থন লাভ করায় সম্ভবত ভারত সরকারের এই ধারণা দৃঢ় হয়। গত জুনের ১৫ তারিখে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লােকসভায় বলেন “বিশ্বশক্তিসমূহ উদ্বাস্তু সমস্যা এড়িয়ে যতে পারবে না (World Powers Cannot get away with the Refugee problem)। এ বিষয়ে ভারত কি করবে সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না বলে তিনি বলেন (ক) ভারত সাময়িকভাবে (temporarily) উদ্বাস্তুদের দেখাশােনা করছে, এবং রাজনৈতিক দিক থেকে (খ) ভারত বাংলাদেশের মৃত্যু মেনে নেবে না। (India would not accept the death of Bangladesh I (Statesman 16 June 1971)|
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কি মেনে নেবেন না সেটা দেশবাসী জানার সুযােগ পেলেও ভারতের সরকারি নীতির বাস্তব রূপায়ণে মহাশক্তিগুলাের ভূমিকা কি হবে, দেশবাসী তা জানতে পারেনি। অতঃপর অন্যতম মহাশক্তি মার্কিন সরকারের নীতি (বা তার আত্যন্তিক অভাব) জুন মাসের শেষ সপ্তাহে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই নীতি ও আচরণের কার্যকারণ আমরা আগেই আলােচনা করেছি।

সােভিয়েত নীতি
অপর যে মহাশক্তি সােভিয়েত ইউনিয়ন, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তাদের কার্যক্রম আলােচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁদের নীতি ও রাজনীতির মধ্যে সামঞ্জস্য স্পষ্ট নয়। ২৫শে মার্চ রাত্রে ঢাকায় জঙ্গীশাহীর বর্বর আক্রমণ শুরু হবার সপ্তাহ কাল পরেই ২রা এপ্রিল, সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগনি পূর্ববঙ্গের আক্রান্ত জনসাধারণের দুঃখকষ্টের জন্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে ইয়াহিয়া খানকে টেলিগ্রাম করেন ও সেই Cofanetta ICT 96619 We consider it our duty, Mr. President to appeal to you on behalf of the Presidium of the U.S.S.R., Supreme Soviet with a request to stop the bloodshed and repression against the populations of E. Pakistan and turn to methods of peaceful political settlement.
(New Times’, Moscow. 14 April 1971).
পূর্ববঙ্গে রক্তপাত ও অত্যাচার, (bloodshed & repression) চলতে থাকলে যে, ভারত-পাক ভূখণ্ডে শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে সে কথাও উক্ত টেলিগ্রামে উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু সােভিয়েতের সর্বোচ্চ সরকারী সংস্থার পক্ষ থেকে সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের দ্বারা প্রেরিত টেলিগ্রামটিকে ইয়াহিয়া খান যখন কার্যত বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করলেন তখন সােভিয়েত সরকার কী করলেন? বিস্ময়ের বিষয় এই যে, তারা কিছুই করলেন না। (কূটনৈতিক শলাপরামর্শের প্রসঙ্গ বাদ দিচ্ছি কারণ আমরা তার অংশীদার হইনি, এবং সে বিষয়ে অবহিত নই)। কিন্তু আমরা জানি যে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেমন রাজনীতিতেও তেমনই follow up action বলে একটা ব্যাপার আছে। তা না করে, কেবল, নীতির ঘােষণা করে, কাজে চুপ করে থাকলে, বিরােধী শক্তিগুলােকে কেবল সচেতন ভাবে বেড়ে ওঠার ও কার্যকরী হবার সুযােগ দেওয়া হয়। গত কয়েক মাস পাক জঙ্গীশাহী যে সােভিয়েত সরকারের এই স্থৈর্যের অন্যায় সুযােগ নিচ্ছিল, তার | প্রমাণের অভাব নেই। এর পর গত ৯ই জুন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সােভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে ভারত
ও সােভিয়েত সরকারের যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। স্টেটসম্যান ১০ই জুন ৭১-এ প্রকাশিত উক্ত বিবতির (পূর্ণ?) বয়ান অনুসারে এতে :
i. ভারতে উদ্বাস্তু আগমন রােধ করার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থাদি নেওয়াকে অত্যাবশ্যক(imperative) বলে উল্লেখ করা হয়। (কিন্তু এও তাে নতুন কোনাে কথা নয়। তাসখন্দ চুক্তির অষ্টম ধারাতে (clause viii) এ বিষয় সুস্পষ্ট নীতি নির্দেশ আছে।)
