বাংলাদেশ প্রসঙ্গে
রঘুবীর চক্রবর্তী
বাংলাদেশের আর্বিভাব এশিয়ার চলমান ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বাংলাদেশ হলাে অসহ্য ও অমানুষিক ঔপনিবেশিক শােষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ এক মানবিক প্রতিবাদ। বাস্তবিকই সমগ্র এশিয়া মহাদেশে বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদ ও আধা-ঔপনিবেশিকবাদ বনাম জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের যে প্রত্যক্ষ লড়াই চলেছে, বাংলাদেশ তারই একটি বিশিষ্ট স্তর মাত্র। ঠিক এই কারণেই পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষের কাছেই আজ বাংলাদেশ শুধুমাত্র একটি ভৌগলিক অবস্থান নয়, বাংলাদেশ একটি প্রেরণা। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এক নতুন রাজনৈতিক দিগন্তের দিশারী। বাংলাদেশ হলাে গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের অন্যতম এক অগ্নি পরীক্ষা।
সত্যিই ভাবতে অবাক লাগে যে দক্ষিণ এশিয়ার অচলায়তন, জরাজীর্ণ এবং প্রায় হতাশাগ্রস্ত ইতিহাসে যখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ নতুন ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলের আওয়াজ স্পষ্টতর হয়ে উঠছিল ঠিক তখনই এমন এক রাষ্ট্রশক্তি জন্মগ্রহণ করবে যার যৌবন দৃপ্ত উজ্জলতায় মুক্তিকামী মানুষ আবার ভাস্বর হয়ে উঠবে। এ যেন এক যুগ সন্ধিক্ষণে দক্ষিণ এশিয়ার রাহুমুক্তি। বলাবাহুল্য এর জন্মলগ্ন থেকে যে নতুন ধারায় এই ইতিহাস প্রবাহিত হচ্ছে তা একদিকে যেমন অনিশ্চিত তেমনই অপরদিকে প্রাণবন্ত ও সম্ভাবনাময়। এই নতুন গতিবেগ শুধু এশিয়ারই নয় সমগ্র বিশ্বের জীবনধারাকে কোনও না কোনােভাবে প্রভাবান্বিত করবে। আর ঠিক এই কারণেই বাংলাদেশ নানা ধরনের আলাপ আলােচনা, তর্কবিতর্ক ও উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে।
সমস্ত আবেগ ও ভাবালুতার মধ্যে যে কথা বার বার স্মরণ রাখা দরকার সে হলাে এই যে বাংলাদেশ একটি সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং ঠিক এই যুক্তিতেই এর গৌরবময় অগ্রগতি অবধারিত। যে ইতিহাস এর ভূমিকা রচনা করেছে সেই ইতিহাসই একে সাফল্যমণ্ডিত করে তুলবে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এই বদ্ধমূল ধারণা কোনও প্রকার রাজনৈতিক জ্যোতিষী নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ প্রসূত ফলাফল।
যেদিন ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রযাত্রা শুরু করেছিল, সেদিন কিন্তু কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে এমন একটা কিছু ঘটতে পারে। অথচ ধর্মান্ধতার আড়ালে যেভাবে প্রায় গায়ের জোরে দুটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতিসম্পন্ন জাতীয় জনসমাজকে একত্রিত করা হয়েছিল তার মধ্যে পরবর্তী ইতিহাসের বীজ যে অন্তর্নিহিত ছিল সে কথাও অস্বীকার করা একেবারে যায় না। আর ধর্মই যদি জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের এক মাত্র বন্ধন হয় তাহলে পশ্চিম এশিয়ার এতগুলাে মুসলিম রাষ্ট্র থাকার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। এমন কি ইউরােপেও ধর্মগত ঐক্য থাকা সত্ত্বেও এত বিচিত্র ধরনের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু থাকারও অর্থ তাহলে থাকতে পারে না। যাই হােক সব কিছু ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বাদ দিয়েই পাকিস্তান গঠিত হলাে এবং তার দুই অংশের মধ্যে থেকে গেল হাজার মাইল ভৌগলিক দূরত্ব। এমন এক বিচিত্র রাষ্ট্রব্যবস্থার নজীর আর পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহের বিষয়। ভারতবর্ষে একদা নিপীড়িত মুসলমান সমাজের বন্ধন-মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে এলাে এই পাকিস্তান।
কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই এই প্রতিশ্রুতির অসারবত্তা পরিস্ফুট হতে লাগল। পশ্চিম পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় কয়েকটি সামন্ততান্ত্রিক শাসক পরিবার সমগ্র দেশে একচেটিয়া রাজনৈতিক মালিকানা স্থাপন করল। একই সাথে পূর্ব পাকিস্তানকে নয়া উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করা হলাে। পূর্ব পাকিস্তান হয়ে দাঁড়াল একটি কাঁচামাল সরবরাহের উৎসস্থল এবং শিল্পজাত দ্রব্যের লাভজনক এক বাজার। অথচ প্রাকৃতিক ও মানবিক সম্পদে পূর্ব পাকিস্তানই ছিল সমগ্র রাষ্ট্রের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ। কিন্তু একে শুধু একতরফা শােষণ করে এমন এক রক্তশূন্যতার স্তরে নিয়ে যাওয়া হলাে যে তার পক্ষে অবধারিত মৃত্যুর একমাত্র বিকল্প পথ হলাে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবী। পাকিস্তানের নেতৃবর্গের চরম শােষণ ও ঔদাসীন্যের প্রতিফলেই পূর্ব পাকিস্তান রূপান্তরিত হলাে পূর্ব বাংলায় এবং তারই পরের ধাপে, বাংলাদেশ।
এই বিবর্তনের ইতিকথার একমাত্র রচয়িতা হলাে পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বোধ, হৃদয়হীন ও অপরিনামদর্শী নেতৃবর্গ। ১৯৪৭ সালে জিন্না-লিয়াকত চক্র যে অন্যায় ও অবিচার শুরু করেছিল ১৯৭১ সালে ভূট্টো-ইয়াহিয়া চক্র তারই পরিণতি ঘটালাে পাকিস্তানকে ভেঙে দু’ভাগ করে দিয়ে। সুতর বাংলাদেশ হলাে একদিকে অবাস্তব ভৌগলিক ব্যবধান ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং অপর দিকে নির্দয় ইতিহাসের অবধারিত এক প্রতিফল। আর ঠিক এই কারণেই কোনও প্রকার হুমকি বা নির্যাতনের, বন্দুক বা কামানের, বােমাবাজী বা গণহত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদায় অগ্রগতিকে শেষ পর্যন্ত গতিরােধ করা যাবে না। সামরিকভাবেই ভূট্টো-ইয়াহিয়া জল্লাদচক্র এর গতিবেগ খানিকটা হ্রাস করে দিলেও, এর অগ্রগতি বন্ধ হবে না। যে ইতিহাস আজ বাংলাদেশকে অবধারিত করে তুলেছে ঠিক সেই ইতিহাসই একে অপ্রতিহত করে তুলবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এক নতুন ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। এর ফলে ঔপনিবেশিক শােষণের স্বরূপ ও সীমাবদ্ধতা নতুন করে প্রকাশিত হয়েছে। একই সাথে, এর ফলে মানুষের সহনশীলতার সীমা ও প্রতিরােধ ক্ষমতাও নির্ণীত হয়েছে। বাংলাদেশ হলাে চিরনবীন ও মাধুর্যময় চলমান জীবনের অন্যতম মূর্ত প্রতীক।
এই অঞ্চলের রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে যে নতুন তরঙ্গ আজ দেখা দিয়েছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব উত্তরােত্তর কালে আরও ব্যাপকভাবেই স্বীকৃত হবে। এখানকার আশা-আকাঙ্ক্ষার ক্রমবর্ধমান বিপ্লবে বাংলাদেশ নতুন শক্তি ও উদ্দীপনা এনে দিয়েছে। এর ফলে চিরাচরিত রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা, এমনকি আন্দোলনের রীতি প্রকৃতির মধ্যেও এক আমূল সংস্কারবাদী মতবাদ দেখা দেবে। আর এই ধরনের মতবাদ এক সবল, সুস্থ ও সাবলীল রাজনৈতিক জনজীবন গড়ে তুলবে। বিশেষ করে ভারতের জাতীয় জীবনে যে বাংলাদেশ যুগান্তকারী বিপ্লবের সূত্রপাত করবে সে কথা নিঃসঙ্কোচেই বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশ এশিয়ার ইতিহাসে এক যুগসন্ধিক্ষণ। একদিকে যেমন বাংলাদেশ পাকিস্তানের এক অবধারিত পরিণতি, অপরদিকে তেমনই এই রাষ্ট্রশক্তি মুক্ত ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়। বাংলাদেশ আজ প্রকৃত মুক্তি, মানবিক মর্যাদাবােধ এবং অধিকারের প্রতিমূর্তির রূপ পরিগ্রহ করেছে। বাংলাদেশ এক নতুন মানবিক এবং গণতান্ত্রিক সভ্যতার বলিষ্ঠ প্রতিশ্রুতি।
সূত্র: কম্পাস, ১৩ই নভেম্বর ১৯৭১