ii. উদ্বাস্তুদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্যে প্রয়ােজনীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে বাঞ্ছনীয় বলে (dsirable) উল্লেখ করা হয়।
iii. পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের ওপর নতুন করে জোর দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সংবাদসূত্র অনুযায়ী ভারত ও সােভিয়েত সরকার এই সব বিষয়ে পরামর্শের জন্যে পারস্পরিক যােগ রাখবেন। যৌথ বিবৃতির অব্যবহিত পরেই (স্টেট, ১১ জুন ৭১) সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সাই কোসিগিন পাক সরকারকে স্বদেশে এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে আহ্বান জানান যাতে উদ্বাস্তুরা স্ব স্ব জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারেন। সমস্ত রাজনৈতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বানও তিনি জানান। এটা অবশ্যই উল্লেখযােগ্য যে, তখনও পর্যন্ত পৃথিবীর আর কোনাে সরকার পূর্ব বাংলার প্রসঙ্গে এমন স্পষ্ট ও মানবিক অধিকার সম্মত কথা বলেননি। (কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দেশের পার্লামেন্টে মুখ খােলেন ১৬ই জুন)।
কিন্তু এই সঙ্গেই সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী বলেন যে বর্তমান সমস্যাবলীর নিরসনের জন্য Tashkent Pact is and remains a good basis’। এর থেকে মনে হয় যে তখনও পর্যন্ত সােভিয়েত সরকারের চিন্তাধারা ভারত ভূখণ্ডে বাস্তব পরিস্থিতির প্রকৃত মূল্যায়ন করেনি। কিন্তু আজকের পরিপ্রেক্ষিতে তাসখন্দ চুক্তি অর্থহীন হয়ে যায়। ১৯৪১ এর জুনে হিটলারী ফৌজ সােভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার প্রাক্তণে অনাক্রমণ চুক্তি যেমন জার্মান ও সােভিয়েত সরকারের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে কার্যকরী ছিল না, তেমনই পাঁচ বছর আগের সেই চুক্তি এখন শান্তির good basis রূপে বজায় থাকেনি। তা যদি না হয়ে থাকে, তাহলে, পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে (যে অত্যাচার ও রক্তপাতের বিষয় সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট স্বয়ং তাঁর ২রা এপ্রিলের টেলিগ্রামে উল্লেখ করেছিলেন) এদেশে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসার পর পাঁচ বছর আগের সেই চুক্তি কি করে এখনও শান্তির ‘good basis’ রূপে বজায় থাকে? এবং এরপর ১৯শে জুলাই থেকে ইয়াহিয়া যখন ক্রমেই যুদ্ধের হুমকি দিতে থাকেন, ভারতের পক্ষে একলা তাসখন্দ চুক্তি আঁকড়ে পড়ে থাকার কোনাে পথই আর অবশিষ্ট থাকেনি। বস্তুত এই উক্তির দ্বারা সােভিয়েত প্রেসিডেন্টের ও সরকারের প্রাক্তন বক্তব্যের গুরুত্ব হ্রাস পায়। ফলে এর দ্বারা পাক জঙ্গীশাহীর অন্তরে আশার সঞ্চার করা হলাে এবং বাংলাদেশ’-এর সরকারের প্রতিনিধিদের মর্যাদা ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মূল বক্তব্য স্বীকৃত হলাে না।
পাক জঙ্গীশাহী এতে বিশেষ আশা পেল এই জন্য যে, আজ পর্যন্ত তারা তাসখন্দ চুক্তির একটি ধারাও কার্যকরী করেনি, বরং গত পাঁচ বছরে ভারতের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের যােগাযােগ ও বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ করে রেখেছিল। এমনকি আয়ুব ১৯৯৬-এর জানুয়ারিতে (১৪ই) রেডিওযােগে তাসখন্দ চুক্তির যে মূল কথা—সমস্ত ভারত পাক সমস্যার শান্তিপূর্ণ পথে সমাধান সেইটাই অস্বীকার করেন। এ ব্যাপারেও সােভিয়েতের তরফ থেকে কোনাে প্রতিবাদ বা follow up action দেখা যায়নি। বরং আয়ুব শাহীর একেবারে শেষ পর্যায়ে তারা তাকে অস্ত্র সাহায্য দিতে এগিয়ে এলেন—যার ফলে, একদিকে জঙ্গীশাহী যেমন তিরস্কৃত না হয়ে পুরস্কৃত হলাে, অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরে সােভিয়েত বিরােধী শক্তিগুলাে নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করার সুযােগ পেল। এর জন্যে সােভিয়েত সরকারের চেয়েও ভারতের অভ্যন্তরে সােভিয়েতের তথাকথিত বন্ধুদের বেশি দায়ী মনে করি। তারা একবাক্যে বলতে শুরু করেন, ‘পাকিস্তানকে এরকম অস্ত্র সাহায্য দেবার অধিকার সােভিয়েত সরকারের আছে’। যেন প্রশ্নটা নৈতিক ও রাজনৈতিক নয়। নিছক আইনের ব্যাখ্যার ব্যাপার। তারা যদি যথা সময়ে ঐ অস্ত্র সাহায্যের ক্ষতিকর পরিণামের বিষয় সােভিয়েত সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে অবহিত করতেন তাহলে সােভিয়েত সরকার এপথে অগ্রসর হতেন না।
‘বাংলাদেশ’ বা পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে সােভিয়েত সরকারের নৈতিক প্রতিবাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বক্তব্য যে খাপ খাচ্ছে না পূর্বোক্ত New Times (১৪ এপ্রিল) এর Events in Pakistan শীর্ষক রচনা থেকে জানা যায়। উক্ত রচনার লেখক শ্রী এ. উলানঙ্কী রচনার শেষদিকে বলেন :
It is a notewarthy fact that some western newspaper apparently betraying the hopes of certain circles are predicting that “Pakistan can not remain united” and that sooner or later “it will be partitioned.” It looks as though the imperialists would not be averse to taking advantage of the situation to further their selfish neo-colonialism aims.
ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান যে এক রাষ্ট্র থাকতে পারবে না ও দ্বিধা (নাকি বহুধা?) বিভক্ত হবে একথা যারা বলছে তারা সাম্রাজ্যবাদী’ নয়। এ কথা বলেছে পূর্ববঙ্গের কম্যুনিস্ট পার্টি তাদের সাম্প্রতিক ত্রিপুরা সম্মেলনে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবী করেছেন তাঁরা। এই স্বাধীনতার দাবী সমর্থন করেছে পূর্ববঙ্গের প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক দল ও সংগঠন। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবী সমর্থন করেছে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির উভয় শাখা এবং ভারতীয় জাতীয় গণতান্ত্রিক দলগুলাে। আর পাকিস্তানের পার্টিশান হলে, নয়া-সাম্রাজ্যবাদীর এমন কোনােই সুবিধে হবে না যে সুবিধে তাদের হয়েছে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারতভূখণ্ডকে পার্টিশান করে এবং সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে জিইয়ে রেখে। এরই ফলে তারা এশিয়ায় তাদের most allied ally কে পেয়েছে। (লক্ষ্যণীয় এই যে আয়ুব তার Friends not Masters বইটি তে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বা Security বলতে কেবল তার আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষাকে বুঝিয়েছেন তাই নয় তার ওপর তাদের Ideology অথবা সাম্প্রদায়িকতাকে বজায় রাখাও Security’র অপরিহার্য অঙ্গ বলে দাবী করেছেন। দ্রষ্টব্য ঐ পৃ. ১১৪। (১৯৬৭ সংস্করণ) রাশিয়াতে মার্কিনের most allied ally সম্পর্কে এ সত্য কারুর অজানা থাকার কথা নয়। কাজেই উক্ত বক্তব্য যদি শ্রীযুক্ত উলানস্কীর না হয়ে সােভিয়েত সরকারের হয়, তাহলে চিন্তার কারণ ঘটে বই কি! বিশেষত উলানস্কী সাহেব পূর্ব বাংলা সম্পর্কে এতই ওয়াকিবহাল যে রয়টারের সংবাদ উল্লেখ করে যশাের শহর সম্পর্কে আমাদের জানান (ঐ পূ. ৮) যে, ২রা এপ্রিল সরকার বিরােধী “মুক্তিফৌজের” (উদ্ধৃতি চিহ্ন শ্রীউলানস্কীর) অভিযানের পর The town seemed dead. There were no trarms or buses running….। যশাের শহরে বা পূর্ব বাংলার কোনাে শহরেই যে ট্রাম চলে না, একথাও কি New Times-এর লেখক জানেন না? সােভিয়েত নীতি নির্ধারকরাও যদি লেখকের মতাে ‘ওয়াকিবহাল হন তাহলে সােভিয়েতের জন্যেই চিন্তা হয়!
বলা বাহুল্য মূল রাজনৈতিক প্রশ্নে সােভিয়েতের এই স্ব-বিরােধিতার সুযােগ নিতে পাক জঙ্গীশাহী এতটুকুও দেরী বা দ্বিধা করেনি। তারা প্রেসিডেন্ট পদগর্ণি বা প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের সমস্ত বক্তব্য সম্বন্ধে যথাসম্ভব নীরব থেকে কেবল একটা কথাই বারবার বেতারে ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচার করে চলেছে। সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের সংহতি বজায় রাখতে চায়। অর্থাৎ সােভিয়েত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছুক নয়। অথচ এই সংহতির একমাত্র ভিত্তি যে সাম্প্রদায়িকতা, সে কথা ি থেকে শুরু করে আয়ুব বা ইয়াহিয়া সকলেই বার বার সরবে ও সদম্ভে ঘােষণা করেছেন। এই অবস্থাতেই ভারত-পাকিস্তানে সােভিয়েত নীতি কী সে বিষয়ে নানা সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে এবং সােভিয়েত বিরােধীরা তার সুযোেগ নিতেও দেরী করেনি। কেন-ই বা করবে? প্রতিপক্ষকে জব্দ করার সুযােগ তারা ছেড়ে দেবে, এটা আমরা আশাই বা করবাে কেন?
কিন্তু ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যখন সােভিয়েত ইউনিয়নের সরবরাহের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল তখন ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বিশেষত যখন যুদ্ধাবস্থা ঘনায়মান তখন সােভিয়েত ইউনিয়নের বক্তব্য যে মূল্যহীন হবে না, এটাও অনুমান করা যায়। তাই ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতি যখন বাংলাদেশ প্রসঙ্গে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন সেই দ্বিধার পিছনে মার্কিন সরকারের চাপ ছাড়াও সােভিয়েতের ভূমিকা কি সে প্রশ্নও অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিশেষত বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সােভিয়েত নীতি যখন গুরুতর দ্বিধায় দোদুল্যমান বলে দেখা যায়। ৯ই আগস্টের সম্পাদিত কুড়ি বছরের শান্তি চুক্তি এই দ্বিধা ও দোদুল্যমানতার অবসান ঘটিয়েছে। সােভিয়েতে নীতি ও রাজনীতির মধ্যেকার ফারাক এবার ঘুচে গেছে। পাক জঙ্গীশাহীর যুদ্ধবাজ রাজনীতি এর ফলে কঠিন আঘাত পেয়েছে। আমরা এ বিষয়ে পরে আলােচনা করব।

ইজভেস্তিয়ার আবেদন
এই প্রসংগেই সােভিয়েত সরকারি মুখপাত্র ইজভেস্তিয়া’তে গত ১১ই জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি এক সঙ্গে যে আবেদন প্রচারিত হয়েছে (দ্রষ্টব্য স্টেটসম্যান, ১২ জুলাই ৭১) তার আলােচনা আবশ্যিক হয়ে পড়ে। কারণ এর থেকেও দেখা যায় যে, ভারত ভূখণ্ডে আজকের অমানুষিক পরিস্থিতি যে নিক্সন সরকারের সমর্থন পুষ্ট পাক জঙ্গীশাহীরই সৃষ্টি সে বিষয়ে সােভিয়েত সরকার যথেষ্ট সচেতনতার পরিচয় দেননি। তখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে তাদের চিন্তা স্পষ্ট ছিল না, তাই কোনাে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। জুনের শেষ দিকে বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন সরকারের মিথ্যাচরণ যখন স্পষ্ট হয়ে পড়ে তখন ভারতীয় লােকসভায় পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশের বিষয়ে অবিলম্বে কার্যকরী ব্যবস্থা অবলম্বনের দাবীও ক্রমশ জোরদার হয়ে পড়ে। (এই প্রসঙ্গে লােকসভায় দীনেশ সিং ও কৃষ্ণমেননের ২৮ জুনের বক্তব্য আগেই উল্লেখ করছি। এই সব দাবীর মুখে ঢাকা এঁটে দেওয়া হয় ২রা জুলাইতে ‘বাংলাদেশ’ এর স্বীকৃতির ব্যাপারে লােকসভায় সরকারি বক্তব্য পেশ করে। এতে বলা হয় সরকার স্বীকৃতি দিতে রাজি, তবে সময়টা তারাই ঠিক করবেন। কিন্তু Justice delayed is Justice denied.) যাই হােক ভারতীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের প্রসঙ্গে ক্রমশ উত্তাপ ও উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে এই পটভূমিকাতেই সম্ভবত উভয় রাষ্ট্রের প্রতি ইজভেস্তিয়াতে আবেদনটি প্রচারিত হয়। এই আবেদনের পূর্ণবয়ান আমরা পাইনি কিন্তু এর যতটুকু দেখেছি তা যদি অসত্য না হয়, তা হলে এই আবেদনটি যে কোনাে রাজনীতি সচেতন মানুষকে বিস্মিত করবে মনে হয়। পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে wichalco TT RC3165 “preservation of peace in the Indian subcontinent is the only correct road to meeting the national interests of the Indian and Pakistani peoples” কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে (অর্থাৎ ভারত-পাক বাংলাদেশ ভূখণ্ডে) শান্তি ভঙ্গ ঘটল কী করে? সে কথা কি প্রেসিডেন্ট পদগর্নির ২রা এপ্রিলের টেলিগ্রামেই স্পষ্ট হয়নি? পূর্ববঙ্গের সমগ্র জনসাধারণের স্বীকৃত অধিকার সম্পূর্ণভাবে পদদলিত করার জন্যে ২৫ মার্চের রাত্রি থেকে সেখানকার জনসাধারণের বিরুদ্ধে যে সামরিক আক্রমণ শুরু করা হয়, তখনই কি সমগ্র ভারত-ভূখণ্ডে শান্তি সম্পূর্ণ ধ্বস্ত বিধ্বস্ত হয়ে যায়নি? তারপর আজ সত্তর লক্ষ মানুষ যখন গৃহহীন, অন্নহীন ও সমস্ত সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় ভারতীয় এলাকায় এসে উপুড় হয়ে পড়েছে তখন এই ভয়াবহ শান্তিভঙ্গের আদি ও একমাত্র কারণ, পাক জঙ্গীশাহীর হানাদারি হামলাকে রােধ করার জন্যে কোনাে কার্যকরী ব্যবস্থা না নিয়ে, এমন কি সে বিষয়ে কোনাে পথনির্দেশ না করে, উভয় রাষ্ট্রকে (দেশ নয়) একই স্তরে ফেলে কার্যত কেবল ভারতকে নিষ্ক্রিয় থাকার পরামর্শ দেবার তাৎপর্য কী? এতে কি হানাদারদের যা খুশি তাই চালিয়ে যাওয়ার অন্তহীন অধিকার কার্যত মেনে নেওয়া হয়নি? যে শান্তিরক্ষা বা preservation of peace-এর কথা বলা হয়েছে পূর্ববঙ্গে ও সন্নিহিত অঞ্চলে সেই peace বা শান্তি কি গত চারমাস preserved বা রক্ষিত হয়ে আছে? তা নেই। কাজেই এই আবেদনের কার্যকরী মূল্য কিছুই হয়নি। বরং ভারত ও সােভিয়েত বিরােধী একশ্রেণীর লােকের হাতে প্রচারের নতুন হাতিয়ার তুলে দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত ভারত ও পাকিস্তানের জাতিসমূহের জাতীয় স্বার্থের বিরােধী বলে যা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে ইংরেজিতে যাকে বলে begging the question সেইটাই নিহিত।
পা
কিস্তান কি একটি নেশন?
যে ধর্ম সাম্প্রদায়িকতাকে পাকিস্তানের ভিত্তি বলে পাক শাসকচক্র অপপ্রচারের সাহায্যে এবং এখন বন্দুকের জোরে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে ও চাইছে তাতে পাকিস্তানের মতাে বহুজাতিক রাষ্ট্রের প্রত্যেক জাতিগােষ্ঠীর (nationality’র) জাতীয় ভাষা ও সাংস্কৃতিক অধিকার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিদিন অস্বীকৃত হয়নি কি?
(প্রসঙ্গত ১৪ আগস্ট ১৯৬৮-র দৈনিক সংবাদ থেকে আমাদের পূর্বতন উদ্ধৃতি দ্রষ্টব্য)। বস্তুত বহুজাতিক ভারতীয় Nation বা মহাজাতি বা বাঙালি, মারাঠী প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের স্বীকৃতির উপর প্রতিষ্ঠিত (যেমন-সােভিয়েত ইউনিয়নে, রুশ বা তাজিক সকল জাতির ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকার স্বীকৃত) তার সঙ্গে, জাতি গঠনের প্রত্যেক বাস্তব উপাদানকে অস্বীকার করে কেবল ধর্ম সম্প্রদায়ের লেবেল দেখে দেখে যে সব জাতিগােষ্ঠী বা তারও ভগ্নাংশকে, কোনাে গণভােট না নিয়ে, ব্রিটিশ আধিপত্যের যুগে হঠাৎ সৃষ্ট একটি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেই রাজনৈতিক জগাখিচুড়িকে (Political Conglomerate) নেশন বলে উল্লেখ করাটাই প্রাথমিক রাজনৈতিক ভুল। পাকিস্তান একটি নেশন নয় বলেই গত ২৪ বছরে পাক শাসকচক্রের পক্ষেও একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। আজ যদি পর্তুগাল ও পােল্যান্ডকে উভয় দেশেই রােমান কাথলিক ধর্ম প্রবল বলে—উভয় দেশকে এক রাষ্ট্রবন্ধনে এক জাতি বলে এক নেশন ঘােষণা করা হয়, তাহলে তারা এক নেশন হবে না, এবং তাদের উভয়ের জন্য একটি শাসনতন্ত্র রচনাও সম্ভব হবে না। তেমনি পূর্ববঙ্গ ও বহুদূরব্যাপী প, পাকিস্তানকে ধর্মের ভিত্তিতে এক রাষ্ট্রের জোয়ালে জুড়ে দেওয়ার ফলে তারা এক নেশন হয়নি। হবেও না, কোনােদিন। এই প্রাথমিক সত্য বিস্মৃত হয়ে, পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের কথা বলা সম্পূর্ণ অবাস্তব। এই আবেদন তাই কেবলমাত্র ভাবালুতার বাহন হয়েছে কোনাে সৃজনশীর প্রভাব : বিস্তার করেনি।
এবং মূল রাজনৈতিক প্রশ্নে স্বকীয় কার্যক্রম দৃঢ় ও বাস্তবানুগ না করে, সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে কেবল হৈচৈ তুলে কি লাভ? সাম্রাজ্যবাদীরা তাে তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে যা করতে পারে তা করবেই। তাদের কাছ থেকে অন্য রকম ব্যবহার আশা করাই তাে ভুল! কিন্তু সমাজতন্ত্রী শিবির থেকে যদি তার বিরুদ্ধে কোনাে সক্রিয় কর্মপন্থা উদ্ভাসিত না হয়, তাহলে সমাজতন্ত্রী মহলের মধ্যেই ভাঙন এবং পথ ও মতভেদ অনিবার্য হয় না কি? পাকিস্তানেও আজ সােভিয়েতের বন্ধুদের মধ্যে এই রকম ভাঙন দেখা দিয়েছে, মনে হয়। এবং সেটা। বাংলায় নয়, খাস পশ্চিম পাকিস্তানে। কিছুকাল আগেই মস্কোপন্থী ন্যাপ (NAP) নামে পরিচিত দলের সর্বপ্রধান নেতা ওয়ালী খান (বাদশা খাঁর অন্যতম পুত্র) স্বীয় দলের নেতৃত্ব ত্যাগ করেন। কেন, তার কারণ তখন স্পষ্ট হয়নি। গত ১৮ই জুলাই দিল্লী থেকে প্রচারিত এক সংবাদ সূত্রে জানা যায় যে, ওয়ালী খান চক্ষু চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাতায়াতের পথে সােভিয়েত ইউনিয়নে যেতে অস্বীকার করেছেন। (স্টে, ১৯ জুলাই ‘৭১) কারণ নাকি এই যে, তাঁর পিতা স্বয়ং বাদশা খাঁকে সাে, ইউনিয়নে প্রবেশের ছাড়পত্র (visa) দেওয়া হয়নি। এইসব ঘটনা থেকে যদি আমরা অনুমান করি যে, পাখতুন আন্দোলন সম্পর্কে সােভিয়েতের ঘােষিত নীতি বর্তমানে পরিবর্তিত ও পরিত্যক্ত হচ্ছে তাহলে কি খুব ভুল করা হবে। (স্মরণ রাখা দরকার যে ওয়ালী খানকে এই বছর মার্চেও শেখ মুজিব তার বিশিষ্ট বন্ধু বলে উল্লেখ করেন। ওয়ালী ন্যাপ বহুলাংশে আওয়ামী লীগের অগ্রবাহিনী হিসেবে কাজ করেছে)।
যাই হােক, বৃহৎ শক্তিবর্গ এসে ভারতের উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধান করে দেবে তথা বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করবে বলে ভারত সরকার অন্তত জুন মাসেও যে আশা পােষণ করেছেন বাস্তব ঘটনাবলি-ই তা ভুল প্রমাণ করেছে। এক্ষেত্রে ও ভারত সরকারের সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনাে পথ বা option থাকছে না। আজকে ভারত সােভিয়েত মৈত্রী ও শান্তি চুক্তি নিঃসন্দেহে ভারতীয় নীতির পিছনে সােভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন কার্যকরী করেছে। এর ফলে ভারত সরকারের পক্ষে সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণের বাধা দূর হয়েছে। কিন্তু তবু তারা শেষ পর্যন্ত আরাে সক্রিয় পন্থা গ্রহণ করবেন কিনা, সেটা ভারত সরকারের উপরেই নির্ভর করছে।

সূত্র: কম্পাস, ২৮ শে আগস্ট ১৯৭১
…………………………………………………..
বর্তমানে পূর্ববাংলায় এই দল সরাসরি পূর্ববঙ্গে কম্যুনিস্ট পার্টিরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। দলনেতা অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ। এই রচনা সমাপ্ত হবার পর গত ২৫ জুলাই আকাশবাণীর দিল্লী থেকে সর্বভারতীয় সান্ধ্য বাংলা সংবাদে শুনতে পাই যে, অধ্যাপক আহমদ বাংলাদেশের সগ্রামে সমাজতন্ত্রী দেশ ও আরব দেশগুলাের ভূমিকায় নৈরাশ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি পাখতুন অঞ্চলে সংগ্রাম আসন্ন বলে উল্লেখ করেছেন। পূর্ববঙ্গের বাঙালি প্রধান দলগুলাের মধ্যে এদেরই পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে বাস্তব যােগ আছে।
………………………………………………………